এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • 'তুমি'/ একটি ভোরের কথা

    Aryaman Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৯ জুন ২০২১ | ১০৪০ বার পঠিত
  • জ্বরের ঘোর থেকে উঠলে যেমনি হয়, আমার তেমনি লাগছে। মুখটা একটানা বিস্বাদ; কালকের তেতো প্যারাসেটামল আর জলের স্বাদ যখন মুখের মধ্যে বিরাজমান, আগেরদিনের মদের গন্ধের মতো, কিন্তু বুক পেট ঘিরে প্রচন্ড ভাতের খিদে। আমার জ্বর হয়নি। বা হয়েও থাকতে পারে। সেটা বড় কথা নয়। এখন কোনো কথাই এই ভোরের বেলায় (ভোর না রাতের এক্সটেনশন, রাতের কালি বারুদ ফুরোবার বিষণ্ণতা?) তেমন কিছু নয়। সবই কেমন যেন নিস্তেজ, ম্রিয়মাণ; তেমন ভীষণ কোন ভাবের সঞ্চার নেই এই বাগানের গাছপালাগুলোদের মধ্যে, এই সকালের আলোয় ফিকে হয়ে আশা উল্টো দিকের একচিলতে পাঁচিলের মধ্যে। কিন্তু আমার মধ্যে একটা খুশি খুশি ভাব একটু একটু করে উঁকি দিচ্ছে, রাতের প্রথম প্রহরে যার কোন আপাত আভাস আমরা পাইনি। আমি হতে পারে বা আমরা। সেটা জরুরি নয়; আমি তো জ্বর থেকে উঠেছি সদ্য। বিশাল ঘাম পিঠে-ঘাড়ে-কপালে-বগলে। একটা অনন্ত ঘামের কুয়োর মতো উঠে এসেছি সকালের সেচনের দেশে। এই কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো রাস্তা ধোয়া হবে; হয়তো ও বাড়ির বারান্দা আর সিঁড়ির ধাপগুলোকে ঝকঝকে মসৃণ করে, ঢেলে দেবে কালো কুয়ার জল একবালতি কোনো উবু হয়ে বসা পরিচারিকা -- তার হাতের শাখা-পলা কেঁপে উঠবে, আর গাঢ় থিকথিকে জলটা কোনো মসৃণ সর্পের অনুকরণ করে ধেয়ে আসবে রাস্তার আড়াআড়ি ভাবে; থমকে থাকবে রক্তে পিচ্ছিল ভোর। এইভাবে নতুন একটা ভোর আসবে, পুরোনো ভোরের মডেলেই আদৌতে যা গড়া -- তবুও আমাদের মতো জানালায় অপেক্ষাকৃত ভিক্ষুক এর কাছে যা চিত্তাকর্ষক। লিকলিকে বেণী বাঁধা ভোর আমাদের খুব পছন্দ, সকালের চা এর আগেও তাকেই চেয়ে থাকি; ফোনের হঠাৎ ঝলসে ওঠা স্ক্রীনের চেয়েও, তা টানে বেশি। জ্বরের ঘোর থেকে উঠছি তো, এমনি হয়। মন-টা হালকা লাগে ভারী হওয়ার জন্য, নিশ্বাস অনেকটা সুন্দর ভাবে নেওয়া যায় ।


    অনেক সময় মনে হয় ওই পাশে একটা মহা সমুদ্র, জ্বল জ্বল করছে, ঝিক্ ঝিক্ করছে ঠিক আমাদেরই বাড়ির বাঁকে, চোখে পড়ছে ফিকে পাঁচিলের ফাঁকে। ওই পাশটায় সমুদ্র নেই, কেবলই একটা মাঠ আছে, যেখানে আগেরদিনের বৃষ্টির কাদা এখনো জমে থিক থিক করছে। কিন্তু আমি মিথ্যে বলছি এরম মনে করার কারণ নেই। কারণ সত্যিই অনেক দূর কুয়াশার মতো, মৃদু ছন্দে কেঁপে সমুদ্র ডাকছে এই ভোরে। লোনা গন্ধ এখন প্রশ্রয়ে এদিকে ধেয়ে আসছে, পোষা কুকুরের মতো একসাথে দুই' পা মাত্র মাটিতে ফেলে, হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে। এখন হঠাৎ অনেক্ষানি নিস্তব্ধতা। অনেকখানি গভীর সমুদ্রের বাতাস খেলে যাচ্ছে সদ্য স্থাপিত ঝাউ বনের মধ্যে দিয়ে, যেই স্থানে এর আগে স্পর্ধা নিয়ে চেয়েছিল কয়েকটা সুন্দর পরিপাটি বাড়ি। এই ভোরের বেলা সমুদ্র যখন অচকিতে অনেক বিলীনের ডাক নিয়ে হাজির হয়, ও অগাধ প্রশ্রয়ে আমায় মুড়ে দেয়, তখন বড় ভালো লাগে। মনে হয় কাছের কেউ রয়েছে, কেউ অপেক্ষায় রয়েছে আমার জন্য। মুখখানি কাছে এনে মৃদু মৃদু ভাষায় অনেক ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হয়; মনে হয় বলি, 'আমি জানতাম তোমাকে এখানে পাবো আবার-'  


    সকল শূন্যতা ভরিয়ে মেঘ আসে আকাশে, চোখে ঝলকের মত রংবেরঙের আলো খেলে যায়। আমি অনেক্ষণ চুপ করে বসে থাকি নির্জনে। তারপর হাত তুলে তাকে আমন্ত্রণ জানাই ভোরের মধ্যে। সে যে কেউ-ই হতে পারে এই সকালের সোঁদা বাতাসে -- আজ ভাগ্যক্রমে তুমি এসেছো। এলো চুল, ম্লান হাসি, সকরুণ অথচ গভীর চাহনি -- এমনি করে অনেক কবিরা দেখেছি তোমাকে টিপিক্যাল নারী রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে; আমি ওদের দোষ দিইনা, যারা সেই সমস্ত ছিপছিপে কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরী করেন ওই ঢঙে-- তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ অনুতাপ নেই। যেটা ধরা যায়না তাকে তো ধরতে হবে কোনোক্রমে -- কখনো সে অতিকায় পুরোনো এক উইলো গাছ, বিশাল ছাঁয়ায় ঘন; কখনো কারোর ফেলে রাখা বুট জুতো সে, পুজো-আহ্নিক এর মধ্যে ক্রমশই ধরা পড়ছে তারা, বিভিন্ন মনুষ্য সমাজে। সমুদ্রের কথা এমনি ভাবতে ভাবতে, তোমার কথা এমনি ভাবতে ভাবতে, আমার চটকা ভেঙে যায়। পাশের বাড়ির কোন যন্ত্রের মন্থর গোঁ গোঁ শব্দ হঠাৎ ট্রামের শব্দ বলে গণিত হয়; একটা খোলা তার যে বিদ্যুতে ভারী; অনেকসময় টিউব লাইট জ্বলবার সময় এরম আওয়াজ হয়, অনেক সময় মাইক টেস্টিং-এ এরম থমথমে বিদ্যুতের কণ্ঠস্বর শুনেছি। এই আওয়াজ, এই সব দৃশ্য পরস্পর বিরধী মনে হতে পারে, আমার কাছে সেটা বড় ব্যাপার নয়। জ্বরের ঘোরের মধ্যে উঠে চারদিকে যে নিস্পৃহ ভাবটি লক্ষ্য করেছিলাম, সেটি এখন আপনিই আপনার নিয়মে ভীষণ অর্থে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে টলটল করছে আমার বাগানে। সমুদ্রকে খুঁজছিলাম, তোমায় খুঁজছিলাম। গেলাসের অনেকটা জল চুমুকে নিঃশেষ করে এখন আরাম হচ্ছে বুকের কাছে।  


    ভোর উঠবে, দাউ দাউ করে জ্বলবে দিন। চৌরঙ্গী আজ ও ফাঁকা থাকবে, মৃত দৈত্যের মতো পরে থাকবে অজানা অহংকারে। আমরা রাস্তা দেখতে পাবো না আজ। অনেক রাস্তা এরম আমাদের চোখের বাইরে রয়ে যাবে, চশমার আড়ালে থাকা আলোর রশ্মির মতো। আজ কোনো হাহাকার ? ঝনঝনিয়ে ট্রাম চলবে না হয়তো দ্রুত লঘু পদে, পৃথিবীর প্রাচীনতম জানোয়ারটির মতো; এখন কোনো কর্কশ শব্দে দোকানের চেইন উঠে গিয়ে, সরবে না শাটার মুখের সামনে থেকে। এখন অনেক্ষানি সমুদ্র সেই শাখা-পলা পড়া হাতটির থেকে ছুটে, গড়িয়ে যাবে রাস্তায়। সেই জল, সেই কাঁদার ফেনা রাস্তা দিয়ে ছুটবে তো বটেই, আমাদের সকলের চেতনা ঘিরেও ছুটবে। এই ভোরবেলায়, যখন ভোর আর নেই, বেলাই সকল -- সেই সময় আমাদের মন অধিগ্রগণ করবে-- অনেকজন অচেতন এখনো -- রক্ত সঞ্চার করবে তাদের নাভিতে তাদেরই অজান্তে। সস্তার কবিতার বইতে তখন হয়তো মন ভিজবে না আর, মনকে ব্যস্ত রাখতে হবে অন্য কোনো প্রয়াসে, এই বেলাতে।  


    সমুদ্রের মধ্যে সাঁপ গর্জন করে উঠবে। মোটরে মোটরে অনেক উল্লাস ছলকে পড়বে চারদিকে। রবীন্দ্রসংগীত বাজবে ভাঙা মাইকে। ছেঁড়া তোষক বালিশ গুটিয়ে রাখবে ভোরের ভিখারি। আমি জানি তুমি নেই। 


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন