"আমিত্বের উন্মেষ"
কলমে:- তৌজিয়া নাসরিন
বাবা,
সবার সঙ্গেই কথা হয়, তোমার সঙ্গে খুব একটা হয় না। আজ শুধু তোমাকেই বলবো ভাবলাম। জানো বাবা, মনে হচ্ছে হটাৎ করেই আমি বেশ বড়ো হয়ে উঠেছি। সেই সেদিন তুমি আমায় রেখে গেলে ঠিক তার পরমুহুর্ত থেকেই হচ্ছিল এখন আমি বড়ো হয়েছি। এখন বাড়ির কথা মনে করে কান্না পাওয়া আমায় শোভা পায় না। পরের দিন সকালে আমার বুক ব্যথা করে উঠেছিল, গলা ধরে এসেছিল কিন্তু তাও আমি কাঁদিনি।
নতুন জায়গায় নতুন সংসার গোছানোর আমার এত তাড়া ছিল যে তুমি বললে "মা আমি আসছি" কিন্তু আমি ঘুরে দেখলাম না। আমি দেখিনি, যদি চোখে জল গড়িয়ে আসে ! তুমি যে ভেবে বসতে মেয়ে আমার ভালো নেই। কিন্তু আমি ভালো আছি বাবা....ওটা দুঃখ নয়, ওগুলো একটু মায়া।
জানো বাবা, আমি যেদিন প্রথম টিউশন গেলাম সঙ্গে আমার পাঁচটি বান্ধবী, আমরা কেও এর আগে উত্তরপঞ্চনন গ্রামে যায় নি। শুধু বাসে জায়গার নাম লেখা দেখে উঠে পড়েছিলাম। দুচোখে ছিল ভয়, আনন্দ আর বিস্ময়। ভীড় বাসে দাড়িয়ে ছিলাম। আমিতো আবার উচ্চতায় একটু ছোট তাই বাসের ওপরে ধরার জায়গায় হাত পাচ্ছিলাম না, ঝুলে ঝুলে পড়ছিলাম। তারপর থেকে অবশ্য আমি 'high hill' জুতো পরা শুরু করেছি। প্রথম দুদিন পায়ে খুব ব্যাথা ছিল, এখন অভ্যেস হয়ে গেছে।
বাবা তোমাকে বলিনি, কিন্তু আমি একদিন কেঁদেছিলাম। আন্টির তেতো রুটি দেওয়ার সেদিন তৃতীয় দিন ছিল। প্রথম দুদিন ফেলে দিয়েছিলাম কিন্তু সেদিন খিদে পেয়েছিল, আমি রুটি দুটো ফেলে দিয়ে বাথরুম গিয়ে একটু কেঁদেছিলাম। তারপর তেতো রুটি খেতে পারছিনা বলে কাঁদছি মনে পড়ায় লজ্জা করেছিল, তাই বেশিক্ষণ কাঁদিনি। রাতে শুয়ে মনে পড়ছিল তুমিও গল্প করতে তুমি যখন ডানকুনিতে থাকতে তখন তোমাদের আন্টিও ডাল শেষ হয়ে গেলে জল ঢেলে পরিমাণ ঠিক করে দিত। কথাটা মনে করে খুব হাসলাম। বাবা, কি অদ্ভুতভাবে আমরা এক হয়ে গেলাম !
তোমার মনে আছে শীতকালে যখন আমি লেপ কম্বল মুড়িয়ে পড়তে বসতাম তুমি মাঝে মাঝে একটা আপেল, একটা কলা খাতায় ওপর দিয়ে যেতে,ভারী গলায় বলতে "পড়তে পড়তে খেয়ে নাও" মাঝে মাঝে এক গ্লাস জলও দিয়ে যেতে। তিনদিন পর ঘরের এক কোন থেকে পচা ফল আবিষ্কার হতো।আর জলটা আমি জানালা দিয়ে ফেলে দিতাম। শীতকালে বেশি জল খেতে নেই, খুব শীত করে। এখন আমি বিকেলে কোনোদিন জল আনতে ভুলে গেলে রাত পর্যন্ত নিংড়ে চালালেও মাঝরাতে বড়ো জলকষ্ট হয়। মাঝে মাঝে গলা শুকিয়ে ওঠে, ঘুম ভেঙে যায়। আমি এদিক ওদিক করে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে যাই।
বাবা, জিনিসপত্রের খুব দাম বেড়েছে বলো ? এইতো সেদিন আমি বাজার করলাম। মুড়ি, চানাচুর,বাদাম, ওষুধ, আবার জানোতো দেড়শো টাকায় মাত্র চারটে আপেল দিল কাকুটা।
ছোটবেলায় সবাই আমায় বলতো "বাপকা বেটি", তোমার মতই আমি নাকি বেশি কথা বলি। বড়ো হয়ে আমি অবশ্য মা-র মত হয়ে গিয়েছি। কিন্তু তোমার ক্রোমোজোমের কিছু গুন রয়েই গেছে। এখন আমিও আমার রুমমেট দের মাঝে মাঝে মজা করে তোমার বলা মনোলগ গুলোই ঝেঁপে দি "এখন পারবি না, যেদিন ঠেলায় পড়বি সেদিন ঠিক পারবি।"
আমিও পারছি বাবা, অনেক কিছু পারছি। পাশের ঘরে খেতে যেতে মাঝে মাঝে কুড়েমি করতাম। এখন সাড়ে তিন কিলোমিটার হেঁটে মাঝেমাঝে মোমো খেতে যাই। এখন আর আমার স্নান করতেও পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে না। আমি এখন বড়ো হয়ে গেছি। এখন আমিও আমার জুনিয়র কে কুড়ি মিনিট ধরে প্রেরণাদায়ী বাণী শোনায়।
আমি ভালো আছি বাবা। আমি এখন জীবনযুদ্ধে "যুদ্ধ" টুকু শিখছি। মা-র মতো বলি তবে...."এইতো সবে শুরু, এখনও বহু পথ বাকি, সব পেরোতে হবে সাবধানে....."
তোমরা ভালো থেকো। ছুটি হলে আসবো।
- ইতি
আমি
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।