দুই বন্ধু এক ছুটির রাত্রে পাড়া থেকে একটু দূরের সরাইখানায় দু পাত্তর পেটে ফেলে হাল্কা তুরীয় অবস্থায়। কলেজ সবে পেরিয়েছে তারা, রোজ যে দু পাত্তর ছাড়া চলে না তাও নয়। তবে মাঝে মাঝে একটু না হলে চলে না। আবার পাড়ার এবং বাড়ীর বয়স্কদের অসন্মান করতেও এই বয়সে ইচ্ছে করে না। তাই একটু দূরের কোনো সরাইখানাই তাদের পছন্দের। দুই বন্ধুই বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। সবে স্নাতক হয়েছে, স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়েছে দুজনেই, কিন্তু ক্লাস শুরু হয়নি। স্নাতকোত্তরে ভর্তির আনন্দ এবং মেঘলা দিনের কারণে একটু তো ইচ্ছে করবেই এই বয়সে। হাল্কা তুরীয় অবস্থায় দুজনেরই একটু বেশী কথা বলতে ইচ্ছে করছে এখন। ফলে তাদের বাধা দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়। বরং পাশের টেবিল থেকে উপভোগ করাই উচিত।
অন্যদিকের টেবিলে এক বয়স্ক লোক নাগাড়ে অর্ডার দিয়ে চলেছেন। দেখেই মনে হচ্ছে প্রতিদিনের কাস্টমার এই সরাইখানার। ওয়েটাররা অর্ডার অনুযায়ী পেগ সাপ্লাই দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এখনও অব্দি মনে হচ্ছে সাত, আট পেগ পেটে চলে গিয়েছে। বেশ টলোমল অবস্থা, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। সরাইখানা ভর্তি লোকের মধ্যেও তিনি নজরে পড়ে যাচ্ছেন সকলের। মাঝে মাঝেই ওয়েটারকে চিৎকার করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছেন। নিশ্চয়ই তিনি এই গালিগালাজ নিত্য করেন, ওয়েটারদের গা সওয়া হয়ে গেছে।
আমি এক পাত্তর নিয়ে বসেছি বটে কিন্তু মূলতঃ সরাইখানায় আমার আগমনের হেতু এই পরিবেশকে উপভোগ করা। নইলে আমার এজাতীয় নেশার প্রতি বিশেষ কোনো আকর্ষণ নেই আর চাইলে বাড়ীতে বসেই এজাতীয় নেশা করতে পারি, সরাইখানায় আসার প্রয়োজন হয়না। মাঝে মাঝে যখন একা হয়ে পড়ি বাড়ীতে, নতুবা মেজাজ কোনো কারণে বিগড়ে যায়, তখন এই সরাইখানায় এসে এক পেগ নিয়ে বসে পড়ি। আর ঘণ্টা দুয়েক অন্ততঃ সরাইখানার পরিবেশকে উপভোগ করি। এ আমার বেঁচে থাকার রসদ যোগায়। নইলে বন্ধুবান্ধবহীন অবস্থায় এই বয়সে মনের রসদ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অবশ্য এইভাবে যে মনের রসদ সংগ্রহ করা যায় সেটাও এক বন্ধুরই দেখানো। আজকেও বাড়ীতে একা বলে আর দীর্ঘদিন এদিকে আসা হয়নি বলে সকাল থেকেই সরাইখানায় আসার জন্য মনটা উড়ুউড়ু করছিল। বিকেল হতেই আকাশের মেঘকে উপেক্ষা করেই চলে এসেছি এদিকে। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে রসদের পরিমাণটা একটু বেশীই পাবো। অন্ততঃ প্রাথমিক পরিবেশটা সেইরকমই।
ওদিকে দুই বন্ধুর আলোচনা জমে উঠেছে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছিল ছবি নিয়ে তাদের আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু কানটা একটু সজাগ করতেই বোঝা গেলো ছবি নয়, কবি নিয়ে তাদের আলোচনা। কথোপকথনের আকারে শুনলেই মনে হয় আসল মজাটা পাওয়া যাবে, তাই সেইভাবেই আপনাদের বলি।
প্রথম বন্ধু - তুই কেনো এখনও কবি হতে পারলি না?
দ্বিতীয় বন্ধু - আমার দ্বারা কবিতা লেখা হয় না, তাই।
প্রথম বন্ধু - কখনও না, কখনও না।
দ্বিতীয় বন্ধু - আমার দ্বারা কবিতা কেনো, কিছুই লেখা হয় না। শালা গল্পই লিখতে পারি না, তায় কবিতা।
প্রথম বন্ধু - তুই কোনোদিন লিখেছিস কিছু?
দ্বিতীয় বন্ধু - নিশ্চয়ই, বাংলার ছাত্র, লেখার চেষ্টা করবো না তাই হয়? কিন্তু সেগুলো শালা রচনার বেশী কিছু হয়নি।
প্রথম বন্ধু - প্রেম করেছিস কখনও?
দ্বিতীয় বন্ধু - হ্যাঁ, কলেজে দু তিনবার করেছি।
প্রথম বন্ধু - কতদূর এগিয়েছিলি?
দ্বিতীয় বন্ধু - এগুলো শালা ব্যক্তিগত প্রশ্ন হয়ে যাচ্ছে।
প্রথম বন্ধু - না, আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য হলো খুব বেশীদূর এগিয়েছিলি কি? এরপরে কি কেউ তোর সাথে বিট্রে করেছে?
