~রহিম ব্যাপারীর অন্তর্ধান~
সবচে' চটকদার ব্যাপারটা হলো, রহিম ব্যাপারীর চলে যাওয়া।
রহিম ব্যাপারী কোথায় গিয়েছে? ওর শ্বাশুড়ির বদ্ধমূল ধারণা রহিম ব্যাপারী এই পৃথিবী ছেড়েই হাওয়া হয়ে গেছে, যদিও ওর স্ত্রী রিনা মনে করে রহিম ব্যাপারী জাহাজ বা অন্য কোনো যানের সাহায্যে ওদের ছেড়ে বিদেশ চলে গেছে, অর্থাৎ দেশ ছেড়েছে।
যেহেতু, রহিম ব্যাপারী বর্তমানে আশেপাশে উপস্থিত নেই। তাই, ওর অন্তর্ধান নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করা মানায় না। কারণ, এই চিন্তাভাবনার ফলাফল একটাই আসবে, রহিম ব্যাপারী কোথায় হারিয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে আমরা কেউ-ই জানি না।
এবার ওর পরিবারের দিকে তাকানো যাক। ব্যাপারীর সতেরো বছরের একটি মেয়ে রয়েছে, যাকে ওর দাদী কালী বলে ডাকে। এই কালী ডাক থেকে আমরা অনুমান করতে পারি, মেয়েটির গায়ের বর্ণ কালো। অবশ্য এটা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত ছিল, কারণ কালীর মা-বাবা অর্থাৎ রহিম ব্যাপারী এবং তার স্ত্রী রিনা, দুজনের কেউই তেমন কালো না। তাই যখন রহিম ব্যাপারীর মা নিজ নাতনির মুখ দেখলো তখন মুখ কুচকে চরম বিরক্তি নিয়ে বলেছিল, মাইয়াডা তাইলে নানার রঙই পাইলো! রিনার বাবার রঙ কালো ছিল।
ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে গেলে ভালো হতো, কিন্তু তা হয় না। রহিম ব্যাপারী নিজের ঝুলে থাকা অঙ্গের সম্মান স্বরূপ, নিজের পৌরুষত্ব প্রদর্শনের জন্য নিজ স্ত্রীর উপর হাত তোলা শুরু করে। অতঃপর একদিন ও ভাতের প্লেট মেঝেতে ছুঁড়ে মারে, আর তখন ওর মা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠলেও মুখটা বেশ বিকৃত করে রাখেন এবং রিনাকে বলে ওঠেন, কোলের বেডিরে রাখো। ছুরৎ দেইখাই তো লাগতেসে আরেক ব্যাডার লগে হুইতা ওর জন্ম দিছো।
এইভাবে কালীর জন্মপরিচয়েই একটি দগদগে ঘা তৈরি করে ফেলে ওর আপন দাদি শবজান বানু৷ এবং এইসব কিছুর সূত্রপাত হয় জন্মের সময় তার বর্ণ কালো হওয়ায়, এবং তার একটি ঝুলন্ত অঙ্গ অনুপস্থিত থাকায়। এমনকি রহিম ব্যাপারীর অন্তর্ধানের দিনও ব্যাপারী চোখ দুটো লাল রঙে রাঙিয়ে বলেছিল, এতো তেল থাকলে তোর বাপের কাছে যা। আমার ঘাড়ে পইড়ে আছস ক্যান?
কালীর বর্ণ কালো হলেও ওর চোখ মুখ কেমন গাণিতিক সৌন্দর্য মেনে চলতো। পাশের বাড়ির রোহেনা চাচীর মতে, মাইয়া কালো হইলেও চেহারাখান একদম খোদার নিজ হাতে খোদাই করা। অর্থাৎ, আমরা বুঝতে পারি কালীর রূপ ছিল৷ নিজ গায়ের বর্ণ ওই রূপকে দমিয়ে রাখতে পারতো না, এইজন্য পাশের বাড়ির চাচী তারিফ না করে থাকতে পারে না। এই রূপ দেখেই পাড়ার ক্লাবে ক্যারাম খেলায় পারদর্শী হানিফ ভাই ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন কানাঘুষা শুরু হয় যে হানিফ ভাই ওর দলের ছেলেদের বলে দিয়েছে, কালী স্কুলে যাওয়ার সময় অন্য কোনো ছেলে যেন ওর ধারেকাছে না ঘেঁষে। এমনকি মুদির দোকানি আনোয়ার অনেককেই বলে বেড়ালো, সে কোথাকার কোন চিপায় হানিফকে কালীর হাত ধরতে দেখেছে, এবং ঐ সময় দু'জনের মুখেই বেশ উজ্জ্বলতা ছিল। পরবর্তীতে আমরা খবর পাই, হানিফ এই কথা শুনে দীর্ঘকাল আনোয়ারের কাছ থেকে স্বাভাবিকের থেকে বেশি চাঁদা নিয়ে দোকানিকে 'টাইট' দিয়েছে
আমরা আবার রহিম ব্যাপারীর অন্তর্ধানের দিনের ঘটনাবলীতে ফিরে আসি। রহিম ব্যাপারী নিজ মেয়ের জন্মপরিচয় নিয়ে হাজারতম বা তারও বেশিতম বারের জন্য অপবাদ ঘোষণা করে যথারীতি তার স্ত্রী রিনার পিঠে ঝাড়ুর দাগ বসাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। কালী সবকিছুই দেখে, এবং নিজের মনে মনে ওর বাবাকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দেয়। ওইদিন বিকেলে তাকে হানিফের সঙ্গে দেখা করতে দেখা যায় এবং চাঁদা ও মার খাওয়ার ভয়ে ভীত না থাকলে আনোয়ার হয়তো পাড়ার অনেককেই জানাতো যে কালীকে ওইদিন বেশ উত্তেজিত দেখা যায় এবং সে হানিফের কলার চেপে ধরে৷ এতে আনোয়ার যথেষ্ট অবাক হয়। কারণ যে হানিফ কথায় কথায় ছুরি চালায়, তার কলার ধরার মতো উঁচু হাত খোদা কাউকে দিয়েছেন, তা তার বিশ্বাস হয় না।
যাই হোক, ওইদিন রাতে রহিম ব্যাপারী আর বাড়িতে ফিরে না। অনেক খোঁজাখুঁজি চলে, এমনকি থানায় একটি জিডিও করা হয়। তবে সপ্তাহ খানেকের পর পুরো পাড়ার সবাই-ই বলাবলি শুরু করে যে রহিম ব্যাপারী হয়তো মারা গেছে বা কোথাও চলে গেছে। ওকে খোঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। আরও মাসখানেক পর রিনা ওর মেয়েকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি বেড়াতে যায় এবং সেখানে ওরা রহিম ব্যাপারীকে নিয়ে আলোচনায় মগ্ন থাকে। যদিও রিনা এবং তার মায়ের কোনো ধারণাই নেই রহিম ব্যাপারী কোথায় চলে গেল, কিন্তু বারান্দার কোণে বসে চাল বাছতে থাকা কালীকে(যার ভালো নাম লিপি) দেখে আমাদের একটি ধারণা হয়, সে তার বাবার অন্তর্ধান নিয়ে হয়তোবা সম্পূর্ণ ধারণাই রাখে।