১৯৫০ সালে আমাদের পরিবার কিশোরগঞ্জ ত্যাগ করে। তার আগেই আমার মা ময়মনসিংহের বাড়ি থেকে আমাদের ভাই বোনদের নিয়ে কলকাতা বেহালা অঞ্চলে চলে আসে। আমাদের সব আত্মীয় স্বজন পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে। কলকাতা শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং রানাঘাট কৃষ্ণনগর অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। আর সেই সময় থেকে বহু আত্মীয়-স্বজন অনেক ময়মনসিংহের পরিচিত লোক আমাদের বাড়িতে আসত। দেশ ভাগ, দাঙ্গা ইত্যাদির সম্বন্ধে আলোচনা হত।
আমার বাবার ঠাকুমা শিবসুন্দরী সরকারের বয়স তখন ৯২ বছর। তিনি বুদ্ধিমতি ও বিদ্যাবতি ছিলেন। সেই সময় তিনি দেশভাগ সমন্ধে যা বলতেন তাই আমি লিখছি। আমার বড়মা সবাইকে বলতেন, ‘দেশ ভাগ কারে কয় শুন।’
প্রথমে - মানুষ ভাগ,
হিন্দু ও মুসলমান
তারপর - মাটিভাগ,
পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান
তারপর - নদীভাগ,
গঙ্গাও পদ্মা’ ।
তারপরে আমার বড়মা বলতেন, :
‘দ্যাশ হইসে বিদ্যাশ,
পড়শী হইসে শত্রু,
জল হইসে ঘোলা,
বাতাস হইসে বিষ’
অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ (পূর্ব পাকিস্তান) এখন আর হিন্দুদের থাকার যোগ্য জায়গা নয়।
তারপর বলতেন, ‘নিজেদের বাড়িঘর ছাইড়া কলকাতা শহরে রেশনের দোকানে লাইন লাগাই। এর নাম দেশ ভাগ।’
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পূর্ববঙ্গ (পূর্ব)পাকিস্তান হয়ে যায়। পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের জীবনে নেমে আসে আতঙ্ক ভয় অনিশ্চিয়তা। কেন এই দেশ ভাগ? হিন্দু ও মুসলমান কেউ একদেশে থাকবে না। হিন্দু রাজনৈতিক নেতারা দেশভাগ চেয়েছেন। পূর্ববঙ্গের হিন্দু জনগণও দেশ ভাগ চেয়েছে। দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুরা বসবাস করতে পারবেনা তা কি হিন্দুরা বুঝতে পারেনি? হিন্দুদের মধ্যে শিক্ষিত লোকের তো অভাব ছিল না। মুসলমান রাজত্বে হিন্দুদের কোনো রকম সুখ শান্তি ছিল না হিন্দুদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিল না সেটা কি হিন্দুরা জানত না?
ব্রিটিশ আমলে বাঙালি হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা লাভের পর নিজেদের খুব জ্ঞানী ভাবত। হিন্দুরা ভাবত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ পড়েছি আর রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধ গান গাই আমরা খুব ভালো রাজনীতি বুঝি। এরপর সিলেট ও চট্টগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানে যুক্ত হওয়াটা হিন্দুদের মুর্খামি ছাড়া আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না।
তবুও আজও একটি প্রশ্ন বহু মানুষের মনে জাগে কেন এই দেশ ভাগ? তুরস্ক, পারস্য, আফগানিস্থান, উজবেকিসস্থান, মঙ্গোল প্রভৃতি অঞ্চল থেকে মুসলমানরা ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। হিন্দু রাজাদের পরাজিত করে কেউ লুটপাট করে নিজের দেশে চলে যায়। আবার কেউ ভারতবর্ষে রাজত্ব করতে থাকে। যেখানে মুসলমান নবাব বা বাদশা রাজত্ব করত সেখানে হিন্দু প্রজাদের উপর নির্য্যাতন বেশি হত। কিন্তু তারা বাদশা/নবাবের প্রজা থেকে যেত। যেসব অঞ্চলে হিন্দু রাজা ছিল সেখান মুসলমানেরা নিপীড়িত হত। আমি সংক্ষেপে বলতে চাইছি যে দীর্ঘকাল বিভিন্ন বাদশা নবাব ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজত্ব করেছে। দীর্ঘদিন হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি থাকতে থাকতে এক সাথে দেশের মহামারী ঝড় দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করেছে। একই মাটিতে হিন্দুর মৃতদেহ দাহ হয়েছে আর মুসলমানের কবর হয়েছে।
প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ বাইরে থেকে বসবাস শুরু করে। এই সব মানুষরাই ভারতবর্ষের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। প্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষের দর্শন ছিল ধর্ম যার যার কিন্তু দেশ সবার।
কিন্তু ব্রিটিশদের দুশো বছর ভারতবর্ষ শাসনকালে ভারতবর্ষের শিক্ষিত মানুষরা ইউরোপিয়ান দর্শন, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান স্বার্থে পারিচিত হয়। ‘জাতীয়তাবাদ’ এই শব্দ ভারতীয় সব রাজনৈতিক নেতাদের ও মানুষদের মাথায় ঢুকে যায়। আর তার ফল দেশ ভাগ। কংগ্রেস বা হিন্দু মহাসভার নেতারা কেউ পাকিস্তানে কি করে হিন্দুরা থাকবে তার উপর চিন্তাভাবনা করেনি।আর বাঙালীরা নেতার নির্দেশ ছাড়া কোনো কাজ করতে পারে না। তাই পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা পাকিস্তান রাষ্ট্রে কি করে বসবাস করবে তার জন্য কোনো পরিকল্পনা করেনি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।