দ্বিতীয় বন্ধু - হ্যাঁ করেছে, দু তিনজন যাদের সাথেই প্রেম করেছি, সকলেই বিট্রে করেছে।
প্রথম বন্ধু - তারপরেও তুই কবিতা লিখতে পারিস না?
দ্বিতীয় বন্ধু - প্রেমে বিট্রের সাথে কবিতা লেখার কি সম্পর্ক?
প্রথম বন্ধু - ধর যেদিন তোর কোনো প্রেমিকা তোর সাথে ব্রেকআপ করলো সেদিন রাত্রে তোর মনে হয়নি একটা কবিতা লিখতে? পেটে দু পাত্তর দিতে?
দ্বিতীয় বন্ধু - সেদিন রাত্রে এই সরাইখানায় একা বসে পেটে ছ পাত্তর ঢেলেছিলাম। কিন্তু লেখার কথা তো মনে হয়নি সেদিন বা তারপরেও কোনোদিন। তাহলে তো রবীন্দ্রনাথকে জীবনে অন্ততঃ একশোবার প্রেমে ব্যর্থ হতে হয়েছিল। ভাটের কথা রাখ তো।
প্রথম বন্ধু - কিন্তু আমার পেটে একটু পড়লেই কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। এই ধর -
তা ধিন ধিন,
গরুর দুটো শিং।
তেটে কেটে ধা,
গরুর চারটে পা।
আর একদিন লিখেছিলাম -
তোমার মুখের দিকে তাকালেই,
বৃষ্টি ঝরে আমার নয়নে।
আমার দিকে তাকালে,
কি হয় তোমার চাঁদ বদনে?
বৃষ্টির সময় জানলার ধারে কবিতা লেখার মজাই আলাদা বুঝলি। এটা অবশ্য অভ্যাসের ব্যাপার। তুইও চেষ্টা কর হয়ে যাবে।
প্রথম বন্ধুর কথা শেষ হতে না হতেই পাশের টেবিলের বয়স্ক লোক এ কে 47 এর মতো অঝোর ধারায় কিছু দুই, চার, ছয় অক্ষরের বাছাই করা অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে শুরু করলেন। বেশ কিছুক্ষণ অঝোর ধারা চলার পরে একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করলেন, শান্তির ছেলেরা, মাল পেটে পড়লেই কবিতা! কবিতার ছিরি দেখো! তোর বন্ধু পারে না সেটা তো স্বীকার করছেই। আর তুই শালা বাতেলা মারছিস? শালা এগুলো কবিতা? আবার তিনি একটু দম নিলেন। তোর চেয়ে ভালো কবিতা আমি লিখতাম শালা, পেটে মাল পড়ার দরকার পড়তো না। রবীন্দ্রনাথ পড়েছিস, শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়েছিস শালা শান্তির ছেলে? শক্তি না হয় খেত একটু, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি খেত রে শালা? সরাইখানার পরিবেশটাই নষ্ট করে দিচ্ছিস তোরা। একটু শান্তিতে দু পাত্তর খাবো তার জো নেই তোদের জন্য। কবিতা তোদের পেছনে ঢুকিয়ে দেব। এরপরে তিনি হঠাৎ করেই একদম ঠান্ডা হয়ে গেলেন, সুর করে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন:
এত কালো মেখেছি দু হাতে এতকাল ধরে
কখনো তোমার করে, তোমাকে ভাবিনি।
এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়
যেতে পারি
যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো ?
সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো
যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না
তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবো
একাকী যাবো না- অসময়ে।
(যেতে পারি কিন্তু কেনো যাবো - শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
শালা, শান্তির ছেলে, পেটে দু পাত্তর পড়লে এইরকম কবিতা বেরোয়, পড়েছিস কখনও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা? তোর মতো দুটো শিং আর চারটে পা নয়। আরও শুনবি? কবিতা কাকে বলে? শোন...
মোর লাগি করিয়ো না শোক—
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শূন্যেরে করিব পূর্ণ এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে,
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।
ওগো তুমি নিরুপম,
হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান;
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
(শেষের কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এরপরে সত্যিই সেই বয়স্ক ভদ্রলোক টেবিল ছেড়ে সরাইখানার বাইরে বেরিয়ে গেলেন। শুধু দুইবার আস্তে আস্তে বললেন, হে বন্ধু, বিদায়। বুঝলাম হয়তো তিনি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন নতুবা তাঁর পেগের সীমা সম্পূর্ণ হয়েছে নতুবা এখন তাঁর কবিতার নেশা পেয়েছে যা সরাইখানায় বসে এই পরিবেশে সম্ভব নয়। দুই বন্ধু হতভম্ব অবস্থায় বসে রইলো, হাতের পাত্তর হাতেই রয়ে গেলো, ঠোঁট অব্দি আর পৌঁছালো না। আমিও বুঝলাম পাত্তরের নেশায় কিছুই হয়না, পরিবেশ পরিস্থিতি সাময়িক হয়তো ভুলে থাকা যায়। আসল নেশা কবিতা, বুঁদ করে রাখে সারাটা জীবন। ধীরে ধীরে দাম মিটিয়ে সরাইখানা থেকে বেরিয়ে এলাম। দেখি যদি সেই ভদ্রলোকের সাথে একবার কথা বলা যায়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।