সদ্য স্কুল পরীক্ষা দেওয়া এক ছেলে একবার তাঁর বান্ধবীর উদ্দেশ্যে হঠাৎ একদিন লিখে ফেলল একটি কবিতা। কবিতার নাম 'একটি চিঠি'। কিছু একটা ভেবে ডাক যোগে বিখ্যাত 'দেশ' পত্রিকার অফিসে পাঠিয়ে দিল সেই কবিতা।
১৯৫১ সালের ৩১শে মার্চ দেশ পত্রিকার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল কবিতাটি। দেশ পত্রিকার অফিস থেকে সেই ছেলের নামে আসল ভারী একটা খাম। এত ভারী খামের উপরে নিজের নাম লিখা দেখে ঘাবড়ে গেল ছেলেটি।
সেই ছেলেটির নাম ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
স্কুল পরীক্ষা দেওয়া এক কিশোরের পক্ষে এমন কবিতা লেখা সম্ভব তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো অনেকের৷ এমনকি যে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে লিখা হয়েছিল কবিতাটি সেও বিশ্বাস করতে চাইল না কবিতাটি সুনীলের লেখা৷
দুরন্ত সুনীল ছেলেবেলায় বেশিরভাগ সময় কাটাতেন বন্ধুদের সাথে বাইরে ঘুরে বেড়িয়ে। ছেলেকে ঘরে আটকে রাখার জন্য তার বাবা তাকে কবি টেনিসনের একটি কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বলেছিলেন প্রতিদিন দুইটি কবিতা অনুবাদ করতে৷ কবিতা অনুবাদ করতে করতে একঘেয়েমি চলে এলে সুনীল নিজেই রচনা করেন 'একটি চিঠি' নামের কবিতাটি। এই কবিতার মাধ্যমেই সুনীল সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন৷
শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রায়ই বলতেন, তাও রক্ষে, সুনীল মোটে একবেলা লেখে, দুবেলা লিখলে সে যে কি দাঁড়াত!
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মৃদু হেসে উত্তর দিতেন, তা হলে মদটা খাওয়া হত কখন?
৭৯ বছরের জীবনে মাত্র একবেলা লিখে সুনীল যা রেখে গেছেন তা রবীন্দ্রনাথ সম্ভারের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়৷
১৯৭২ সালে ইংরেজি এক সাক্ষাৎকারে সুনীল বলেছিলেন, বড্ড বেশি লেখা হয়ে যাচ্ছে। মানিক বাবুর পুতুল নাচের ইতিকথার মত একটা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারলে সব লেখা বন্ধ করে দেব৷
'পুতুল নাচের ইতিকথা' হয়তো লেখা হয়নি সুনীলের। তবুও আমরা তার কলম থেকে পেয়েছি 'সেই সময়', 'প্রথম আলো' ও 'পূর্ব পশ্চিম'এর মত সুবৃহৎ ও সুলিখিত উপন্যাস।
সময়ের দাসত্ব থেকে মুক্ত থাকতে কোনওদিনই ঘড়ি পরতেন না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একবার এক আড্ডার আসরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিয়ের সময় পাওয়া সায়মা ঘড়িটি খোয়া যায়৷ পরে পুলিশে রিপোর্ট করতে গিয়ে ঘড়ির নাম বলেছেন কখনও পার্কার, কখনও শেফার্স, কখনও পাইলট!
বন্ধুদের সাথে নিছক মজার ছলে কলকাতার সাহেবপাড়ার চৌরঙ্গীর মোড়ে একবার ভিক্ষে করতেও নেমেছিলেন সুনীল৷ তখন তরুণ বয়স৷ আড্ডা দিতেন আর ঘুরে বেড়াতেন প্রতিদিন৷ সেসব করতে অর্থের প্রয়োজন৷ সুনীলের এক বন্ধু বলে উঠল ভিক্ষে করলে কেমন হয়? যেই কথা সেই কাজ৷ দাঁড়িয়ে পড়ল তারা রাস্তা মোড়ে। প্রথমে কেউ ভিক্ষে দিতে চায়নি, যার কাছেই যার সে হুড়হুড় করে তাড়িয়ে দেয়৷ তারপর তারা চালাকি করে ইংরেজি বলা শুধু করল৷ সবাই তাজ্জব বনে গেল, এ দেখি ইংরেজি বলা ভিক্ষুক!
সুনীলের লেখালিখির ভক্ত ছিলেন জীবনসঙ্গীনী স্বাতী৷ যোগাযোগ ছিল চিঠির মাধ্যেম, সেখান থেকে প্রণয়৷ স্বাতীর পরিবারের দিক থেকে বাঁধা থাকলেও সুনীলকে উপেক্ষা করতে পারেনি স্বাতী৷
স্বাতীর সঙ্গে যখন বিয়ের আলোচনা চলছিল তখন মার্গারিটের কথার স্বাতীকে জানিয়েছিল সুনীল৷ বলেছিল তাঁর আর মার্গারিটের গভীর বন্ধুত্বের কথা। সবশুনে স্বাতী বলেছিলেন, শোন বিয়ে আগে যা করেছ করে ফেলছ। সেটা নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। বিয়ের পর যেন আর কিছু শুনতে না হয় আমাকে।
সুনীলের প্রিয় লেখক ছিলেন ফিওদর দস্তয়েভস্কি৷ তাঁর লেখার গভীর ব্যাপ্তিতে বার বার মুগ্ধ হয়েছেন সুনীল। দস্তয়েভস্কি'র লেখা উপন্যাস 'নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড' কে তুলনা করেছেন বেদের সঙ্গে৷ বন্ধুদের ধরে ধরে জিজ্ঞেস করতেন উপন্যাসটি পড়েছিস? পড়িসনি? পড়ে নে। সাহিত্যিক হতে হলে অবশ্যই ওটা লাগবে৷
কৈশোরে যে কবি টেনিসনের কারণে সুনীলের কবিসত্ত্বার প্রকাশ ঘটে সেই টেনিসনের নামে লিখেছেন একটি গ্রন্থ৷ বইয়ের নাম 'কবি টেনিসন-কে গালাগালি'।
বিতর্ক আর সমালোচনা কখনো পিছু ছাড়েনি সুনীলের। 'সেই সময়' উপন্যাসে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে সমকামী হিসেবে দেখানোর কারণে আদালত পর্যন্ত দৌঁড়াতে হয় তাকে৷ 'প্রথম আলো' উপন্যাসে একটি প্রত্যক্ষ উক্তিকে কেন্দ্র করে পড়েছিলেন ধর্মান্ধদের রোষানলে। রামায়ণের ভিন্নধর্মী এক ব্যাখা নিয়ে শুরু করেছিলেন উপন্যাস রচনা, শেষ করে যেতে পারেননি৷ নয়তো এই উপন্যাসও বিতর্কের জন্ম দিত তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
সুনীলের জন্মস্থান ছিল বাংলাদেশের মাদারীপুরে। সুনীলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাঁর নিজ গ্রাম কালকিনিতে 'সুনীল মেলা'র আয়োজন করা হয়৷ জীবিত অবস্থায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কয়েকবার এ মেলায় এসেছিলেন।
বাংলা সাহিত্যের বিরাট অংশজুড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম মিশে আছে৷ কবিতার মাধ্যমে তার সাহিত্য জগতে আগমন ঘটলেও ঐতিহাসিক ঘরানার লেখক হিসেবে সারাবিশ্বের কাছে তিনি সমাদৃত৷ তবে নিজেকে একজন কবি কিংবা ঔপন্যাসিক নয়, বরং কবিতা লেখক হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন তিনি ৷ সুনীলের 'সময় ট্রিলজি' নামে খ্যাত তিন উপন্যাস ( সেই সময়, প্রথম আলো, পূর্ব পশ্চিম) সকলস্তরের পাঠকের কাছে এক বিস্ময়!
খুব ভাল লাগার মত