আরে মশাই, আপনি কোন্ দিকে আছেন বলুন তো ! আপনি কী ধর্মেও আছেন, আবার জিরাফেও আছেন?
- কেন? যেমন ছিলাম তেমনই আছি, আমি বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী এবং ধার্মিক।
ডোন্ট মাইন্ড, মাই ডিয়ার। আসলে মাঘ চতুর্দশীর রাতে বাড়িতে কালী পূজো হলো কিনা, তাই বলছিলাম !
- আসলে ডারউইন সাহেব শিখিয়েছেন কিনা! তাই একটু জিরাফ দেখার ইচ্ছে হলো।
হাঁ, হাঁ, হাঁ। বেশ তো, তা হলে ধর্মেই থাকুন না মশাই , আবার জিরাফে কেন?
- এটাই তো আমার দোষ মশাই, ভুবন স্যার সেই যে ক্লাস টেনে থাকতে মাথায় ঢুকিয়েছিলেন ডারউইনের 'ভূত' !
এক্কেবারে ঠিক বলেছেন মশাই, আমিও তো পড়েছিলাম, এখন কিনা জানছি ওসব ভূত-ভূতুমের গপ্পো ! তাইতো এখন ওসব বাদ দেবে সিলেবাস থেকে। যাকগে, এই জেনারেশনটা বেঁচে যাবে। এবার দেখবেন তরতর করে এগোচ্ছে আমাদের জাতি। জানি না সেই দিন দেখে যেতে পারবো কি না, যেদিন কর্মে, ধর্মে, বর্ণে আমরা মহান হবো।
- কী জানি, মাথাটা কেন এত ঝিমঝিম করছে। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা বিজ্ঞান তো যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, যিনি বিজ্ঞানমনস্ক তিনিই তো যুক্তিবাদী, কিন্তু তার সঙ্গে ধর্মের বা জিরাফের কোনো বিরোধ আছে কী? আমি আস্তিক নই, কিন্তু মনেপ্রাণে তো আমি ধার্মিক। কাকে বোঝাই বলুনতো ! মাঝেমধ্যেই পাশের পাড়ার আগমার্কা বামপন্থী নিপাট ভদ্রলোক কমল বাবুকে দেখা যায় মাধবপুরের চালপট্টির গলির মুখের শনি মন্দিরের চৌকাঠে নিষ্ঠা সহকারে করজোড়ে মাথা ঠুকছেন। আবার তিনিই পার্টির প্রতি এতটাই একনিষ্ঠ কিছু না বুঝেশুনেই বা হয়তো স্রেফ লোকে কী মনে করবে তা ভেবে আমার বাড়ির কালীপূজোয় নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে কুন্ঠাবোধ করেছেন। বাগবাজার বাঁড়ুজ্জে পরিবারে বারো মাসে তেরো পাবর্ণ সামলে বনেদি বাড়ির জীববিজ্ঞানের প্রবাদপ্রতীম শিক্ষক অতীন বাবুর লেখা ডিসেন্ট অফ ম্যানের অসাধারণ বাংলা ভাবানুবাদ পড়ে আমার মত বহু মানুষ আজও অভিভূত।
কী? চুপ করে রইলেন যে? বিবর্তনবাদ তো বাতিলই হয়ে গেল, এবার তা হলে আপনার মতো ধার্মিক ও যুক্তিবাদী লোকেরা মানুষের উদ্ভব সম্মন্ধে কী মতামত দেবেন?
- দেখুন, ডারউইন সাহেবকে প্রায় দুশো বছর আগে চার্চের যাজকদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করতে হয়েছিল সেই যুদ্ধের সুফলেই কিনা বিজ্ঞান পৃথিবীব্যাপী উন্নয়নের বিজয়রথ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। সেই বিজয়রথ থামিয়ে দেবে কার সাধ্য বলুন তো? সত্য প্রতিষ্ঠার সেই যুদ্ধ আজও চলছে।
বাইবেলের কথা ছাড়ুন মশাই। ভাগ্য ভালো ডারউইন সাহেবকে আমাদের হিন্দু দর্শনের মুখোমুখি হতে হয়নি। আরে মশাই, মহাজগৎ ও মানব সৃষ্টির সম্যক বর্ণনা আছে আমাদের পুরাণে।
- দেখুন হিন্দু পুরাণ, কোরান, বাইবেল কী বলেছে তার অনেকাংশ থেকে অবশ্যই অনুপ্রাণিত হওয়া যায় , কিন্তু আমি নিশ্চই তার অপব্যাখ্যা করে ভগবানের নামে লোক ঠকাবো না বা তার থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটব না।
কিন্তু প্রশ্নটা তো থেকেই গেল,ডিম আগে না মুরগি আগে !
- হেয়ালী না করে যদি আপনি প্রশ্ন করেন, তাহলে বলবো ডিম যেহেতু এককোষী আর মুরগি যেহেতু বহুকোষী, তাই আগে ডিম ও তার পরে মুরগি।
তাহলে মশাই, ডিমটা কীভাবে এলো?
- আলবৎ, সেটাই তো কথা। আর আপনাকে কী বলবো বলুন তো, আপনি তো বিজ্ঞান জানা মানুষ। জীব সৃষ্টির প্রাথমিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আপনি তো জানেনই। হট ডাইলিউট স্যুপ বা প্রাইমর্ডিয়াল স্যুপের কথা তো আপনি শুনেছেন? কোলকাতার সায়েন্স সিটির ঠিকানা যার নামে সেই বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী জে.বি.এস হ্যালডেন এই 'হট ডাইলিউট স্যুপ' তত্ত্বের প্রবক্তা। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হ্যালডেন বাধ্য হয়েছিলেন তার মাতৃভূমি ত্যাগ করতে, জীবনের শেষ কয়েকটি বছর ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটে বিজ্ঞান সাধনা করেছিলেন।
হ্যাঁ তাই বলুন, উনি ভারতে এসে ডারউইনকে নস্যাৎ করে ভাগবতের আলোকে পুরাণ দর্শন নিয়ে বুঝি গবেষণা করেছিলেন?
- আরে ধূর মশাই। উনি আকড়ে ধরেছিলেন ডারউইনের বিবর্তনবাদকে। আধুনিক জিন তত্ত্বের ভিত্তিতে ডারউইনবাদের কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি শুধরে নিয়ে এবং আরও কয়েকজন বিজ্ঞানীর ভাবনাচিন্তা জুড়ে দিয়ে তৈরি করলেন নয়া-ডারউইনবাদ।
ওরে বাবা, সেইতো আবার ডারউইন ! একই গল্প বারবার শোনাচ্ছেন কেন বলুনতো ! না, না, না। বুঝতে পেরেছি, এটা কম্যুউনিস্টদের কারসাজি।
- আরে মশাই, ডারউইনকে বাদ দিয়ে আপনি এগোবেন কী ভাবে? এই মহাবিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে দেশে- বিদেশে যা যা মতবাদ আছে তার সবকটিই তো ডারউইন-নির্ভর।
আচ্ছা, নয়া-ডারউইনবাদ মানুষ সৃষ্টি নিয়ে কী পথ বাতলে দিল তা একটু খোলাসা করুন দেখি।
- হ্যাঁ, মানুষতো এক্কেবারে শেষে। বিবর্তনের ক্যালেন্ডারে আমরা অনেক অনেক জুনিয়র। বাকি না-মানুষী সিনিয়ররা অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব থেকে বিবর্তনের পথে ক্রমে-ক্রমে দেহগঠন জটিল থেকে জটিলতর করেছে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ১৯২৪ - এ বিজ্ঞানী ওপারিন ও ১৯২৯ -এ হ্যালডেন জানালেন প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে সমুদ্রের ফুটন্ত জলে কার্বন, হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া, মিথেন ইত্যাদি মিলেমিশে তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন জৈবযৌগ যেমন অ্যামাইনো অ্যাসিড, ফ্যাটি অ্যাসিড, পলিস্যাকারাইড, প্রোটিন ইত্যাদি। তারপর একসময় তৈরি হলো প্রাণের উৎস নিউক্লিক অ্যাসিড, মানে প্রথমে RNA ও তারপর DNA। সৃষ্টি হলো এককোষী সরল নিউক্লিয়াসের ব্যাকটেরিয়া, তারপর আদর্শ নিউক্লিয়াসের এককোষী অর্থাৎ ঐ অ্যামিবার মতো জীব। বহুযুগ ধরে একে একে এলো বিভিন্ন সরল গঠনের বহুকোষী জীব - এই যেমন স্পঞ্জ, হাইড্রা,কৃমি, কেঁচো,পোকামাকড়, শামুক, তারামাছ, নরম হাড়ের হাঙর মাছ, শক্ত হাড়ের অন্যান্য মাছ, ব্যাঙ,সরীসৃপ হয়ে তারপর পাখি ও স্তন্যপায়ীরা অর্থাৎ গরু, ছাগল, বনমানুষ। সেই বনমানুষ থেকেই আজকের মানুষ।
আচ্ছা, গাছপালাও কী ঐ একইভাবে সরল থেকে ক্রমশ জটিল গঠনের হয়েছে?
- অবশ্যই। তবে এদের শুরুটা হয়েছিল প্রাণীদের শুরুর অনেকটা আগেই। সরল গঠনের শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ থেকে একসময় এসেছিল বড় বড় গাছপালা।
তাহলে ওরা মানুষকে মিথ্যা বলছে, তাইতো? সত্যিই তো, আমিও তো স্কুল-কলেজে বিজ্ঞানে এসবই
পড়েছি ! এখন বুঝতে পারছি, বিজ্ঞান জানলেই বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া যায় না।
- হ্যাঁ, ঠিক তাই। ঐ ভন্ড ধর্মিকরা, যাদের অনেকেই বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষিত হয়েও সব জেনেবুঝে সাধারণ মানুষের মনে মেকি-ধর্মের বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাই বলছি বন্ধু, একটু ভাবুন, নিজের বিবেক-বোধ-বুদ্ধি কে প্রশ্ন করুন। আর এই ভাবতে পারি বলেই কিনা আমরা মানুষ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।