এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আমার কথা ও গল্পগাছা

    Mousumi Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০২ অক্টোবর ২০২৩ | ৪০০ বার পঠিত
  • পর্ব ৭
    বেনারস পর্ব ৭

    সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বেনারসের রাস্তা আলোয় ঝলমল করছে। জনস্রোত চলেছে। নিজস্ব ছন্দে, গতিতে এগিয়ে চলেছে সকলেই। আমিও চলেছি দোকান দেখতে দেখতে, মানুষ জন দেখতে দেখতে। এ চলাও এক অদ্ভুত চলা ! এমন ভীড় রাস্তায় একমাত্র কলকাতার পূজোর সময়েই চলেছি। জামাকাপড়, বাসনের দোকান, মিষ্টি, রাবড়ি, চাট, ঠাণ্ডাই , মশলা দুধ, চা – কি না! সব দোকানেই ভীড়। একটি জায়গায় দেখা গেল বড় বড় হাঁড়িতে খিচুড়ি – বিলি করা হচ্ছে পথ চলতি মানুষের মধ্যে । সেই প্রসাদ কেউ গ্ৰহণ করছেন প্রসাদরূপে কেউ বা ক্ষুধা নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে। স্বয়ং মা অন্নপূর্ণার বাস বারাণসীতে – সেখানে মায়ের কোনোও সন্তান কি আর অভুক্ত থাকতে পারে? 

    জনস্রোতে মিলেমিশে নানা বেশে সাধু বাবারাও চলেছেন। কেউ কৌপীনধারী, কারোও বা গেরুয়া পোশাক, কারোও মাথায় জটার বাহার আবার কেউ বা মুণ্ডিত মস্তক আবার কেউ চলেছেন সাদা ধুতি পরে – নানান সাজে চলেছেন একই গন্তব্যে। উদ্দেশ্য পুণ্য অর্জন – পুণ্য বিতরণেও অনেকেই বিশেষ উৎসাহী। । কত রকম সাজ তাঁদের। কারোও হাতে ত্রিশূল, কারোও বা বিরাট জটা অথবা গলা ভর্তি রুদ্রাক্ষের মালা, লাল, নীল, সবুজ নানা রঙের পাথরের মালা, কারোও অঙ্গে ভস্মের পরশ। কারোও মুখে অবিরাম 'জয় শিব শম্ভু' কারোও মুখে 'হর হর মহাদেব' ধ্বনি। 

    একজন জটাধারী বাঘছাল পরা বাবাজী হাতে ডমরু বাজিয়ে ঐ ভীড়ের মাঝেই ছোটখাটো শিব তাণ্ডব নৃত্যে মাতোয়ারা হয়ে চলেছেন । বাবাজীর সঙ্গে চলেছেন সাদামাটা বেশধারী একজন – সহকারী হয়তো বা ! শ্রী বিশ্বনাথ কাশীতে জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে বিরাজিত। সাধারণের চোখে জ্যোতিঃ স্বরূপ মহাকাল ধরা দেন না। অথচ ভক্ত মন চায় তাঁর সঙ্গ – ক্ষণিকের লীলাবিলাসের মাধ্যমে। বোধহয় এই কারণেই রক্ত মাংসে গড়া মহাদেবকে দেখে ভীড়ের মাঝখান থেকেই হৈ হৈ করে অনেকেই এগিয়ে এলেন হাতজোড় করে, রাস্তার মাঝেই প্রণাম করে প্রণামী দিয়েই তাঁরা খুশী। সহকারী বাবাজীর হাতে প্রণামী সামলানোর দায়িত্ব। মহাদেব অদ্ভুত সুন্দর নৃত্যে উন্মত্ত। আমিও দেখছিলাম মন দিয়ে। অনাদি, অনন্তের মহিমার খোঁজ একটু হলেও হয়তো বাবাজী পেয়ে থাকবেন। দেহধারী বাবাজী – সেই দেহের সেবার উদ্দেশ্যে প্রণামী দেওয়া হয়তো যেতেই পারে! 

    দু চার পা এগোতেই কানে এল বেশ জোরালো 'হর হর ব্যোম্ ব্যোম্' ধ্বনি। শক্তপোক্ত দেহধারী এক বাবাজী – ধুতি ও পাঞ্জাবী তাঁর পরণে । বড় বড় কালো চুল মাথার মাঝখানে চূড়ো করে বাঁধা। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। এক হাতে একটি ছোটখাটো থালা। থালাতে কিছু পয়সা। চার, পাঁচজন ছেলে–কলেজ পড়ুয়া বলেই মনে হল – চলেছে তারা। বাবাজী ওদের উদ্দেশ্যে হাঁক দিলেন – 'জয় ভোলে বাবা কী'! দান করো বেটা! পুণ্য মিলেগা '– ছেলেরা নিজেদের মধ্যে কথায় ব্যস্ত। হেঁটেই চলেছে তারা। আমরাও একই দিকে চলেছি। এবার সাধুটি র মুখে নতুন ধ্বনি ' জয় অন্নপূর্ণা মাঈ কী' – বেটা মাঈ কে নাম লে কে দান করো – বহুৎ পুণ্য মিলেগা ' । না, সে ছেলেদের মোটেই পুণ্যার্জনে মন নেই । এরপর বাবাজী অধীর হয়ে বড় বড় পা ফেলে ওদের পিছনে গিয়ে শুধুই ' নারায়ণ ! ও নারায়ণ! বলে ডাকাডাকি শুরু করলেন। অত হৈ হট্টগোলের মাঝেই অত ডাকাডাকি মিলিয়ে গেল। এতরূপে ডেকেও ছেলেদের অন্তরাত্মা সাড়া দিলেন না বাবাজীকে । গোদোলিয়া মোড়ের ভীড়ের মাঝে হারিয়ে ফেললাম বাবাজী কে । কারণ, আমার দৃষ্টি তখন গিয়ে পড়েছে বড় করে গোরুর ছবি আঁকা Kashi Chickan Centre এ। ও হরি!!! এ তো দেখি জামাকাপড়ের দোকান! হ্যাঁ, জামাকাপড় ই। লক্ষ্ণৌ এর চিকনের কাজ করা কাপড় বা সেই কাপড়ে তৈরী শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবী ইত্যাদি সেই দোকানে বিক্রি হচ্ছে। Chickan বলতে চিকনের কাজ! অবাক না হয়ে পারলাম না। বুঝতে যাতে ভুল না হয় তাই বলে গরুর ছবি? জামাকাপড়ের সঙ্গে গরুর কি সম্পর্ক হল আজও মাথায় আসে নি। 

    ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে। মন্দিরে আরতি চলছে। সেখানে গিয়ে বসলাম। পরদিন সকালেই এই আশ্রম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে। আশ্রমের সর্বত্র জুড়ে আছে একশো বছরেরও বেশী সময়ের কত ঘটনা। মন্দিরের সামনে এসে বসলেই যেন দালান, থাম, সিঁড়িগুলো কত কথাই না জানাতে চায়! 

    পাশেই দুর্গামণ্ডপ। দুর্গাপূজা ছাড়াও ঐ মণ্ডপে কালীপূজা, লক্ষ্মী পূজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ১৯১২ সালে শ্রীশ্রীমা কাশীতে আসেন ৫ ই নভেম্বর আর তার তিনদিন পর, ৮ই নভেম্বর ছিল কালী পূজো। শ্রীশ্রীমা এসেই প্রথমটায় এই মণ্ডপের উত্তরে ঠাকুর ঘরের পাশে একটি ঘরে তাঁর সহচরীদের নিয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম, সামান্য জলযোগ এবং সকলের প্রণাম গ্ৰহণ করে সকলকে আশীর্বাদ করে আগে থেকে করা ব্যবস্থা অনুযায়ী আশ্রমের কাছেই 'লক্ষ্মীনিবাস' নামক নতুন বাড়িটিতে চলে যান। শ্রীশ্রীমা কাশীতে এসে পৌঁছনর পরই মহাপুরুষ মহারাজ এই আশ্রমে প্রতিমায় কালী পূজো ও জগদ্ধাত্রী পূজোর ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই বছর কালীপুজোর দিন সকালে শ্রীশ্রীমা পালকি করে সেবাশ্রম ঘুরে দেখেন। সেবাশ্রমের কাজ দেখে শ্রীশ্রীমা বড় খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন – " এখানে ঠাকুর সাক্ষাৎ বিরাজমান রয়েছেন দেখলাম। ... সেবাশ্রমের কাজ ঠাকুরের কাজ।... মা - লক্ষ্মী ও এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। " লক্ষ্মীনিবাসে পৌঁছে জনৈক সন্তানের হাতে একখানি দশ টাকার নোট দান স্বরূপ সেবাশ্রমে পাঠিয়ে দেন। (ঐ নোটখানি এখনও সেবাশ্রমের অফিসে সযত্নে রাখা আছে)। 

    'সেই বছরে শ্রীশ্রীমায়ের উপস্থিতিতে ১৮ই নভেম্বর জগদ্ধাত্রী পূজোর আয়োজন করা হয় এবং জগদ্ধাত্রী পূজো জ্যান্ত জগদ্ধাত্রী পূজো য় পরিণত হয়। পূজোর সময় যখন শ্রীশ্রীমা উপস্থিত হয়ে মণ্ডপে কিছুক্ষণ ছিলেন, তখন সকলেই জগদ্ধাত্রী মায়ের দিব্য আবির্ভাব অনুভব করে ধন্য হয়েছিলেন।' ... কি অপূর্ব সব কথা! ভাবছিলাম অতীতের সেই দিন যদি ফিরে পাওয়া যেত! 

    রাতের খাবার খেয়ে ঘরের জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিলাম। পরদিন সকালে বেরোব আটটা নাগাদ। তবে বেনারস ছাড়া হচ্ছে না। গঙ্গার পাড়ে একটি হোটেলের নদীতীরের একটি ঘর হতে চলেছে আমাদের এক রাতের আশ্রয়।

    . .. ক্রমশঃ
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব ৭
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:edf8:dba7:5c27:***:*** | ০২ অক্টোবর ২০২৩ ২২:৫১524190
  • সুন্দর 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন