এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শিলাইদহের বাউল ত্রয়ী, লালন-গগন-রবীন্দ্রনাথ

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৫ নভেম্বর ২০২২ | ৫৫৪ বার পঠিত
  • বাংলার মাটি, বাংলার নদী, বাংলার শস্য শ্যামলা বসুন্ধরা, সবুজ ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে চলা মানুষটির কানে যে সুরের অনুরণন সৃষ্টি করে তা বাউল কিংবা ভাটিয়ালি। ভাটির টানে নৌকার অনায়াস ভেসে চলার কারণে উদ্ভূত অবসরে নৌকার মাঝি-মল্লারদের যে সুরচর্চা বা উদাত্ত গলার যে গান, তাই ভাটিয়ালি। অন্যদিকে বাউল গান মুলতঃ সাধন-সঙ্গীত হলেও তা ভাটিয়ালির মতোই লোকসঙ্গীতের ধারাগুলোর একটি। বাউল ও ভাটিয়ালি দুটো ধারাতেই সাধারণ লোকের সুখ-দুঃখের কথা, সাধারণ মানুষের জীবনের কথা, প্রকৃতির কথা, ঈশ্বর সাধনার কথা ইত্যাদি ইত্যাদি বলা হয় আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় এবং প্রকৃতি থেকে উদ্ভাসিত সুরে। লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন ধারাগুলোর মধ্যে অবশ্যই গঠনগত, উদ্দেশ্যগত, তত্ত্বগত এবং অন্যান্য অনেকভাবেই পার্থক্য আছে। সেইকারণেই তাদের কথা, সুর, নাম, গায়কী আলাদা আলাদা। কিন্তু প্রত্যেক ধারার সঙ্গীতের সাথেই জুড়ে আছে মাটির গন্ধ, প্রকৃতির গন্ধ, সীমাহীন জলরাশির উথাল-পাথালের শব্দ, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের মোহময় মিষ্টি সুর। লোকসঙ্গীত এবং তার বিভিন্ন ধারাগুলো বাংলাতেই সৃষ্টি হয়েছে বলা হলেও এই ধারাগুলোর সাথে জুড়ে আছে পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমানের বাংলাদেশ নামক দেশটি। পশ্চিমবঙ্গের অবদান বাংলা লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের থেকে অনেকটাই কম। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রতি জেলাতেই লোকসঙ্গীতের কিছু কিছু ধারা বিদ্যমান হলেও সর্বাধিক জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতগুলো (বাউল, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি ইত্যাদি) পূর্ববঙ্গেই সৃষ্ট এবং এই বঙ্গেও সমান প্রচলিত ও জনপ্রিয়।

    এই বঙ্গের সর্বাধিক জনপ্রিয় ও সফল বাউল যিনি, সেই রবি-বাউল অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (যদিও দেশ, কালের সীমানায় তাঁকে বেঁধে রাখা যায়না) তাঁর জীবনে বহুবার গিয়েছিলেন অধুনা বাংলাদেশের শিলাইদহে (কুষ্টিয়া জেলা)। ঠাকুর পরিবারের মস্তবড় জমিদারি ছিল এই শিলাইদহে। পিতা ও দাদাদের হাত ঘুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে জমিদারির ভার এসে পড়লে তিনি বহুবার গিয়েছেন এবং বসবাস করছেন সেখানে। তাঁদের জমিদারির অংশেই বসবাস করতেন বাউল-সম্রাট লালন ফকির। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলারই ছেঁউরিয়া গ্রামে ছিল লালন ফকিরের আখড়া অর্থাৎ তিনি সেখানেই বসবাস করতেন। লালন ফকিরের সাথে রবি ঠাকুরের সাক্ষাৎ হয়েছিল এইরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না (মতান্তর এবং অনেক ধোঁয়াশা আছে অবশ্য এইব্যাপারে), কিন্তু তিনি লালনের গান বা বাউল সঙ্গীতের পরিচয় ও প্রেমে পড়েছিলেন শিলাইদহের বাউল-সম্রাট গগন দাসের মাধ্যমে।

    আনুমানিক ১৮৪৫ সালে শিলাইদহের আড়পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রী গগন চন্দ্র দাস। পিতা-মাতার পরিচয় বা তাঁর শৈশব সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায়না। শুধুমাত্র জানা যায় যে কিরণ চন্দ্র দাস নামে তাঁর একটি ছেলে ছিল। গগন চন্দ্র দাস ছিলেন স্বভাব বাউল, তিনি নিজেই গান লিখতেন এবং সুর করতেন। গানের গলাও তাঁর খুব ভালো ছিলো। লালন ফকিরের সাথে তাঁর সখ্যতার কথা পাওয়া যায় নবুদে। গগনের সঙ্গীত শিক্ষার গুরু কে ছিলেন তার হিসেবও পাওয়া যায় না। লালন ফকির গগনের গানের খুব ভক্ত ছিলেন আবার গগন ছিলেন লালন ফকিরের গানের একনিষ্ঠ ভক্ত। লালন ও গগনের বহুবার সাক্ষাৎ হয়েছে বলেই প্রমান পাওয়া যায়। গগনের লেখা ও সুর করা বাউল গানের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় যে গানগুলো পাওয়া যায় সেগুলো হলো:

    ১.

    আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।।
    হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে,
    আমি দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।

    ২.

    (ও মন) অসার মায়ায় ভুলে রবে, কতকাল এমনিভাবে।
     এসব ভোজবাজির প্রায়, (মন রে) কেউ কারো নয়।
    দেখতে দেখতে কোথায় যাবে।

    রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে থাকলেই ডাক পড়তো গগন দাসের। তিনি গগন দাসের গানের একনিষ্ঠ শ্রোতা ছিলেন এবং পূর্ববঙ্গের বাউল সহ বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের প্রভাব তাঁর গানে পড়েছিল। তিনি গগনের গানের এতটাই গুণমুগ্ধ ছিলেন যে, গগনের গানের ব্যাপারে তাঁর লেখা প্রবন্ধ “An Indian Folk Religion” -এ লিখেছিলেন, “The first Baul song, which I chanced to hear with any attention, profoundly stirred my mind.”। গগনের গানের সুরে প্রভাবিত হয়ে তিনি তাঁর নিজের গানেও সেই সুর ভেঙে ব্যবহার করেছিলেন। একে কোনোভাবেই নকল করা বলা যায় না, প্রভাবান্বিত বলতে হবে কারণ কোনো সুরের ওপর ভিত্তি করে মৌলিক কোনো সৃষ্টিকে নকল বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি" এবং "যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না মা!" গানদুটির সুর গগনের ওপরের গানদুটির সুরের প্রভাবে করেছিলেন। পরবর্তীতে আমার সোনার বাংলা গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়, সেইকারণে অনেকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের সুরকার হিসেবে গগনের নাম গৃহীত হওয়ার দাবী করে এখনও।

    গগনের মাধ্যমেই লালন ফকিরের বাউল গানের সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। যদিও ঠাকুর পরিবারের কিছু সদস্যদের সাথে লালন ফকিরের সাক্ষাৎ হয়েছিল বলেই জানা যায়। ১৮৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম শিলাইদহে যান জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে জমিদারির কাজে দাদাকে সাহায্য করার জন্য (অবশ্য ছোটবেলা থেকেই বাবা বা দাদাদের সাথে বহুবার শিলাইদহে তিনি এসেছেন। কিন্তু লালন ফকির যেহেতু শিলাইদহে বাস করতেন না সেইহেতু হয়তো রবীন্দ্রনাথের জমিদারির সময়টা অনেকে ধরতে চাইছেন)। এর মাত্র চার বছর পরে ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর মৃত্যু হয় লালন ফকিরের। সেইকারণে অনেকের মত রবীন্দ্রনাথের সাথে লালন ফকিরের সাক্ষাৎ হয়নি। আবার বিরুদ্ধ মতও আছে, আবার এই ব্যাপারে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কথাও ধোঁয়াশাপূর্ণ।

    রবীন্দ্রনাথ-লালন ফকির সাক্ষাৎকারের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় জলধর সেনের কাঙাল হরিনাথ-জীবনীতে। সেখানে লিখেছেন তিনি— “শুনিয়াছি, কবিবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহের কুঠিতে লালন ফকির একবার গান করিয়া সকলকে মন্ত্রমুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। প্রাতঃকাল হইতে আরম্ভ করিয়া অপরাহ্ন তিনটা পর্য্যন্ত গান চলিয়াছিল; ইহার মধ্যে কেহ স্থানত্যাগ করিতে পারেন নাই।” তবে রবীন্দ্রনাথ-লালন ফকির সাক্ষাতের ধারণাটি সবচেয়ে বেশি প্রচার পেয়েছে শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর একটি রচনার সৌজন্যে। তাঁর "পল্লীর মানুষ রবীন্দ্রনাথ" (বৈশাখ ১৩৫২) বইয়ে তিনি ‘লালন ফকিরের সঙ্গে মোলাকাৎ’ নামে একটি কাহিনি প্রকাশ করেন। এই কাহিনিই কথিত সাক্ষাৎকারের প্রধান উৎস। কিন্তু এই বইয়ের পরের এক সংস্করণে শচীন্দ্রনাথ এই মত ফিরিয়ে নিয়ে পাদটীকায় মন্তব্য করেন, এই সাক্ষাৎ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সেজোদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। এ বিষয়ে তিনি এক চিঠিতে (০৪/১১/১৯৭০) আবুল আহসান চৌধুরীকে জানান: “লালন ফকিরের সম্বন্ধে ‘পল্লীর মানুষ রবীন্দ্রনাথ’-এ যে ফুটনোট আছে, তা সত্যি। উপেনবাবু তাঁর ‘বাংলার বাউল ও বাউলগান’ গ্রন্থে...বহু গবেষণা করে লিখেছেন যে, লালনের মৃত্যু ১৮৯০ খ্রিঃ ১৭ ই অক্টোবর ১১৬ বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথ ঐ সময়ে জমিদারীর ভার পান নি, তাই সাক্ষাৎ হয়নি ধরা যেতে পারে। তবে আমার ঐ কাহিনী অসত্য নয়, কারণ যার কাছে শোনা...সে ছেঁউড়েরই বুড়ো— সে বাজে কথা বলার লোক নয়। রবীন্দ্রনাথের স্থানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হবেন, কারণ ঐ সময়ে জ্যোতিবাবু ঘনঘন শিলাইদহ যেতেন ও থাকতেন। তাঁকেই প্রজারা ‘বাবুমশাই’ বলত।” শচীন্দ্রনাথ অন্য এক জায়গায় বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এঁর [লালন] পরিচয় ছিল কিনা তার বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রাচীনেরা বলেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এঁর আলাপ হয়েছিল, কিন্তু সে কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়।”

    বসন্তকুমার পালের "মহাত্মা লালন ফকির" বইয়ে ‘প্রকাশকের নিবেদন’-এ অজিতকুমার স্মৃতিরত্ন উল্লেখ করেছেন: “নিরক্ষর পল্লীবাসী হইতে আরম্ভ করিয়া আমরা শুনিয়াছি জ্ঞানবৃদ্ধ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত ফকিরের সহিত ধর্ম্মালাপ করিয়া পরিতৃপ্ত হইয়াছেন। শিলাইদহে মহাকবি রবীন্দ্রনাথের সহিত প্রথম যেদিন তাঁহার ভাবের বিনিময় হয় তাহা জাহ্নবী-যমুনা মহামিলনের ন্যায় রসোচ্ছ্বাসের সঙ্গমতীর্থ রচনা করে।” শিলাইদহের সাধক কবি গোসাঁই গোপালের সংগীতসংগ্রহ "গোপাল গীতাবলী"-র সংকলক ও প্রকাশক গোপালপুত্র রাসবিহারী জোয়ারদারও উল্লেখ করেছেন: “নদীয়া জেলায় কুষ্টিয়া মহকুমার শিলাইদহ একটি গ্রাম। ঠাকুরবংশের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পাদস্পর্শে পূত হইয়া গ্রামটির নাম চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়ে। পূত গ্রামটি পবিত্র গঙ্গাসলিলা পদ্মানদীর তীরে অবস্থিত। শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পদ্মার উপর বজরায় থাকিতেন এবং এখানেই তাঁহার কবিত্বশক্তির বিকাশ পায়।... সাধক লালন সাঁই প্রভৃতি বহু সাধু ও দরবেশ ঠাকুর মহাশয়ের সহিত দেখা করিতে আসিতেন। কবি রবীন্দ্রনাথ সাধক লালন সাঁইকে ভালবাসিতেন ও তাঁহার সুললিত গান একাগ্র মনে শ্রবণ করিতেন।” মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন ‘জনশ্রুতি’-র দোহাই দিয়ে বলেছেন: “কবি রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে লালন ফকীর তাঁহার শিলাইদহস্থ বোটে সাক্ষাৎ করিতে আসেন বলিয়া জনশ্রুতি রহিয়াছে। ...সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মহাশয়া লালনকে দেখিয়াছিলেন এবং বোটে তাঁহার গান শুনিয়াছিলেন।” আর এক জায়গায় মনসুর উদ্দিন মন্তব্য করেছেন, “একটা আশ্চর্যের ব্যাপার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন শাহের দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে কি না তার নিশ্চিত কোন খবর পাওয়া যায় না।” আবার পাশাপাশি এ-কথাও বলেছেন: “...জানতে পারা যায় লালন শাহের মৃত্যুর পর শিষ্য-সাগরেদের মধ্যে ২/৩ জন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে সাক্ষাৎ করেন এবং রবীন্দ্রনাথ লালনের মৃত্যুর খবর শুনে লালনের শ্রাদ্ধশান্তির জন্যে নগদ দুইশত টাকা দান করেন।”

    সুকুমার সেন কোনও সূত্র উল্লেখ না করেই জানিয়েছেন: “সাধনা চালাইবার কালে রবীন্দ্রনাথ উত্তর-মধ্যবঙ্গে লালন ফকির ও আন্দী (?) বোষ্টমীর মতো অনেক বাউল-বৈষ্ণব-দরবেশের সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের গীতিনিষ্ঠ ধর্ম-অনুশীলনের পরিচয় পাইয়াছিলেন।” বিনয় ঘোষও সম্ভবত খানিকটা অনুমানেই সাক্ষাৎকারের পক্ষে তাঁর মত দিয়েছেন: “১৮৮৪-৮৫ খ্রীস্টাব্দে বাউলগানের সংগ্রহটি তাঁর হাতে পড়ার পর যখন বাংলা লোকসাহিত্যের গোপন রত্নভাণ্ডারের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল, তার দু-তিন বছরের মধ্যেই মনে হয়, শিলাইদহে বিখ্যাত বাউল লালন ফকিরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল।” হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় এক প্রবন্ধে এই সাক্ষাৎ না-হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লেখ করে বলেছেন, “আমার মনে হয় এই কাহিনী সম্পূর্ণ কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।” অন্নদাশঙ্কর রায়ও এ-বিষয়ে সম্ভাবনা যাচাই করে মন্তব্য করেছেন, “...দুই জ্যোতিষ্কের সাক্ষাৎকার প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ।” লালন ফকিরের গানের সঙ্গে আধুনিক মনের একটা সংযোগ আছে, সে-কারণে তিনি রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিলেন; অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যের ইতিহাসে এই মন্তব্য করার সময় বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করেছেন যে, “যদিও তাঁদের দেখাশুনা হয়নি”। রবীন্দ্রনাথের কাছে লালনশিষ্য মনিরুদ্দিন শাহ যে দরখাস্ত পেশ করেছিলেন, তা থেকেই এই ইঙ্গিত স্পষ্টই পাওয়া যায় যে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেই তাঁর পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি ‘লালন সাহা ছাহেবকে নিষ্কর দিতে প্রতিশ্রুত ছিলেন, কিন্তু সাহা ছাহেব লোকান্তর হওয়ায় তাঁহার সে আশা পূর্ণ হইয়াছিল না।’ লালনের মৃত্যুর পর লালনশিষ্যদের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথও ছেঁউড়িয়ার আখড়াকে নিষ্করদানের কথা দিয়েছিলেন।লালনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ-বিষয়ে পক্ষে বা বিপক্ষে রবীন্দ্রনাথ কোনওই আভাস দেননি, এই প্রচলিত ধারণাটি ঠিক নয়। তবে এ-সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য কিছুটা অস্পষ্ট ও হেঁয়ালিপূর্ণ। মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন সংকলিত "হারামণি"-র (১ম খণ্ড, কলকাতা, বৈশাখ ১৩৩৭) ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউলদলের সঙ্গে আমার সর্ব্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হত।” লালন ফকির এই ‘বাউলদল’-এর মধ্যে ছিলেন কিনা সে সম্পর্কেও আজ স্পষ্টভাবে জানা অসম্ভব। লালনের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নিজেরই দুই ধরনের কথা আছে। ১৯২২ সালে শ্রীনিকেতন পল্লিসেবা বিভাগের কাজের ধারা কেমন হবে সে-বিষয়ে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কথায় কথায় শান্তিদেব ঘোষের বাবা কালীমোহন ঘোষকে বলেছিলেন: ‘তুমি তো দেখেছো শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যগণের সহিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার কিরূপ আলাপ জমত। তারা গরীব। পোষাক-পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝবার জো নাই তারা কত মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় কত সহজভাবে তারা বলতে পারত।’ এই উক্তি থেকে ধারণা জন্মায় যে রবীন্দ্রনাথ লালন নন, তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। লালনের সঙ্গে মুখোমুখি পরিচয় থাকলে এখানে তাঁর উল্লেখই বেশি গুরুত্ব বহন করত। আবার অন্য দিকে নীচের তথ্য থেকে মনে হতে পারে দুজনের আলাপ-পরিচয় ছিল। 

    বসন্তকুমার পাল লালনজীবনী লেখার আগে রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছু জানতে চেয়ে তাঁকে চিঠি লেখেন। কবির পক্ষ থেকে সেই চিঠির জবাব দেন তাঁর একান্ত সচিব সুধীরচন্দ্র কর। ২০ জুলাই ১৯৩৯ তারিখে শান্তিনিকেতন থেকে পাঠানো চিঠিতে বসন্তকুমারকে জানানো হয়: ‘কবি আপনার চিঠি পেয়ে সুখী হয়েছেন। আপনাকে এই মহৎ কাজে সাহায্য করতে পারলে তিনি আরো সুখী হতেন সন্দেহ নাই। ফকির সাহেবকে তিনি জানতেন বটে কিন্তু সে তো বহুদিন আগে; বুঝতেই পারেন এখন সে সব সুদূর স্মৃতির বিষয় তাঁর মনে তেমন উজ্জ্বল নয়। তবে তিনি বললেন, কলকাতায় “লালবাংলা”, ২০ নং মে ফেয়ার, বালিগঞ্জ— এই ঠিকানায় শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর মশায় থাকেন, তিনিও ফকির সাহেবকে জানতেন, তাঁর কাছে খোঁজ করলে অনেক বিষয় আপনার জানবার সুবিধা হোতে পারে।’ ‘ফকির সাহেবকে [লালন] তিনি [রবীন্দ্রনাথ] জানতেন’— এই কথাটি অবশ্য দুজনের আলাপ-পরিচয়ের ধারণাকে সমর্থন করে। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে পাকাপাকি জমিদারি দেখাশোনার ভার নিয়ে আসার আগে ১৮৮৯ সালের শেষ দিকে বেশ কিছুদিনের জন্যে শিলাইদহে ছিলেন। জমিদারির দায়িত্ব নেওয়ার আগে ছেলেবেলা থেকেই নানা সময়ে রবীন্দ্রনাথ অনেকবারই শিলাইদহে এসেছেন। সেই সময়ে লালন ফকিরের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু এ-বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসার পক্ষে সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণের একান্তই অভাব। "হারামণি"-র ভূমিকায় বাউলদলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের প্রসঙ্গে কারও নামের উল্লেখ করেননি তিনি।

    গগনের সাথে লালন ফকিরের সাক্ষাৎ হয়েছিল একাধিকবার, সে সম্পর্কে অবশ্য কোনো দ্বিমত নেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গগনের সাক্ষাৎ হয়েছিল কিভাবে তা এখনও বলা হয়নি। আসল নাম গগন চন্দ্র দাস হলেও তিনি আমাদের কাছে এবং বাংলাদেশবাসীর কাছে গগন হরকরা বলেই পরিচিত। গগন চন্দ্র দাস ছিলেন শিলাইদহ পোস্ট অফিসের কর্মী, তাঁর কাজ ছিল ডাক অর্থাৎ চিঠি বিলি করা। গ্রামে এখনও ডাক পিওনকে ডাক হরকরা বলেই ডাকা হয় বেশীরভাগ জায়গায়। হরকরা শব্দের অর্থ বিলি করা। তখনকার দিনে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল চিঠি, সুতরাং রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের সেরেস্তায় নিত্য চিঠি বিলি করতে হতো এবং সেই সূত্রেই গগনের জমিদারি সেরেস্তায় প্রবেশের অনুমতি ছিল। চিঠি বিলি করার সময়ে মেঠো পথ ধরে যাতায়াতের সাথে গ্রামবাসীর উপরি পাওনা ছিল গগনের উদাত্ত কণ্ঠে বাউল গান। এইভাবেই রবীন্দ্রনাথের কানে গিয়ে পৌঁছয় গগনের সঙ্গীত ও গায়কী সম্পর্কে। এরপরে জমিদারি সেরেস্তায় গগনের গান শোনা রবীন্দ্রনাথের, যা পরে নিয়মে পরিণত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গগনের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হওয়া, গগনের সুরের প্রভাবে সঙ্গীত রচনা করা এবং পরবর্তীতে "আমার সোনার বাংলা" গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হওয়া, গগন হরকরা-কে বাংলাদেশের লোক তথা আপামর বাঙালীর হৃদয়ে স্থান করে দিয়েছে। বাউল গানে গগন হরকরার অবদানও ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী করে দিয়েছে। ১৯১০ সালে এই বাউল কবির মৃত্যু হয়। তাঁর স্মৃতিতে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার নিশান মোড়ে তাঁর একটি ভাস্কর্য স্থাপনা করা হয়েছে। যতদিন আমাদের হৃদয়ে "সোনার বাংলা" থাকবে ততদিন গগন হরকরাও থাকবে।

    গগন চন্দ্র দাস ওরফে গগন হরকরা
    (১৮৪৫ - ১৯১০)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন