এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জীবন তরঙ্গের দোলায়: 

    Amlan Sarkar লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ৩৬৩ বার পঠিত
  • জীবন তরঙ্গের দোলায়:
    অম্লান সরকার

    "কি রে তুই কোন প্রতিক্রিয়া দিলিনা এই ব্যাপারে।"

    "রতিক্রিয়া? নাহ্, ওটা এখন আর হয় না। বয়স হয়ে গেছে। তার ওপর আবার প্রোস্টেট গ্রন্থির সমস্যায় অনেক দিন ধরেই যন্তরটা উত্থান শক্তি রহিত। কাজেই বুঝতেই পারছিস।"

    কথা হচ্ছিলো ষাটোর্ধ্ব দুই পুরনো বন্ধুর মধ্যে। বরুণ ঘোষাল আর বাদল মৈত্র। এক জমানায় দুজনে কলেজে একসঙ্গে পড়াশোনা করার সঙ্গে সঙ্গে হোস্টেলেও একই রুমের সহআবাসিক রূপে থেকেছেন। তারপর কেটে গেছে চার দশকেরও বেশি সময়। বরুণ বাবু বর্তমানে কর্মজীবন থেকে অবসরপ্রাপ্ত। ছেলে মেয়েরা সব নিজের নিজের মত নিজেদের সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। তাই বরুণ বাবুকে এখন আর সাংসারিক ব্যাপার স্যাপারে সে ভাবে মাথা ঘামাতে হয় না। কাজেই বরুণ বাবুর আজকাল অফুরন্ত অবসর। বরুণ বাবু সুযোগ পেলেই সহধর্মিণী কে বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে, আশেপাশে দুপাঁচশো কিলোমিটারের মধ্যে ছোটখাটো বা মাঝারি ঘোরার জায়গা কতই আছে। আর বরুণ বাবু ঘুরতে খুব ভালোবাসেন। তবে হ্যাঁ, সঙ্গে তাঁর সহধর্মিণীটিকে চাই। একা ঘুরতে উনি ভালোবাসেন না।

    এদিকে বাদল বাবু আবার খুব একটা বেরোতে পারেন না। কর্মজীবনের প্রথম দিকে যে ব্যবসাতে হাত দিয়েছিলেন সেটা রমরম করে না হলেও হোঁচট খেয়ে খেয়ে চলছে এখনও। ছেলে পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরিতে সবে যোগ দিয়েছে। বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করার কোন রকম কোন ইচ্ছা তার নেই। এদিকে বাদল বাবু ব্যবসাটা দুম করে বন্ধও করে দিতে পারছেন না। অনেক গুলো যুবক যুবতীর রুজি রোজগারের ব্যবস্থা হচ্ছে তাঁর এই ব্যবসা থেকে। কাজেই মানবিকতার খাতিরে এই বয়সে এসেও তাকে ব্যবসাটা চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

    দুই বন্ধুর মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ কমই হয়। ওই কালেভদ্রে কোন উপলক্ষ্যে। এছাড়া তাদের কলেজের পুরনো সহপাঠীদের একটা WhatsApp গ্রুপ আছে। গোটা ২০ জনের এই গ্রুপের সদস্যরা বছরে একবার সবাই একসঙ্গে মিলিত হয়ে একটা পুনর্মিলন উৎসব মত করে থাকেন প্রতি বছর। সেখানে বছরে একবার দেখা তো হয়েই যায়।

