বাল্মীকির রামায়ণে অকালবোধনের প্রসঙ্গ নেই, অবশ্যই সত্য। কিন্তু পরবর্তী পুরাণগুলিতে অকালবোধন ও দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। দেবীভাগবত পুরাণ অনুযায়ী দেবর্ষি নারদের পৌরোহিত্যে রামচন্দ্র নবরাত্র ব্রতপালন করেন। কালিকাপুরাণ, মহাভাগবত পুরাণ, বৃহদ্ধর্ম পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে (অষ্টম-চতুর্দশ শতাব্দী) অকালবোধনের কাহিনী বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায়। রাবণের পরাজয় কামনায় দেবগণ পিতামহ ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে ব্রহ্মা বলেন দেবীর কৃপা ভিন্ন রাবণকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাই রাবণকে বিনাশ করার জন্য দেবীপূজা একান্ত প্রয়োজন। অতএব দেবীর প্রসন্নতালাভের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবগণ দেবীস্তব করলে দেবী কুমারীমূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে বিল্ববৃক্ষতলে দেবীর বোধন করতে বলেন। দেবীর আদেশানুসারে ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবগণ মর্ত্যে এসে অতি দুর্গম নির্জন স্থানে বেলগাছের শাখায় পরমাসুন্দরী এক বালিকাকে নিদ্রিতা দেখতে পেলেন। ব্রহ্মা বুঝলেন, এই বালিকাই স্বয়ং জগজ্জননী, বালিকারূপে আত্মগোপন করেছেন।তখন ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবগণ নতজানু হয়ে দেবীস্তব পাঠ করলেন। তাঁরা বললেন,
"হে দেবী, আমরা নিশ্চিতরূপে জানি তুমিই মহেশ্বরী, সকল শক্তির মূর্তবিগ্রহ। ভূতল তোমার ক্রীড়াভূমি, তাই তুমি এখানে এসেছ।.... মহাযোগিগণও তোমার মহিমা সম্যকরূপে জ্ঞাত নন।...... এই ব্রহ্মাণ্ডে সর্বত্র তোমার শক্তির প্রকাশ। ব্রহ্মা, রুদ্র ও অন্যান্য দেবগণ সবাই তোমার শক্তিতে শক্তিমান। হে সর্বশক্তিস্বরূপিণী, রামের শক্তিও তোমার, রাবণের শক্তিও তোমার। হে সর্বশক্তিস্বরূপিণী, তুমি রামে অধিষ্ঠিতা হও, তোমার বোধন করি, তুমি প্রসন্না হও।"
ব্রহ্মার স্তবে সন্তুষ্টা হয়ে দেবী প্রবুদ্ধা হলেন ও তাঁর বালিকামূর্তি পরিত্যাগ করে উগ্রচণ্ডামূর্তিতে প্রকাশিত হলেন। নতজানু হয়ে ব্রহ্মা বললেন,
"ঐং রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ।
অকালে তু শিবে বোধস্তব দেব্যা কৃতো ময়া।।"
( হে বিশ্বজননী, রাবণকে বধের জন্য ও রামচন্দ্রকে অনুগ্রহের জন্য আমরা তোমার বোধন করছি। হে দেবী, তুমি প্রসন্না হও।)
প্রবুদ্ধা দেবী ব্রহ্মা ও দেবগণকে অভিলষিত বর প্রদান করে অন্তর্হিত হলেন। রামও দেবীর শক্তিতে শক্তিমান হয়ে রাবণ বিনাশে সমর্থ হলেন। মহাবিপদ কেটে যাওয়ায় অষ্টমী তিথি হলো মহাষ্টমী, আর মহাসম্পদ লাভ হলো বলে নবমী তিথি হলো মহানবমী। দশমীতে বিজয়োৎসব হওয়ায় এই দিন বিজয়াদশমী নামে বিখ্যাত হলো।
সংক্ষেপে বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী এটিই অকালবোধনের কাহিনী। কালিকাপুরাণ ও মহাভাগবত পুরাণেও অনুরূপ কাহিনী পাওয়া যায়।
কালিকাপুরাণ, মহাভাগবত পুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণের এই কাহিনী প্রমাণ করে দীর্ঘদিন ধরেই এই কাহিনী পূর্বভারতে প্রচলিত ছিল। সংস্কৃতজ্ঞ কৃত্তিবাস এই কাহিনী পড়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন এই কাহিনী তাঁর রামায়ণে থাকলে তাঁর লেখা পাঠকের কাছে আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তিনি তাঁর কাব্যে এই কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন।
প্রসঙ্গত ষষ্ঠীর দিন বোধনের সময় যে দেবীস্তব পাঠ করা হয়, সেখানেও এই কাহিনী আছে। সেখানে বলা হয়, "হে দেবি, রাবণ বিনাশের নিমিত্ত ও রামচন্দ্রকে অনুগ্রহের জন্য পুরাকালে ব্রহ্মা তোমার বোধন করেছিলেন। তদনুরূপ আমিও আশ্বিন মাসে ষষ্ঠী তিথির সায়াহ্নে তোমার বোধন করছি।"
অর্থাৎ অকালবোধনের কোনো শাস্ত্রীয় প্রমাণ নেই, এই কথা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। যাঁরা বলেন, তাঁরা নিজেরাই বিশেষ পড়াশোনা করেননি!