- | 223.29.193.71 | ২৯ আগস্ট ২০২২ ০২:৪৭
Gautam Mitra১০ জুন (পাবলিক পোস্ট) ·
১৩ মে ২০২২! আদম আয়োজিত 'গৌতম বসু সম্মননা জ্ঞাপন' অনুষ্ঠানে যখন পল্লব ভট্টাচার্যকে নিয়ে বলতে উঠলাম তখন অনুষ্ঠান শুরুর নির্ধারিত সময় অনেকটাই পেরিয়ে গেছে।ফলত সম্পাদক গৌতম মণ্ডলের অনুরোধে আমার বক্তব্য বেশ খানিকটা সংক্ষিপ্ত করতে হল।
কিন্তু সেদিনের অনুষ্ঠানে আমার এমন অনেক শুভানুধ্যায়ী ছিলেন যাঁরা সম্পূর্ণ লেখাটি শুনতে চেয়েছিলেন।তাঁদের সম্মানার্থে সম্পূর্ণ লেখাটি এখানে প্রকাশ করলাম।
একটি অনুরোধ, কেউ যদি লেখাটি কোনও ওয়েব ম্যাগাজিনে বা পত্রিকায় প্রকাশ করতে চান, দয়া করে জানাবেন, সংশোধন করে পাঠাব।
জীবনানন্দ দাশের একটি গল্প 'কুয়াশার ভিতর মৃত্যুর সময়'। সেখানে নায়ক লেখেন,'নিজের জীবনের কথাই, নামগুলো মাত্র বদলে দিয়ে লিখতে শুরু করেছে সে'! অতঃপর লেখক বিনোদ হয়ে ওঠে নায়ক হিমাংশু।
কেন গল্পটির কথা মনে হল? আসলে আমরা সবাই হয়তো লেখক সত্তা থেকে ব্যবহারিক সত্তাকে আলাদা করতে চাই।এবং পল্লব ভট্টাচার্য এতে সফল হয়েছেন।
দু'জন পল্লব ভট্টাচার্য। যখন প্রথম পল্লবের অফিসে যাই, নেমপ্লেটে লেখা প্রসেনজিত ভট্টাচার্য, সরকারী উচ্চপদস্থ সদা ব্যাস্ত মানুষটিকে দেখে কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারবে না যে ইনিই কবি ও লেখক পল্লব ভট্টাচার্য।জীবনানন্দ গল্পের নায়কের নাম বদলেছিলেন লেখার 'কুড়কুড়ানি'-তে। কুড়কুড়ানি শব্দটি জীবনানন্দর-ই। আর পল্লবও বাস্তব জীবনে তার লেখকসত্তাকে চাকরিজীবীসত্তা থেকে আলাদা করতে সক্ষম হয়েছেন, সেই লেখার কুড়কুড়ানিতে।
গত ৪০ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন লেখালেখির ফসল পল্কবের ৭ টি কাব্যগ্রন্থ।
১.নিঃশব্দের নিচে
২.সামান্য তামাক পাতা
৩.অপেক্ষার জল
৪.গন্ধের ঈশ্বরী
৫.মরিল সুশীলা
৬.শূন্যের প্রচ্ছদ
৭.(স্ব)নির্বাচিত কবিতা
কাব্যগ্রন্থগুলির রচনাকাল ও প্রকাশকাল লক্ষ্য করলে কবির মনোজগতের একটি ম্যাপ আঁকা যায়।
জন্ম ষাট দশকের প্রথম দিকে, নিয়মিতভাবে কবিতা লেখার শুরু ১৯৮১/৮২ থেকে হলেও প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করতে কবি সময় নেন প্রায় ২৮ বছর।
বাংলা কবিতার ইতিহাসে এটি অবশ্যই ব্যতিক্রমী ঘটনা। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। ২০০৮-এ যে প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হবে তার রচনাকাল ৭ থেকে ৪ বছর আগের।একমাত্র জীবনানন্দই বুঝি এমনটি করেছেন।অতঃপর পল্লবের পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোর জন্যও আমাদের আরও এক অতিশয় তৃণাঙ্কুর অপেক্ষার দিকে যেতে হবে।
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ৬ বছর পর ২০১৪-তে এবং এখানেও সেই ৮ থেকে ৫ বছর আগে লেখা কবিতা সঙ্কলিত হয়েছে।
আর বললাম বটে একটা নির্দিষ্ট সময়ের কবিতা সঙ্কলিত হয়েছে, তবে ঠিক কতটা সঙ্কলিত হয়েছে?
আমি ব্যক্তিগতভাবে পল্লবের দু'টি বইয়ের প্রকাশক। দেখেছি, কী নির্মমভাবে কবিতা বাতিল করতে। অন্ততপক্ষে পাণ্ডুলিপির ষাট শতাংশ কবিতাকে পল্লব প্রকাশযোগ্য মনে করেনি।অথচ কবিতাগুলো পড়ে বারবার আমার মনে হয়েছে,পাণ্ডুলিপির প্রতিটি কবিতাই প্রকাশযোগ্য।
আমি খুব নিশ্চিত, যখন স্বনির্বাচিত কবিতার বইটি পল্লব তৈরি করছে, হারিয়ে ও নষ্ট করেও,তার কাছে অন্ততপক্ষে ২০০০ কবিতার পাণ্ডুলিপি ছিল।অথচ যখন 'স্বনির্বাচিত কবিতা' প্রকাশ পেল আমরা দেখলাম কবিতার সংখ্যা মাত্র ১০০-র সামান্য বেশি।অথচ আমি জানি, প্রকাশক সেলিম বারবার কবিকে অনুরোধ করেছে যাতে কবিতার সংখ্যা একটু বেশি হয়।
এই মুহূর্তে তিনজন কবির কথা মনে পড়ছে, যাঁদের কাব্যজীবন এমন সংযমী, কবিতা প্রকাশে অনীহা। এক জীবনানন্দ দাশ,দুই বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত ও তিন গৌতম বসু।
আমি বলছি না যাঁরা কবিতা লিখে তার প্রায় সবটা প্রকাশ করেন তাঁদের লেখা দুর্বল বা এমনটিও বলছি না যাঁরা কবিতা লিখে ফেলে রাখেন, প্রকাশে অনীহা, তাঁদের সব কবিতা সফল।আমি শুধু একটা প্রবণতার কথা বলছি। যে প্রবণতা একজন কবিকে তার ৯৫ শতাংশ কবিতাকে অন্তরালে রাখতে প্ররোচিত করে।
যদি এমনটি হত, এই অপ্রকাশিত কবিতার প্রতি কবির অনীহা, তবে উদ্বাস্তু জীবনানন্দ দাশ প্রায় ৩০০০ কবিতা ট্রাঙ্কে করে বয়ে বেড়াতেন না।গৌতম বসুকে বলতে হত না, চারপাশে কবিতার নামে বেশিরভাগ যা ছাপা হচ্ছে তা যদি কবিতা হয় তবে আমি যা লিখছি তা কবিতা নয়, আর আমি যা লিখছি তা যদি কবিতা হয় তবে চারপাশে যা লেখা হচ্ছে তা তা আদৌ কবিতা নয়।তথাকথিত সমৃদ্ধ বন্ধুবলয়ে থেকেও জীবিতকালে বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা পাঁচটিও নয়।কারণ তিনি জানেন:
"সমগ্র সত্তার মধ্যে পাঁচ আঙুলের সমাহার
হাতের মুঠোয় তবু কতটুকু ধরে;
ধরলো না তৃণের দেহ,বালিবিম্ব,সমুদ্রের মুখ;
সুপ্তি থেকে,স্বপ্ন থেকে,জাগ্রত মৃত্যুর জ্বালা থেকে একে একে ঝরে পড়ছে স্থিতির প্রবল অহঙ্কার।“
একটি দীর্ঘ কবিতা, প্রায় ৩০০০ পংক্তির ও প্রায় ২০০০০ শব্দের, এবং আমার মনে হয় পল্লবের নামহীন এই দীর্ঘ কবিতা যদি যথাসময়ে প্রকাশ পেত, বাংলা দীর্ঘ কবিতার ইতিহাসও অন্যরকম হত।'নাট্যময়তা' যা দীর্ঘ কবিতার সবচেয়ে বড়ো গুণ তা এই কবিতাটির ছত্রে ছত্রে।আর আছে প্রখর ইতিহাসবোধ। আর আছে শ্লেষ।এই কবিতায় পল্লব যেন প্রান্তিক বাঙালি জাতির ইতিহাস ও প্রান্তিক বাঙলা ভাষার ইতিহাস নির্মাণ করেছে।এক অলটারনেটিভ ইতিহাস।ব্যক্তিগত ইতিহাস।যাকে কেউ কেউ সাব অলর্টান বলে।
৩০০০ পংক্তি থেকে সামান্য কয়েকটি লাইন উদ্বৃতি দিলে কবিতাটির প্রতি অবিচার করা হয় জেনেও আমি এখানে নিজেকে নিরপেক্ষ অবস্থানে রাখতে পারছি না।কবিতাটির কয়েকটি লাইন:
'পাগল পাগল এক আলো, মৃত্তিকার পোকারা জাগালো ।
এ আলোয় জাদুর বিস্ময়, মুছে দিয়ে ভয়,
ফুটিয়েছে নিশির আওয়াজ :
'না পথ বানাইমু আমি, না দিমু রসদ।’
জুলুমের মদ চড়ছে মাথায়
টিকে থাকা দায় ।
ববম ববম ব্যোম, অদ্ভুত ধুম;
আলো করে পীরের মাজার
জমে গেছে পাগল বাজার ।
পাগল খাজনা দেবে না । পাগল উড়াল দিয়ে যায়।
পাগল মারতে গেলে লাঠি উঠায়, পাগল মারা দায়।
পাগল ভালো কর । সাহেব , ঠান্ডা কর মেরে ।
আবার যেন শান্তটি হয়, জাদুর নাচন ছেড়ে ।
জুলুমের লাঠি থেকে পাগল বাঁচাতে আমি অসহায় । ভাবি, লাঠি হয়ে উঠি সব পাগলের হাতে , কাঠের বন্দুক জুড়ে পুরে দিই প্রাণ । যদি আসলি বন্দুক নিয়ে তেড়ে আসে গোরা, আমিও শরীর নই, সমূহ চেতনা।
এই চেতনা চৈতন্যময়ী চেনো তো মাস্টার , মাটি থেকে উঠে ফের মাটিতে মিলানো ঘুমন্ত পোকাদের জেগে ওঠা; দিব্যতার চিঠি । নীরবের জানকু পাথরে বসে মা-সাহেবা হাসে মিটিমিটি ।
হাসির সড়ক থেকে এঁকেবেঁকে বহুদূর গিয়ে, বাস্তু গোখরো যদি পথও না পায় পাতালের ,
তবে হে লোকপাল, - ফণাই ধর্ম, আমি ছোবলে বিশ্বাসী ।'
এমন নয় যে পল্লবের কবিতার জীবন আর ব্যক্তি জীবন আলাদা।আলাদা যদি হয়ও, পল্লব কবিতার জীবনে ব্যক্তিকে ও ব্যক্তির জীবনে কবিতাকে প্রজেক্ট করে।আমি বলতে চাইছি, পল্লব শুধু কবিতা লেখে না, কখনও কখনও কবিতাও পল্লবকে লেখে।
এই যে পাগলের অনুষঙ্গে কবিতাটির উল্লেখ করলাম, এখানে একটি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উত্থাপন করি।আগরতলায় আমার অফিস যাওয়ার দীর্ঘ পথে একজন ক্ষ্যাপা মানুষকে প্রায়ই দেখতাম।পল্লবকে কথাটি জানাতেই, পল্লবের মধ্যে এক উন্মাদনা লক্ষ করি, সেই মানুষটির সঙ্গে কথা বলার উন্মাদনা।আমি পরবর্তীকালে জানতে পারি পল্লব নিভৃতে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৪০ জন এমন ক্ষ্যাপা ও আপনভোলা মানুষের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছে।জানি না কবে সেই বই প্রকাশিত হবে।
আমাদের আবারও জীবনানন্দ দাশের কথা মনে পড়ে।জীবনানন্দ কলকাতার পথে পথে ঘুরে ভিখিরি ও কুষ্ঠরোগীর তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন।গৌতম বসুর লেখায় বিভিন্ন ঘাট ও গ্রাম কীভাবে ধরা দিয়েছে আমরা জানি।বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কবিতার ভাষা তৈরি করছে তাঁর ছেলে পান্থ। 'ও অনন্ত এলোমেলো ছেলেটি' যে পান্থ বুঝতে আমাদের বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না।এসব ক্ষেত্রে জীবন ও কবিতা একে অপরের পপরিপূরক।
কাফকার মতো, দস্তয়েভস্কির মতো, জীবনানন্দের মতো, পল্লব লেখে কারণ সে জানে, লিখতে না পারলে তাকে আত্মহত্যা করতে হবে।কাফকা বলেছিলেন, তিনি লেখেন কারণ অন্যথায় তিনি পাগল হয়ে যেতেন, এবং তিনি এ-ও জানেন যে লেখাই ইতিমধ্যে উন্মাদনা, এক ধরণের সতর্কতা, ঘুম থেকে বেঁচে ওঠা কোনও জাগরণের সাথে সম্পর্কিত নয়: অনিদ্রা। লেখা পাগলের বিরুদ্ধে পাগলামি, তখন। দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন সাফারিঙের কথা।নিরবধি এক বেদনার কথা। আর জীবনানন্দের প্রবাদপ্রতিম 'আমরা বেদনার সন্তান' তো আজ মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়।
পল্লবও তো 'স্বপ্নে আঁচড়ানো ছোটো আলো' কথা বলে,বলে 'সিল গালা বন্ধ লেফাফা'-র কথা। পল্লবও তো জানে, বারুদ আছে, ভেজাও নয়, তবু যতবারই ঘষছি,আগুন জ্বলছে না।
রবীন্দ্রনাথ এক শূন্যের কথা বলেছিলেন।'শূন্য করিয়া রাখ তোর বাঁশি বাজাবার যিনি বাজাবেন আসি।' তো এ কেমন শূন্যতা! আমরা জানি বাঁশি শূন্য হলে বাঁশি তো আর বাজে না, বাঁশির পূর্ণতা হাওয়ায়।আর এই হাওয়া শূন্য বাঁশি বাজাবারই কথা বলেন রবীন্দ্রনাথ।এক অদ্ভুত গোলকধাঁধার দিকে ঠেলে দেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ।এক প্যারাডক্স।
পল্লবও তার কাব্যগ্রন্থের নামকরণে আমাদের এই প্যারাডক্সের দিকেই নিয়ে যান।শূন্যই যদি হয় তার আবার প্রচ্ছদ হয় নাকি!অথচ পল্লবের কাব্যগ্রন্থের নাম 'শূন্যের প্রচ্ছদ'। আসলে পল্লব শূন্য থেকে শূন্যতায় পৌঁছাতে চায়।এই জার্নিটুকু তার আজীবন কবিতা-চর্যার ললাটলিখন। আর আমরা যারা এই পল্লবের এই যাত্রার সহযাত্রী 'রহস্য পোড়ানো ধোঁয়া', 'তামারং আপলের গল্প', 'ক্ষতের ভাস্কর্য', 'তর্কপ্রিয় শালিখ', 'কথার আলো', 'ভাষাহীন চিৎকার', 'সুতোর পৃথিবী' -কে অল্প অল্প চিনতে পারি।
অল্প অল্প চেনারই তো কথা।কবিতা কে কবে সম্পূর্ণ বুঝতে পেরেছে!স্বয়ং কবিও কী বুঝতে পারে সবটা।যেমন 'সত্যের মিথ্যা পাখি' কবিতাটি।
'সত্য এমন এক পাখি, যা কেউ দেখেনি, অথচ বিশ্বাস করে আছে।
আমার মেয়ের মতোই সেই পাখির ছবিও অনেকে আঁকে। যা অনেকটা পাখি,
কিছুটা মানুষ, মাছ, বিড়াল, গাছ, বাড়ি বা যা,খুশিও হতে পারে।
তবু সেই পাখি নিয়ে, পাখির গড়ন, ধরন স্পষ্টতা নিয়ে, কারও কোনও দ্বিধা,নেই।
প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মতো একটা পাখি এঁকে, রং ঢেলে দিয়েছে পালকে।
আর অমনি, সেই পাখি দু-পাখা ছড়িয়ে দিল আকাশে।
এ তো মিথ্যা! তোমার এই কথার সুরে, ডানা গুটিয়ে নেমে এল মাটিতে।
অবাক হয়ে দেখলাম, সমস্ত সত্যের পাখি আমাদের কাছে এসে মিথ্যা হয়ে গেছে।'
আমার কেন জানি মনে হয়েছে কবিতাটির নাম 'মিথ্যের সত্যি পাখি'-ও হতে পারত। কবিতা সবসময় আমাদের এই হ্যাঁ ও না-য়ের দোলাচলে রাখে।সত্য ও মিথ্যার,গ্রহণ ও বর্জনের, দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের দোলাচলে।
শূন্যের প্রচ্ছদ-ই তো।পাঁচ বছরের পুরোনো একটি বাতিল লিপস্টিকে চুলের কাঁটার পা লাগাতেই সে মেট্রোপলিস থেকে মফঃস্বলের দিকে হাঁটতে লাগল।আর চকপেন্সিল তার কাঁধে লাগাতে সে কুসুম নামের একটি মেয়ের হাত ধরল আর তাকে বোঝাতে লাগল মহাবিশ্বের সুন্দরী প্রতিযোগিতায় কুসুমও কিছু হতে পারে। এর পর পল্লব ভয়ঙ্কর এক পলিটিকাল কথা বলেছেন।বলেছেন, এই লিপস্টিক ও মেয়েটির গল্পে যারা বিশ্বাস করেন তাদের একদিকে রেখে অবিশ্বাসীদের নিয়ে একটা বাস সটান চলে যাচ্ছে লেনিনের কবর দেখতে।
আসলে আমরা যুগপৎ বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী, শিকার ও শিকারী, স্রষ্টা ও সৃষ্টি। আর তাই একটি প্রায়ান্ধ ময়ূর যখন দিগবিদিক ঝলমল করে ছুটে আসে তখন সাপের খোলসে ঢুকে যাওয়া কবিসত্তার যুগপৎ সাপ হিসেবে ভয় ও মানুষ হিসেবে মুগ্ধতা আসলে প্রত্যেক কবির ভবিষ্যৎ-ই তো।
রাজনীতি পল্লবের কবিতার পরতে পরতে।অথচ তা কখনওই উচ্চকিত নয়।যখন 'মামাকাহিনি'-তে যখন লেখেন, 'কানা-মামা হয়ে উঠছেন আরও বড়ো এক নেই-মামা' বা 'চেয়ার' কবিতায় লেখেন,মাননীয় মন্ত্রীর 'ঝকঝকে হাসি থেকে চেয়ারকে আলাদা করা যায় না বা 'বাণিজ্য সংগঠনতত্ত্ব' কবিতায় 'যেকোনো বন্ধুক কিনলেই ফুল ফ্রি' তখন আমরা পল্লবের চোরাগোপ্তা বারুদ টের পাই।
১৯৮২-তে পল্লবের বয়স কত? খুব বড়োজোর ১৮! অথচ সেই সময়ে পল্লব তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি লিখে ফেলেছে।'মরিল সুশীলা'! এত নিস্প্রিহ ও উদাসীন পল্লব যে সেই কবিতা প্রকাশ পাবে ৩৭ বছর পর ২০১৯-এ।তা-ও আংশিক।এবং আমার খোঁচাখুঁচিতে। আমি ওর খুদে অক্ষরে লেখা পাণ্ডুলিপির রাশি দেখতে দেখতে ভাবতাম, নিরভিসন্ধির এই দীক্ষা পল্লবকে কে দিল।শুধু তো হাজার দুয়েক কবিতা নয়, প্রায় ১০ টি উপন্যাস, ১০০ টি গল্প, অসংখ্য গদ্য এখনও বাক্সবন্দী হয়ে আছে।এই ক্রমাগত নিজেকে শূন্য করে ফেলা, নিরাভরণ করে তোলা ও মার্জিনের বাইরে নিয়ে যাওয়া ওকে কে শেখাল।
উত্তর অবশ্য পল্লবের কবিতাতেই পাই।শুরুতে যে দুজন পল্লবের কথা বলেছিলাম,তার একজন যখন কোনও প্রশ্ন তোলে, আরেকজন উত্তর দেয়। 'যেভাবে বাঁকিয়া গেলে সরলরেখারা ক্রমে বক্ররেখা হয়, ততটা জ্যামিতি আজও অধিগত হয় নাই।' আর তাই 'আমার ভিতর,রেখাটির স্বভাব ও সম্ভাবনা খেলা করে বহুদিন'!
এই 'সম্ভাবনা'-র জন্যই বারবার পল্লবের কবিতার কাছে ফিরতে হয়। যেমন এখানে পল্লবের একটি কবিতা আমি আমার মতো ব্যাখ্যা করেছি।
প্রথমে কবিতাটি।
কাহিনি
অনিশ্চিত কাহিনির অন্ধকারে একটি বিষণ্ণ সুতো ঝুলে আছে।
আজ ভোরে,তুমি এই সুতোয় সমস্ত আলো গেঁথে নিতে চাও।
সম্ভব? উদ্বেগের আবছায়া জুড়ে
একটি ব্যাকুল সুঁচ নিজেকেও হারিয়ে ফেলেছে।
এবার আমার আলোচনা:
অনিশ্চিত উদ্বেগ ব্যাকুল এই শব্দগুলো কবির একধরনের মানসিক আবহাওয়া তৈরি করেছে...কী বলতে চাইছেন কবি?
অনিশ্চিত কাহিনির অন্ধকারের গল্পই তো শোনাতে চাইছিলেন কিন্তু একটা বিষণ্ণ সুতো কীভাবে এত নিশ্চিত হয়ে ধরা দিল?
সুতো মানে তো বুনন...একটা সম্ভাবনা...প্রবাহ... সম্ভাবনা।
আলো গেঁথে নিতে হবেই তো এই সুতোয়।কিন্তু প্রশ্ন এই আলোর স্বরূপ কী? অন্ধকারের প্রতিশব্দ এখানে আলো বলে আমার মনে হয় না...এই আলো এক আলাদা আইডেনটেটি...যে নিজের পরিচয়ে মাথা তুলতে পারে...এই আলো অক্ষর...দৃকপাত... কামনা।
উদ্বেগ শব্দটির এক দিগন্ত জোড়া বিস্তৃতি আছে...অনিশ্চিত দিয়ে যার শুরু সে তো সম্ভবনায় প্রশ্নের যতি রাখবেই।কিন্তু প্রশ্ন হল সুঁচ ব্যাকুল কেন?
আলোর মতো অক্ষর যারা গেঁথে নিতে চায় তারা তো শাপগ্রস্ত...তাদের নীটসের মতো হেরাক্লেটাসের মতো রিলকের মতো ব্যাকুল না হয়ে যে উপায় থাকে না।এই কবিতা সৃষ্টিরহস্যের কবিতা...সকল সাধকের কবিতা...প্রাণের চিহ্ন সেঁটে আছে এই কবিতায়।
সাধকের কাছে তাঁর ইষ্ট স্পষ্ট নয়...কবির কাছে তাঁর কবিতা...প্রেমিকের কাছে প্রেম।বারবার হারিয়ে ফেলে খুঁজে নিতে হয়।
ধীরে ধীরে অন্ধকারের খোলস ভেঙ্গে আলো ফোটে...ছায়া...আবছায়া...অকস্মাৎ যদি দেখা মেলে তার।
আমি ব্যক্তিগতভাবে পল্লবের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি কিছুকিছু পড়েছি এবং আমার মনে হয়েছে এক্ষুনি অন্তত ১০ টি বই প্রকাশিত হওয়া জরুরি।তাতে বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত প্রসারিত হবে।বিশেষত অমন দীর্ঘ কবিতা ও একেকটা ঘোরে লেখা গুচ্ছকবিতা বাংলাভাষায় আগে খুব কমই লেখা হয়নি।
পল্লবের পড়াশোনা ঈর্ষণীয়। সাহিত্য, তন্ত্র, ইতিহাস ও দর্শনে ওঁর দখল আমাকে বারবার মুগ্ধ করেছে।বেশি কথা বলে না, যতটুকু বলে সারদিন তার রেশ গুনগুন করে।
বারবার পল্লবের লেখা মার্জিনের বাইরে চলে যায়, কেন্দ্রচ্যুত হয়, ভাষাহীন হয়।ভাষা নিয়ে, প্রান্তিক মানুষজন নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে এত ভাবুক মানুষ খুব কম দেখেছি।আপাতভাবে দেখে কে বলবে ও একজন উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা।
এখানে পল্লবের কয়েকটি কবিতা:
১.
একটু ঝুঁকে, তিনি দেখেন, পুরুষের বুকে এক বাড়তি পাঁজর। যা তাকে
টেনে নামিয়ে আনছে মাটিতে।
শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে, তিনি পুরুষের বুক থেকে উপড়ে ফেললেন
সেই পাঁজর। আর তা দিয়ে সৃষ্টি করলেন ছায়ার বিভ্রম, গ্লানি,
সৌন্দর্য-ছলনা
সেই থেকে, পৃথিবীর পুরুষদের বুকে এক গভীর শূন্যতা আর হাহাকার।
তাদের ফুটো নৌকা ভেসে যাচ্ছে অতলের সমুদ্রের দিকে।
২.
আকৃতির ভেতরেই আকৃতি ভাঙ্গার বাষ্প আকাশের চিঠি
অনক্ষরে লেখা হয়।কতটুকু পড়ি?
৪.
আদা ব্যাপারির প্রতি জাহাজের ঈষৎ বাঁকানো ডেক,আড়কথা
বন্দরের আগে রান্নাঘরে পৌঁছে গেলে,মহিলারা টের পায়
পুং মনস্তাত্ত্বিকতা...
পল্লব নিজের 'আত্মচরিত' এভাবে লেখেন :
অদ্য রোজ ১৫ আষাঢ়, ১৩৯০ বাং বিকাল ৪ ঘটিকায়, ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ আমাতে নগ্ন সরস্বতী কৃপা করিলেন জানিয়া, গুণরহিত আমি অই গোলক দেখিতে পাই।
লেখেন:
শুধু অই রুবিসদৃশ আভা, জলরং স্বচ্ছতায়, বাংলা ঘরাণার উপস্থাপনে, যেরূপে আমার সংজ্ঞাহীনতা অবারিত করিল, তাহাতে কুন্দ বল, --- অই গোলক লইয়া আমি কী করিব!
পল্লবের কবিতা পড়তে পড়তে পল্লবেরই কবিতার লাইন মনে পড়ে:
তবে কী এখনও পড়ি, পড়তে চেষ্টা করি, ডানা।
পালক ঝরছে, কেউ উড়াল জানি না।
পল্লবের কবিতায় ডানা পড়ি,পালকও ঝরছে সেই কবিতায়,কিন্তু বড়ো উড়াল দেখি।
আমি খুব আনন্দিত যে পল্লব আজ গৌতম বসু সম্মাননা পাচ্ছেন।