অদ্রিজা রাগ করে নাক ফুঁলিয়ে রেখেছে৷
সন্ধ্যা সাতটার ট্রেন৷ সে বাপের বাড়ি যাবে৷ সাথে আমাকেও যেতে হবে৷ অফিসে কাজের ছুঁতো দেখিয়ে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শ্বাশুড়ি আম্মা এমনভাবে চেপে ধরল যে না গিয়ে আর উপায় নেই৷ গাঁটছড়া বাঁধা সব হয়ে গেছে৷ একটা লাগেজ আর দুটো বস্তা। বস্তার মধ্যে রাজ্যের আজগুবি জিনিসপত্রে ভরা৷ যেমনঃ কোঁড়া নারকোল, দুটো ২ লিটারের বোতল ভর্তি খাঁটি ছাগীর দুধ, তিনটে কাঁচা কাঁঠাল, দুটো পেঁপে, এইসব আর কি।
বিয়ের সময় লোকে যৌতুক নেয়, আমি তো তাও নিইনি৷ শুধু বউটা নিয়ে এসেছিলাম। বউয়ের বদলে সারাজীবন ধরে এতকিছু দিতে হবে বলে একটু রসিকতা করেছিলাম শুধু। তাতেই নাকটা যেন দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছে৷
অদ্রিজা মোটে এক বাপের এক মেয়ে৷ কিন্তু ওর জ্যাঠাতো, মাসিতো কিংবা পিসতোতো ভাইবোনের সংখ্যা যে কত তা আমি বিয়ের ৩ বছর পরে এসেও হিসেবে করে শেষ করতে পারিনি৷ এসব শ্যালক-শ্যালিকাদের জ্বালায় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে টেকাই দায় হয়ে দাঁড়ায়। ও এসে ডাকে, সে এসে হাঁক দেয়, বউয়ের মুখ রাখতে আমাকেও যেতে হয়। আর গেলেই খরচা।
প্রতিবারই শ্বশুরবাড়ি থেকে শূন্য পকেটে ফিরতে হয়৷
৬টার দিকে বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। আপাতত স্টেশনে একটা বেঞ্চিতে বসে ট্রেনের প্রতীক্ষা করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। টিকিট আগেই কেটেছিলাম। অদ্রিজা জিনিসপত্রের ব্যাপারে মারাত্মক সংশয়বাদী। বার বার দেখে নিচ্ছে সব ঠিকঠাক আছে কি না।
একটু চোখ বুঁজে গিয়েছিল। অদ্রিজা চিৎকার করে উঠল, ওগো শিগরির ওঠো। সর্বনাশ হয়ে গেছে।
ধড়মড়িয়ে উঠে বললাম, তোমার আবার এরমধ্যে কে সর্বনাশ করল? সর্বনাশ তো যা হবার আমার হয়েছে৷
অদ্রিজা বলল, হ্যাঁ৷ কতই না তোমার সর্বনাশ করেছি৷ সংসারের জন্য চিনির বদলের মত খেঁটে গেলাম তবুও মিনসের মন পেলাম না৷
বললাম, এত ভণিতা না করে কি হয়েছে তা খুলে বলো দেখি৷
অদ্রিজা বলল, আম আনতে ভুলে গেছি। ছোট কাকার মেয়ে বিন্তি আম খেতে বড্ড ভালোবাসে৷ স্টেশনের বাইরেই দেখলাম আম নিয়ে বসে আছে। যাও না একটু, কেজি পাঁচেক আম নিয়ে এসো।
অগত্যা আমাকে স্টেশনের বাইরে আম কিনতে যেতে হলো। স্টেশনের বাইরে সারি সারি আমের দোকান। আমের মৌসুম চলছে, তারপর আমাদের রাজশাহীর পাশের জেলা নাটোর। বৃষ্টির অভাব থাকলেও আমাদের আমের অভাব হয় না কখনো।
এক দোকানির কাছে গিয়ে দরদাম জিজ্ঞেস করলাম৷ আম্রপালি ১১০ টাকা কেজি, কালুয়া ৭০ টাকা, ল্যাঙরা ৯০ টাকা আর মোগনভোগ-গোপালভোগ ১৮০ টাকা করে কেজি। মানুষের মধ্যে জাত-পাত, বর্ণপ্রথা আছে কিন্তু আমের মধ্যেও যে এত জেতের ফাতা আছে তা বড়ই বিস্ময়কর।
দোকানিরা দাম কমাতে রাজি নয়। আমার মত ক্রেতার তাদের অভাব নেই। এখানে না বিক্রি হলেই আজ রাতেই স্পেশাল ম্যাংগো ট্রেনে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দেবে৷
এ দোকান-সে দোকান ঘুরছি। আম পছন্দ হচ্ছে কিন্তু দামে কুলোচ্ছে না। এক দোকানি হাঁক দিল,
আরে অতিসদা না? কত্তদিন পর দেখা। এদিকে আসুন।
কাছে গিয়ে মুখ খানা দেখেই চিনে ফেললাম। আমাদের রাজশাহী কলেজের দুই ব্যাচ জুনিয়র ছেলে আলতাফ। ছাত্রবস্থায় একসাথে ছাত্র ইউনিয়ন করেছি। লেখাপড়ার সাথে সাথে রাজনীতির পাটও চুকিয়ে ফেলেছি বহু আগে৷ এদের সাথে আর তেমন দেখা নেই।
আলতাফের সাথে খানিকক্ষণ কুশলাদি সেরে নিলাম৷ জানলাম তাদের পারিবারিক আমের ব্যবসা৷ খুচরো বিক্রির পাশাপাশি বড় বড় শহরেও চালান দেয়৷ সুযোগ বুঝে ওর কাছেই কথাটা পারলাম৷
বললাম, বুঝলি তো আলতাফ। ছাত্রবস্থায় থাকতে এসব জাত-পাত মানতাম না। বর্ণবাদ প্রথার ঘোর বিরোধী ছিলাম, কত আন্দোলন করেছি এসব নিয়ে। কিন্তু দ্যাখ মানুষ কোনওভাবেই বর্ণবাদের বাইরে যেতে পারেনি৷
সামান্য আম, তাও তাদের মধ্যে বর্ণ বিভেদ!
কালুয়া বা ল্যাঙরা বলেই কি শুধু ওদের দাম গোপালভোগ-মোহনভোগদের চেয়ে কম হবে?
আলতাফ এতক্ষণ নিঃশব্দে শুনছিল। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার চোখ অশ্রুসজল। আমার হাত চেপে বলল, দাদা তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছ। আমি এতদিন কি অন্যায়টাই না করে এসেছি। ছিঃ ছিঃ। তুমি দাঁড়াও, আমি এক্ষুণি আসছি।
আলতাফ দুই কর্মচারীকে সাথে নিয়ে ফিরল। তাদের হুকুম করল সব আমের বস্তা থেকে এক কেজি করে আম নিয়ে একসাথে ভালো করে মিশাতে। তারপর এক থলের মধ্যে রেখে আমার হাতে দিয়ে বলল, দাদা এই উপহারটুকু তুমি গ্রহণ করো৷ তুমি আমার ভেতরে সত্যকে জাগিয়ে তুলেছ। এই সামান্য কটা আম আমি তোমাকে উৎসর্গ করলাম৷
আলতাফের হাত থেকে আমের থলেটা নিয়ে তাকে প্রাণভরে আর্শীবাদ করলাম। আলতাফ ট্রেন পর্যন্ত এসে বিদায় দিয়ে গেল।
আলতাফ যা আম দিয়েছিল তা ওজন করলে অন্তত কেজি দশেক তো হবেই। এদিকে পাঁচ কেজির জায়গায় দশ কেজি আম নিয়ে আসায় গিন্নি তো বেজায় খুশি, ওদিকে পয়সা খরচ না হওয়ায় আমারও খুশি আর ধরে না৷ একেই বলে 'ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি ফলে।'