রিজেন্ট পার্ক একটা মোটামুটি মাঝারি সাইজের পার্ক। তুলনা করা যেহেতু আমার তখন স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে, তাই সোভিয়েত দেশের পার্কগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এটা খুবই ছোট্ট একটা পার্ক, আবার যে শহর আমার জন্মস্থান সেখানে ট্র্যাংগুলার পার্ক ও আছে, সে তুলনায় ইহা সুবিশাল। পার্কের একেবারে ধার ঘেঁষে সেই মস্ক অর্থাৎ মসজিদ। ছোট্ট মর্জিনা পরেছে কমলা রঙের একটা ছিটের ফ্রক, ছেলেরা সব নতুন নতুন শার্ট প্যান্ট, নতুন শার্টগুলো একটু খড়মড়িয়ে রয়েছে। আকন্দবাবু আজ কোট পরেন নি। মরিয়মের সাজ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সে টিনেজার, শ্যাম্পু করা বাদামি চুল পুরো খোলা, স্কিনটাইট জিন্স এবং হালকা গোলাপি স্লিভলেস ব্লাউজে তাকে পরীর মতো দেখাচ্ছে। মস্কের দিক থেকে এদের কয়েকজন চেনা লোককে আসতে দেখা গেল, কুশল বিনিময় করে করে তারা চলেও যাচ্ছে। রিজেন্ট পার্কে প্রচুর লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এখানে সম্ভবত আমরা বেশিক্ষণ থাকব না, কারন একটু আগেই প্ল্যান করা হচ্ছিল যে সবাই মিলে চিড়িয়াখানা যাওয়া হবে। লন্ডন জু।
এখন মোটামুটি যেটা হচ্ছে সেটা সামাজিকতা রক্ষা টাইপের ব্যাপার। এরা কেও ধার্মিক নয়। তবে মনোয়ারা প্রত্যেক দিনই নামাজ পড়েন তা কয়েকবার নজর করেছি।
আজ সকালেই মনোয়ারা আমার ঘরে এসে বিছানার ওপর বসে তাঁর অদ্ভূত বিশ্বাসের কথা বলছিলেন। আজ সকাল থেকেই বেশ গরম, ইয়োরোপে অধিকাংশ বাড়িতেই পাখা থাকে না, এয়ারকন্ডিশনারের তো প্রশ্নই নেই। কথায় কথায় মনোয়ারা বললেন যে মক্কায় তাঁর স্বামীর কত কষ্ট হচ্ছে এখন গরমে।
আমি উত্তরে বলেছিলাম যে সৌদিতে তো গ্রীষ্মে খুবই গরম, এই ইদে হজ করার তীর্থযাত্রীদের খুবই কষ্ট হবে।
উনি ওঁর নিজের মতামত জানালেন — মক্কায় আছে আল্লাহর ঘর। সেই ঘরে থাকে চন্দ্র ও সূর্য। সূর্য সেই ঘর থেকে বের হলেই দিন হয়। চাঁদের ক্ষেত্রেও ঐভাবেই নানারকম সাইজ পূর্ণিমা, না বের হলে অমাবস্যা। সূর্যের অত তাপ ওখানে, তাই মক্কা অত গরম। তাই হজ করা এত কষ্টের।
এঁকে কিছু বোঝানো বৃথা। যার যার বিশ্বাস তার কার কাছে। আমি কথা বাড়ানোর পথে যাই ই নি।
আমার যেটা মনে হচ্ছিল সেটা হচ্ছে অনেক অনেক কথা জমে আছে মনোয়ারার ভেতরে। তার কিছু বাস্তব, কিছু কল্পনা, কিছু গর্ব, কিছু দুঃখ, হতাশা, আনন্দ, অসহায়তা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, অবহেলা, সব মিলে মিশে উপচে পড়ছে, অথচ সেসব ব্যক্ত করবার মাধ্যম নেই, শোনানোর পাত্র নেই। হয়ত সেজন্য সম্পূর্ণ অচেনা একজনকে তিনি বলে চলেন তাঁর কল্পনা ও বাস্তব মেশানো কথা। কত কিছু বললেন — লন্ডনের সিলেটি কমিউনিটির কথা, এঁরা নোয়াখালির লোক, প্রায় বিশ বছর আগে এদেশে আসার গল্প, এই দামী অ্যাপার্টমেন্ট কেনার পেছনে স্বামীর দীর্ঘ সঞ্চয়ের অবদান এবং কর্মক্ষেত্রের সাফল্য, তা সত্ত্বেও প্রচুর পাউন্ড কিস্তির জন্য গুনতে হচ্ছে এই অ্যাপার্টমেন্টের জন্য, সেই সঙ্গে তুলনা — আমরা অল্ডগেট ইস্টের বাংগালীদের মতো না, ওরা কাপড় কেচে বাইরে টানিয়ে রাখে, ন্যাস্টি, আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট বড়োলোকদের অ্যাপার্টমেন্ট, দেখেছেন তো এখানে কাপড় কাচার মেশিন বাথরুমের পাশের ঐ ছোটঘরটাতে, আমরা রান্নাঘরে ওয়াশিং মেশিন রাখি না।
পার্কে সবাই সাজুগুজু করে এসেছে। সবাই মুসলমান তবে নানান দেশের, মরিয়ম খুব কায়দা করে হাঁটছে, তার চেনা বন্ধু বান্ধব সম্ভবত ক্লাসমেটদের সঙ্গেও কথা বলল। হঠাৎ একটু সাইডে পার্কের উঁচু রেলিং এর দিক থেকে কে বা কারা যেন শিস দিল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম চারজন ইয়াং ছেলে রেলিংএর ওপর ব্যালেন্স করে বসে পা নাচাচ্ছে। মরিয়ম সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে। একজন ছেলে আবার শিস দিলো, চেঁচিয়ে কী যেন বলল, লোকজনের কথাবার্তার নয়েজ এবং ঐ ছেলেটির ব্রিটিশ অ্যাকসেন্ট এসব মিলিয়ে কিছুই বুঝলাম না।
মরিয়ম বেশ দ্রুত পদক্ষেপে চলে গেল সেই ছেলেদের দিকে।
বোঝো কাণ্ড! আমার মধ্যেকার রক্ষণশীলতাবোধ ফের জেগে উঠেছে। যতই নিজেকে আধুনিক মনে করি না কেন, শৈশবের পরিবেশ, শিক্ষা, সব মশলার মতো মিশে রয়েছে ম্যারিনেড হয়ে শিরায় শিরায় ধমনীতে ধমনীতে।
চারটে বখাটে ছেলে ডাকল আর মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে সে দিকে চলে গেল? বিরক্ত লাগল আমার। আকন্দবাবুকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। মর্জিনা তার দাদাদের সঙ্গে ঘুরছে, নজরুলকে অবশ্য কাছেই দেখলাম, সে রাস্তা থেকে একটা সস্তার রিস্টওয়াচ কিনেছে, সেই রিস্টওয়াচ নিয়েই খুটখাট করছে।
পনের বিশ মিটার মত দূরত্ব পা চালিয়ে হেঁটে মরিয়ম ঐ পাঁচিলের নীচে দাঁড়িয়ে কী সব যেন বলল, অমনি ধুপ ধাপ করে দুজন ছেলে নেমে পড়ল নীচে। চারটে ছেলের পরনেই ট্র্যাক সুট, যে ছেলেটি মরিয়মের একদম কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল তার পরনে বেগুনী রঙের আডিডাস ট্র্যাকসুট। আমি নিজের অজান্তেই এগিয়ে যাচ্ছি ওদিকে। খুব হাসাহাসি চলছে ওখানে। ছেলেটার মাথার চুল রুক্ষ্ম, চোখ দুটো ঘোলাটে, তারা চারজনে সিগারেট খাচ্ছিল একটু আগে। ব্যাপারটা ভাল করে বুঝবার জন্য আমি আরও কয়েক পা এগোলাম।
মরিয়ম এবার পাশ ফিরে আমাকে দেখতে পেল, কিন্তু তোয়াক্কা করল না, তার চোখ অন্য কারোকে খুঁজছে।
হ্যাঁ, পেয়ে গেছে। নজরুলকে দেখতে পেয়ে মরিয়ম, নজরুলও মরিয়মকে দেখা মাত্র তীরবেগে ছুট্টে চলে এল তার কাছে। তবে মরিয়ম নয়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঐ বেগুনী ট্র্যাকসুট পরা ছেলেটির ওপর। তারপর বলল — ইড মোবারক ভাইয়া!
পাওয়া গেছে। মনিরুলকে পাওয়া গেছে।