    বাদল বাবু আজকাল কানে কম শুনতে পারছেন। আর সেই জন্যই প্রতিক্রিয়াকে উনি রতিক্রিয়া শুনতে পেরেছেন। আর চোরের নজর বোচকার দিকে থাকার মত এই বয়সে শারীরিক অসমর্থতা থাকা সত্ত্বেও একটু ছুকছুকানি থেকেই যায়। আর তাই এই শ্রবণ জনিত সমস্যার কারণে কান শুনতে ধান শোনার মত ব্যাপার গুলো ঘটে যায়। সাহিত্য সংস্কৃতি প্রিয় বাদল বাবুর দিন গুলো এখনও নিজের ব্যবসা দেখাশোনার কাজেই বেরিয়ে যায়। পূজোর সময় নিজেদের আবাসনের নিজস্ব পূজোতে তিনি চণ্ডীপাঠ করে থাকেন। পূজোর সময় আবাসনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড গুলো দেখাশোনা করা বা নাটক মঞ্চস্থ করার কাজে অভিনয় থেকে আরম্ভ করে পরিচালনার কাজ, সবেতেই বাদল বাবুর উৎসাহ দেখার মত। তবে ইদানিং এই কানে একটু কম শুনতে পাওয়ার সমস্যাটা অনেক রকম জটিলতার সৃষ্টি করে চলেছে তাঁর জীবনে। এই যেমন সেদিন দূর্গা পূজো উপলক্ষে মঞ্চস্থ হতে যাওয়া নাটকের রিহার্সাল চলছিল আবাসনের কমিউনিটি হলে। তা রিহার্সাল উপলক্ষে মোমো আনা হয়েছে সবাই জলখাবার হিসাবে খাবে বলে। রিহার্সাল পরিচালনা করেন বাদল বাবুর থেকে বয়সে বছর ১৫ ছোট এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা। ৪০ এর কোঠায় পদার্পণ করা এই ভদ্রমহিলার চেহারাটা এখনও বেশ আঁটোসাঁটো এবং আকর্ষণীয়। তিনি রিহার্সালে অংশগ্রহণকারী সবাইকে ডেকে বলছিলেন আমার কাছে মোমো রাখা আছে, সবাই এসে খেয়ে যাও। বাদল বাবু কানে কম শুনতে পাওয়ার কারণে শুনতে পেলেন আমার কাছে চুমু রাখা আছে, সবাই এসে খেয়ে যাও। কথাটা শোনার পর বাদল বাবু কেঁপে কুঁপে, লাল হয়ে একেবারে উত্তেজিত হয়ে পরলেন। তবে সমবেত বাকি সবার মধ্যে কোন ভাবান্তর না দেখে এবং শেষ পর্যন্ত সবাইকে হাসিখুশি ভাবে মোমো খেতে দেখে নিজের শোনার ভুল বুঝতে পেরে শান্ত হয়ে মোমো খাওয়ায় মন দিলেন।

    এদিকে বরুণ বাবু নিজের জীবন নিয়ে মানসিক ভাবে বেশ সুখী। বাধাবন্ধন তেমন কিছু নেই। শুধু খাওদাও, ঘোরো আর বগল বাজাও। তবে আজকাল শরীরটা মাঝেমাঝে একটু সমস্যার সৃষ্টি করছে। মাঝখানে গলব্লাডারে পাথর ধরা পরেছিল। অপারেশন করে গলব্লাডারটা কেটে বাদ দিতে হয়েছে। মাসখানেক আগে কলেজের রি ইউনিয়ন উপলক্ষে দুই বন্ধুর দেখা হয়েছিল। সেখানে গ্রুপের আরো বন্ধুবান্ধবরাও উপস্থিত ছিল। অনেক দিন বাদে অনেক গুলো পুরনো মুখ একত্রিত হয়ে বেশ একটু আড্ডা মত হল।

    বরুণ ও বাদল বাবুর সহপাঠীদের মধ্যে অনেক রকম চরিত্রের ভিড়। যৌবনে তাদের মধ্যে কেউ হয়তো ছিল একটু উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রের। আবার কেউ নিজের পড়াশোনা ও ভবিষ্যত্ কর্মজীবন নিয়ে এতটাই সচেতন ছিল যে পড়াশোনার বাইরেও যে একটা জগৎ আছে সেদিকে কখনও তাকিয়ে দেখারও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেনি। এই পার্থ বাবুর কথাই ধরা যাক না কেন। অত্যন্ত সিরিয়াস প্রকৃতির পার্থ বাবু কলেজ জীবনে বাড়ি, কলেজ এবং পড়াশোনার বাইরে আর কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজী ছিল না। পাশ করার পর যথাসময়ে কর্পোরেট জগতে একটা ভাল চাকরি জুটে গেছিলো পার্থ বাবুর। সারা জীবন সেই চাকরির ঘানি টেনে এখন এই প্রৌঢ় বয়সে এসে অবশ্য পার্থ বাবু বন্ধুবান্ধবের প্রয়োজনীয়তা বা উপযোগিতার সুফল সম্বন্ধে বেশ সদর্থক মনোভাবই পোষণ করেন।

    আবার যদি চারুব্রত সান্যালের কথা বলি, তাহলে বলতে হয় কলেজ জীবন থেকে আজ পর্যন্ত চারুবাবুর ঘনিষ্ঠ মহলের বন্ধুবান্ধব সর্বদাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর হবে নাই বা কেন? চারু বাবু একজন অত্যন্ত ভদ্র, অমায়িক এবং পরিশীলিত ব্যক্তি। অজাতশত্রু শব্দটিকেও চারু বাবুর ক্ষেত্রে সঠিক ভাবে প্রয়োগ করা যায়। কলেজের বন্ধুবান্ধবের গ্রুপটিকে চার দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও একসূত্রে গেঁথে রাখার অনেকখানি শ্রেয়ই চারু বাবুর প্রাপ্য।

    সুজয় ঘোষ বাবুর এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে কিছু দিন হলো ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েশন সম্পূর্ণ করে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করার জন্য যোগ দিয়েছে। মেয়েটা সুজয় বাবুর বিয়ের পর একটু দেরি করে সুজয় বাবুর চল্লিশের ওপর বয়স হয়ে যাওয়ার পর জন্মেছে। মেয়েটি এখন দূর্গাপুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে বায়ো টেকনোলজি নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। সুজয় বাবুর মেয়ের নাম শম্পা, শম্পা ঘোষ। বর্তমান প্রজন্মের মেয়ে শম্পা ছেলেমেয়ের মেলামেশার ব্যাপারে এখনকার প্রজন্মের রীতিনীতিতে ঘোরতর বিশ্বাসী এবং আজকের জমানার লিভ টুগেদারের একজন সরব সমর্থক। আজকালকার ছেলেমেয়েদের খোলাখুলি মেলামেশা বা সেক্সের ব্যাপারে কোন রকম বাধানিষেধ মেনে না চলার পক্ষপাতী সুজয় ঘোষের আদরের দুলালী এই শম্পা।

    সুজয় বাবুর ছোটবেলাটা কেটেছে খুব সাধারণ ভাবে। বাবার হোমিওপ্যাথিক ডিসপেনসারি ও সামান্য কিছু জমিজমা থেকে যেটুকু আয় হতো ৫ জনের একটি সংসার চালানোর জন্য তা নিতান্তই অপ্রতুল ছিল। দুই বড় দিদির পর বাড়ির একমাত্র পুত্র সন্তান সুজয় বাবুকে ওনার বাবা মা অনেকটাই শিবরাত্রির সলতের মত আগলে রাখতেন। কাজেই ছোট বেলাটা সুজয় বাবু সে ভাবে হাত পা মেলে চলাফেরা করতে পারেন নি। তবে বয়সটা ১৫-১৬র কোঠায় পৌঁছানোর পর ধীরে ধীরে ওনার একটু পাখনা গজানো শুরু হয় পরবর্তীতে যা বেড়েই যেতে থাকে।

    প্রথম যৌবনের দিনগুলোতে সুজয় বাবুকে লড়াই করতে হয়েছে অনেক। কিভাবে কোন ব্যবসাটা করলে দুটো পয়সা হাতে আসবে তার ফন্দি ফিকির গুলো তিনি ভালো ভাবেই রপ্ত করে নিয়েছিলেন। আর ছোট বেলাটা যেমনই বাবা মার কড়া প্রহরার মাঝে কাটাতে হয়েছে ওনাকে, একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং হাতে দুটো পয়সা আসা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনটাকে সব রকম ভাবে উপভোগ করার ব্যাপারে আর কোন কার্পণ্য করেন নি উনি।

    জীবনের শুরুতে চরম দারিদ্র্য সুজয় বাবুকে যেমন দূরদর্শী ও হিসাবি করে গড়ে তুলেছিল তেমনি একটাই জীবন আর সেই জীবনটাকে পূর্ণ মাত্রায় উপভোগ করে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ, এই জীবন দর্শনে বিশ্বাসী সুজয় নিজের জীবনটাকে সম্পূর্ণ ভাবে উপভোগ করে যাওয়ার ব্যাপারে কোন সময়েই পেছপা হয়নি। আর ঠিক সেই জন্যই ওনার আদরের দুলালী, নৃত্য পটিয়সী তথা বিদুষী তার আত্মজা যখন তাকে বর্তমান প্রজন্মের আদব কায়দা, ছেলেমেয়েদের খোলামেলা মেলামেশার ব্যাপারে তাকে মাঝেমাঝে জ্ঞান দেয়, তখন তিনি মনে মনে মিটিমিটি হাসেন।

    সুজয় বাবু তার বিগত দিন গুলোর কথা স্মরণ করলে দেখতে পান স্কুল পর্যায়ে একটু উঁচু ক্লাস অর্থাৎ কি না এগারো বারো ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই কিভাবে উনি রাজনীতির দিকে ধীরে ধীরে আকর্ষিত হয়ে পড়েন। ওনার এগারো বারো ক্লাসে পড়ার সময়েই বাংলার ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে। পতন হয় সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের ৬ বছর ধরে চলা কংগ্রেস মন্ত্রিসভার। প্রথম বারের মত নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে অনেক গুলো বামপন্থী দলের একটি জোট। বাংলার এই অভূতপূর্ব পটপরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে সুজয় বাবুও আকর্ষিত হয়ে পড়েন তথাকথিত মার্ক্সবাদী এই লাল পার্টির প্রতি। ততদিনে সুজয় বাবু নিজের এক সময়কার নিরীহ, গোবেচারা খোলস ছুড়ে ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছেন। জন্ম নিয়েছে এক বলিয়ে কইয়ে, বাগ্মী ব্যক্তিত্বের। কাজেই একবার রাজনীতির মঞ্চে প্রবেশের পর নিজের সক্রিয় ভূমিকা খুব অল্প দিনের মধ্যেই সুজয় বাবুকে পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তুলছিল। তবে ঠিক এই সময়েই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন এক মন্ত্রকে সরকারি চাকরি পেয়ে যাওয়াতে ওনাকে নিজের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা জলাঞ্জলি দিয়ে ভারত সরকারের একজন অরাজনৈতিক কর্মচারী রূপে নিজের ভোল বদল করে আইন কানুন মেনে চলা এক সাধারণ, স্বাভাবিক নাগরিকে পরিবর্তিত হয়ে যেতে হয়েছিল।

    আজ চাকরি জীবন শেষ করে তিনি একজন অবসর প্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ নাগরিক। চিরটাকাল মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশা করে মানব চরিত্র সম্পর্কেও তাঁর জ্ঞানের গভীরতা কিছু কম নয়। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে বেশির ভাগ পুরুষ মানুষই কিছুটা হলেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। মুখে পুরুষেরা কতই না নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতার কথা বলুক না কেন, অন্তরের গভীরে বেশির ভাগ পুরুষই নারী জাতির ওপর পুরুষের সনাতন, চিরন্তন অধিকার আছে বলেই বিশ্বাস করে থাকে এবং নিজেদেরকে নারী জাতির থেকে উৎকর্ষের দিক দিয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে বলেই মনে করে থাকে। সুজয় বাবুও এই মানসিকতার বাইরে না। তবে সংসার ধর্ম সুচারু রূপে পালন করার কায়দাটা উনি ভাল করেই বোঝেন। আর তাই নিজের সংসারেও তিনিই অবিসংবাদিত নেতা। আর পাঁচটা সংসারের মত তাঁর কথা, তার সিদ্ধান্ত মতোই সংসারের সমস্ত কিছু সংঘটিত হয়।

    সংস্কৃতিমনস্ক সুজয় বাবু নিজেকে বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মের মধ্যে জড়িয়ে রাখতে পছন্দ করেন। মেয়েকে যেমনি ছোটবেলা থেকেই নাচ শিখিয়ে একজন কুশলী নৃত্য শিল্পী করে গড়ে তুলেছেন, নিজেও তেমনি নাটকে অভিনয় করা থেকে আরম্ভ করে সমস্ত রকম সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে নিজেকে সক্রিয় রেখে নিজের শখ চরিতার্থ করে থাকেন। আজ তাই জীবনের দুই তৃতীয়াংশ অতিক্রম করে সুজয় বাবু যখনই নিজের জীবনের হিসাব নিকাশ করতে বসেন তখনই আবিষ্কার করেন জীবনে পাওয়ার ঘর তার সর্বদাই ভরাই থেকেছে। মানুষ কথায় বলে জীবন যেমনি দুহাত ভরে নেয়, তেমনি দুহাত ভরে দেয়ও। সুজয় বাবুর জীবনে এর থেকে বড় সত্য আর কিছু নেই। কিন্তু জীবনতো থেমে থাকে না। অব্যাহত গতিতে জীবন চলতেই থাকে পথের বাধা বিঘ্ন সব অতিক্রম করে। কাজেই মানুষ যখনই চিন্তা করে আমার এই জীবন থেকে সব কিছু পাওয়া হয়ে গেছে, আর কিছুই অবশিষ্ট নেই পাওয়ার মত, ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত বিপর্যয় নেমে আসে মানুষের জীবনে। সুজয় বাবুর জীবনেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

    সুজয় বাবুর জীবনে প্রথম ছন্দপতন ঘটলো যখন তিনি জানতে পারলেন তার পড়াশোনায় ভাল, মেধাবী পুত্র সন্তান কিছু নক্সাল বা মাওবাদী গ্রুপের সঙ্গে সংস্পর্শে এসে ওদের প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়েছে। BHU হোস্টেলে ছেলের নিজস্ব রুম এই ধরনের কিছু রাজনৈতিক আদর্শবাদে বিশ্বাসী ছেলেদের মেলামেশা, দেখাসাক্ষাৎ করার আখড়া হয়ে উঠেছে। নিরুপায় সুজয় বাবু খবর পেয়ে প্রথমে ছেলের সঙ্গে দেখা করে তাকে বিভিন্ন পরিচিত তথা অপরিচিত ব্যক্তির জীবনের উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে এই ধরনের মেকি আদর্শবাদের বশবর্তী হয়ে নিজের ভবিষ্যত জীবনকে বিড়ম্বিত করে তোলা একটা চূড়ান্ত বোকামির কাজ হবে। আর এতে করে ছেলের নিজের পড়াশোনা তথা ভবিষ্যত্ কর্মজীবনের সম্ভাবনার বারোটা বাজবে। প্রথম যৌবনের আবেগ জর্জরিত ছেলের পক্ষে বাবার কথা মেনে নেওয়াটা একটা বেশ কঠিন সমস্যাই ছিল। কিন্তু সুজয় বাবু তার নিজের সারা জীবনের অভিজ্ঞতা লব্ধ অনুভব দিয়ে ব্যাপারটার অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে ছেলের মাথায় এই মাওবাদী গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অসারতা অনেকাংশেই ঢোকাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং ছেলেকে বিপথে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে সুজয় বাবুর নিজের জীবনের উপলব্ধি গুলো খুবই কাজে এসে গিয়েছিলো।

    ছেলের ব্যাপারটা সামলাতে না সামলাতে ঘোষ পরিবার আর এক সংকটের মুখোমুখি হয়ে পড়লো। সুজয় বাবুর আদরের কন্যা সন্তান শম্পা আবদার করে বসলো যে সে তার বর্তমান ছেলে বন্ধু, যে কিনা ওই একই কলেজে অন্য একটি বিভাগে পড়াশোনা করে, তার সঙ্গে একসঙ্গে থাকবে। ছেলেটি শম্পার থেকে দুবছরের সিনিয়র। ঘটনার আকস্মিকতা ও পরিণাম সুজয় বাবু ও তার স্ত্রীর মাথায় একেবারে বজ্রাঘাতের মত আঘাত হানলো। তারা দুজনেই অল্প সময়ের জন্য হলেও একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। তবে সুজয় বাবু, তার স্ত্রী ও তাঁদের মেয়ে শম্পার ভাগ্য ভাল বলতে হবে এই কারণে যে ঠিক এই সময়েই খবরের কাগজ তথা টেলিভিশনের সংবাদ মাধ্যম গুলোতে পরপর লিভ টুগেদার সম্পর্ক যুক্ত বেশ কিছু জুটির মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়ায় পুরুষ বন্ধু তার মহিলা বন্ধুকে নিষ্ঠুর ভাবে খুন তথা খুন পরবর্তী তথ্য গোপন ও মৃতদেহ লোপাট করার চেষ্টার মত ঘটনা জনমানসে রীতিমত বহুল প্রচারিত হয়ে পড়লো। ডুবন্ত মানুষ যেমন সামনে খড়কুটো যাই পায় তাকেই অবলম্বন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে, ঠিক তেমনি ভাবে সুজয় বাবু ও তার স্ত্রী বহুল প্রচারিত এই খুনের ঘটনা গুলোকে বিয়ে না করে ছেলে ও মেয়ের একসঙ্গে থাকার একটা ভয়ংকর কুফল বলে শম্পাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। ঘটনার ভয়াবহতায় শম্পাকেও পুনরায় একবার আরো নিজের ওই পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করলো এবং ঘটনা পরম্পরা পর্যালোচনা করে পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত রদ করলো।

    গত প্রায় মাস ছয়েকের মধ্যেই সুজয় বাবুকে পরপর দুটো বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলাতে হয়েছে। সৌভাগ্যের বিষয় যে সব ভালোয় ভালোয় মিটে গেছে। অনেক দিন পর একটু নিশ্চিন্ত মনে রবিবারের বাজার করতে বেড়িয়েছেন সুজয় বাবু। সামনেই দূর্গাপুজো। ছেলে মেয়ে দুজনেই বাড়ি আসছে। ছেলেটা মাংস খেতে ভালোবাসে আর মেয়ে ইলিশ মাছ। দুজনকেই প্রাণ ভরে মাংস আর ইলিশ মাছ খাইয়ে দিতে হবে। বাজার করার ভার তো সুজয় বাবুর ওপরই ন্যস্ত। তারপর একবার বাজার হয়ে গেলে কাঁচা জিনিষ গুলো একবার হেঁসেলে চালান করে দিতে পারলে তিনি নিশ্চিন্ত। বাকি কাজটা তার রন্ধনে দ্রৌপদী সহধর্মিণীই সামলে দেবে। ছেলে মেয়েকে পছন্দ মত খাবার পেট পুরে খাইয়ে বিকেলে আবার সবাই মিলে পূজো দেখতে বেরোনো আছে। বছরকার দিন বলে কথা। পূজো শেষ হলে ছেলে মেয়ে আবার চলে যাবে নিজের নিজের কলেজ যেখানে সেখানে। তাই পূজোর এই চারটে দিন সুজয় বাবু চুটিয়ে উপভোগ করে নিতে চান ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীর সঙ্গে। তারপর ছেলে মেয়ে চলে গেলে জীবন চলবে সেই বরাবরের মত গতানুগতিক রাস্তা ধরেই। আর জীবনতো এরকমই। সুখ দুঃখ আবর্তিত হতে থাকবে কালের নিয়মে। সুজয় বাবুও কালচক্রের সেই অমোঘ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দিন কাটিয়ে যাবেন যেভাবে তিনি জীবন কাটাতে অভ্যস্ত এতকাল ঠিক সেইভাবে। আর সেই কাল চক্রের আবর্তনের এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে থাকবে বরুণ, বাদল, পার্থ, চারুব্রত, সুজয় বা বাপী মিত্রের মত তাদের কলেজের সহপাঠীদের গ্রুপটা। এই গ্রুপের সদস্যরা এমন একটা বন্ধুত্বের গভীর সম্পর্কে পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে নিয়ে চলেছে চার দশক অতিক্রম করে যার গভীরতা যেন আরো বেড়েই চলেছে চিরন্তন, অলঙ্ঘনীয়, অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্কের পথে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন