পাষাণের ভাঙালে ঘুম
কে তুমি সোনার ছোঁওয়ায়...
এমন হৃদয় মুচরানো গজল যিনি বাংলা সঙ্গীত জগতকে উপহার দিয়েছেন, ভাবতে অবাক লাগে জীবনের অন্তিম ৩৪টা বছর তিনি নিজেই পাষাণ হয়ে কাটিয়েছেন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে আসানসোলের কাছে চুরুলিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম; ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ। বুঝতে অসুবিধা হয় না তিনি কাজী নজরুল ইসলাম।
আমার আপনার চেয়ে
আপন যে জন....
কাজী সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় আকাশবাণী কলকাতাকেন্দ্রের সৌজন্যে। নব্বইয়ের দশকে আমরা যারা শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছি তাদের একান্ত বন্ধু ছিল কলকাতা বেতারকেন্দ্র। সকাল শুরু হতো প্রাত্যহিকী দিয়ে। নাটক ও অনুরোধের আসর ছিল আমার দিনযাপনের অন্যতম আকর্ষণ। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ফিরোজা বেগম, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষাল এমন কত প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর কন্ঠে তাঁর গান আমাকে একটু একটু করে গ্রাস করেছিল শৈশবেই।
ভোর হলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠো রে...
ছাত্রীবেলায় নজরুল ইসলামের কবিতা পড়েছি স্কুলপাঠ্য বইতে। উঁচু ক্লাসে উঠে বুদ্ধদেব বসুর 'রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক' প্রবন্ধ পড়েছি। জেনেছি তাঁর ধুমকেতু পত্রিকা সম্পাদনার কথা। 'আনন্দময়ীর আগমনে' লিখে রাজরোষে পড়ার কথা। উপলব্ধি করেছি তাঁর সাহিত্যের গণজাগরণী ক্ষমতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যবাদী দর্শনকে। রবীন্দ্রযুগে দাঁড়িয়ে তাঁর আদ্যন্ত মৌলিকতাকে। তবুও গীতিকার ও সুরকার নজরুলেরই গুনমুগ্ধ এ কানিজ।
অরুনোকান্তি কে গো যোগী ভিখারী..
বাংলা গানে গজলের ভগীরথ তিনি। 'আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন', 'গুলবাগিচার বুলবুলি আমি', 'পথ চলিতে যদি চকিতে', যিনি শুনেছেন তিনিই এর মর্ম জানেন। রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্যৈর পরেই কাজী সাহেবের শ্যামা সংগীতের কথা মনে পড়ে। 'শ্যামা নামের লাগলো আগুন /আমার দেহ ধূপকাঠিতে'। এই গান যাঁর কলম থেকে বেরিয়েছে তিনিই লিখেছেন 'মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই'। ঈশ্বরদৃষ্টি কতখানি স্বচ্ছ হলে এমন নিরপেক্ষ সমর্পণের গান লেখা যায়।
এই রাঙ্গামাটির পথে লো
মাদল বাজে
বাজে বাঁশের বাঁশি...
কাজী নজরুল ইসলামের গান রচনা এবং সুরবোধের কান তৈরি একেবারে শৈশবে, লেটোর দলে। কাকা বজলে করিম ছিলেন চুরুলিয়া অঞ্চলে লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ। আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষাতেও ছিলেন চোস্ত। শৈশবে নজরুল এই লেটোর দলে গায়ক এর কাজ করতেন। দলের প্রয়োজনে মুখে মুখে গান রচনা করে সুরারোপে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এই পর্বেই তাঁর নাটক, লোকগান, কবিতা এবং হিন্দুপুরাণের প্রাথমিক শিক্ষা। ১৯১৪-১৭ খ্রিস্টাব্দে রানীগঞ্জের সিয়ারসোল স্কুলে থাকাকালে তিনি উচ্চাঙ্গসংগীতের শিক্ষা নেন সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলালের এর কাছে। ফারসি সাহিত্যের জ্ঞান অর্জন করেন হাফিজ নুরুন্নবীর কাছে। সৈনিক হিসাবে করাচির ৪৯ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের থাকাকালে পাঞ্জাবি মৌলভীর কাছে ভাষা শিক্ষা করতেন এবং সহ সৈনিকদের সঙ্গে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান-বাজনা চর্চা করতেন।
ভরিয়া পরান শুনিতেছি গান...
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার অধিকৃত গ্রামোফোন কোম্পানি কাজী সাহেবের সাংগীতিক প্রতিভায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে বিশেষ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে গীত রচয়িতা, সুরকার ও প্রশিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করেন। তিন হাজারের ওপর গান রচনা করেছেন তিনি। টপ্পা, ঠুমরি, ধ্রুপদ, কীর্তন, বাউল, ঝুমুর, ভাটিয়ালি, হাসির গান, মার্চ সং সর্বত্র তাঁর অবাধ গতি। 'সন্ধ্যা', 'গীতিশতদল', 'বুলবুল', 'চোখের চাতক', 'রাঙা জবা', 'সুর মুকুর' তাঁর কিছু সঙ্গীত সংকলন গ্রন্থ। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে নজরুল মঞ্চ ও চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। কলকাতা বেতারকেন্দ্রও সংগীত শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন।
মোর না মিটিতে আশা
ভাঙিল খেলা...
শোনা যায় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই আগস্ট রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিবসে কলকাতা রেডিওতে 'রবিহারা' কবিতাটি পাঠ করার সময়ই কবির কণ্ঠস্বর জড়িয়ে যায়। Biography of kazi Nazrul Islam : A documentary of Government of India -র তথ্য থেকে জানা যায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বেতারের এক অনুষ্ঠানের মাঝখানেই কবি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। ধীরে ধীরে নিজের উপরে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারান। শত চিকিৎসাতেও যে অবস্থার উন্নতি হয়নি। এভাবেই মাত্র ৪৩ বছরে স্তব্ধ হয়ে যান এই সৃষ্টিশীল কর্মচঞ্চল মানুষটি।
জানি জানি প্রিয় এই জীবনে
মিটিবে না সাধ....
ভাগ্যবিড়ম্বনা যেন দুখুমিঞার জীবনের নিত্য সঙ্গী ছিল। মেধাবী হওয়া সত্বেও শৈশবে অর্থাভাবে পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। প্রথম স্ত্রী নার্গিসকে বিশেষ পরিস্থিতিতে বাসর সম্পন্ন হওয়ার আগেই ছেড়ে আসতে বাধ্য হন। অকালে হারান শিশুপুত্র বুলবুলকে। এই যন্ত্রণাগুলিই হয়তো কবিকে দিয়ে সৃষ্টি করিয়ে নিয়েছে 'বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে' কিংবা 'শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়' মত কিছু কালজয়ী গান। শেষ বয়সে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণে সম্মানিত করেছে। বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে একুশে পদক ও জাতীয় কবির মর্যাদা। কিন্তু এই সবই তখন তাঁর অনুভূতি রাজ্যের বাইরের ঘটনা।
পরজনমে দেখা হবে প্রিয়
ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও...
জানিনা পরজনম বলে কিছু আছে কিনা; যদি থেকে থাকে তবে সেই জীবনেও বুঝিবা তিনি এমনই শত-সহস্র সুর সৃষ্টি করে চলেছেন। আমরা মাটির পৃথিবী হয়তো তার নাগাল পাবনা। তবে তাঁর রেখে যাওয়া সম্ভারই বা কম কী!!
৭ই অক্টোবর, ২০২২
ভালবাসি বাংলা নামক
নিউজ জার্নালে প্রকাশিত।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।