জ্বরের ঘোর থেকে উঠলে যেমনি হয়, আমার তেমনি লাগছে। মুখটা একটানা বিস্বাদ; কালকের তেতো প্যারাসেটামল আর জলের স্বাদ যখন মুখের মধ্যে বিরাজমান, আগেরদিনের মদের গন্ধের মতো, কিন্তু বুক পেট ঘিরে প্রচন্ড ভাতের খিদে। আমার জ্বর হয়নি। বা হয়েও থাকতে পারে। সেটা বড় কথা নয়। এখন কোনো কথাই এই ভোরের বেলায় (ভোর না রাতের এক্সটেনশন, রাতের কালি বারুদ ফুরোবার বিষণ্ণতা?) তেমন কিছু নয়। সবই কেমন যেন নিস্তেজ, ম্রিয়মাণ; তেমন ভীষণ কোন ভাবের সঞ্চার নেই এই বাগানের গাছপালাগুলোদের মধ্যে, এই সকালের আলোয় ফিকে হয়ে আশা উল্টো দিকের একচিলতে পাঁচিলের মধ্যে। কিন্তু আমার মধ্যে একটা খুশি খুশি ভাব একটু একটু করে উঁকি দিচ্ছে, রাতের প্রথম প্রহরে যার কোন আপাত আভাস আমরা পাইনি। আমি হতে পারে বা আমরা। সেটা জরুরি নয়; আমি তো জ্বর থেকে উঠেছি সদ্য। বিশাল ঘাম পিঠে-ঘাড়ে-কপালে-বগলে। একটা অনন্ত ঘামের কুয়োর মতো উঠে এসেছি সকালের সেচনের দেশে। এই কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো রাস্তা ধোয়া হবে; হয়তো ও বাড়ির বারান্দা আর সিঁড়ির ধাপগুলোকে ঝকঝকে মসৃণ করে, ঢেলে দেবে কালো কুয়ার জল একবালতি কোনো উবু হয়ে বসা পরিচারিকা -- তার হাতের শাখা-পলা কেঁপে উঠবে, আর গাঢ় থিকথিকে জলটা কোনো মসৃণ সর্পের অনুকরণ করে ধেয়ে আসবে রাস্তার আড়াআড়ি ভাবে; থমকে থাকবে রক্তে পিচ্ছিল ভোর। এইভাবে নতুন একটা ভোর আসবে, পুরোনো ভোরের মডেলেই আদৌতে যা গড়া -- তবুও আমাদের মতো জানালায় অপেক্ষাকৃত ভিক্ষুক এর কাছে যা চিত্তাকর্ষক। লিকলিকে বেণী বাঁধা ভোর আমাদের খুব পছন্দ, সকালের চা এর আগেও তাকেই চেয়ে থাকি; ফোনের হঠাৎ ঝলসে ওঠা স্ক্রীনের চেয়েও, তা টানে বেশি। জ্বরের ঘোর থেকে উঠছি তো, এমনি হয়। মন-টা হালকা লাগে ভারী হওয়ার জন্য, নিশ্বাস অনেকটা সুন্দর ভাবে নেওয়া যায় ।
অনেক সময় মনে হয় ওই পাশে একটা মহা সমুদ্র, জ্বল জ্বল করছে, ঝিক্ ঝিক্ করছে ঠিক আমাদেরই বাড়ির বাঁকে, চোখে পড়ছে ফিকে পাঁচিলের ফাঁকে। ওই পাশটায় সমুদ্র নেই, কেবলই একটা মাঠ আছে, যেখানে আগেরদিনের বৃষ্টির কাদা এখনো জমে থিক থিক করছে। কিন্তু আমি মিথ্যে বলছি এরম মনে করার কারণ নেই। কারণ সত্যিই অনেক দূর কুয়াশার মতো, মৃদু ছন্দে কেঁপে সমুদ্র ডাকছে এই ভোরে। লোনা গন্ধ এখন প্রশ্রয়ে এদিকে ধেয়ে আসছে, পোষা কুকুরের মতো একসাথে দুই' পা মাত্র মাটিতে ফেলে, হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে। এখন হঠাৎ অনেক্ষানি নিস্তব্ধতা। অনেকখানি গভীর সমুদ্রের বাতাস খেলে যাচ্ছে সদ্য স্থাপিত ঝাউ বনের মধ্যে দিয়ে, যেই স্থানে এর আগে স্পর্ধা নিয়ে চেয়েছিল কয়েকটা সুন্দর পরিপাটি বাড়ি। এই ভোরের বেলা সমুদ্র যখন অচকিতে অনেক বিলীনের ডাক নিয়ে হাজির হয়, ও অগাধ প্রশ্রয়ে আমায় মুড়ে দেয়, তখন বড় ভালো লাগে। মনে হয় কাছের কেউ রয়েছে, কেউ অপেক্ষায় রয়েছে আমার জন্য। মুখখানি কাছে এনে মৃদু মৃদু ভাষায় অনেক ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হয়; মনে হয় বলি, 'আমি জানতাম তোমাকে এখানে পাবো আবার-'
সকল শূন্যতা ভরিয়ে মেঘ আসে আকাশে, চোখে ঝলকের মত রংবেরঙের আলো খেলে যায়। আমি অনেক্ষণ চুপ করে বসে থাকি নির্জনে। তারপর হাত তুলে তাকে আমন্ত্রণ জানাই ভোরের মধ্যে। সে যে কেউ-ই হতে পারে এই সকালের সোঁদা বাতাসে -- আজ ভাগ্যক্রমে তুমি এসেছো। এলো চুল, ম্লান হাসি, সকরুণ অথচ গভীর চাহনি -- এমনি করে অনেক কবিরা দেখেছি তোমাকে টিপিক্যাল নারী রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে; আমি ওদের দোষ দিইনা, যারা সেই সমস্ত ছিপছিপে কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরী করেন ওই ঢঙে-- তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ অনুতাপ নেই। যেটা ধরা যায়না তাকে তো ধরতে হবে কোনোক্রমে -- কখনো সে অতিকায় পুরোনো এক উইলো গাছ, বিশাল ছাঁয়ায় ঘন; কখনো কারোর ফেলে রাখা বুট জুতো সে, পুজো-আহ্নিক এর মধ্যে ক্রমশই ধরা পড়ছে তারা, বিভিন্ন মনুষ্য সমাজে। সমুদ্রের কথা এমনি ভাবতে ভাবতে, তোমার কথা এমনি ভাবতে ভাবতে, আমার চটকা ভেঙে যায়। পাশের বাড়ির কোন যন্ত্রের মন্থর গোঁ গোঁ শব্দ হঠাৎ ট্রামের শব্দ বলে গণিত হয়; একটা খোলা তার যে বিদ্যুতে ভারী; অনেকসময় টিউব লাইট জ্বলবার সময় এরম আওয়াজ হয়, অনেক সময় মাইক টেস্টিং-এ এরম থমথমে বিদ্যুতের কণ্ঠস্বর শুনেছি। এই আওয়াজ, এই সব দৃশ্য পরস্পর বিরধী মনে হতে পারে, আমার কাছে সেটা বড় ব্যাপার নয়। জ্বরের ঘোরের মধ্যে উঠে চারদিকে যে নিস্পৃহ ভাবটি লক্ষ্য করেছিলাম, সেটি এখন আপনিই আপনার নিয়মে ভীষণ অর্থে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে টলটল করছে আমার বাগানে। সমুদ্রকে খুঁজছিলাম, তোমায় খুঁজছিলাম। গেলাসের অনেকটা জল চুমুকে নিঃশেষ করে এখন আরাম হচ্ছে বুকের কাছে।
ভোর উঠবে, দাউ দাউ করে জ্বলবে দিন। চৌরঙ্গী আজ ও ফাঁকা থাকবে, মৃত দৈত্যের মতো পরে থাকবে অজানা অহংকারে। আমরা রাস্তা দেখতে পাবো না আজ। অনেক রাস্তা এরম আমাদের চোখের বাইরে রয়ে যাবে, চশমার আড়ালে থাকা আলোর রশ্মির মতো। আজ কোনো হাহাকার ? ঝনঝনিয়ে ট্রাম চলবে না হয়তো দ্রুত লঘু পদে, পৃথিবীর প্রাচীনতম জানোয়ারটির মতো; এখন কোনো কর্কশ শব্দে দোকানের চেইন উঠে গিয়ে, সরবে না শাটার মুখের সামনে থেকে। এখন অনেক্ষানি সমুদ্র সেই শাখা-পলা পড়া হাতটির থেকে ছুটে, গড়িয়ে যাবে রাস্তায়। সেই জল, সেই কাঁদার ফেনা রাস্তা দিয়ে ছুটবে তো বটেই, আমাদের সকলের চেতনা ঘিরেও ছুটবে। এই ভোরবেলায়, যখন ভোর আর নেই, বেলাই সকল -- সেই সময় আমাদের মন অধিগ্রগণ করবে-- অনেকজন অচেতন এখনো -- রক্ত সঞ্চার করবে তাদের নাভিতে তাদেরই অজান্তে। সস্তার কবিতার বইতে তখন হয়তো মন ভিজবে না আর, মনকে ব্যস্ত রাখতে হবে অন্য কোনো প্রয়াসে, এই বেলাতে।
সমুদ্রের মধ্যে সাঁপ গর্জন করে উঠবে। মোটরে মোটরে অনেক উল্লাস ছলকে পড়বে চারদিকে। রবীন্দ্রসংগীত বাজবে ভাঙা মাইকে। ছেঁড়া তোষক বালিশ গুটিয়ে রাখবে ভোরের ভিখারি। আমি জানি তুমি নেই।