গত এক বছরে কমপক্ষে পঁচিশ থেকে তিরিশজন পরিচিত ব্যক্তি মারা গেছেন, বেশিরভাগই কোভিডে। এমন বহু মানুষ, যাদের স্নেহছায়ায় ছোটবেলা কেটেছে, যাদের সঙ্গে একসময় নিত্যকার হাসিমজা বা খুনসুটির সম্পর্ক ছিল, তারা চুপচাপ বিদায় নিয়েছে মহামারির মধ্যেই। আচমকা বিদ্যুৎচমকের মতো একেকটা দুঃসংবাদ আছড়ে পড়ে, স্কুলের বন্ধুর মা বা পরিচিত কোনো বন্ধুর বাবা গত হয়েছেন, তখন কত কথা মনে পড়ে যায়। এরকম কত কত মানুষ যাদের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে দেখা সাক্ষাত নেই, তাদের ঘিরে ধরে থাকা সুখস্মৃতি নাড়া দিয়ে যায় তখন। বন্ধুর মায়ের হাতের রান্না বা প্রয়াত অগ্রজ বান্ধবদের স্নেহমাখা বকুনির কথা এসে ধাক্কা দেয় মানসপটে।
কত কত সম্পর্ক! কত স্মৃতি!
কালের নিয়মে ফ্যাকাসে হয়ে আসে কত কথা, অভিমান বা সময়ের অভাবে ফিকে হয়ে আসে বন্ধুত্বের বাঁধন! যারা স্নেহ করতেন, এক এক করে চলে যাচ্ছেন, মন খারাপ করে সত্যিকে মেনে নিচ্ছি আমরাও... অবশ্যম্ভাবী নিয়তির গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার জন্যেই যেন প্রতীক্ষারত আছে বহু আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পত্রমিতালি, সোশ্যাল মিডিয়া বা পথের সাথীরা, প্রিয় লেখক বা শিল্পী! ইয়োগেশ প্রভীনের মতো প্রিয় লেখক ইতিহাসবিদ বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন, মাংলেশ দাবরাল হারিয়ে গেলেন তিন দিনের জ্বর আর সংক্রমণে... আরো কত কত প্রিয় নাম! ব্যাক্তিগত পরিসরেও নামের লিস্ট বেড়েই চলেছে। অনেকের সঙ্গে হয়তো কথা হয়েছে শেষ দশ বছর আগে, এর মাঝে একদিনের জন্যেও কথা হয়নি। সত্যি বলতে তারা বেঁচে ছিলেন কি না সেটাও ঠিক করে জানা ছিল না। তাদের মৃত্যুসংবাদ শুনে অবশেষে স্মৃতিচারণ করছি, মনে পড়ছে কত পুরোনো কথা! হয়তো হিপোক্রেসি! অথবা এটাই স্বাভাবিক!
যেভাবে ঝড়ের বেগে বছরগুলো কেটে যাচ্ছে, কয়েক দশক কেটে যেতে খুব একটা সময় লাগবে না। বয়স যত বাড়বে, পরিচিত বৃত্ত ক্রমেই সংকুচিত হবে। আরো গভীর আঘাত আসতে চলেছে, আরো বহু প্রিয় মানুষের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে হবে, সেটাও প্রায় জানা কথা। নতুন কিছু সম্পর্ক হয়তো তৈরি হবে, কিন্তু পুরোনোগুলো হারিয়ে যাওয়ার বেদনা তাতে মিটবে না। যত দিন যাচ্ছে, এই কথাগুলো মনের পরিসরে জায়গা করে নিচ্ছে আরো বেশি করে। এই পরিণতি আমাদের প্রত্যেকের জন্যে, প্রকৃতির এই চক্রে কোনো ব্যতিক্রম নেই।
একের পর এক মৃত্যুসংবাদ হজম করে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে আরো ভালো করে উপলব্ধি করছি, জীবনের এইটুকু সময়ে এজ আর সোশ্যাল সেগমেন্টেশন কতটা যুক্তিহীন, কতটা অবান্তর! ভালো রেজাল্ট আর ভিত্তিহীন প্রতিযোগিতার দৌড়েই অর্ধেক জীবন কেটে গেল, সেটা শেষ হতে না হতেই কর্মজীবন আর আনুসাঙ্গিক দায়িত্ব নির্বাহ! দিনের পর দিন কিছু টাকার জন্যে নষ্ট করা অমূল্য সময়! পছন্দসই কাজ না হলে বছরের পর বছর চাকরি বা ব্যবসা করার মতো বাধ্যবাধকতা শুধুই কি অর্থের জন্য? এর মধ্যে এসে জুটেছে আমাদের ভ্যালিডেশন পাওয়ার তাৎক্ষণিক লালসা! ফেসবুক পোস্ট হোক অথবা অন্য কোনও কাজের স্বীকৃতি, সব কিছুই এক্ষুনি চাই। কালে কালে কত জিনিয়াস এলেন-- শিল্পী, অভিনেতা, লেখক, রাজনেতা-- তাদের নিরানব্বই শতাংশ স্রেফ উবে গেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মস্তিষ্ক বা বৃহত্তর মানবসমাজ থেকে, কেউ তাদের মনেও রাখেনি। বড় বেশি গুরুত্ব দিই নিজেদের আমরা! বোকা হলে যা হয়! উই আর ইনসিগ্নিফিক্যান্ট ইন দিজ ইউনিভার্স! জেনেবুঝেও আমরা কোন মায়ার ফাঁদে পড়ে আছি। হায়!
এই ছুটোছুটি আর তাড়াহুড়ো ছাড়া কি আজকের সমাজে বাঁচা যায় না? সবাইকে সাফল্য পেতেই হবে, জবাব দিতেই হবে, নিয়ম মানতেই হবে, এমন দিব্যি কে দিয়েছে?
কুড়ি দিন ধরে যেখানে আছি, পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা গ্রাম। গাড়ি আসার পথ নেই, ট্রেক করে আসতে হয়। পাইন গাছের বনের পিছনে প্রায় গাঁয়ের কোলেই অবস্থিত বরফের পাহাড়, ঘন্টা দেড়েক হাঁটলেই গ্লেশিয়ার আর তুষারের রাজ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। রাতে মাঝেমধ্যেই বরফ পড়ে(আবহাওয়া বদল হলে সকালেও পড়ে), ভোরের সবুজ আলোয় দেখি পাহাড়ের চুড়াগুলো ভ্যানিলা আইসক্রিমের মতো দেখতে লাগে। শরতের মতো নির্মেঘ নীল আকাশ, শীতও প্রচন্ড! রোদ বাড়লে শীতের কামড় আলগা হয় খানিক, যদিও দুপুরের পর বেশিরভাগ দিনই বৃষ্টি পড়ে, দামাল হাওয়া দেয়। শীতে কাঁপতে কাঁপতে দেখি, ঘোড়ায় মাল চাপিয়ে গ্রামের লোক পাকদণ্ডী বেয়ে চলেছে অন্য গ্রামে। রেডিওতে গান চলছে, অথবা নিজেই গুনগুনিয়ে চলেছে পছন্দের সুর।
গ্রামটা অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো, যেখানেই দেখি অ্যাপেল অর্চার্ড। আপেলের চাষ করে গ্রামের মানুষ, অনেকেই বেশ বিত্তশালী। কাঠ আর পাথর দিয়ে তৈরি দু'তলা তিনতলা বাড়িগুলো ট্র্যাডিশনল স্টাইলে তৈরি, কাঠের সিড়ি দিয়ে উঠলে মটমট করে শব্দ হয়। আমরা যেখানে আছি, সেই বাড়ির মালকিনের নাম সীতা। ছোট ছোট কয়েকটা ছেলেমেয়ে আছে, সারাদিন খেলে বেড়াচ্ছে আর কার্টুন নেটওয়ার্ক দেখছে। পরীক্ষার পর স্কুল ছুটি, অনলাইন ক্লাস শুরু হবে পরের মাসে, এর মাঝে দিব্যি ছুটি উপভোগ করা চলছে। রোদ ভালো থাকলেও গ্রামের অন্য বাড়ি থেকে কচিকাঁচাদের দল চলে আসে, শুরু হয়ে যায় খেলা। দৌড়াদৌড়ি, ছুটোছুটি। এর মধ্যে মাঝে একদিন একজন আমাকে ডাব্লু ডাব্লু স্টাইলে কব্জা করতে এসেছিল, তাকে ধরে আচ্ছাসে কাতুকুতু দিতেই পালোয়ানবাবু রণেভঙ্গ দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে হাসতে শুরু করলেন। সে দেখে অন্য মেয়েগুলোর কি হাসি! তিনটে ছোট বোন আছে ছেলেটার, একদম পুতুল পুতুল দেখতে, চিনির গুঁড়োর মতো মিষ্টি হাসি। দাদাকে একটু ভয়ই পায়, তার এমনধারা অবস্থা দেখে মেয়েগুলো তিড়িং তিড়িং করে লাফাতে শুরু করল, তারপর থেকে আমাকে দেখলেই অনুমোদনের হাসি হাসছে পুতুলত্রয়ী কন্যারা।
সকাল থেকে কাঠের বারান্দায় বসে পাহাড় আর মেঘের খেলা দেখি, বই পড়ি পিঠে রোদ লাগিয়ে। গান শুনি। মাঝে মাঝে হাওয়া দেয় বলে জ্যাকেট রাখতে হয় সামনেই। ঘোড়া আর খচ্চরের দলের পাশে কয়েকজন ডে ট্রিপার আসে লাঠি নিয়ে, দু একজন রাতে থেকেও যায় কোনো বাড়িতে। আপেলের ক্ষেতে আর দেবদারু বন ছাড়াও নানা রকমের গাছ আর সব্জির বাগান আছে, তার ফাঁক দিয়ে নালার জল বয়ে যায়। আসলে গ্লেসিয়ার থেকে আসা স্বচ্ছ জলধারা, এই জল সব জায়গাতেই ব্যবহার করা হয়। কিছু নতুন হোমস্টে তৈরি হচ্ছে, স্থানীয় মানুষরা জায়গা লিজ দিয়েছে। সেখান থেকে আচমকা গিটার বা ইংরেজি গানের সুর ভেসে আসে। রোদে বসে গায়ে সর্ষের তেল মাখতে মাখতে গরুর গলার ঘণ্টার শব্দ শুনি। বুঝতে পারি, গ্রামের বউরা এইবার গরু নিয়ে পাহাড়ে চলেছে। মিনিট তিরিশেক চড়াই উঠলেই দেবদারু গাছের বনে গুল্মলতা আর ঘাসের জঙ্গল, চারার অভাব হয় না। বিকেলে গরুগুলোকে নিয়ে ফিরে আসবে তারা, কিছু কাঠও সংগ্রহ করে আনবে সঙ্গে। তারপর বাড়িতে এসে চা!
প্রায় সব বাড়িতেই হয় গরু নয় ঘোড়া আছে, মাল বইতে না গেলে ঘোড়াগুলো আপেলের বাগানে ঘুরে বেড়ায়, চি হিঁ হিঁ শব্দ ভেসে আসে দূর থেকে। গরু ঘোড়া না থাকলেও কুকুর আছে তাগড়াই, যদিও খুবই সভ্যভব্য। পোষা না হলেও সকলেই খাবার দেয় কুকুরদের, কুকুরগুলোও সেই আশায় থাকে। বৃষ্টি হলে সটান দোতলার বারান্দায় উঠে আসে, বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বসে তাদের কার্টুন দেখার বিরল দৃশ্যেরও সাক্ষী হয়েছি।
গ্রামের মধ্যে পাকা রাস্তা নেই, এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথ। বৃষ্টি হলে কাদা হয় বড্ড, পা পিছলে আলুরদম হওয়ার চান্স ষোলোআনা, তাই সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। গ্রামে ঢোকার মুখে দু' চারটে দোকান, সেখানে সস্তায় খাবারের বন্দোবস্ত করে নিয়েছি, সুতরাং সন্ধ্যের পর বেরোতেই হয়। অন্ধকার রাস্তা, ল্যাম্পপোস্টের বালাই নেই, টর্চ হাতে উতরাই নামা এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। শীত বেশি বলে সোজা দোকানের রান্নাঘরে চলে যাই, সেখানে তখন দুই বন্ধু রান্না শুরু করে দিয়েছে। অনু আর গীতা বলে দু'জন অল্পবয়সী মেয়ে দোকানটা চালায়, তাদের রান্নার হাত অসাধারণ। মংগোলোয়েড ধরনের মুখ, সম্ভবত তিবেতান। মাঝে মধ্যে খাওয়ার সময় একটা কালো তুলোর বলের মতো ছোট কুকুর ঢুকে পড়ে, নাম সাইচু। অন্য দোকানির মেয়ের সঙ্গে সারাদিন তার কুস্তি চলছে, যেন সাইচু তার আপন ভাই। বহুত দুষ্টু হয়েছে সাইচু, তাই পাউরুটির পাশাপাশি আকছার আদরের কানচপাটিও খেতে হয় তাকে।
দিন কেটে যাচ্ছে নিরুদ্বেগে। আশেপাশের গ্রামে চলে যাই মাঝেমাঝে, বনে গিয়ে শুয়েবসে থাকি। সূর্য ওঠে, ডুবে যায়। অনেক নীচে নদী বয়ে যাচ্ছে, জলের শব্দ আর হিমেল হাওয়ার শব্দে মিশে যায় ঘোড়া আর গরুর গলার ঘন্টি, বাচ্চাদের হাসি আর হিমাচলি ভাষার কথোপকথন। গ্রামের মিঠে গন্ধ মহামারির মধ্যেও মুছে যায়নি, দেখে স্বস্তি হয়।
দিল্লি আর সারা দেশে কী অবস্থা, সেই খবর আগেই কানে এসেছে। ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায় নেই। আগে-পরে এই মহামারিও কেটেই যাবে, হয়তো অনেক কিছু কেড়ে নিয়ে যাবে। তার পরেও আমাদের জীবন চলবে একই ভাবে, বদলাবে না কিছুই। ইঁদুর দৌড়ে ছুটতে থাকবে পৃথিবীর মানুষ, লকডাউন হবে না আর! বরং ক্ষতি পোষাতে উঠেপড়ে লাগবে সবাই। 'গ্রোথ' এর সরলরৈখিক টার্গেট অ্যাচিভ করতে বেশি বেশি কাজ করবে সবাই, ছুটিতে টান পড়বে। আরো বেশি করে নজর দেওয়া হবে বন্ধ থাকা ইন্ডাস্ট্রির দিকে, উন্নয়ন হবে জোরগতিতে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আর নতুন হাইওয়ের পাশাপাশি এক্সটেনশন হবে টুরিজম মার্কেট, ছোট ছোট গ্রামগুলোতে হোটেল হবে, রাস্তা হবে। দশ বছর পর এই গ্রামটা আর থাকবে না, এই ভাবে থাকবে না। বাচ্চাদের হাসিমজা আর ঘোড়ার গলার ঘণ্টি সুদ্ধ সব কিছুই বেমালুম উবে যাবে। জানি, আমাদের জীবনটাও বদলে যেতে থাকবে একইভাবে। কিন্তু প্রার্থনা করি, এই গ্রামে যেন ফিরে না আসতে হয় সে সময়। এই উন্নয়ন আমি সইতে পারব না।
জীবনের কয়েকটা দিন! কিছু অভিজ্ঞতা আর সুখস্মৃতি অর্জন করি যেন, বাকি সব অবান্তর কথাবার্তা দূর হয়ে যাক। এইটুকুই চাওয়া। এইটুকুই।