এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোর জাতীয়-সংগীত এবং রবীন্দ্রনাথ

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ৫৭২ বার পঠিত
  • ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরে ভারতবর্ষ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা দেশগুলোর স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নেয় জাতিসংঘ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলো। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এরপরে এই দেশগুলোর অন্যান্য অনেক আবশ্যিক বিষয়ের সঙ্গে প্রয়োজন হয়ে পরে রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীতের। ভারতবর্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ভারত-বিধাতা' গানটির প্রথম স্তবকটিকেই জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করে। হঠাৎ করেই যে গানটি আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পেল তা একদমই নয়, এর পেছনে এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। গানটির রচনাকাল থেকে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া অব্দি ইতিহাসটা এইরকম:

    'ভারত-বিধাতা' (জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে) সংগীতের কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না। সেই কারণে এই গানটি কোথায় কবে রচিত হয়েছিল তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। গানটি প্রথম গাওয়া হয়েছিল ২৭ ডিসেম্বর, ১৯১১ তারিখে কলকাতায় আয়োজিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ২৬তম বার্ষিক অধিবেশনে। গানটি গাওয়া হয়েছিল সমবেতকণ্ঠে। দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে গানের রিহার্সাল হয়েছিল ডক্টর নীলরতন সরকারের হ্যারিসন রোডের (বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড) বাড়ীতে। পরদিন দ্য বেঙ্গলি পত্রিকায় গানটির ইংরেজি অনুবাদসহ সংবাদের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আদি ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মাঘ ১৩১৮ সংখ্যা অর্থাৎ জানুয়ারি ১৯১২ সংখ্যায় ভারত-বিধাতা শিরোনামে প্রকাশিত এই গানটি ব্রহ্মসঙ্গীত আখ্যায় প্রচারিত হয়েছিল। সেই বছর মাঘোৎসবেও গানটি গাওয়া হয়েছিল। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংগীত হিসাবে প্রথম জনগণমন গানটির নাম প্রস্তাব করেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জুলাই আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের কথা ঘোষণা করা হয় এবং সেই দিনই প্রথম জাতীয় সংগীত হিসাবে জনগণমন গাওয়া হয়। এরপর ওই বছরের ২৫ অগস্ট নেতাজী আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাপতির পদ গ্রহণ করেন ও ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে আরজি হুকুমৎ-এ-আজাদ হিন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। এই দিনও জাতীয় সংগীত হিসাবে জনগণমন গাওয়া হয়েছিল। এরপরে নেতাজী আজাদ হিন্দ সরকারের সেক্রেটারি আনন্দমোহন সহায়ের উপর দায়িত্ব দেন গানটির হিন্দুস্থানী অনুবাদের জন্য। তিনি লয়ালপুরের তরুণ কবি হুসেনের সাহায্যে কাজটি সম্পাদন করেন। অনুবাদের সময় মূল গানের সামান্য পরিবর্তন সাধিত হলেও তার ভাব ও সুর অক্ষুণ্ণ থাকে। পরবর্তীকালে আনন্দমোহন সহায়ের লেখা থেকে জানা যায়, এই গান সেই সময় ভারত ও ভারতের বাইরেও বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং জাপান ও জার্মানির বিদ্বান সমাজ এই গান শুনে অভিভূত হয়েছিলেন। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে আজাদ হিন্দ ফৌজ মৌডক রণক্ষেত্রে জয়লাভ করে ভারতের মাটিতে প্রবেশ করে ও সেই দিনই প্রথম ভারতের মাটিতে জনগণমন ভারতের জাতীয় সংগীতরূপে বাজানো হয়।

    নেতাজী যদিও জন-গণ-মন কে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেছিলেন স্বাধীনতার বহু আগেই, তবুও ১৯৪৭ সালের আগে জাতীয় সংগীতরূপে কোনো গানকেই গ্রহণ করা হয়নি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার অব্যহিত পরেই জাতিসংঘ থেকে কোনো এক অনুষ্ঠানে বাজানোর জন্য ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত চেয়ে পাঠানো হলে তড়িঘড়ি জন-গণ-মন কেই পাঠানো হয়। এর আগে অব্দি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'বন্দেমাতরম' গানটিও সমমর্যাদা সম্পন্ন ছিল। কিন্তু বন্দেমাতরম গানটিতে ভারতমাতাকে হিন্দুদেবীর আদলে বর্ণনা করা হয়েছে - এই যুক্তি দেখিয়ে জন-গণ-মন-কে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মুসলিম সমাজে বন্দেমাতরম গানটি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা ছিলনা। অবশেষে ১৯৫০ সালে সংবিধান-সভা 'জন-গণ-মন' গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে এবং 'বন্দেমাতরম' গানটিকে জাতীয় স্ত্রোত্র হিসেবে গ্রহণ করে।

    পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুটি অংশ ছিল স্বাধীনতা লাভের পরে, একটি পশ্চিম পাকিস্তান বা পাকিস্তান আর অন্যটি পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দু আর পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা বাংলা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই অনেককিছুই গোলমেলে। যিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জাতির জনক এবং ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উল্লেখযোগ্য নাম সেই মহম্মদ আলি জিন্নাহ, সারাজীবন ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এলেন আর যেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের গন্ধ পেলেন অমনি পাকিস্তানের আইনসভা থেকে নিজের নাম নতুন দেশের গভর্নর জেনারেল হিসেবে পাশ করিয়ে ইংল্যান্ডের রাজার কাছে পাঠিয়ে দিলেন এবং ইংল্যান্ডের রাজার প্রতিনিধি হিসেবে জীবনের বাকী দিনগুলো পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে কাটিয়ে দিলেন আর সেই ইংল্যান্ডের রাজার প্রতিনিধিই হয়ে গেলেন দেশের জাতির জনক। দেশের জাতীয় সংগীতের ক্ষেত্রেও তাই, ১৪ অগস্ট ১৯৪৭ তারিখে যখন পাকিস্তান প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালন করছে, সেই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে লর্ড মাউন্টব্যাটন ও লেডি মাউন্টব্যাটন ও গভর্নর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্নার উপস্থিতিতে নবগঠিত রাষ্ট্রের প্রথম জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘তরানা এ পাকিস্তান’ গানটি গাওয়া হয়। সেই মুহূর্তে তৈরি হয় নজির।

    এক ভারতীয় নাগরিক জগন্নাথ আজাদের লেখা গান হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত। কবি জগন্নাথ আজাদের জন্ম ১৯১৮ সালে। যে গ্রামে তার আদি বাড়ি সেটি দেশভাগের পর পাকিস্তানে পড়েছে। পাক পাঞ্জাব প্রদেশের এই গ্রামের নাম ইসা খেল। কিশোরকাল থেকেই উর্দু কবিতার প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল জগন্নাথ আজাদের। লেখাপড়া প্রথমে রাওয়ালপিন্ডিতে পরে লাহোর ইউনিভার্সিটি এফ পাঞ্জাবে। লাহোরেই সাংবাদিকতা শুরু করেন জগন্নাথ আজাদ। দেশভাগের পর দিল্লিতে এসে উর্দু সংবাদপত্রের সম্পাদক হন। ১৯৪৮ সালে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ পেপারের সম্পাদক হয়েছিল তিনি। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের প্রথম জনসংযোগ আধিকারিক জগন্নাথ আজাদ। ওই একই পদে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকেও। এছাড়াও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তিনি। উর্দু দুনিয়ার শাহেনশা হিসেবে পরিচিত মহম্মদ ইকবালের জীবনাদর্শে অনুরক্ত জগন্নাথ আজাদের সঙ্গে মহম্মদ আলি জিন্নার সুসম্পর্ক ছিল। তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। মহম্মদ আলি জিন্নার ইচ্ছেতেই বন্ধু কবি জগন্নাথ আজাদের লেখা গান ‘তরানা এ পাকিস্তান’ পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয় স্বাধীনতার পরে পরেই। কিন্তু মহম্মদ আলি জিন্নার মারা যাওয়ার পরে জাতির জনকের ইচ্ছেকে শিকেয় তুলে, ভারতীয় হিন্দু কবির লেখা-এই অজুহাতে ১৯৫৪ সালে (১৩ ই অগস্ট) পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হয়। হাফিজ জলন্ধরি-র লেখা এবং আহমদ গোলাম আলী ছাগলা-র সুর করা 'পাক সরজমীন শাদ বাদ' গানটিকে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত হিসেবে পাক আইনসভা স্বীকৃতি প্রদান করে। গানটি মূলতঃ ফার্সি ভাষায় লেখা। শুদ্ধ উর্দু ও ফার্সি ভাষার মিল থাকার ফলে গানটি উর্দু ভাষায় লেখা বলা হয়, কিন্তু আদপে 'কা' জাতীয় উর্দু শব্দ ছাড়া সবটাই ফার্সি ভাষায় লেখা। অন্যদিকে ‘তরানা এ পাকিস্তান’-এর গোলাম মোস্তফা কৃত এবং নাজির আহমেদ কর্তৃক সুরারোপিত বাংলা অনুবাদ 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' গানটি পূর্ব পাকিস্তানের বিকল্প জাতীয় সংগীত হিসেবে ১৯৭১ সাল অব্দি (২৬শে মার্চ তারিখে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার আগে অব্দি) স্বীকৃত ছিল। অর্থাৎ জাতীয় সংগীত পরিবর্তিত হলেও ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তারিখ অব্দি পাকিস্তানের দুটো জাতীয় সংগীত বিদ্যমান ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের একটি আর পূর্ব পাকিস্তানের একটি।

    বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'আমার সোনার বাংলা' গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। গানটি ১৯০৫ সালে বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে কবিগুরুর লেখা। ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ লাইন সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়। গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি, তাই এর সঠিক রচনাকাল জানা যায় না। সত্যেন রায়ের রচনা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথম গীত হয়েছিল। এই বছরই ৭ সেপ্টেম্বর (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) সঞ্জীবনী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে গানটি মুদ্রিত হয়। এই বছর বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি মুদ্রিত হয়েছিল। আবার বিশিষ্ট রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, 'আমার সোনার বাংলা' গানটি ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে 'অবস্থা ও ব্যবস্থা' প্রবন্ধ পাঠের আসরে প্রথম গাওয়া হয়েছিল। 'আমার সোনার বাংলা' গানটি রচিত হয়েছিল শিলাইদহের ডাকপিয়ন গগন হরকরা রচিত 'আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে' গানটির সুরের অণুষঙ্গে। সরলা দেবী চৌধুরানী ইতিপূর্বে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে তার শতগান সংকলনে গগন হরকরা রচিত গানটির স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ-সমসাময়িক অনেক স্বদেশী গানের সুরই এই স্বরলিপি গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছিল। যদিও পূর্ববঙ্গের বাউলদের ভিডমিড ও ভাটিয়ালি সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি ইতিপূর্বেই হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৮৮৯-১৯০১ সময়কালে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারির কাজে ভ্রমণ ও বসবাসের সময় বাংলার লোকজ সুরের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা ঘটে। তারই অভিপ্রকাশ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী আন্দোলনের সমসাময়িক গানগুলি, বিশেষত আমার সোনার বাংলা। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলার কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ। পরে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা শেষে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সংগীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সংগীত হিসাবে গাওয়া হয়।

    ১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতা পায় ব্রিটিশদের কাছ থেকে এবং ১৯৫১ সালের ২২শে নভেম্বর তারিখে 'নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা' গানটিকে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেওয়া হয়। গানটির রচয়িতা শ্রীলঙ্কার খ্যাতিমান সংগীত ব্যক্তিত্ব আনন্দ সামারাকুন। উইকিপিডিয়া-তে দেখা যায় জাতীয় সংগীতটির সুরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে গানটির রচয়িতা ও সুরকার নিয়ে অনেক মতবাদ আছে। সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে শ্রীলঙ্কার খ্যাতিমান সংগীত ব্যক্তিত্ব আনন্দ সামারাকুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হয়ে গানটি লিখেছেন। অনেকে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরো গানটি লিখেছেন। কেউ কেউ বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথ গানটির সুরকার এবং আনন্দ সামারাকুন রচয়িতা। রবীন্দ্রনাথ সরাসরি এই গান রচনায় যুক্ত ছিলেন এই ধারণা ভারতীয় ঐতিহাসিক লিপি ঘোষ এবং শ্রীলঙ্কার ঐতিহাসিক Sandagomi Coperahewa অস্বীকার করেছেন। আনন্দ সামারাকুন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের ছাত্র ছিলেন। অনেকের মতে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সামরাকুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শ্রীলঙ্কা নিয়ে একটি কবিতা লিখে দিতে অনুরোধ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলায় একটি কবিতা লিখে তাতে সুর দেন। শ্রীলঙ্কা ফিরে গিয়ে সামারাকুন কবিতাটি সিংহলি ভাষায় অনুবাদ করেন এবং সুর একই রাখেন। শ্রীলঙ্কা ফিরে যাবার পর তিনি মাহিন্দা কলেজে গান শেখাতেন। মাহিন্দা কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রথম 'নমো নমো মাতা' গানটি পরিবেশন করেন। পরে মিউসেস কলেজ নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গায়ক দল গানটি পরিবেশন করার পর এটি শ্রীলঙ্কায় জনপ্রিয় হয়। তৎকালীন সময়ে বেতারে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল গানটি।

    ১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা ব্রিটেনের নিকট হতে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু স্বাধীনতার পরও শ্রীলঙ্কায় ব্রিটেনের জাতীয় সংগীত ব্যবহার করা হত। ১৯৫০ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী জে.আর জয়বর্ধনে শ্রীলঙ্কা সরকারকে আনন্দ সামারাকুনের অনুবাদকৃত 'নমো নমো মাতা, সু্ন্দর শ্রীবরণী' গানটিকে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত করার আবেদন জানান। তখন শ্রীলঙ্কা সরকার গৃহ ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী এডুইন বিজয়রত্নের নেতৃত্বে জাতীয় সংগীত প্রনয়ন সংক্রান্ত কমিটি গঠন করেন। উক্ত কমিটি অনেকগুলো গান নির্বাচন করে, কিন্তু তারমধ্যে আনন্দ সামারাকুনের 'নমো নমো মাতা' গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই কমিটি সামারাকুনের সমর্থনে গানটির দশম পঙক্তিতে কিছু পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন আনে। ২২ নভেম্বর ১৯৫১ সালে সরকার গানটিকে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত রূপে ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালে এম. নল্লথম্বি গানটি তামিল ভাষায় অনুবাদ করেন। ১৯৫২ সালে শ্রীলঙ্কার প্রথম স্বাধীনতা দিবসে গানটি আনুষ্ঠানিকভাবে গাওয়া হয়। ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে গানটির প্রথম লাইন 'নমো নমো মাতা' নিয়ে অনেক বিতর্ক শুরু হয়। এটিকে দেশের জন্য দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ী করা হয়। তাই শ্রীলঙ্কা সরকার ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আনন্দ সামারাকুনের অমতে ও প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও গানটির প্রথম লাইনে পরিবর্তন আনে এবং প্রথম লাইনটি বদলে 'শ্রীলঙ্কা মাতা, আপা শ্রীলঙ্কা নমো নমো নমো নমো মাতা' করা হয়। আনন্দ সামারাকুন ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেন ও তার আত্মহত্যার কারণ হিসেবে তার রচিত জাতীয় সংগীতের ক্ষতিসাধনকে দায়ী করেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রী সংবিধান 'শ্রীলঙ্কা মাতা' গানটিকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করে।

    সুতরাং ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা হলেও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক একেবারে নেই তা বলা যাবে না। একমাত্র পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও স্বাধীনতার শুরুতে এক ভারতীয় কবির সম্পর্ক ছিল, পরে তা মুছে দেওয়া হয়েছে।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন