এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ব্যক্তিগত আলোকপ্রাপ্তি ও মার্ক্সবাদ

    Souvik Porel লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৬ মার্চ ২০২৪ | ৩৩১ বার পঠিত
  • বিগত কয়েক বছরে একটা ব্যপার খুব লক্ষনীয় যে, বুদ্ধদেব ভাট্টাচার্য কে নিয়ে তখনই কথা হয় যখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর কারনটা কি? এমনকি আমাদের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীও সেই নিয়ে বলেন, ওনার মতো নীতিবান মানুষ আর হয়না। বাবুল সুপ্রিয় যাদবপুরে গিয়ে বলেন, বুদ্ধবাবুকে দেখে কিছু শিখুন। এখন ওনার একটা 'ব্যক্তিগত আলোকপ্রাপ্ত' প্রকারের একটা ছবি তৈরি হয়েছে। উপরোক্ত দুই ব্যক্তি যাদের নীতিহীনতা নিয়ে আশাকরি কারও কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়, কিন্তু 'ব্যক্তিগত আলোকপ্রাপ্ত' ওই মানুষটিকে নিয়ে তাদের কোন সমস্যা আছে বলে মনে হয়না। বুদ্ধদেব ভাট্টাচার্য কে নিয়ে তাদের কোনদিনই কোনো সমস্যা ছিলনা সেকথা বলছিনা এবং ওনার এই 'ব্যক্তিগত আলোকপ্রাপ্ত' ছবিটা যে তৈরি করা হয়েছে সেটা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। লেনিন তার রাষ্ট্র ও বিপ্লব বইয়ের প্রথম পাতায় দেখিয়েছেন বিপ্লবী নেতাদের জীবনচরিত বিকৃত করে তাদের এক ক্ষতিহীন-নিরীহ ছবি তৈরি করা হয়। খ্রিষ্টান ধর্মের আদি চারটি গসপেল বিচার করে উৎপল দত্ত দেখিয়েছেন কিভাবে প্রথম গসপেল-এর প্রতিবাদী যীশু চতুর্থ গসপেলে এসে এক হার্মলেস 'ব্যক্তিগত আলোকপ্রাপ্ত' যীশুতে পরিণত হয়েছে। বুদ্ধ-র ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য মানবেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন পাশ্চাত্যে গোড়ার দিকের খ্রিস্টান ধর্ম যে ভূমিকা পালন করেছে ভারতে বৌদ্ধধর্মও একই ভূমিকা পালন করেছে। ফলে তাদের এই 'ব্যক্তিগত আলোকপ্রাপ্ত' ইমেজটা একটা বিকৃত ইমেজ।

    কিন্তু বুদ্ধদেব ভাট্টাচার্যের ক্ষেত্রে সেই ইমেজটা কি পুরপুরি তৈরি। প্রথম কথা উনি বিপ্লবী নেতা নন। একথা সত্য যে ব্যক্তিগত জীবনে উনি নীতিনিষ্ঠ। কিন্ত সমাজ জীবনে? মার্ক্সবাদ ব্যক্তিকে সমাজ থেকে আলাদা করে দেখেনা। সমাজ ও মানুষ অবিচ্ছেদ্য ও একই সূত্রে বাঁধা। বরং বলা যেতে পারে একজন মানুষ যত অনন্যই হোক না কেন সে একটি বিশেষ সময়ের একটি বিশেষ সমাজের মানুষ। তাহলে, মার্ক্সবাদে এই ব্যক্তিগত নীতির জায়গাটা কোথায়? ব্যক্তিগত আলোকপ্রাপ্তি ও প্রকৃত কমিউনিস্টদের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। তাহলে এখন কমিউনিস্টদের সাথে নীতি-র সম্পর্ক কি? কমিউনিস্টদের সাথে নীতির সম্পর্ক গভীর। লেভিনাস বলেছেন 'Ethics is the first the philosophy' ইতিহাসের মহান কমিউনিস্টরাই এই কথাটির সবথেকে আক্ষরিক প্রতিপালক। 'How To Be A Good Communist' বইয়ে লিউ শাও কি একটি কথা বার বার অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন, নতুন যারা পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন তারা একটি আদর্শ শ্রেনীসংগ্রামকেই পার্টির কাজ হিসাবে ভাবেন। কিন্তু কমিউনিস্টদের এমন অনেক কাজ করতে হয় যেগুলো তথাকথিত আদর্শ শ্রেনীসংগ্রামের মধ্যে ঠিক পড়েনা। যেমন, পুঁজিবাদকে যারা রক্ষা করছে সেই সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষমতাধারী রক্ষকদের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এই সবই একই কমিউনিস্ট ন্যায়ে বাঁধা – ইউনিভার্সালিজম। 'ব্যক্তিগত আলোকপ্রাপ্তি'-র যে নীতিবোধ তার সাথে কমিউনিস্ট নীতিবোধের দন্দ্ব এখানেই। ব্যক্তিগত আলোকপ্রাপ্তির ধারণা ব্যষ্টিকে সমষ্টি থেকে আলাদা করে ব্যক্তিই (individualism) সেখানে প্রাধান্য পায়। কমিউনিস্ট নীতিবোধ ব্যক্তি ও সমাজকে আলাদা করে না বরং একই সূত্রে গ্রন্থিত করে, ব্যক্তির জ্ঞান এমনকি যুগপরিবর্তনকারী নেতাদের জ্ঞানও সেই সমাজ দ্বারা নির্ধারিত।

    এখন সেই পুরনো প্রশ্নে ফিরে আসা যাক, কেন কোলকাতায় এমনকি বুদ্ধদেব ভাট্টাচার্যের আসে পাশে থাকা কমিউনিস্টরাও ভোগলিপ্সু? তার কারন নীতির গ্রন্থন ছড়িয়ে পড়েনি। এই কথা খুব একটা গোপন কিছু নয়। প্রকৃত সমাজতন্ত্রকামী অনেক মানুষই সি পি আই এম-র এই সমালোচনা করে থাকেন। নব্বইয়ের দশক থেকে ওদের ছদ্মবেশী কংগ্রেসী পলিসি নিয়ে আর কোন গোপনীয়তা থাকল না। চৌত্রিশ বছরের সরকারে স্কুলে স্কুলে কোন কমিউনিস্ট ক্যারিকুলাম চালু হওয়া তো দুরের কথা পার্টির সংগঠনগত দিকেও শিক্ষাগত প্রোগ্রাম প্রায় হয়নি বললেই চলে। আর এস এস বিরোধী বিশেষ কোন সচেতনতাই যে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়নি এটা তার প্রমান। ম্যক্স হোর্খাইমার 'On Sociology of Class Relation' শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, চরম মোনোপলি সমাজে কয়েকটি শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নও তাদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে। তিরিশের দশকে রুজভেল্টের 'নিউ ডিল' পলিসির সময়ে তাই ঘটেছিল। আমেরিকার তৎকালীন লেবার ইউনিয়নগুলি শ্রমিকদের দাবির সাথে রাষ্ট্রের মধ্যস্থতা ঘটাল। কমিউনিস্ট নামধারী পার্টিগুলির ভ্রান্ত পলিসি, ভোট সর্বস্ব রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের সাথে মধ্যস্থতার ফলে এত বছরের বামফ্রন্ট সরকারে স্কুলে স্কুলে কোন ক্যরিকুলাম চালু হওয়া তো দূরের কথা পার্টির আঞ্চলিক সংগঠনগত দিকেও শিক্ষাগত প্রোগ্রাম প্রায় হয়নি বললেই চলে। আরএসএস-বিজেপি বিরোধি কোন সচেতনতাই যে বাংলায় তৈরি হয়নি এটাই তার প্রমান। মার্ক্স বলেছেন ইতিহাসের দ্বিতীয় পুনরাবৃত্তি হয় ব্যঙ্গাত্মক। এতো বড়ো একটা কৃষক আন্দোলন সফল হওয়ার পরেও আমরা আজও সেই বাৎসরিক গড়ে দশ হাজার কৃষক আত্মহত্যার পরিস্থিতিতেই দাঁড়িয়ে আছি। ধর্মীয় ডেমাগগদের মতো কয়েকজনকে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাবিত করা ছাড়া শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নীতিবোধের ভূমিকা খুব কম। আবারও একথা বলতে হয় ব্যক্তিগত জীবনে নীতিবোধ আবশ্যক তবে তা যদি সাংগঠনিক নীতিতে পরিনত না হয় তাহলেই বুর্জোয়া ইন্ডিভিজুয়ালিজম তার জয়গান হাঁকাবে। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পলিটিশিয়ান | 2603:8001:b102:14fa:3ce1:e92f:eb14:***:*** | ০৭ মার্চ ২০২৪ ০১:৩৮529077
  • আইডিয়াটা কি? ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হলে মার্কসবাদের তাতে কিছু যায় আসে না!!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন