আমি যখন এই লেখাটা শেষ করেছি, খবর পেলাম, সমরেশ মজুমদার আর আমাদের মধ্যে নেই। তার চলে যাওয়া যতটা না ক্ষতি, তার থেকেও বেশি ক্ষতি সাহিত্যের আঙ্গিনায় এক শূন্যতার সৃষ্টি হওয়া। অনিমেষ-মাধবীলতার লেখা যায় না। একমাত্র সরস্বতীর বরপুত্রই এমন নির্মাণ করতে সক্ষম। তিনি ছিলেন সেই বরপুত্র।
‘অনিমেষ-মাধবীলতা’ সিরিজ নিয়ে অনেকেই কথা বলবেন। কারণ, তা কালবিজয়ী। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলব ‘গর্ভধারিণী’-র কথা। তার লেখা এই একটা মাত্র বই আমি আমার নিজস্ব সংগ্রহে রেখেছি। শুধু তাই নয়, আমার কিশোরী বেলার যেকটা সযত্নে রাখা বইয়ে ন্যুনতম ধুলো পড়লেও আঁচল কিম্বা ওড়না দিয়ে পরম যত্নে মুছে তার দিকে তাকিয়ে থাকি, তারই একটা বই এটা। গডব্রাদারের হাত থেকে এই বই আমার হাতে এসেছে। আজও সযত্নে রক্ষিত।
কিশোরী থেকে যুবতী হবার পথে বেশ কিছু বই আমায় সঙ্গ দিয়েছে। বয়ঃসন্ধিক্ষণ এসে বাইরের জগৎটার সম্পর্কে যে রূপকথামাত্রিক চেতনা আচ্ছাদিত করে রেখেছিল, সেখান থেকে বাস্তবের কঠোর রাস্তার ইঙ্গিত দিয়েছিল কিছু বই, তার মধ্যে এই বই অন্যতম। এই উপন্যাসটা আমি বহুবার পড়েছি, এবং পড়তে পড়তে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, জয়ীতা হতে গেলে কেবলমাত্র বুকের পাটা থাকলেই চলবে না, চোখের দৃষ্টিশক্তিকেও অতিচেতন হতে হবে। যে চোখ চিনে নেবে আনন্দ, সুদীপ আর কল্যাণের প্রাণশক্তিকে।
ধন্যবাদ সমরেশ মজুমদার, আমায় কিশোরী থেকে যুবতীতে পরিণত করার জন্য। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন...
২
---
রবীন্দ্রনাথ এক অদ্ভুত জীবন যাপন করেছিলেন তার সমগ্র আশি বছরের সময়কাল জুড়ে। সবকিছুর মধ্যেই সুন্দরকে দেখতে চেয়েছেন, পেরেওছেন, এমনকি অসুন্দরের মধ্যেও। বীভৎসতাকে অস্বীকার করেন নি, তাকে অসম্পূর্ণ মনে করেছেন। মনে করেছেন, সত্যলাভ তখনই করা যায় যখন আমাদের হৃদয় অসুন্দরের মধ্যেও সুন্দরকে আবিস্কার করতে পারে। “Truth is everywhere, therefore everything is the object of our knowledge. Beauty is omnipresent; therefore everything is capable of giving us joy.” --- সত্য সর্বত্র রয়েছে, সেইজন্য সবকিছুই আমাদের জ্ঞানের বিষয়। সুন্দর সর্বব্যাপী, তাই সবই আমাদের আনন্দ দিতে পারে।
১৯১২ সালে আর্বানাতে থাকাকালীন ‘Sadhana’–র প্রবন্ধগুলির সৃষ্টি। মনে রাখা দরকার, তখনও তার নোবেল পেতে এক বছর দেরী আছে। তিনি ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণ করছেন, যাকে বলে ‘ব্যক্তিগত ভ্রমণ’। কিন্তু ততদিনে তার পরিচয় খানিকটা জেনে গেছেন দুই মহাদেশই। তার পেছনের এক বড়ো কারণ, স্বামী বিবেকানন্দ। “১৮৯৩ সালে শিকাগোর Parliament of Religion-এ প্রদত্ত স্বামী বিবেকানন্দের যুগান্তকারী ভাষণ এবং তার পরবর্তীকালে আমেরিকার নানা জায়গায় দেওয়া তাঁর বক্তৃতা ও আলোচনাসভা ভারতীয় দর্শনের প্রতি আমেরিকাবাসীর আগ্রহ বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল।” লিখছেন শ্রীমতী নীলা দাস, সাধনা-র অনুবাদিকা। আর সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক পরিচয় ছিল অতীন্দ্রিয়বাদী কবিরূপে। তাকে আমন্ত্রণও জানানো হচ্ছিল মূলত “ভারতীয় দর্শন বিশেষতঃ উপনিষদের উপর বক্তৃতা করার জন্য।” অর্থাৎ, তাদের চোখে তিনি হলেন – Philosopher-Poet।
সেটা যে খুব অত্যুক্তি, তা নয়। ‘শান্তিনিকেতন’ প্রবন্ধগুচ্ছ, ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থ, কিম্বা ‘গোরা’ উপন্যাস --- তিন-তিনটে অত্যুজ্বল উদাহরণ। অতঃপর, সাধনার আটটি অতি সাংঘাতিক প্রবন্ধ। তাও ইংরাজীতে। বারংবার, বিভিন্ন জায়গায় তিনি এই বক্তৃতাগুলি পাঠও করেছিলেন সে যাত্রায়। অধ্যাপক সেমুরের বাড়ির আলোচনাসভা থেকে শুরু করে আমেরিকার নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিদ্বজ্জনসভায়।
আটটি প্রবন্ধ গুচ্ছাকারে পরবর্তীকালে ‘সাধনা’ নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। আমার বিস্ময়কর লেগেছে এই প্রবন্ধগুলো পড়ে। মনে রাখা দরকার, যারা রবীন্দ্রনাথ আদ্যোপান্ত পড়েছেন, তাদের কাছে সাধনার এই প্রবন্ধগুলোকে খুব একটা নতুন ঠেকবে না। এই প্রবন্ধের যে ‘এসেন্স’, সেটা যে কেবল একটা একাডেমিক লেখার কারণে, তা নয়, তিনি নিজেও এই প্রবন্ধগুলোর অন্তর্নিহিত সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ এবং তাকেই প্রকাশ করে এসেছেন নানারূপে, নানাভাবে। গল্পে, গানে, প্রবন্ধে, নাটকে, উপন্যাসে, এমনকি চিত্রকলাতেও। আমি এই প্রবন্ধগুচ্ছকে দেখছি তার সেই সমগ্র জীবনের প্রত্যেকটি কথায়, লেখায় ও কাজের মধ্যে দিয়ে সনাতন ভারতীয় দর্শনের যে রূপধারাকে তিনি ধারণ করেছিলেন নিজের বোধে, উপলব্ধিতে, আনন্দ-বেদনায়, তারই সারাংশরূপে। আর যদি এক লাইনে তা প্রকাশ করতে হয়?
রবীন্দ্রনাথের প্রভু সুন্দরস্বরূপ, মঙ্গলময়, আনন্দস্বরূপ।
আসলে সমস্ত বিশ্বভুবনজুড়ে তিনি সুন্দরকেই দেখতে চেয়েছেন। তার স্বামী অসীম ও সুন্দর। আর এই সুন্দরের রূপ তিনি পেয়েছেন মূলত উপনিষদ থেকে। তিনি তার প্রথম বক্তৃতায় বলছেন, “Hence the spirit of the teachings of Upanishad is: In order to find him you must embrace all” – তার সাক্ষাৎ পেতে হলে তোমায় সকলকে সাগ্রহে গ্রহণ করতে হবে। “The Supreme being is all-pervading, therefore he is the innate good in all.”
‘The Problem Of Evil’ প্রবন্ধে বলছেন, “A poet is a true poet when he can make his personal ideas joyful to all men, which he could not do if he had not a medium common to all his audience.” – কবিকে সকল শ্রোতার বোধগম্য এক সাধারণ মাধ্যমকে আবিস্কার করতে হবে। আর সেই আবিস্কার কিভাবে সম্ভব? প্রেমে। যে প্রেমিক, সে-ই কবি। ‘কবি’ শব্দটিকে যদি আমরা বৃহৎ অর্থে ধরি তো। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেককেই সেই কবি হতে হবে। এতএব সর্বাগ্রে আমাদের প্রেমিক হতে হবে। মানুষের লক্ষ্যই তাই – “The human soul is on its journey from the law of love, from discipline to liberation, from the moral plane to the spiritual”। মানুষের যাত্রা চলেছে নিয়ম থেকে প্রেমে – ‘Realisation Of Love’ প্রবন্ধে বলছেন। প্রবন্ধের একদম শেষ লাইনে এসে বলছেন, “আনন্দ হল ঐক্যের সত্য উপলব্ধি, জগতের সঙ্গে আমাদের আত্মার ঐক্য উপলব্ধি ও পরম প্রেমিকের সঙ্গে বিশ্বাত্মার ঐক্য উপলব্ধি।”
সাধনার প্রবন্ধগুলোকে একত্রিত করে দেখলে আমার অবাক লাগে। জীবনের স্তরে স্তরে প্রবহমান সুন্দরকে তিনি এক এবং অসীমরূপে অনুভব করতে চাইছেন। সেকথা বোঝাতেও চাইছেন। আর তৎকালীন সমগ্র শিক্ষিত বিশ্ব তা বুঝতে চাইছে, অনুভব করতে চাইছে, বোধে বোধ করতে চাইছে। আশ্চর্যবৎ তা শুনছে। বারবার শুনছে...
আমি এই প্রবন্ধগুচ্ছ সম্পর্কে আরোও অনেক অনেক কিছু লিখতে চাইছি, কিন্তু অপারগ। কারণ আমার বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান এর তল পাচ্ছে না। মাত্র দুইবার পড়ে এই অপরোক্ষনুভূতিকে সম্যক উপলব্ধি করতে পারে, আমি সে নই। আমি বিস্ময় নিয়ে পড়ছি, আবার পড়ব, বারবার পড়ব, হয়তো ‘সাধনা’ নিয়ে আবার আমাকে ফিরে আসতে হবে।
এই বইয়ের অনুবাদ হল এত বছর পরে! এতেই বোঝা যায় আমরা বাঙালীরা কতটা উদাসীন। নীলা দাসের অনুবাদ যে সার্থক অনুবাদ তা বলা যাবে না। কারণ, এই প্রথম আমি বুঝতে পারছি অনুবাদের সীমাবদ্ধতা। রবীন্দ্রনাথের লেখার একটা ছন্দ আছে, মাধুর্যের ধারা আছে, যা তার ‘সিগনেচার’, যেটা মূল ইংরাজী প্রবন্ধে স্বাভাবিকভাবেই আছে। কিন্তু বাংলা অনুবাদে তা পদে পদে ঠোক্কর খেয়েছে, এবং অধিকাংশ জায়গায় নীলা দাসের ছন্দ এসে পড়েছে। তার মানে কি বাজে অনুবাদ? মোটেই না। রাবিন্দ্রীক চেতনাকে কি সম্যক ধরা যায়? না সম্ভব? তবু এমন অসম্ভব কাজে তিনি হাত দিয়েছেন এবং কাজটি সম্পূর্ণ করেছেন, কোন প্রশংসাই এর জন্যে যথেষ্ট নয়। আমার মতো যারা ইংরাজী ভাষাকে ভয় পায়, তাদের জন্যে এই বই অমোঘ। প্রতিটা বাক্যকে যত্ন করে অনুবাদ করা হয়েছে, শুধু তাই নয়, বইয়ের শুরুতে ‘অনুবাদকের নিবেদন’ এক অতি প্রয়োজনীয় প্রবন্ধ। যেটা পড়ার পরেই, আমার মনে হয়, ‘সাধনা’-র মূল প্রবন্ধে প্রবেশ করা উচিৎ।
=======================================
sadhana
Rabindranath Tagore
Alpha Edition
Price: 125/-
সাধনাঃ জীবনের উপলব্ধি
অনুবাদিকাঃ নীলা দাস
সিগনেট প্রেস
মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৫০ টাকা