১। প্রথমেই মনে রাখতে হবে, বাঙালী শপিং করে না। তারা মার্কেটে যায় 'মার্কেটিং' করতে। আর দোকানদার শপ্ খুলে বসে থাকে, তাই সে করে শপিং। গ্রামার আর ইকনমির হাতে হ্যারিকেন, বাঙালীর জয়।
২। দ্বিতীয়ত, বাঙালী দোকানে জিনিস কিনতে যায় -- কে বলেছে আপনাকে? তারা যায় দোকানদারের রিয়ালিটি চেক করাতে। প্রতিটা প্রোডাক্টেই প্রায় রে-রে করে তেড়ে যাওয়া -- কি বললি? ওইটা পাশের দোকানে (পাশে কোনো দোকান নেই, 'পাশের দোকান' হল ঈশ্বরের মতো অ্যাবসেন্ট প্রেজেন্স) তিরিশ টাকা বলল, আর তুই দেড় টাকা বাড়িয়ে বলছিস কেন? ইত্যাদি অন্তে দোকানদারের মুখে ফেনা তুলিয়ে জিনিসটা পঁচিশ টাকায় নামিয়ে না কিনে চলে যাওয়া (দাঁড়া পাশের দোকানে দেখে আসি)।
৩। এইফাঁকে বলে রাখি, আমি বাজার করতে ভালোবাসি না। বাড়ি থেকে চিনিপাতা-দই ডিমভরা-কই ভেবে বেরিয়ে আমার চিনিপাতা-কই আর ডিমভরা-দই আনার অবস্থা হয়। মুদির দোকানে গিয়ে আমি হাতে লেখা লম্বা ফর্দ ফেলে দিয়ে পাশের মিষ্টির দোকানে গিয়ে দই আর কমলাভোগ খাই। তারপর উল্টোদিকের রিক্সাস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সার চাকার স্পোক গুনি, তারপর দোকানে গিয়ে টাকা দিয়ে ফর্দটা পকেটে ঢুকিয়ে জিনিসপত্র কিছু না নিয়ে আধপথ এসে মনে পড়ে, ও না আমার হাতে তো কিছু থাকার কথা। তখন আবার ফিরে যেতে আমাকে প্যাকেট ধরিয়ে প্রায় বাড়ির পথ দেখিয়ে দেওয়া হয়।
৪। আর ভাই মাছের বাজার! অনেক দেখে বুঝেছি, সেখানকার স্ট্র্যাটেজি হল, আপনি গিয়ে কোনো বিশেষ দিকে না তাকিয়ে হাওয়ায় "কত?" প্রশ্নটা ভাসিয়ে দিন। ক্যাসুয়ালি। প্রশ্নের রেশ মেলাতে না মেলাতেই দোকানী, খদ্দের, বেড়াল, মায় জিওল মাছগুলো হাঁকুপাঁকু করে আপনাকে দর বলতে আসবে। সেসব শুনে সুস্থিরভাবে আপনি যুগপুরুষের মতো মাছ বাছবেন। তারপরে আবার কিসব কানকো দেখা, পেটি-মুড়ো কাটাকাটি, পেট টেপার (মাছের) ব্যাপার আছে। খুব কঠিন। আশ্চর্য ব্যাপার, আমি একটা মাছের পেট টিপে কি বুঝব? একবার পমফ্রেট কিনতে গেছি, দোকানী বলল, ফ্রেশ একদম। দেখুন পেটটা টিপে। যারপরনাই ইতস্তত করে হাত রাখলাম। মাছের পেট বলেই মনে হল। আর কি বুঝবো! তারপর খেয়াল না করে রুই মাছের আন্দাজে টুকরো করতে বলায় শেষে দেখলাম পেনসিলের মতো হয়ে গেছে মাছগুলো।
৫। দরদামে আমি ভীষণ অপটু। একবার গোলপার্কের ফুটপাথে অনেক দর করে একটা দেড়শো টাকার বই একশো-তিরিশ টাকায় কিনে খুব গর্ব করছিলাম মনে মনে। কিন্তু পরে বুঝেছি, দরদামের জন্য গলার জোর আর কল্পনাশক্তির প্রয়োজন। এমন একটা দাম বলতে হবে আপনাকে, যেটা শুনে দোকানদারের আপনার সঙ্গে লড়াই করার ইচ্ছে চলে যাবে। একবার বাবার সঙ্গে বেরিয়েছি, রাস্তায় ঢালাও টুপি বিক্রি হচ্ছে, কিনব। দাম কত? এক দাম -- একশোকুড়ি। বাবা বলল, তিরিশ টাকায় দিলে দাও। আমি তো লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছি প্রায়, বাবার হয়ে দোকানদারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার তোড়জোড় করছি, তাকে যে 'এক দাম' একশোকুড়ির উত্তরে তিরিশ শুনতে হল, এর ক্ষতিপূরণ হিসেবেই তাকে কিছু টাকা দেওয়া যায় কিনা ভাবছি, এমন সময় দেখি দোকানী সুড়সুড় করে চল্লিশ টাকায় আমার মনের মতো টুপিটা দিয়ে দিল। আরেকবার আমার পিসোর সঙ্গে আহার-অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে পাতিলেবু কিনতে গিয়ে গলার জোর দেখেছিলাম। জোড়া একটাকা শুনে পিসো একবার "কীইইই?" বলায় দোকানী প্রায় গামছায় বেঁধে শ' খানেক পাতিলেবু পনেরো টাকার বিনিময়ে বেচতে চেয়েছিল।
৬। কলেজস্ট্রীট। ওয়ান-ওয়ে রাস্তায় কানের পাশ দিয়ে সাঁইসাঁই করে বাস-গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে, তবু আপনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়েই হাঁটবেন, কারণ ফুটপাথে উঠলে "এই যে বড়ভাই এদিকে", "বইটা এদিকে পাবেন দাদা", "কোন্ বইটা, এইত্তো...", "হ্যাঁ বলবে ভাইটি, ABTA-JEE-MBA সব রাখি।"
- "লোকেশন অফ্ কালচার-টা হবে?"
শুনে ইনকনফিডেন্সেই দোকানটা মাটিতে ডেবে যায়। তারপর তারা আমাকে চরম অভক্তিতে "নেই" বলে। অনেকে তাও বলে না, স্রেফ্ ইগনোর করতে থাকে এসব নাম শুনলে। আর কেউ কেউ খুব ভদ্র হলে একটা অসম্ভব রহস্যপূর্ণ হাসি হেসে বলেন, সামনের মাসে আসুন। (তদ্দিনে কালচার লোকেটেড হয়ে যাবে।)
৭। শাড়ির দোকান। যেতে হবে শুনলে অ্যান্টিসিপেশনেই পা ব্যাথা হয়ে যায়। কতরকম শাড়ি, তার কতরকম দোকান, শাড়িকুটীর, শাড়িকুঠি, শাড়িদূর্গ, শাড়িগুহা, তার আবার 'আদি' (অন্ত বলে তো কিছু হয় না), আর সবশেষে বুটিক। মহিলারা তাকগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে হারমোনিয়ামের রীড বাজানোর মতো শূন্যে আঙুল বোলান, মুখ থেকে নিঃসৃত হতে থাকে "ওইটাএইটাওইটাএইটাওইটা"। কাউন্টারের মানুষেরা মানুষ নন, দেবতা। ঐ ইশারাতেই ঠিক ঠিক শাড়িগুলো নামাতে থাকেন (আমি হলে তো তাক উপুড় করে দিয়ে বলতাম, "নে তোর যা প্রাণ চায় কর এগুলো নিয়ে")। এরপর কিছু স্টেপ আছে। কিছু শাড়ি দেখে ভুরু কপালে উঠবে, কিছু শাড়ি দেখে নাক কুঁচকে ছোটো হবে, কিছু শাড়িকে চোখ সরু করে পরিহিত অবস্থায় ইম্যাজিন করা হবে। তারপর মোটামুটি পঁয়ত্রিশটা শাড়ি সামনে খুলে আলোচনা করা হবে এটার পাড়টা যদি ওটায় বসতো আর ওটার আঁচলটা যদি সেটায় বসতো, আর এটার আর সেটার ডিজাইন যদি ওটার কালারে আসতো, বা 2003 সালের পুজোতে দেখা একটা শাড়ির বেসটা যদি তস্য ডিসট্যান্ট একটা শাড়ির রঙে মিল খেত, তবে কি ভালোই না হত? সবশেষে আপনার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করা হবে, "তাই না?" এরপর আপনি কোনদিকে ঘাড় নাড়বেন, আপনার ব্যাপার।
৮। মিষ্টির দোকান। প্রায় শাড়ির মতোই গল্প। আহাহা, এই দুধ চমচমের মিষ্টিটা যদি জলভরায় আনতে পারতিস রে!
বা
আমাকে দশটা রসগোল্লা পনেরোটা কালোজাম চারশো মিহিদানা আর ঐ গুল্লিগুল্লি নতুন মালটা ছশো পাঁচ জায়গায় আলাদাভাবে আর এক জায়গায় চারভাগে দে।
বা
দাদা, রাবড়ি কত?
একশোচল্লিশ কিলো।
আর রাজভোগ?
পনেরো টাকা পিস্।
আচ্ছা, আমাকে তাহলে পাঁচটা গুজিয়া দিন।
৯। একমাত্র মলে গেলে আমরা দর করি না। দোকানেই ঢুকি না। ভদ্র টিকটিকির মতো দোকানের বাইরের কাচের দেওয়ালে লেপ্টে সেলফি তুলি, আর দোকান দেখিয়ে বলি, "ওইদ্দ্যা, ব্র্যান্ড!!!"
১০। তবে এখনো সেরা সিচুয়েশন হল, হিন্দুস্তানী দোকানে বাঙালীর কেনাকাটা। "ইয়ে চিজ হিঁয়া সে লে কর হুঁয়া রাখো, অর হুঁয়া সে উসকো বাজু মে সরা দো। দেখনা বাবা, হামকো ঠকানা নেহি, হাঁটু মে দরদ হ্যায়। আরে ইয়ে কেয়া করতা? দাঁড়িপাল্লা তো অভি ভি কাত হ্যায়। কারচুপি?" আর এই করতে করতেই আমাদের দিন মাস বছর কেটে যায়। সির্ফ হিঁয়া কা চিজ হুঁয়া অর হুঁয়া কা চিজ হিঁয়া করতে করতে হাম বড়া হো গ্যায়া অউর আব উস বড়া কে ঝোল মে সাঁতার কাট রাহা, লেকিন একূল ওকূল দুকূল হি গ্যায়া মালুম হোতা। না শিখা ভাষা, না হুয়া বাজার।