নভেম্বরের শুষ্ক দুপুরের শেষে, যখন অস্তগামী সূর্য্য তার শেষটুকু কমলা রঙের আলো গলিত লাভার মত ঢেলে দেয়, সেই সময় ট্রেন ছুঁয়ে যায় কয়েকটি মাঠ। দুইধারে গোলপোস্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অনন্ত স্থবির স্কুলের মাঠ; দোকান, ফ্ল্যাট, শপিং মল, সিনেমা হলের মাঝে এখনও অস্তিত্ব বজায় রাখতে পাড়া একটা-দুটো ছোটো ছোটো মাঠ। নভেম্বরের শেষ বিকেলে সেখানে ফুটবল খেলে রংবেরঙের জামা পরে থাকা ছেলেরা, আবর্জনার স্তূপের গা ঘেঁষে থাকা মাঠে ক্রিকেট খেলে। আর এই সময় যখন ট্রেন পাশ কাটিয়ে যায়, কোনো কোনো ছেলে, যাদের মুখ দেখা যায় না, ব্যাট তুলে তাকিয়ে থাকে মাঠের দিকে। ক্ষণস্থায়ী দর্শকদের কাছে নিজের কৃতিত্বের সাক্ষ্য রাখে।
হাপরের মত ওঠানামা করা বুক নিয়ে দৌড়ে বেড়ানো ছেলেটা, পঞ্চাশ কিংবা একশো করে শচীনের মত ব্যাট তুলে তাকিয়ে থাকা ছেলেগুলো কেমন অবাক করে দেয় আমাকে। কিছুক্ষণ পরেই কেউ বাড়ি গিয়ে পড়তে বসবে, কোনো বেকার ছেলে যাবে দুটো টিউশন পড়াতে, কিংবা অন্ধকার গলিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানবে, অথচ এই বিকেলের সময়টা, যখন কমলা আলো আর অন্ধকার মিলেমিশে যায়, কি স্বচ্ছ স্বপ্ন দেখে ওরা! কেউ ভেসে যায় স্টেডিয়ামে দর্শকের গর্জনে, কেউ স্বপ্ন দেখে একদিন দেশের জার্সি গায়ে চাপিয়ে সেঞ্চুরি করার। অবাস্তব স্বপ্ন, যার ভবিষ্যৎ হতাশার পুনরাবৃত্তি।
অবাস্তব স্বপ্নগুলোই বাঁচিয়ে রাখে আমাদের। বিকলাঙ্গ হয়ে হেঁটে বেড়ানোর এইসব একঘেয়ে দিনে মাথা তুলে বাঁচার, একটু নিষ্পাপ আনন্দ খুঁজে নেওয়ার জায়গা এইসব স্বপ্ন গুলো। একটু নিশ্চয়তা, আশ্রয় আর জয়ের আভাস।
ছুটতে থাকা ট্রেনের গর্জন ছাপিয়ে কে যেন ফিসিফিসিয়ে মনে করিয়ে দিয়ে যায়, শেষ স্বপ্নে আমি আমার শীতল মৃত্যুকে দেখেছিলাম।
নভেম্বরের শুষ্ক দুপুরের শেষে, অস্তগামী সূর্য্য তার শেষটুকু কমলা রঙের আলো গলিত লাভার মত ঢেলে দেয়। সারাদিন হকারী করে তখন বাড়ি ফিরি।
শীত পড়ার শুরুতেই একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করি, মরে যাওয়া গাছের ডগায় পাতা গজিয়েছে, শুষ্ক ডালে জন্মেছে ছোট ছোট সাদা ফুল। এক অপূর্ব বিস্ফোরণের সম্ভবনা নিয়ে আবার সবুজ ফিরে আসছে বৃক্ষে। শহরে প্রতিদিন যেমন নিঃশব্দে মরে যায় কত কত মানুষ, তেমনই চুপিসারে কতজন উঠে দাঁড়াচ্ছে বৃক্ষের মত। তাদের বুকের ভিতর থেকে উঁকি মারছে সাদা ফুল। পিঠের কাছে কচি পাতার মত জন্মেছে পালক। সদ্যজাতের চিৎকারের শব্দ অ্যামপ্লিফায়েড হয়ে ধাক্কা খায় প্রতিটা মোড়ে, প্রতিটা দেওয়ালে।
বিস্ফোরণের শব্দ সর্বনিম্ন কত দূরত্বে শোনা যায়?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।