এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ছোটগল্পঃ অমেরুদণ্ডী

    বিশুপাল লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৪৮৮ বার পঠিত
  • (বাইশ গজের বাইরে  বইমেলা ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত। লেখকঃ বিশুপাল)
     
     
     

    হঠাৎ ভীষণ শীত করছে।

    সকালে যদিও এমন কোনও পূর্বাভাস ছিল না। আর বছরের প্রথম বসন্তদিনের মতই। বাতাসে হিমঋতুর রেখে যাওয়া জমাট শৈত্যের অধঃক্ষেপটুকু বাদ দিলে বাকিটা দিব্যি শরৎ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।

    ঘুম ভেঙে বাইরে বেরোতে তবু কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল।

    স্বাভাবিক, বয়স হয়েছে--- আজকাল শরীর আগের মত সাড়া দেয় না। বিশেষত... তিন মাস জড়বৎ পড়ে থাকার পর।

    প্রায়ান্ধকার বিবরে আলস্য জড়িয়ে শুয়েছিলাম। চোখের অনচ্ছ পর্দায় আঠার মত লেপ্টে থাকা দীর্ঘ নিদ্রা যাই-যাই করেও চিলতে লেগে থাকে। প্রাণের স্পন্দন, সে তখন কেবল হৃদপিণ্ডের মৃদু ওঠাপড়ায়। এমন সময়...

    মৃত্তিকার অভ্যন্তরে শুয়ে বাইরের জগতের কম্পন রীতিমত টের পাওয়া যায়। তরঙ্গের পর তরঙ্গের আকারে তারা বয়ে আনে রকমারি বার্তা। কোনওটা শিকারের, কোনওটা শত্রুর। আজ সকালেরটা অবশ্য এ দুটোর একটারও ইঙ্গিতবাহী ছিল না।

    কিন্তু ভারী চেনা কম্পন। সুষুপ্তির আবরণ ভেদ ক’রে এক নিমেষে বুকের শীতল রক্তে চাঞ্চল্য ধরিয়ে দেয়। উদাসীন কৌতূহল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

    বুকে ভর দিয়ে দীঘল শরীরটাকে ঘষটাতে ঘষটাতে নিয়ে আসি মাটির উপরে। দীর্ঘ অনভ্যস্ততায় চোট লাগে, গ্রাহ্য করি না।

    একটুকরো কমলা সূর্যের মায়াবি দ্যুতিতে চরাচর মাখামাখি। সে উদ্ভাস যদিও আমার চোখে ধরা পড়ে ফিকে নীল রঙে... প্রজাতিগত অভিশাপ! আকন্দ ঝোপের ওধারে চিত্রার্পিত দাঁড়িয়ে চৌকোণা বাগান। অযত্নের আগাছায় ভরে উঠেছে, তবু আজও নয়নাভিরাম। সীমানা বরাবর সার দিয়ে নীরব দর্শকের মত অপেক্ষমান বনস্পতি। সবাই যেন মুগ্ধ চোখে দেখছিল বাগানের মাঝখানে বিবর্ণ ঘাসের উপর দিয়ে একজোড়া সতেজ পায়ের ক্ষিপ্র চলাফেরা।

    খোকা!

    মুগ্ধ দুই নিষ্পলক চোখ মেলে নিজেও তাকিয়ে ছিলাম। আয়তাকার কপালের উপর এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা চুল, কয়েকটা ঘামে লেপ্টে। নাকের ডগাতেও জমে একবিন্দু ঘাম। গালগুলো সামান্য ভাঙা, চেহারা আগের চাইতে আরও শীর্ণ হয়েছে, কেবল পা দুটো ব্যতিক্রম। একটু লম্বাও হয়েছে কি? ঘোলাটে দৃষ্টিতে ঠিকমত ঠাহর করতে পারিনি। সবকিছু ছাপিয়ে আমায় টানছিল খোকার চোখদুটো। একাগ্র দৃষ্টি নিবদ্ধ পায়ের সামনে সঞ্চারমান অবাধ্য চামড়ার ফুটবলটায়। এক মুহূর্তের জন্যও সরছে না লক্ষ্য থেকে।

    কী এক অদ্ভুত মায়াময় বিষাদ জড়ানো ঐ চোখে! দূর অতীতের ঝাপসা এক অবয়বকে মনে পড়িয়ে দেয়।

    সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ চোখে পড়ল আকন্দ ঝোপটার দিকে এগিয়ে আসছে চামড়ার গোলাটা। পিছু ধাওয়া ক’রে একজোড়া চঞ্চল পা। কুণ্ডলি পাকানো শরীর প্রস্তুত ছিল না, তবু মস্তিষ্কে চকিত বার্তা যেতে স্থবির দেহটা খোলস সমেত টেনে হিঁচড়ে চালান করতে হয় ঝোপের আড়ালে। ঘুণাক্ষরেও যেন ও টের না পায় আমার অস্তিত্ব!

    যেমনটা পায়নি গত দশ বছর। এভাবেই ওর চোখের আড়ালে রয়ে যেতে চেয়েছিলাম বরাবর।

    খোকা দেখতে পায়নি আমায়। পোড় খাওয়া খেলোয়াড়ের মত বলটা পায়ে নাচাতে নাচাতে চলে গেল অন্যদিকে। বল তখন আবার ওর সবুজ আভা ফুটে ওঠা সাদা কেড্‌স-এর একান্ত অনুগত পোষ্য।

    জরাগ্রস্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়ে খানিক দম নিতে হল। সময় ক্রমশ তার ছাপ ফেলতে শুরু করেছে দীর্ঘ বিসর্পিল চেহারায়। ক্ষণিক উত্তেজনার ধকলে কোষগুলোয় চুঁইয়ে পড়ছে অবসাদ। ভাগ্যিস বলটা খুব কাছে এসে পড়েনি! সাবধানী দৃষ্টি ইতিউতি ফিরিয়ে দেখতে পেলাম খোকা দক্ষিণ প্রান্তের ন্যাড়া জামগাছটার কাছে।

    ভয়? না এক যুগ ধরে বুকের উপর জগদ্দলের মত চেপে থাকা অপরাধবোধ?

    কুশলী দুই কিশোর পায়ে চামড়ার বলটাকে কথা বলাতে বলাতে সে চষে বেড়াচ্ছিল মাঠের আনাচকানাচ। উঁচু গাছেদের নীচে অবাঞ্ছিত আগাছার ভিড়ে পথ মানুষের দুর্গম, কোথাও চোরকাঁটায় ছেয়ে আছে ঘাসের আস্তরণ। সেসবের তোয়াক্কা না করে প্র্যাকটিসে মগ্ন এক তের বছরের ছেলে--- তের, নাকি চোদ্দ? কালের হিসেব কবেই ঘুলিয়ে গেছে।
     
    অজান্তে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। এই মায়াবি সকালে জনপ্রাণীহীন প্রান্তরে খোকার নিঃশব্দ সাধনা--- ব্যতিক্রম কেবল ওর পায়ের আঘাতে একটানা ছন্দে বলের ধপ্‌ধপ্‌ শব্দ--- এসব কেমন অপার্থিব মনে হয়। অনিমেষ দৃষ্টি ফেরাই মাঠটার দিকে। একসময়ের সাজানো বাগান... বৌমণির কত আদরের বাগান! আজ তার পরিণতি এই কঙ্কালসার ধ্বংসস্তূপ!

    শুধু কি বাগান? ঘুরতে ঘুরতে নজর চলে যায় অদূরে চৌধুরীদের বন্ধ গুদামঘরের দিকে। ভারিক্কি দরজায় অতিকায় তালা ঝুলছে। তালার বয়সও বোধ করি আজ দশ বছর।

    বৌমণি নিজে একা যায়নি, সঙ্গে করে নিয়ে গেছে ঐ বাড়ির সমস্ত প্রাণোচ্ছলতা। যেন বাড়িটার হৃদ্‌পিণ্ডটাই কেউ সমূলে উপড়ে দিয়েছিল সেই দিনটায়।

    সেই অভিশপ্ত দিনটায়! যেদিন আমার এই একাকী দুর্বিষহ পথচলার শুরু।

    চামড়ার নীচে সঞ্চিত বহু পুরনো ক্ষতে ফের ব্যথা পাওয়ার মত চিনচিনে অনুভূতিতে টাটিয়ে ওঠে মন। আপ্রাণ চেষ্টা করি সে ভয়াবহ স্মৃতিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে। নইলে যে...

    বেলা বাড়ছে, রোদের তাপও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। খোকার অনুশীলনে কিন্ত বিরাম নেই। মসৃণ গতিতে ফুটবলটাকে সঙ্গী করে সে দৌড়ে চলেছে বৃত্তাকার মাঠের সীমানা বরাবর। অসমান ভূমি, মাটির গহীন থেকে হঠাৎ উদয় হওয়া অশ্বত্থের চারা, পিঁপড়েদের ঢিবিপাহাড়ের ঢাল--- কিছুই তার ছন্দে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

    সূর্যের তেজে তেতে উঠছে মাঠের জমি, নিজের শরীরে সে তাপের স্পর্শ টের পাই। টানা শীতঘুমে শরীর এখনও অবসন্ন। খাবারের জোগাড় না দেখলেই নয়, কিন্ত মন সায় দেয় না। ঝোপের আড়ালে খানিক নির্জীব পড়ে থাকি। খোকাকে আজ ভোরে দেখা ইস্তক পুরনো কথারা ভিড় করে আসছে চোখের পাতায়।

    আজও স্মৃতিতে টাটকা ওকে প্রথম দেখার মুহূর্তটা। বৌমণি একটা সাদা গাড়িতে চড়ে এসে নামল চৌধুরীবাড়ির সদর দরজায়, কোলের মধ্যে সযত্নে লুকনো একরত্তি মাংসের ডেলা। কনকচাঁপার মত রঙ অনেকটা জ্বলে গেছে, কিন্ত ফ্যাকাশে মুখে জগত আলো করা উজ্জ্বল হাসি। তার সাথে মিশে মাতৃত্বের প্রচ্ছন্ন গর্ব। বাতাসী বলেছিল মা হলে নাকি সব মেয়েদের মধ্যেই অমন চাপা অহঙ্কার আসে।

    কী পরম মমতায় আর যত্নে বৌমণি আগলে রাখছিল খোকাকে। যেন হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া সাত রাজার ধন এক মানিক।

    সেই শুরু, তারপর আমাদের চোখের সামনে খোকার একটু একটু করে বেড়ে ওঠা। ওর এক বছর বয়স হতে না হতেই মায়ের হাত ধরে টলমল পায়ে হাঁটতে আসত মাঠের দিকে। সেদিনের বৌমণির পরিচর্যা করা বাগানের সাথে আজকের এই আগাছার জঙ্গলকে মেলানো শক্ত। বৌমণি প্রায় সময় একাই নিয়ে আসত খোকাকে, কখনও সঙ্গে পীতবাস--- চৌধুরীদের গুদামের কাজের লোক। বেজায় প্রভুভক্ত, তেমনি খোকার ন্যাওটা। অবশ্য ঐ ফোকলা মাড়ির অনির্বচনীয় হাসি দেখলে ত্রিভুবনের যে কেউ বশ হয়ে যেত।

    বৌমণিই আমাদের চিনিয়েছিল খোকাকে। আদর করে বলত, “বাস্তুসাপ”। দূর থেকে একটু একটু ক’রে নতুন খুদে মানুষটার সাথে আলাপ-পরিচয়। চিরন্তন মাতৃহৃদয় অকল্যাণের আশঙ্কায় আকন্দ ঝোপের চৌহদ্দি এড়িয়ে গেলেও সে দূরত্বে ব্যবধান বাড়েনি। ওদের ভিটের আশেপাশে নির্ভয় গতিবিধি ছিল আমার, পরে আমি আর বাতাসী--- দুজনেরই। গুদামের ডাঁই করা চালের বস্তার দৌলতে মেঠো ইঁদুরের অঢেল জোগান--- সেসব আমরা দুজনে মহানন্দে সাবাড় করতাম। কর্মচারী আর মালিক--- উভয় পক্ষের সস্নেহ প্রশ্রয় ছাড়া সম্ভব হত কি?

    শুধু একটিমাত্র লোক আমাদের সুনজরে দেখত না। পীতবাস। সম্ভবত বাতাসীর ফণার নীচে লুকনো বিষের থলির অস্তিত্ব টের পেয়ে গিয়েছিল সে কোনওভাবে, কিংবা... কে জানে! বাতাসীও মোটে বরদাস্ত করতে পারত না লোকটাকে। তখন অবশ্য দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি যে একদিন...

    বুকের ভিতর লুকনো ব্যথার উৎসটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠছে। জোর করে চেষ্টা করি মনকে বর্তমানে ফেরানোর। মাঠের দিকে দৃষ্টি যেতে ভিতরটা আচমকা ছ্যাঁত করে ওঠে।

    রোদের ক্রমবর্ধমান তাপ থেকে বাঁচতেই বোধহয়... খোকা এখন দৌড় থামিয়ে খানিক জিরোচ্ছে। মাঠের মধ্যে দিনের এসময়ে ছায়া বড় অমিল, একমাত্র পুবদিকটা বাদে। সারা শরীর বেয়ে ঝরনার মত গড়িয়ে পড়া স্বেদবিন্দু দুহাতের তেলোয় মুছতে মুছতে খোকা ওদিকটাতেই গিয়ে বসেছে, গাবগাছটার তলায়।

    ওখানেই তো কিছু মাস হল ডেরা বেঁধেছে দুই আগন্তুক! এ তল্লাটে আগে কেউই ওদের দ্যাখেনি।

    পুরনো মুখেরা একে একে বিদায় নিচ্ছে, নতুনদের আনাগোনায় নিজের বহুদিনের আবাসভূমি আজকাল অচেনা ঠেকে। তবু স্বজাতিদের মধ্যে পারস্পরিক সহাবস্থানের কারণে কিছুটা চেনাজানা হয়েই যায়। আসল কারণ খাদ্যশৃঙ্খল, কে আর চায় শিকারের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে অযথা ঝামেলা ডেকে আনতে! শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থা--- নিজের মত থাকো, খাবার জোগাড় করো, পড়শির খাবারে নজর দিও না।

    ছোট-মাঝারি সদস্যদের এতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। গোলমাল বাধে অতিকায়দের ক্ষেত্রে। জগতের চিরকেলে নিয়ম, ক্ষমতা বেশি হলে অল্পে মন ভরে না। আর ঠিক সেটাই হয়েছে নবাগত ঐ দম্পতির বেলায়। মিটার আড়াই লম্বা কুৎসিত মদ্দটা বয়সে একেবারে নবীন নয়, টেনেটুনে মধ্য-প্রাচীন বলা চলে। বুদ্ধিমান সে নিজেও নিজেকে বোধ করি ভাবে না, তবে খামতিটা গায়েগতরে পুষিয়ে দেয়। শিকারে বাছবিচার নেই, নেই নীতিজ্ঞানের বালাই। যথেচ্ছভাবে নিজের ও সঙ্গিনীর উদরপূর্তি ছাড়া তার অন্য কোনও মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হয় না।

    সঙ্গিনীটি প্রায় সর্বার্থেই এর উল্টো। ছিপছিপে হিলহিলে দেহকাণ্ড, নিকষ কালো রঙের আঁশে আলো ঠিকরে যায়। হিংস্র দাঁতের সৌন্দর্যে সংবৃত তার মারাত্মক বিষের ভাণ্ডার। শঙ্খিনী গতিতে মেশানো লাস্য আর ঠমক জানান দেয় যৌবন অস্তে যেতে ঢের দেরি। চলার দৃপ্ত ছন্দে শক্ত ঘাটে নৌকো বাঁধতে পারার আত্মবিশ্বাস।

    আমায় সে প্রথম দেখাতেই অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সম্ভবত নারীর ষষ্ঠেন্দ্রিয় টের পেয়ে গিয়েছিল নিঃসঙ্গ পুরুষের ঠাণ্ডা রক্তের নিভু-নিভু তেজ।

    অনেক অ-নে-ক বছর আগে, বহুযুগের ওপারের কোনও এক স্বর্ণালি অতীতে বাতাসীও এভাবেই প্রথম দেখায় জানান দিয়েছিল ছদ্ম অবজ্ঞা। শরীরে তখন তার সদ্য যৌবনের ঢল নেমেছে, প্রকৃতি সাজিয়ে দিচ্ছে নিত্যনতুন অলঙ্কারে।

    তফাৎ একটাই--- আমার নিজের সর্বাঙ্গেও তখন দাপাদাপি করছে উন্মত্ত রক্তকণিকারা। প্রতি গ্রন্থিতে অবরুদ্ধ পৌরুষের আস্ফালন। অভিমানিনীর দর্প ভাঙতে বেশিদিন লাগেনি।

    পোষ মেনে যাওয়ার পরে সে ধরা দিল সম্পূর্ণ অন্য রূপে। বিষের থলির গভীরে অন্তঃস্থলে এত মায়া, এত মাধুর্য লুকিয়ে থাকতে পারে ধারণাতেও ছিল না। খানিকটা সে ধীরে ধীরে সঞ্চারিত করল আমার মধ্যে। ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছিলাম আমি, অজান্তেই। রুক্ষ উষর মাটির প্রথম বর্ষায় ধারাস্নানের মত।

    কোথায় কোন চুলো থেকে এসেছিল সে তথ্য কিন্তু অজানাই রয়ে গেল। প্রশ্ন করলে শুধু মিটিমিটি হাসত রহস্যময়ী। আর উচ্ছল মুহূর্তগুলোয় পাকে পাকে জড়িয়ে ধরত নিবিড় আশ্লেষে।

    এতদিন পরে বিস্মরণের পর্দা ভেদ করে স্মৃতিরা কখন ভাসিয়ে নিয়ে গেছে খেয়াল নেই। হুঁশ ফিরতে দেখি গুটিগুটি চলে এসেছি গুদামঘরের পিছন দিকটায়। এখান থেকেও কম্পন অনুভূত হচ্ছে কেডস পরা একজোড়া দামাল পায়ের। খোকার বিশ্রামপর্ব তবে শেষ। যাক, গাবগাছের সামনে থেকে সরেছে এটুকু নিশ্চিন্তিই অনেক।

    গোটা দুই ধাড়ি ইঁদুর চোখে পড়ে, বোধহয় দলছুট হয়ে রসদ খুঁজতে বেরিয়েছে। বেচারাদের দেখে অনুকম্পা জাগে--- লোল দেহে বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট। বয়স তবে শুধু আমারই হয়নি!

    পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। কৃশকায় ইঁদুরটা আমার অস্তিত্ব জানতে পেরে পড়িমরি দৌড় দিল, তুলনায় স্থূল জনের সে সৌভাগ্য হল না। ঠাণ্ডা, দরকচা মেরে যাওয়া মাংস, গলা দিয়ে পাকস্থলীর দিকে নামার সময়ই টের পেলাম। হাহ্‌, শেষ বিচারের অপেক্ষায় থাকা আসামীর আবার স্বাদগন্ধবিচার! জঠরের পূর্তি... আর কী চাই!

    শরীরের ভেতরের কলকব্জায় জং পড়তে শুরু করেছে--- সেটা আজকাল সব থেকে বেশি টের পাওয়া যায় খাবার হজম করতে গেলে। জীবনীশক্তির অন্তিম বিন্দুটুকু খরচ করে জারক রস নিঃসৃত হয়, প্রতিবারই মনে হয় এই বুঝি শেষ খাওয়া।

    কিছুক্ষণ স্থাণুবৎ পড়ে থেকে জিরোনোর ইচ্ছে চাগাড় দিচ্ছিল, সহসা বিজাতীয় তরঙ্গের আগমন। কেউ যেন গুদামঘরের দরজাটা খোলার চেষ্টা করছে। এতদিন পরে কে...

    কিন্তু আমার এদিকে সাড়ে সর্বনাশ! এক্ষুণি এখান থেকে না পালালেই নয়। দরজা খোলার চেষ্টা যে করছে--- গুদামের পুরনো লোক হওয়ার সম্ভাবনা কম, আর দশটা বছর পেরিয়ে এসে এই আমি-কে চিনতে পারবে সে আশঙ্কাও ক্ষীণ। তবু... তবু পালানো দরকার। ভয়ের কীটেরা সারা পিঠ জুড়ে কামড় দিতে শুরু করেছে।

    উদ্ভট এক বিসর্পণে দূরে যেতে থাকি। যেভাবে এতকাল পালিয়ে বেড়িয়েছি সকলের থেকে। নিজের থেকেও।

    সূর্য এখন দিগন্তরেখার অনেক উপরে। প্রহরীর মত বাগান আগলে রাখা উঁচু গাছেদের ছায়াগুলো জড়ামড়ি ক’রে আচ্ছন্ন রেখেছে বিস্তৃত ঘাসজমির একাংশ। আলো-আঁধারির সে বীথিকার মাঝে অক্লান্ত দৌড়ে চলেছে নাতিদীর্ঘ এক অবয়ব। একের পর এক অদৃশ্য প্রতিপক্ষের বাধা পেরিয়ে। মাঠের সীমানার বাইরে থেকে ম্রিয়মাণ উরগদৃষ্টি স্পষ্ট দেখতে পায় না, শুধু অনুভবে ধরা পড়ে ঐ কিশোর বুকের ধুকপুকুনি।

    বিচিত্র দেহবিভঙ্গে চামড়ার গোলকটা নিয়ে নানা কসরতে ব্যস্ত খোকা। বল তার পা থেকে হাঁটু, সেখানে খানিক অবস্থানের পর উরু, কোমর বেয়ে আবার পায়ের তলায়, হঠাৎ এক আঘাতে মাথার উপর, অবশেষে ঘাড়ের খাড়াইতে থিতু হয়। এক... দুই... পাঁচ সেকেণ্ডের বেশি স্থায়ী হয় না এই ভারসাম্য। কিন্তু লড়াই ছাড়ে না নাছোড় খেলোয়াড়।  ঠোঁট কামড়ে নেমে যাওয়া মোজাদুটোকে ফিরিয়ে আনে স্বস্থানে, আবার সংগ্রাম শুরু করে। অবাধ্য বল বাগ মানতে চায় না, বেয়াদপি করে ফের। অভিকর্ষের সাথে যৌথ ষড়যন্ত্রে পরাস্ত হয় খেলোয়াড়ের কৌশল। আবার, আবার। আর প্রতিটি পরাজয়ের শেষে তার চোয়ালে ফুটে ওঠা সঙ্কল্প দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর আকার নেয়। যতক্ষণ না বারংবার আহ্বানে ধ্বস্ত ফুটবলটা বাধ্য হয় আত্মসমর্পণে।

    পাক্কা পনের সেকেণ্ড একহারা শরীরটার ঘাড়ের শীর্ণ অধিত্যকায় গোলাকার বলটাকে বশ মানিয়ে যখন সেটা আবার মাটি ছোঁয়, খোকার মুখে অনাবিল সারল্যের হাসি। অবিকল তার এক বছর বয়সের ফোকলা মাড়ির প্রতিচ্ছবি যেন। ভাঙতে শুরু করা গালের টোলে অভিজ্ঞান রয়ে গেছে আরেকজনের।

    বৌমণিও এভাবেই ছোট্ট টোল ফেলে হাসত, মুখটা সামান্য টিপে। সে হাসিতে মিশে থাকত কৌতুক। বিশেষত যখন বাতাসী আর আমাকে দেখত--- শঙ্খলাগা অবস্থায়।

    প্রথমবার দেখে ফেলার কথাটা এখনও মনে আছে পুঙ্খানুপুঙ্খ। চৌধুরী বাড়ির নবোঢ়া বউ কোনও কালেই আমাদের দেখে ভয় পায়নি, বরং গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করত। তবে সবটাই দূরত্ব রেখে। নতুন সংসারের আহ্লাদের গন্ধ তখনও তার গায়ে লেগে।

    বাতাসী আর আমার মধ্যেও জড়তা তখন পুরোপুরি কেটেছে কি? তার শরীরের আঘ্রাণ পেয়েছি নিয়মিত, কিন্তু দুস্তর মনের সন্ধান নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে। মাঝেমাঝে মনে হত সে যেন স্বেচ্ছায় থাকতে চায় ধরাছোঁয়ার বাইরে, কুহকের আড়ালে।

    হায় মূর্খ মানুষ! তোমরা ভাবো আমাদের যত রিরংসা, যত লিপ্সা--- সবের সমাপ্তি নিছক প্রজননে? একটিবার যদি দেখতে তার উপেক্ষার হাসি… শীতল রক্তে কী অবলীলায় দাবানল লাগিয়ে দিতে পারে!

    তবু জৈবিক তাড়নায় মিলিত হতাম আমরা। তেমনই একদিন, প্রকৃতি তার দুর্নিবার ডাক দিল। খোলা আকাশের নীচে সে-ই প্রথম। বাতাসী শুরুতে খানিক আপত্তির ছলনা করেছিল। চিরাচরিত নিয়মে সে রাশ আলগা হতে বেশি দেরি হয়নি। দুজনের উষ্ণ নিঃশ্বাসে ঘন হতে শুরু করেছে ঘাসবনের বাতাস, হঠাৎ কার পায়ের লঘু ছন্দ ধরা পড়ল ইন্দ্রিয়ে।

    বাতাসীর মসৃণ দেহ পলকে টানটান, ঘনসন্নিবদ্ধ অবস্থায় টের পেলাম তার ফণার নীচে জড়ো হচ্ছে বিষ।

    আসন্ন বিপদের সঙ্কেতে আমার অস্ত্রগুলোতেও শান দিচ্ছি, আচমকা একরাশ অন্ধকার ঘিরে ধরল আমাদের। সুতির বুনটে ঘেরা শাড়ির নিরাপদ আচ্ছাদন। আর... আঁচলের ফাঁকফোকরে দৃশ্যমান কৌতুকে টইটম্বুর টোল পড়া পানপাতা মুখশ্রী। আচম্বিতে বাতাসী কেমন শান্ত হয়ে গেল।

    দুই অসম প্রজাতির নারীর নীরব বন্ধুত্বের সেই শুরু।

    খোকাকে সঙ্গে নিয়ে তার মা যখন বিকেলে বেড়াতে বেরোত, আরেক নারী নিঃশব্দে পাহারা দিত বাগানের সীমারেখা। কোনও মনুষ্যেতর জন্তুর সাধ্য ছিল না সে সময়ে বাগানে ঢুকতে পারে। খোকার অমঙ্গলের ভয়ে সচরাচর নিজেও যেত না তার খেলাঘরের ত্রিসীমানায়। বোধহয় নিজের বিষের থলিকে ভয় ছিল তার। দৈবাৎ লাল রঙের কসকো বলটা খোকার কচি পায়ের আঘাতে বাতাসীর দিকেই উড়ে এলে পড়িমরি ক’রে গর্তে গিয়ে সেঁধোত।

    প্রতিদানে কমতি ছিল না অন্য পক্ষের। শঙ্খ লাগার সময়ে শাড়ি-চাদরের নিরাপদ আশ্রয় তো বটেই... গুদামের চারপাশে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়ানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কার অদৃশ্য নির্দেশে। কলে ধরা পড়া বেচারি ইঁদুরগুলো কাকতালীয় ভাবে মুক্তি পেত আকন্দ ঝোপের ভীষণ কাছাকাছি।

    আর এসবের মধ্যে বৃষ্টিভেজা মাধবীলতার ঝোপের মত একটু একটু ক’রে বেড়ে উঠছিল খোকা। বাড়তে বাড়তে আজকে যার মাঝে ভবিষ্যতের এক মহীরুহের আভাস। শুধু... বৌমণি যদি দেখতে পেত!

    আর, বাতাসীও।

    মাঠের পূর্বদিকের কয়েকটা গাছ খুব কাছাকাছি ঘেঁষে উপবৃত্তের একফালি অংশ তৈরি করেছে। তাদের প্রতিটা গুঁড়ি থেকে এখন পর্যায়ক্রমে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসছে সাদা-কালো চামড়ার বলটা। ভোর থেকে তার উপর হয়ে চলা একটানা অত্যাচারের জুলুমে এখন সে ক্লান্ত, কেবল একনাগাড়ে তামিল করে চলেছে প্রভুর হুকুম। বলের উপর আধিপত্য কায়েম করা প্রভুর মধ্যে অবশ্য সে ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। অখণ্ড মনযোগে সে শট মেরে চলেছে--- ডান পা বলের কয়েক আঙুল দূরে বাইরের দিকে তেরছা ভাবে রেখে, বাঁ পায়ের নমনীয় চেটোর মিঠেকড়া টোকায়।

    অবিকল যে ভঙ্গিতে তাকে শৈশবের কসকো বলটা মারতে শিখিয়েছিল পীতবাস।

    চোখের সামনে মাঠের দৃশ্যপট একই রইল, শুধু সময়টা আচমকা পিছিয়ে গেল দশ বছরের ওপারে। ঐ তো খোকা, পায়ের সামনে পড়ে আছে এখনকার ফুটবলের এক খুদে সংস্করণ। খোকা নিজেও খুদে ছোট্টটি, মহানন্দে লাফাতে লাফাতে এলোপাথাড়ি লাথি মারছে বলে। অধিকাংশই লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে... আর উল্টোদিকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে প্রভুভক্ত পীতবাস। সোল্লাসে নির্দেশ দিয়ে চলেছে তার আদরের ‘খোকাবাবু’কে, কীভাবে এক শটে বাগান পার করা যায়।

    আর, আর... পীতবাস ও আমার মাঝে সমকৌণিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘাসের আড়ালে নীরব দর্শক হয়ে লুকিয়ে বাতাসী। বিমোহিত দৃষ্টিতে একই সাথে খেলা ক’রে যাচ্ছে বাৎসল্য আর উদ্বেগ।

    কিন্তু বৌমণি কোথায়?

    ভাবতে ভাবতেই পীতব্যাসের পরিশ্রম সার্থক ক’রে খোকার জীবনের প্রথম দূরপাল্লার শট। বিকেলের উত্তুরে হাওয়ার দাপটে ভর দিয়ে সটান এসে পড়ল বাতাসীর সংবৃত ফণার থেকে ইঞ্চিখানেক দূরে।

    ক্ষণিকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল কি সে? খোকাকে দেখতে ব্যস্ত ছিল, না বিচিত্র ভাবনায় আটকা পড়ে গিয়েছিল তার রহস্যময়ী মন?

    উত্তরটা জানার সুযোগ হয়নি কখনও।

    শুধু দেখতে পেয়েছিলাম বল নিতে উদ্যত আগুয়ান পীতবাসকে দেখে বাতাসীর চোখে বীতরাগের ঝলক। পরমুহূর্তে দেরি না ক’রে ত্বরিতগতিতে পিছু ফেরা--- আকন্দ ঝোপের উদ্দেশে। এতসব হঠাৎই কয়েক লহমায় ঘটে যাওয়ায় সেও লক্ষ করেনি পীতব্যাসের ঠিক বিপরীতে, আকন্দ ঝোপের দিক থেকে আসা আরেক জোড়া পায়ের মৃদু কম্পন।

    বৌমণি কখন আর কী কারণে সেদিন আমাদের বসতের অত কাছে গিয়েছিল--- এর উত্তর আজও আমার কাছে এক বিরাট প্রহেলিকা। কেবল কতগুলো খণ্ডমুহূর্ত দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া ক’রে বেড়ায়। সহসা প্রতিবর্তের তাড়নায় আনমনা বাতাসীর উদ্যত ফণার ছোবল, বৌমণির আর্তনাদ আর খোকার চিৎকার--- পাথরের মত নিশ্চল ক’রে দিয়েছিল আমায়।

    পড়ে থাকা একটা ভাঙা কঞ্চি তুলে নিয়ে পীতবাস যখন বিহ্বল বাতাসীর ঠিক ঘাড়ের নীচে এক কোপ বসাল তখনও সাড় ফেরেনি আমার শরীরে। অসহায় দৃষ্টিতে দেখলাম উপর্যুপরি আঘাতে প্রায় ছিন্নভিন্ন হতে হতে এঁকেবেঁকে সে মিলিয়ে গেল বাগানের সীমানা পেরিয়ে। ক্রোধোন্মত্ত পীতবাস তখন ব্যস্ত লোকলস্কর ডাকতে।

    অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে সে ফিরে তাকিয়েছিল আমার দিকে। অসহায় সাপিনীর চোখে যন্ত্রণার সাথে মিশে ছিল একদলা ঘৃণা। গোটা শরীরের রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দেওয়া কী ভয়ানক হিমশীতল সে চাহনি!

    সাতদিন সাতরাত গোটা চত্বর তোলপাড় করেছিল চৌধুরীদের গুদামের লোকেরা। আর আমি, ক্ষমার অযোগ্য এক কাপুরুষ, তন্নতন্ন ক’রে খুঁজে বেরিয়েছিলাম বাতাসীকে। অত মারাত্মক চোট নিয়ে কারোর পক্ষে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পাইনি। যে অজানা থেকে এসেছিল একদিন সেই অজানাতেই বুঝি মিলিয়ে গেল কুহকিনী।

    অবশ্য ভালই হয়েছে, দেখা পেলে সে বোধহয় আরও লজ্জার ব্যাপার হত।

    বৌমণিকে আরেকবার দেখার সুযোগ মিলেছিল। চন্দন পরে অন্য একটা সাদা গাড়িতে চেপে বিদায় নিল সেও। আর আসেনি। যাওয়ার সময় কি পবিত্র লাগছিল মৃত্যুনীল ফ্যাকাশে মুখটা!

    চৌধুরীদের পেল্লায় বাড়িটা ক্রমশ ডুবে যেতে থাকল নিঃসীম অন্ধকারে। গুদামের পাট উঠল, কর্মচারীরা একে একে বিদায় নিল। এমনকি পীতবাসও। একসময়ের জমজমাট আসর পরিণত হল খাঁ-খাঁ ভগ্নস্তূপে।

    খোকার বাগানে আসা থামল বটে কয়েক বছরের জন্য, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করা গেল না। একটু বড় হতেই আবারও সে হাজির, এবারে সঙ্গীবিহীন। না, ভুল হল... সবাই ছেড়ে গেলেও রয়ে গেল তার সাধের ফুটবল। সময়ের সাথে সাথে আয়তনে খোকার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলল সে, তারপর এক সময় হাল ছেড়ে দিল অসম প্রতিযোগিতায়।

    আর শ্রান্ত দেহ-মন নিয়ে নীরব নিভৃত দর্শকের ভূমিকা পালন করতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম আমি। আকন্দ ঝোপের আড়ালে, বীতস্পৃহার নির্মোকে।  এভাবেই বাকি দিনগুলো কেটে যাওয়ার কথা।

    বিস্মৃতির গহীনে ডুব দিয়ে উঠে স্থান-কাল ঠাহর করতে পারছিলাম না। হঠাৎ জলে পড়া খাবি খাওয়া মানুষের দশা কেটে একটু একটু ক’রে সংবিৎ ফিরতে নিজেকে আবিষ্কার করলাম গাবগাছটার প্রলম্বিত ছায়ার অদূরে। খোকার সাথে দূরত্ব বড়জোর ফুট দশেকের!

    এতক্ষণে সম্ভবত ক্লান্তির রেশ দেখা যাচ্ছে ওর পেশিগুলোয়। প্রতিটি শটে আগেরটার চাইতে উদ্দীপনা হ্রাসমান, শটের জোরও তথৈবচ। আজকের প্র্যাকটিস কি শেষ হয়ে এল?

    উত্তর খোঁজার অপেক্ষায় থাকতে ভরসা হয় না। কী জানি কখন ধরা পড়ে যাই! সম্ভাবনাটা মাথায় আসতে নিঃশব্দে যাত্রা শুরু করি বুকে ভর দিয়ে। গন্তব্য আমার চিরপরিচিত আকন্দ ঝোপ। একটু বিশ্রাম চাই, উদরস্থ ইঁদুরটা জীর্ণ হওয়ার আগে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

    মৃদুমন্দ বাতাসের গতিবেগ কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যে ঠেকেছে, চারপাশ স্তব্ধ-নিথর। গাবগাছের এদিকে বিশেষ কেউ আনাগোনা করে না। তাই কি শ্রেণিবদ্ধ ঘাসেদের সারিতে মৃদু আলোড়ন বিসদৃশ লাগে?

    সন্দেহটা সত্যি ক’রে ছন্দোবদ্ধ গতিতে এক ঝলক কালো বিদ্যুৎকে দেখলাম অনায়াসে এগোতে, গাছের নীচের ফোকর ছেড়ে। আর... ক্লান্ত খোকা তার সঙ্গীকে কোলে নিয়ে গুটিগুটি পায়ে যাচ্ছে গাবগাছটারই ছায়ায় দু’দণ্ড জিরিয়ে নিতে।

    কর্তব্য স্থির করতে--- কী আশ্চর্য--- সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের বেশি ব্যয় হল না!

    কালনাগিনীর গতি আমার চেয়ে ঢের বেশি, খোকার সাথে দূরত্বও কম। ওর আগে আমার পৌঁছতে পারার কথা নয়। কোনওভাবেই নয়। তবু কোন এক মন্ত্রবলে সে থমকে গেল। বোধ করি রক্তের তেজ মরে যাওয়া একটা বাতিল প্রাণী--- যাকে সে নিজেও ধর্তব্যের মধ্যে আনার প্রয়োজন মনে করেনি--- এতটা ইচ্ছাশক্তি ধরতে পারে তা ওর দূরতম কল্পনাতেও ছিল না।

    আমার কল্পনাতেই কি ছিল?

    উত্তর খুঁজে পাওয়ার আগে নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক অসম রণের প্রতিপক্ষ রূপে। প্রাথমিক সংশয় কাটিয়ে উঠে উন্মত্ত নারী তার ফণা মেলে ধরেছে, বিষের থলি যে কোনও মুহূর্তে উজাড় করতে সে এখন প্রস্তুত। আবছা টের পেলাম গাবগাছের ফোকর থেকে দীর্ঘকায় আরেকটা অবয়ব নিঃশব্দে এদিকেই এগিয়ে আসছে। আমার ঠিক বাঁ পাশে এখন খোকা... না দেখেও অনুমান করতে পারি সে এই মুহূর্তে স্থাণু, দশ বছর আগের এক অভিশপ্ত বিকেলের মত।

    পিছন দিক থেকে বহুদিনের পুরনো অতি-পরিচিত কম্পন ধরা পড়ল। তারপরেই চেনা একটা হুঙ্কার।

    এবারেও কি তোমার হাতে ভাঙা কঞ্চি ছিল, পীতবাস? নাকি... যাকগে, কী যায় আসে আর সে খবরে। বাকি আঘাতগুলো আছড়ে পড়ার আগে দেখতে পেয়েছি নাগ-দম্পতি সুড়সুড় ক’রে সেঁধিয়েছে গাবগাছের তলায় তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে। খোকা তাহলে তোমার জিম্মায় রইল। ওকে বারণ ক’রো মাঠের এদিকে আসতে।

    বড় ইচ্ছে... চেতনা লুপ্ত হওয়ার আগে খোকার মুখটা একবার সামনাসামনি দেখি। কিন্তু কিছুই যে আর গোচর হচ্ছে না! ঘোলাটে দৃষ্টি আরও ঘোলাটে, চরাচরের গায়ে কে যেন একটা অদৃশ্য কালো চাদর পরিয়ে দিয়েছে! যেভাবে বৌমণি শাড়ি বিছিয়ে দিত আমাদের উপর, পরম যত্নে।

    শুধু টের পাই পিঠের উপরে একটা কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তোমার প্রতিটি আঘাতে। প্রতিনিয়ত একটু একটু ক’রে মরে যেতে যেতে যার অস্তিত্বই ভুলে গিয়েছিলাম গত দশটা বছর।

    হঠাৎ ভীষণ শীত করছে!

    অলংকরণ : দেবসত্তম পাল

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন