এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বাসস্ট্যান্ড আর LIC মোড় 

    আফতাব হোসেন লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৭ জুলাই ২০২৪ | ২২৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছেলেটা…
    রোগা পাতলা হাড়জিরজিরে চেহারা। ধোঁয়ার চোটে চুপসে যাওয়া গাল। বারোমাস বাসস্ট্যান্ড থেকে একই বাসে পেছনের জানলার সাইডের সিট। কিসের যেন অপেক্ষা। বাসস্ট্যান্ড থেকে এল আই সি মোড়, মাত্র পাঁচ মিনিট, কে জানে আসে নাকি ? দেখতে ইচ্ছে করে রোজ…
    বাচ্চা তো, খুব বেশি হলে ইলেভেন হবে। কিছু বোঝে নাকি কে জানে ? চোখের দিকে তাকায় না। পড়াকু মনে হয়। আকড়ুও হতে পারে। আজ মনে হয় আসবে না।

    মেয়েটা…
    সবুজ সাদা ইউনিফর্ম, পিঠে স্কুল ব্যাগ, বব ছাঁট চুল, রোজ পেছনের গেটে উঠে বাইরের দিকে মুখ করে মিনিট কুড়ি ঝুলে থাকা। তারপর একবার পেছনের জানলার সিটটার দিকে তাকিয়েই নেমে যাওয়া। ভীতুর ডিম একটা। রোজ হাঁ করে তাকায়। চোখ পড়লে মুখ ঘোরায়। যেমন ছোট মাথা তার চেয়েও কম বুদ্ধি। হাঁ দা রা ম।
    মেয়ে তো নাকি। নিয়ম ভাঙতে বড্ড ভয়। বোঝেই না।

    বেশ চলছিল …
    তা চলুক।

    ছেলেটা…
    জাত ক্যাবলা। প্যান্টের পকেটে ছোট চিরুনি। এল এই সি মোড় আসার আগে চুল ঠিকঠাক। মুখে রুমাল। আর তাকাব না ওদিকে। জানলার বাইরে সুন্দর পৃথিবী, চোখে তাকালে সর্বনাশী আগুন। আমার একলা ঘর আমার দেশ। কিছুতেই ভাবব না তোমার কথা। কদিন বাস ফেল। টাইমে নয়, ভয়ে। পারব না বলতে তোমায়। তাই ভুলে থাকা ভালো।

    মেয়েটা…
    ঠোঁটে রঙ লাগালে স্কুল বকে। ইউনিফর্মে কি তোমার ভালো লাগে না। দুদিন পেছনের সিট খালি কেন। নম্বর কমলে খুব বকবে বাড়িতে। কাল ভুল করে অন্য কোথাও নেমে গিয়েছিলাম। আর কি আসবে না? সামনে পরীক্ষা।

    হঠাৎ একদিন …
    সরস্বতী পুজো হলুদ পাড় শাড়ি, ঝুমকো দুল, খোলা চুল, সাথে অভিমানে ঘাটা কাজল।
    ঠোঁট ফুলিয়ে প্রশ্ন- এতদিন আসনি কেন? আমি শেষ সিটটা রোজ দেখেছি। তুমি নেই। অংকে এবার চল্লিশে নেমেছে। টিউশনে মন নেই। স্কুলে সব্বাই রাগায়। বাড়ির সবাই চিন্তায়। আমি নাকি সবসময় আনমনা।
    তোমার ঠোঁট কালো কেন ?

    ছেলেটা…
    ভীতু স্বরে আত্মস্বীকার, চাকরির পরীক্ষায় ফেল। নিজের সাথে যুদ্ধ। মাত্র বত্রিশ কিলো। খুব ভীতু। রোজ অম্বল। নিকোটিন সঙ্গী। ঠোঁটের আর দোষ কই।

    তারপর …

    এক অধ্যায়। অনেকগুলো ভ্যালেন্টাইন। অনেকগুলো সরস্বতী পুজো। অনেকগুলো হলুদ পাড় শাড়ি। অনেক বর্ষার রাত। অনেক ফাগুনের দুপুর। অনেক শীতের মনখারাপ। অনেক গ্রীষ্মের আগুন। আর্চিস মনজিনিস এর দম নেই।
    একগাদা রক্তগোলাপ ছিল ভাগ্যিস। সিনেমা হল আর পার্কে সমাজের ভয়। মুঠোফোনেই ভরসা।

    যাঃ…
    নামগুলোই তো বলা হয়নি। নামে কি আসে যায়। নাম দিলাম নিজে। ভালোবাসার নাম। একজনের বাসস্ট্যান্ড আর একজন এল আই সি মোড়।

    এভাবেই হয়ত চলতে পারত। তাহলে হয়ত কাহিনী হত। হত হয়ত রূপকথা। আমি আবার গল্প লিখি। তাই মাঝখানেই হঠাৎ শেষ। রাজা রানী আলাদা হল। বাস এখন এল আই সি মোড় হয়ে যায় না। সব্বাই সুখী। এই বেশ ভালো। গোলাপ, শীত, গরম, বর্ষা, বাসের পেছনের সিট সব আছে। নেই শুধু মুখে রুমাল, চুলে চিরুনি আর নীল সাদা ইউনিফর্মের ভেজা চাউনি আর ঘাটা কাজল। বাসটা আজও চলে। একই টাইমে। শুধু রুটটা আলাদা।

    এক দশক পর…
    নিয়তি আবার উল্টো হাসে মাঝে মাঝে…
    মাঝ বসন্তে হঠাৎ দেখা …

    মেয়েটা…
    সবুজ সাদা ইউনিফর্ম এখন এলোমেলো শাড়ি। টেপা কানের দুল অনেকটা ঝোলা। মুখে যুদ্ধের দাগ। কাজল ঘাটা চোখের নিচে কালো মাস্কারার ছাপ। রোগা পাতলা গাল তোবড়া ছেলেটাকে সামলানো হাতে একটা বছর সাতের কচি দামাল হাত। লাল টিপ আর লাল সিঁদুরে হঠাৎ মুখোমুখি।
    ভ্রু কুঁচকে বলল -
    "বাসস্ট্যান্ড না" ?

    ব্যাকগ্রাউন্ডে…
    ভায়োলিন বাজল হয়ত। জমা খরচের হিসেব মিলল হয়ত। রক্তক্ষরণ বন্ধ হল হয়ত। এবড়ো খেবড়ো রক্তাক্ত ছেলেটা 'পুরুষ' হল হয়ত। যুদ্ধ শেষ হল হয়ত।

    তাই…
    অনেকগুলো সাদা চুল আর কয়েকটা পাকা দাঁড়ির মাঝে একলক্ষ দাগ পড়া কপাল কুঁচকে ছেলেটার পুরুষ হয়ে ওঠা স্বরে প্রশ্ন -

    " কেমন আছো এল আই সি মোড় " ?

    এখানেও শেষ হতে পারত। হল কই …
    অনেক অঙ্ক…
    সিঁড়িভাঙা…
    মিলল কই …
    তাই আরো একটু চলুক…

    মেয়েটার…
    খুব সাহস এখন। রোজগেরে লোকটা বাইরে। স্কুলের জ্ঞান ছেলের হোমওয়ার্কে, নিজের স্বপ্ন এখন সাত বছরের ভবিষ্যতে, অন্য রক্তের বুড়ো বুড়ির আবেগের হাত, বিশ্বাসের কাঁধ, ভরসার চোখ এখন একা সামলে পুরো গিন্নি। জীবন এখন স্কুলের রুটিনের চেয়েও কড়া। টিফিন ব্রেক নেই তাই।
    লজ্জা চোখে অনেক কিছু বলল মনে হয়। বাদও থাকল কিছু। সব শোনাতে নেই।

    ছেলেটা…
    আরো ভীতু এখন। কালো সাদা দাঁড়ির ফাঁকে গাল ফুলেছে , ধোঁয়া বাদ। চব্বিশের কোমর এখন ছত্রিশ। কাঁধটা একটু নিচু, ভাঙা নয় চাপে হয়ত। অম্বল এখন লাল চায়ে থেমে। স্বপ্নগুলো চিনি ছাড়া। সব কিনতে চাওয়া মাসমাইনের বেতন এখন মাসখরচের খোরাক বাঁচিয়ে ভবিষ্যতের সঞ্চয়। চুলে চিরুনি আর মুখে রুমালের বিলাস কই ?
    অনেক কিছু বলবে বলে মুখ খুললেও বলা হল কই ? বললাম না ভীতুর ডিম একটা। যেগুলো বলা হলনা সেগুলো না বলাই থাক।

    তারপর সব চুপচাপ, মুখোমুখি শুধু…

    হয়ত…
    অনেকটা সময় একা হওয়া যেত দুজনেরই…
    অনেক না বলা কথা বলা হয়ে উঠত দুজনেরই…
    একজোড়া চোখ অন্য জোড়াকে মিথ্যের আয়নায় মাপতে পারত দুজনেরই…

    হল কই…

    ওদিকে,
    সাত বছরের দামাল হাত খুব ব্যস্ত। থামল কই। বিরক্তি চোখে প্রশ্ন "মা চলো"।

    এদিকে,
    আবার মুঠোফোনে কচি গলা "বাবা আসছ না কেন ?"।

    চারদিকে এত প্রেম এর ছড়াছড়ি।
    আমি আবার জাত মূর্খ…
    মাত্র বিয়াল্লিশ কিলো। বি এম আই দশ।
    তাই এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছি কোনটা প্রেম
    -বাসস্ট্যান্ড, নাকি
    -এল আই সি মোড়, নাকি
    -ঘাটা কাজল, নাকি
    -বিদেশি রোজগেরে, নাকি
    -সাত বছরের দামাল, নাকি
    -অন্য রক্তের বুড়ো বুড়ি, নাকি
    -বাবা আসছ না কেন ?।

    খুঁজে পেলে লিখব কোনোদিন।

    =======================
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন