এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সময়রেখার পথ ধরে ছায়ামানবেরা

    Pradhanna Das লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ২৫৫ বার পঠিত


  • সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত ইংরাজী উপন্যাস ‘The Shadow Lines’ ওরফে ‘ছায়ারেখা’ অমিতাভ ঘোষের দ্বিতীয় উপন্যাসও বটে। এটি আনন্দ পুরস্কারও পেয়েছিল। বোদ্ধাজনেরা আমায় মাফ করবেন, আমি যখন উপন্যাসটির পঁচিশ শতাংশ পড়ে ফেলেছি, তখন মনে হচ্ছিল, উপন্যাসটা লেখার উদ্দেশ্য কি, আর আমি কেনই বা পড়ছি! পঞ্চাশ শতাংশ পড়ার পর, আমার মনে হল, গল্পের প্লটটা তো পরিস্কার হয়েছে বটে, কিন্তু এই ড্রয়িং ড্রামা’র জন্যে সাহিত্য অকাদেমী পাওয়ার কারণ কি? তৃতীয় পর্যায়ে এসে মনে হল, এ বই এই পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়াটা অনুচিৎ, এবং, শেষ পর্যায়ে এসে যখন পৌছেছি, তখন, এক সময়ে আমার দম আটকে আসছিল ঘটনা পরম্পরায়। শেষ পর্যায়ে এসে, যে বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের জালটির শেষ বুনোট দিলেন, সেই বিষয়বস্তুটি ঝটকা দেওয়ার মতো, কারণ, ওই সময়টাকে নিয়ে, আমার, এযাবৎ কোন প্রবন্ধ, কবিতা বা উপন্যাস বা গল্প চোখে পড়ে নি।

    শেষে আসার আগে আগের কথা বলে নিই।

    উপন্যাসটি তিন প্রজন্মের। ঠাকুমা-কাকা-নাতি, ঠাম্মা-ত্রিদিব-বক্তা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ঠাম্মার বোন মায়াদেবীর পরিবার, যিনি প্রবাসী, এবং যখন তারা ইংলন্ডে থাকতেন, সেই সময়ে যে বাড়ীতে থাকতেন সেই প্রাইস ফ্যামিলির সন্তানেরা – মে এবং নিক। মায়াদেবীর আরেক সন্তান ইলার সাথে নিকের বিয়ে হয়। মে-র পছন্দ ছিল ত্রিদিব, যে ছোটবেলাতেই চলে আসে কলকাতায়। ফলে উপন্যাসের প্রথমার্ধের একটা বড়ো অংশ প্রবাসী এবং কলকাত্তাই বাঙাল পরিবারের একটা মানসিক টানাপোড়েনের পাশাপাশি প্রবাসী ভারতীয় এবং সেখানকার অধিবাসীদের সাথেও যে একটা মানসিক চাপান উতোর ছিল, তার খানিকটাও মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
    এবং ঘটনা শুরু হয়েছে ১৯৪০-এর পর থেকে।

    আজও কি আমরা, বিদেশে যাওয়াকে ‘এচিভমেন্ট’ বলে মনে করি না? সে যেমন চাকরীই হোক না কেন, একটা গ্রীণ কার্ড যে আমাদের স্ট্যাটাস কতটা উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে, তা আজকের যুগের আইটি-র ছেলেমেয়েদের দেখলে অনেকটাই মালুম পাওয়া যায়। বাংলা থেকে ব্যাঙ্গালোর একটা বড়ো এচিভমেন্ট। আর তার কিছুদিন পরে যদি আমেরিকা পাড়ি দেওয়া যায়, তাহলে আমরা মনে করি ডলারের পাহাড়ে থাকা এই মানুষটি আমাদের রূপকথার কল্পলোকে থাকা মানুষ। প্রতি দু-তিন বছর অন্তর বেশ কিছু সস্তার উপহার দেখে আমাদের মন যেমন ভরে যায়, তেমনি তাদের ক্ষেত্রে সম্ভ্রমও আদায় করা যায়। বিদেশের প্রতি আমাদের মোহ তখনও যায় নি, আজও যাচ্ছে না।

    আর আমরা সম্ভ্রম করলেও, কিন্তু, মনে মনে কিছুটা হলেও, বিদ্বেষ পোষণ করি। “সব যায় দাদা তোমাদের পোড়া হিংসেটা যায় না” লিখেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ একটা চিঠিতে। সেই পোড়া হিংসে নিয়েই আমরা দেঁতো হাসি হেসে ওয়েলকাম জানাই, আর পেছনে চলে নানা ধরনের কল্পচর্চা, যাকে বলা হয় পরনিন্দা পরচর্চা। অদ্ভুত এই মানসিক বৈপরিত্যের ফলে আমরাও কিন্তু খুব একটা আপন করে নিতে পারি না এই প্রবাসীদের। একবার দেশছাড়া হলে সে কি আর এদেশের থাকে? না মনে হয়। বহু বছর পর ফিরে এলেও নয়। 

    তারা না তো এদেশের হয়, না ওদেশের। তারা ত্রিশঙ্কুর মতো একধরনের এলিয়েন হয়ে থেকে যায়, যেখানেই থাকুক না কেন।

    অমিতাভ ঘোষের লেখায় এই টানাপোড়েনের আভাস খানিকটা অনুভব করতে পারি। আস্তে আস্তে সময় চলে আসে ১৯৬৪-তে। এবং উপন্যাস শেষের দিকে এগোতে থাকে।

    হজরত মহম্মদের ‘চুল’ এই সময়েই চুরি যায় জম্মু-কাশ্মীরের হজরতবাল মসজিদ থেকে। ১৯৬৩ সালের ২৭শে ডিসেম্বর। ১৯৬৪ সালের ৪ঠা জানুয়ারী তা পুণরুদ্ধার হয়। কিন্তু এই কয়েকদিনের মধ্যে ছোটখাটো দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় দুই বাংলার মানুষ। ধর্মের উচ্ছ্বাস, শোক এবং উষ্মা বেশ কিছু প্রাণের বলি নেয়। এই সময় দুই তরফেই কার্ফু ইত্যাদির মাধ্যমে চটপট পরিস্থিতি শান্ত হয় বটে, কিন্তু এই ‘চটপট’-এর মধ্যেও যে ক্ষণটুকু থাকে, সেই ক্ষণটুকুতেই প্রাণ যায়, উচ্ছেদ হয় অনেক মানুষ।

    দাঙ্গা আজও চলে। দুই ধর্মের মধ্যেকার পরিস্থিতি এখনও ব্যালান্সড নয়। হবে কবে? জানি না। কিন্তু আমি দেখেছি, স্থানীয় মানুষদের মধ্যে, সাধারণ কিম্বা অতি সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মের আঁচ তাদের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে পড়ে না। পেটের দায় বড়ো দায়। সে জাতি-কূল মানে না। সে চায় তাদের ‘সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। আর তাই ‘উদ্দেশ্য’ শব্দটার সাথে দাঙ্গা একটা বড়ো বিষয় হয়ে পড়ে। ধর্মের সাথে নয়। ধর্ম একটা মাধ্যম হয় মাত্র। 

    অমিতাভ ঘোষ একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে তার লেখনির টানে যে মর্মস্পর্শী পরিসমাপ্তি ঘটালেন, তা মনে দাগ কেটে যায় যথেষ্ট। এইখানেই তার লেখনীর মুন্সীয়ানা। যে প্রশ্ন একটা সমাজকে, দুটো দেশকে, এবং তার থেকেও বড়ো, কয়েকটা সম্পর্ককে চিরদিনের জন্য অন্য খাতে বইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, ‘দাঙ্গা’ সংক্রান্ত সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বড্ড জরুরী হয়ে দাড়াচ্ছে দিনের পর দিন। নয়তো, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনেও, আমরা দেখছি একই বিষয়ের টানাপোড়েন। 

    মৌসুমী বসু-র অনুবাদ যথাযথ। পড়তে কোথাও সমস্যা হয় না।

    =========================

    ছায়ারেখা
    অমিতাভ ঘোষ
    অনুবাদিকাঃ মৌসুমী বসু
    সাহিত্য অকাদেমী
    মুদ্রিত মুল্যঃ ১৪০ টাকা
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন