এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ধারাবাহিক  ভ্রমণ কথাঃ অচিনপুরের বালাই – ৩

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৭ জানুয়ারি ২০২২ | ১০২৩ বার পঠিত
  • [প্রথম পর্ব - ১৭/১১/২০২১ এবং দ্বিতীয় পর্ব - ১৯/১২/২০২১ তারিখে প্রকাশিত]

    “তা বাবুর কোথা থেকে আসা হচ্ছে? কলকাতা থেকে বুঝি?”

    “আজ্ঞে হ্যাঁ”।

    “কলকাতার কোথায় বটে?” আমি বললাম।

    “অ। আমি অবিশ্যি কলকাতার তেমন কিসুই চিনি না। এমনি জিগ্যেস করলাম। দুবার মাত্র কলকাতায় গেছি, পেথমবার ময়দানে । আরেকবার আলিপুরে। আলিপুরে পুলিশদের টেনিং দেওয়ার ইস্কুল আছে না? চেনেন?”

    “চিনি বৈকি, পিটিএস। তবে ভেতরে ঢোকার সুবিধে পাইনি কোনদিন”।

    “তা না পাওয়াই ভালো, বাবু। ওসব স্থানে আমাদের মতো লোকের পেয়োজন কী? পেথমবার কলকাতায় গেছিলাম, বাবু, সে এক্কেরে ছোকরা বয়েসে। ময়দানে মিছিল ছিল, পাড়ার সব্বাই হুজুগ তুললে চল, মিছিলে যাব।” ভদ্রলোক কথা থামিয়ে মুখে একটা বিড়ি নিলেন, তারপর দেশলাই ধরাতে গিয়েই বিপত্তি। একটানা ঝিরঝিরে বাতাসে বড়ো বড়ো ধূমপায়ীও বিড়ি সিগারেট ধরাতে হিমসিম খাবে। তিনটে কাঠি নষ্ট করে অবশেষে বিড়িটা ধরল।

    লম্বা একটা টান দিয়ে ভদ্রলোক শুরু করলেন, “মিছিলে যাওয়াটা বাবু মন্দ লাগেনি তখন। যার যার বাড়ি থেকে আলুচোকা দিয়ে দুটি পান্তা খেয়ে, ভোর ভোর দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম। জানেন তো সবই, মিছিলে গেলে রেলের ভাড়া-টাড়া বিলকুল ফিরি। দলের হাতে দু চারটে ঝাণ্ডা থাকলেই, টিকিটবাবুরা সবাই ঠাণ্ডা হয়ে থাকেন। সাড়ে বারোটা - একটা থেকে মিটিং, তা আমরা শেয়ালদা পৌঁছে গেলাম সকাল-সকাল। আমাদের দলে তিনজন পাণ্ডা ছিল, তাদের পেছন পেছন কখনো ট্রাম ধরে, কখনো পায়ে হেঁটে, আমরা প্রায় ঝড়ের বেগে দেখে ফেললাম, মায়ের থান, আলিপুর চিড়িয়াখানা, রাণি ভিক্টোরিয়ার বাগান। আমাদের পাণ্ডাদের মধ্যে দুজন ছিল কলকাতা গুলে খাওয়া লোক, বাবু। তারাই আরো কত কি দেখাল, পিজি হাসপাতাল, পুলিশ টেনিংয়ের ইস্কুল, রবি ঠাকুরের ভবন না সদন, যেখানে নাকি নাচ-গান হয়। তারপর যাদুঘর। যাদুঘরের ভেতরে ঢোকা হয়নি, হাতে আর সময় ছিল না যে! দেরি করলে দুপুরের ডিমের ঝোল দিয়ে গরমভাত ফসকে যেত! সময় থাকলে যাদুঘরে নিগ্‌ঘাত ঢুকতাম বাবু, সেই তিমির চোয়াল আর ন্যাকরা জড়ানো মিশরের মরা দেখতে। আপনি নেশ্চয় দেখেছেন, বাবু”।

    কথার ঝোঁকে বিড়িটা অনেক আগেই নিভে গেছিল, ভদ্রলোক এতক্ষণে সেটা লক্ষ্য করলেন এবং একটু বিরক্ত হয়েই ছুঁড়ে ফেললেন মাটিতে। আমি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে ভদ্রলোককে অফার করতে, ভদ্রলোক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তুলে নিলেন একটা। বাকি সকলকেই অফার করলাম, বালাইকেও – বালাই নিল, আর কেউ নিলেন না। এই সময়েই মালতীমা স্টিলের প্লেটে ছটা কাগজের কাপে চা নিয়ে এলেন, বললেন, “ন্যান বাবু, বিড়ি ধরানোর আগে, চা টুকু খেয়ে ন্যান। থা নয়তো হাওয়ায় জুড়িয়ে জল হয়ে যাবে”।

    আমাদের পরাণটা কখন কিসের জন্যে যে আঁটুবাঁটু করে সে বোঝা ভার। কিছুক্ষণ আগে এই প্রকৃতি পরিবেশে মন মজে ছিল, মন মজে ছিল বালাইয়ের গানে। এই মাত্র শুনছিলাম ময়দানে মহাসভায় মিছিল করে যাওয়ার গল্প। কিন্তু উষ্ণ চায়ের গন্ধে মনটা যেন গেয়ে উঠল আনন্দে। মালতীমায়ের প্লেট থেকে দুটো কাগজের কাপ তুলে একটা দিলাম বালাইকে, একটা নিলাম নিজে। বাকিরাও তুললেন একে একে। প্রথম চুমুকেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “আহাঃ” শব্দটা। তারপর বললাম, “চায়ে মনে হচ্ছে একটু আদাছেঁচাও পড়েছে!”

    মালতী মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “একটু আদার রসে চায়ের তারটা ভালো জমে - ভালো হয়েছে চাটা?

    “ভালো মানে? এখানে এরম চায়েরই খোঁজ করছিলাম মনে মনে। তবে, দিদি, এইটুকু কাপে তো গলাও ভিজবে না। আরেক কাপ দেবেন কিন্তু এটা শেষ হলে। বালাইবাবুকেও দেবেন। আপনারা?” আমি সামনে বসা চারজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। তাঁরা সকলেই মাথা নাড়লেন, মিছিলের ভদ্রলোক বললেন, “না, না, এই আমাদের ঢের”।

    ছোট্ট কাপের চা তিন তুড়িতে শেষ করে, মিছিল-ভদ্রলোক চায়ের খালি কাপ প্লাস্টিকের বালতিতে ফেলে আবার বিড়ি ধরানোর কসরত করতে শুরু করলেন। বিড়ি ধরিয়ে বললেন, “যে কথা বলছিলাম”, মনে হল ওঁর কথার মধ্যে চায়ের বিরতি এবং সেই প্রসঙ্গে মালতীমায়ের সঙ্গে আমাদের কথোপকথনে উনি কিঞ্চিৎ বিরক্তই হয়েছেন। এখন নতুন উদ্যমে হারানো সূত্র কণ্ঠে তুলে নিলেন, “থা কলকাতা দেখা সেরে আমরা যখন ময়দানে পৌঁছলাম, ও বাব্বা, সে কি, মানুষের ঢল রে, নব্‌নে”। বন্ধুজনের আন্তরিক সম্বোধনে নবীনকে হয়তো, নবনে হতে হয়ে হয়েছে এবং এই গল্প নবীনবাবু হয়তো একশবার শুনে থাকবেন, তবুও পাশে বসে থাকা নবীনবাবু নির্বিকার মুখে বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে বললেন, “তাই”?

    বন্ধুর কৌতূহলে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে মিছিলবাবু বললেন, “তাই, মানে? চারিদিকে গিজগিজ করছে লোক আর লোক – সে যে কত! শুনলাম আরো নাকি লোক ঢুকছে তো ঢুকছে। একদম সামনে – বহুদূরে বিশাল মঞ্চ, সেখানে সব গান-টান হচ্ছে, নেতারা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে দৌড়োদৌড়ি করছেন। মুখ্যমন্ত্রী তখনো এসে পৌঁছোননি, তিনি এলে যে কী হবে কে জানে? ভিড়ের জন্যে এতটাই দূরে দাঁড়ানোর জায়গা পেয়েছিলাম, সেখান থেকে মঞ্চের কাউকেই চেনা যায় না। এত লোক এত লোক, কেউ বললে পাঁচলাখ, কেউ বললে ছয় - আমারও তাই মনে হচ্ছিল। লাখ পাঁচেকের কম হতেই পারে না”!

    মিছিলবাবু বিড়ির সুখটান সেরে ছুঁড়ে দিলেন বালির চড়ায়, তাঁর বন্ধু নবীনবাবু বললেন, “পাঁচলাখ - সে কী মুখের কথা, বাপু?”

    আমার চায়ের কাপ শেষ হয়েছিল, মালতীমা লক্ষ্য রাখছিলেন, আমি তাকাতেই ফ্লাস্ক থেকে নতুন দুটো কাপে চা ঢেলে নিয়ে এলেন, আমি হেসে তুলে নিলাম কাপ দুটো – একটা বালাইয়ের অন্যটা আমার। পাঁচলাখ লোকের কথাটা আমার অত্যন্ত বাড়াবাড়ি মনে হল। ময়দানের যা আয়তন, তার থেকে নিরাপত্তার বেষ্টনি আর বিশাল মঞ্চের আয়োজন ছেড়ে দিলে, বড়জোর লাখখানেকের মতো লোককে অ্যাকোমোডেট করা যায়। সেটাও যথেষ্ট এলাহি কাণ্ড। তবে শুনেছি রাজনৈতিক দলগুলিও নির্দ্বিধায় চার-পাঁচ লক্ষ লোক সমাগমের লক্ষ্যে পৌঁছে যান। কিন্তু আমি আদার ব্যাপারী, আমার এ বিতর্কের প্রয়োজন কী? বরং আদার রসে স্বাদু চায়ের দ্বিতীয় কাপে চুমুক দিয়ে কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, “তারপর?”

    আমার এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই যেন ছিলেন, ভদ্রলোক হেসে বলতে শুরু করলেন, “তার আর পর কী? আমাদের পাণ্ডা ছিল ওমরিদা, সে বললে, সাড়ে বারোটা বাজছে, চল খাবার যোগাড় কী আছে দেখি। খেয়েদেয়ে আমরা একটু ঘুরেঘেরে দেখে রওনা হবো শেয়ালদা। আমি বললাম, সে কি? আমরা মিটিং বক্তিতা শুনবো না? ওমরিদা আমার মাথায় হাল্কা চাঁটি মেরে বলল, তুই শুনতে হলে শুনতে থাকিস, আমি কেটে পড়বো। এর পরে আর ফেরার ট্রেনে চাপতে পারবি, হতভাগা?”

    আমি দ্বিতীয় কাপ শেষ করে সিগারেট ধরালাম, বালাইকেও একটা দিলাম। মিছিলবাবুর ওমরিদা হয়তো অমরদা কিংবা ওমরদা। মনে মনে তাঁর বাস্তববোধকে পূর্ণ অ্যাপ্রিসিয়েট করে, খুবই হতাশ গলায় বললাম, “সে কি, মিটিং না শুনেই চলে এলেন”?

    মিছিলবাবু একটু যেন লজ্জাই পেলেন আমার কথায়, বললেন, “থা আর কী করা যাবে? ওমরিদা খারাপ তো বলেনি কিছু! আর অতদূর থেকে আমরা কী আর চিনতে পারতোম কাউকে? চারদিকের অজস্র মাইকের এমন গমগমে আওয়াজ নেতাদের সব কথাও কী আর বুঝতে পারতোম? কাজেই কালবিলম্ব না করে ময়দানের সে পাশে - যেখানে ওমরিদা বলল, শীতকালে নাকি ঘোড়া দৌড়োয়, তার বেড়ার ধারে গিয়ে আমরা খাওয়ার পাট চুকিয়ে, বরাবর হাঁটা দিলাম শেয়লদার পানে”।

    দেশ ভ্রমণ এবং কলকাতা ভ্রমণের অনেক বিখ্যাত কাহিনী শুনেছি, পড়েছি, কিন্তু এমন ভ্রমণের কথা কোনদিন শুনিনি। জনসভার দিন টিভিতে এবং পরের দিন সকালের খবরের কাগজে আমরা রেকর্ড জনসমাবেশের যে তরজা শুনি, তার এমন বাস্তব চিত্র তেমন কোথাও চোখে পড়েনি। আমার এই মিছিলবাবুকে বড়ো ভাল লাগল। কোনরকম বারফট্টাই আজগুবি কথা বলেননি, যা করেছেন, যা দেখেছেন, যেটুকু শুনেছেনে সেটুকুই বললেন সরল কথায়। এমন সহজ সত্যি কথা আজকাল কে বলে আর?

    আমার কৌতূহল তখনো একটুও টসকায়নি, জিজ্ঞাসা করলাম, “আর আপনার সেই পিটিএস যাওয়ার কথাটা? সেখানে কেন গিয়েছিলেন? সেখানে তো কোন মিটিং-টিটিং হওয়ার কথা নয়”।

    মিছিলবাবু খুবই উৎসাহী হলেন আমার প্রশ্নে, “না, না, ওখানে কোন মিটিং নয়, তবে সে এক কাণ্ড বলতে পারেন। আমাদের পাশের গাঁয়ে যাদবখুড়োর ছেলে এক কেলেংকারি বাধিয়ে বসেছিল, জানেন? একটা সিগারেট দেন তো। আপনার আবার কম পড়ে যাবে না তো?” কুণ্ঠিত স্বরে আমাকে মনে করাতেও ভুললেন না।

    তৎক্ষণাৎ আমার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে ধরে বললাম, “কম পড়লেই বা কী? মালতীমায়ের কাছে সিগারেটের প্যাকেট আছে আমি দেখে নিয়েছি”।

    সিগারেটটা ধরিয়ে মিছিলবাবু বলতে শুরু করলেন, “বেশি দিনের কথা নয়, এই বছর তিন-চার আগেকার ঘটনা। যাদবখুড়ো সরকারি কাজ করতেন, সবে রিটার করেছেন। সে সময় তিনি, রিটার করলে ওই গ্রাচুটি না কী যেন বলে, সে টাকা পেয়েছেন, পিএফ পেয়েছেন। পেনসন পাচ্ছেন। কিন্তু তার ছেলেটা গুচ্ছের পাস দিয়েও চাকরি পাচ্ছে না। এদিকে খুড়িমা চাইছেন ছেলের বে দিয়ে ঘরে বৌমা আনতে। তা কথাটা মন্দ কী? বাপের পেনসন আছে, পোস্টাপিসে কিছু টাকাও গচ্ছিত আছে। কিছু জমিজমা আছে, সেখান থেকে ধানটা, তরিতরকারিটা যা ফলে তাতে বছরের খোরাকিটা উঠেই যায়। কিন্তু না, ভাইপো আমার শিক্ষিত ঘাড়ত্যাড়া, বললে, চাকরি পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবো, তবেই বে করব। আমি বলি, বাপু নিজের পায়ে দিব্যি দাঁড়য়ে রয়েছিস, দৌড়োদৌড়ি করছিস, বিয়ের বেলাতেই বসে পড়লি, বাপ? থা সে যাগ্‌গে”।

    সিগারেটের শেষ পাফটুকু বিড়ির মতো সুখটান মেরে ছুঁড়ে ফেললেন বালির চরে, তারপর বললেন, “শ্যালে রক্তের গন্ধ পায় জানেন তো?” মনে মনে ভাবলাম, শ্যাল মানে নিশ্চয়ই শেয়াল। “ঠিক শ্যালের মতন টাকার গন্ধ পেয়ে আর উজবুগ ভাইপোর একলষেঁড়েপনা টের পেয়ে কোথা থেকে এসে উদয় হল এক ফড়ে দালাল। সে ভাইপোকে আর যাদবখুড়োকে বুঝিয়ে ফেলল, আটলাখ নগদ দিলেই রেলে চাকরি এক্কেরে পাকা। যাদবখুড়ো সরকারি চাকরি করেছেন, কাজেই সেই সরকারি মধুর লোভ কি আর ছাড়তে পারেন? বাপ আর ব্যাটা মিলে রাজি হয়ে গেল। অনেক দরদস্তুর টানাহেঁচড়া করে, পাঁচ লাখে রফা করল। যাদবখুড়ো দেড়লাখ টাকা পরের দিনই ফড়েটার হাতে তুলে দিলে। আর কথা হল পোস্টাপিসের জমা ভাঙিয়ে বাকি টাকা দেবে দিন চার-পাঁচেক পর। দালালটা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না, তারপর নাকি অনেক আকচা-আকচিতে হারামজাদা রাজি হল। বলল আজ শুক্রবার, আসছে মঙ্গলবার বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে পিটিএসে থাকবো, ওইদিন বাকি টাকা যদি পাই, রেলে চাকরি হবে নয়তো লবডংকা”। ভদ্রলোক দুই হাতের বুড়ো আঙুল তুলে দেখালেন।

    আমি অবাক হয়ে বললাম, “পিটিএসে রেলের চাকরি?”

    মিছিলবাবু মুখে একগাল বাহাদুরির হাসি নিয়ে বললেন, “ওইটাই তো কথা, বাবু, এতসব ঘটনা হয়েছে, আমাকে কেউ একটা খপরও করেনি। খপরটা আমার কানে এল, রোববার। শুনেই যাদবখুড়োকে গিয়ে ধরলাম। যাদবখুড়ো আর খুড়িমাতো তো আল্লাদে আটখানা – ছেলের রেলে চাকরি হবে, বে হবে, বৌমা আসবে...। সব বিবরণ শুনে আমি বললাম, খুড়ো আমিও যাবো ভাইপোর সঙ্গে। দেখবো কে টাকা নেয়, আর কে চাকরি দেয়। থা গেলাম, জানেন? শেয়ালদা থেকে হলুদ ট্যাস্কি নিয়ে যাদবখুড়ো, আমি আর ভাইপো। পিটিএসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম...বারোটা, সাড়ে বারোটা, একটা, দেড়টা, আড়াইটে... কারো দেখা নেই...”।

    মিছিলবাবু আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে বললেন, “সে দালালের আর দেখা নেই, বুঝলেন বাবু? এমনি সময়ে আমার চেনা একজন লোকের সঙ্গে দেখা হল, তার বাড়ি ডায়মণ্ডে। সে পুলিশেই চাকরি করে। সে আমাকে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললে, আরেঃ তুমি এখানে, খি ব্যাপার? তাকে সব কথা খুলে বললাম। সে একগাল হেসে বললে, যা গেছে অল্পের উপর দিয়েই গেছে হামিদভাই। বাড়ি যাও, টাকাটা পোস্টাপিসে আবার জমা করে দাও গিয়ে। ফেরেব্বাজ দালালের খপ্পরে পড়েছিলে – কোনমতে বেঁচে গিয়েছ। রেলের চাকরি কোনদিন পুলিশে দিতে পারে এমন কস্মিনকালেও শুনেছো?” যাক মিছিলবাবুর নামটা জানা গেল হামিদ। আর হামিদ ভাইয়ের চেনা লোকের বাড়ি নিশ্চয়ই ডায়মণ্ড হারবারে।

    আমি রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় জিজ্ঞাসা করলাম, “তারপর, হামিদভাই?”

    হামিদভাই বললেন, “তারপর আর কি? আমরা পাঁচটা অব্দি ওখানেই ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম। আজ পর্যন্ত বকেয়া টাকা নিতে সে হারামজাদা আর এ মুখো হয়নি। দেড়লাখ পেয়ে সে গায়েব...মাঝের থেকে যাদবখুড়োর সাড়ে তিন লাখ আমি বাঁচিয়ে দিলাম”। আমরা সকলেই চুপ করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বেশ খানিক পরে হামিদভাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “বজ্জাত আর ফিকিরবাজে দেশ ভরে উঠেছে, জানেন বাবু। আমি আর একলা কত সামলাব? যাই, বেলা হল, চান খাওয়া সেরে আমাকে একবার ডায়মণ্ড যেতে হবে। তবে যাই বলেন, বাবু, শহরের লোকগুলোর থিকে এদিকের লোকজন অনেক সাদাসিধে। রাজধানীর লোকেদের পেটে আর মুখে আনকথা। তাদের সব্বোদাই যেন লোক ঠকানোর ব্যবসা। এ আমি পেতক্ষ দেখেছি বাবু”।

    হামিদভাই উঠে দাঁড়ালেন, যাবার আগে বললেন, “চলি বাবু, আমাদের এ গেরাম ঘুরেঘেরে দেখুন, বাউলদা আপনাকে সবই দেখাবে... দেখার আছেটা কি সে অবিশ্যি আপনিই জানেন...হে হে হে...”। হামিদভাই চলে গেলেন, ওঁনার সঙ্গেই উঠে গেল অন্য সবাই...সকলেরই একইসঙ্গে যেন কাজের কথা মনে পড়ে গেল।

    হামিদভাই ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা চলে গেলেন, কিন্তু একটা খোঁচা রয়ে গেল আমার মনে। এমন তো হবার কথা ছিল না। আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বালাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম।

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন