ইয়াসপরবর্তী সুন্দরবনের নদীপথে অনেকটা পথ চলতে হয়েছিল। ভরা-কোটালের নোনাজলে এই দ্বীপগুলো কয়েকদিন আগেই বিপর্যস্ত হয়েগেছে। যাত্রাপথে সেই বিপর্যরের ছড়ানো- ছিটানো ছবি নজরে এল।ধামাখালিতে আসতেই টেরপাওয়া গেল তীব্র জলাভাব। কারণ সমুদ্রের নোনাজল পুরো এলাকাটাকে গ্রাস করেছে। মিষ্টি জলের পুকুর গুলোও লবনাক্ত হয়েছে। দ্রুত তৎপরতায় সরকারি উদ্যোগে পানীয় জল পৌঁছানোর কাজ এখনও লক্ষ্য করা যায়নি। ফলত, চলমান নৌকা থেকে যদি কিছু পাওয়াযায়, এই ভরসায় হাতে থলেনিয়ে সরাদিন অসংখ্য নরনারী বাঁধের উপর বসা। কোন নৌকা কোন ঘাটে থামার সাথে, লোকগুলোর সেদিকে ছুটে চলেছেন। এই ছবি দীর্ঘ নদীপথে ছড়ানো- ছেটানো।ভেঙে যাওয়া ঘর- গেরস্থালী, পানীয় জলের আকাল আর আশ্রয়হীন জনমানসের ছবির সাথে একই পঙতিতে নজরে এল স্থানীয় পঞ্চায়েতের মাত্রাহীন নিস্পৃহতা। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদার সাথে স্বেচ্ছাসেবীদের অপ্রতুল 'দান' আপাত চাহিদাগুলোকে মেটালেও দীর্ঘমেয়াদী অধিকারের প্রশ্ন তোলাথেকে এই দ্বীপরাষ্ট্রের বাসিন্দাদের কিছুটা দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
'ত্রাণ দান' বিপর্যস্ত মানুষের প্রথম চাহিদা। কিন্তু এই প্রাথমিক চাহিদা নয়। সুন্দর বনের এই বিপর্যস্ত হওয়াটা কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। এর পেছনে একদিকে রাষ্ট্রের ' অপরিকল্পিত উন্নয়ন ' মডেল সাথে বিশ্ব-উষ্ণায়নের যোগ নিবিড়। যাকে প্রশ্ন না তুললে আমরা কখনই সমস্যার গোড়ায় পৌঁছাতে পারবনা।এর আগেও এই অঞ্চলে বিপর্যয় হয়েছে। প্রতিটি বিপর্যরের পর আলোচনা হয়েছে, সরকারি পরিকল্পনা হয়েছে, ' ত্রাণ' নিয়ে অনেকে পৌঁছে গেছেন - তারপর কয়েক বছর চুপচাপ। অথচ এই বিপর্যয় গুলোর পরই ' ত্রাণ' কাজের সাথে সুন্দরবনের দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা নিয়ে কাজকরা, প্রশ্ন তোলা শুরু করা দরকার ছিল। লক্ষ্যণীয় সেটি তেমনভাবে হয়ে ওঠেনি।
সুন্দরবন উত্তর বঙ্গোপসাগরের অনেক কাছাকাছি। বদলে যাওয়া প্রকৃতি আর পরিবেশ আর বিশ্ব-উষ্ণায়ন বিগত কয়েকবছর অঞ্চলটির তাপমাত্রা অনেক বাড়িয়ে তুলেছে। এই অঞ্চলটিকে ধরাহয় ' ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের টেক্সট বুক'।ফলে আগামী দিনে বছরে দুটো করে এমন ধরনের সাইক্লোন আর জলোচ্ছ্বাস হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
১৭০-১৮০ বছর আগে ব্রিটিশরা সুন্দরবনে জনবসতি স্থাপন করে। কাটা হয় ৩৫০০ কিমি প্রাকৃতিক বাঁধ আর ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। ১০২ টি দ্বীপের মধ্যে ৫৪ টি দ্বীপে লোকজন কৃত্রিম ভাবে মাটির দেওয়াল তুলে বাঁধ বাধে। ফলত স্বাভাবিক জোয়ার ভাঁটায় পলি আসা বন্ধ হয়। ফলত পাশ্ববর্তী জঙ্গলের তুলনায় এইসব দ্বীপগুলো নীচু হয়ে গেছে।২০ মিলিয়ন টন পলি বহনকরে গঙ্গা মাতলা সহ নদীগুলোর মোহনায় বাঁধাপায়।ফলত তার উল্টোদিকের নদী বাঁধের তলা ভেঙে যায়। আয়লার পর ৭৭৮ কিমি নদীবাঁধ ভেঙেছিল। তৎকালীন সরকার হল্যাণ্ড থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসেন।৫০৩২ কোটি টাকার বাঁধ প্রকল্পের কথা স্থির হয়। বিশেষজ্ঞরা কংক্রিটের বাঁধ তৈরির পরামর্শ দিয়েছিলেন। জমি অধিগ্রহণ করে পলিপ্রপিন শিটের উপর ব্রিক সিমেন্ট পিচিং করে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব দেন তাঁরা। সমস্ত পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এর বিরোধীতা করেছিলেন।সুন্দরবনের মতো জীববৈচিত্র্য আর প্রাকৃতিক পরিবেশের পক্ষে এটি ছিল চরম বিপদের। আর পলিগঠিত ভূমি- ভাগে কংক্রিটের বাঁধ আদৌ দীর্ঘ সময় অক্ষত থাকবে না।অচিরেই ভূগর্ভে বসে যাবে - এটা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছিলেন। যতবার এইসব অঞ্চলে এমন দুর্যোগ হয়, ততবারই কংক্রিটের বাঁধ তৈরির দাবি ওঠে।যেটি এই অঞ্চলের পক্ষে আদৌ মানানসই নয়।
১০, ০০০ বর্গকিমি সুন্দরবনের ৬০% বাংলাদেশে। বাকি ৪০% ভারতে। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির সময়ে পরিবেশ সচেতন জণসমাজ থেকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ও স্থানীয় লোকজনের যে বাঁধা এসেছিল; ফলত সেই প্রকল্প বাতিল হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বনের 'কোর' এরিয়ায় এই প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। যার খেসারত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই জীব বৈচিত্র্য ভরা দ্বীপটিকে দিতে হবে। রাষ্ট্রের যে ভয়াবহ উন্নয়নের মডেলকে সমাধানের একমাত্র পথ বলে ধরে নেই, সেটিই আসলে পরিবেশ, প্রকৃতি আর তার কোলে বসবাসকারী মানুষের জন্য বিপদজনক। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখব পরবর্তী ইতিহাস জুড়ে পরিবেশ আর প্রকৃতির ছেদন কর্তন আর দূষণই বৃদ্ধি আমাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইন্টায়গভর্ণমেন্ট্যাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের একাধিক প্রতিবেদনে দেখি - ১৭৫০ থেকে ২০১৯ সালেের মধ্যে পৃথিবীর বাতাসে কার্বনের পরিমান বেড়েছে ২৮০+_১০ পার্টস পার মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৪১০ পিপিএম। যা ৮ লক্ষ্য বছরের ইতিহাসে কখনও ছিলনা৷ ২০১৭ পরবর্তী এক দশকের মধ্যে এই কার্বনের ৪৯% কমানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়। তা তা না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে আরও ০.৫ শতাংশ তাপমাত্রা বাড়বে। ধ্বংস হয়ে যাবে বাস্তুতন্ত্র।জলস্তর বেড়ে ডুবে যাবে বহু দ্বীপ- জনপদ । আজ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা। ১৯৪৮ সালে নেহেরু নদীবাঁধকে আধুনিক ভারতের ' মন্দির' বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন। ১৯৫৮ এর নভেম্বরে এসে নেহেরু উপলব্ধি করলেন উন্নয়ন নামক এই বাঁধনির্মাণ হল -" we are suffering from what we may call ' the disease of gigantism '. এই ব্যাপকতর উন্নয়নের মডেলই আজকের প্রধান সমস্যা। সেই সমস্যাকে বিপর্যয় পরবর্তী সময়ে আমরা ডেকে আনছি সহজ সমাধান খুঁজতে গিয়ে। বহুদিন ধরে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা একটি বিকল্প মডেলের কথা বলে আসছেন। সুন্দরবনের নদী- তীরবর্তী জনবসতিকে অন্তত ৫০০ মিটার ভিতরের দিকে সরিয়ে নেওয়া। আর পলিকাদার সাথে চুন মিশিয়ে বাঁশের কঞ্চি এবং খুঁটি ও বেড়াকে ব্যবহার করে শক্ত মাটির বাঁধ তৈরি সম্ভব। আর বাঁধের ঢালে রোপন করা দরকার ব্যাপকহারে ক্ষয়রোধী ম্যানগ্রোভ।
ত্রাণ সমস্যা ও বাকিদের ভূমিকাঃ
ধামাখালি থেকে জলপথে পৌঁছালাম সন্দেশখালি ব্লক -২ এ। নদীপথে চোখে এল মাটির বাঁধ জায়গায় জায়গায় ভাঙা। নদীপাড়ের প্রায় সবকটা ঘাটে নর- নারী থেকে শিশু বৃদ্ধদের ভিড়। সাহায্য সামগ্রী নিয়ে এগিয়ে যাওয়া প্রতিটি নৌকাকে তারা তীরে বসে প্রাণপণে ডেকে চলেছেন। জায়গায় জায়গায় নদীবাঁধে ত্রিপল টাঙানো। ত্রিপলের পাশে দড়িতে ঝুলছে কারো শাড়ি কারো জামা প্যান্ট। কেউ বাঁধের উপর বসা। বোঝাযায়, নদীর জলে ভেসে যাওয়া বাড়িঘর ছেড়ে তারা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।
সন্দেশখালি ২ ব্লকের আতাপুর ঘাটে পৌঁছাতেই নজরে এল ইতিমধ্যে একটি খাদ্য সামগ্রির নৌকা সেখানে পৌঁছেছে। নদীর চড়ায় দীর্ঘ লাইন।পাশে জমি, বাড়িঘরে এখনও জল আছে।লাইটপোস্ট হেলে আছে। স্থানীয় লোকজনের কথায় ফুটেউঠল তীব্র ক্ষোভ। বিপর্যয়ের দুদিন বাদে পরিবার পিছু ২০০ গ্রাম চিঁড়ে আর গুড় দিয়েছিল, তারপর আর প্রশাসনের কোন সাহায্য তারা পায়নি।স্থানীয় বিডিও দুদিন ঘুরে গেছেন। সরকারি সাহায্যের বিষয় কিছু বলতে পারেননি তিনি। বরং নদীর বাঁধ তৈরির জন্য যে শ্রমিকরা কাজ করছিলেন, সেটির টাকাও অজানা কারণে বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলত কাজ বন্ধ। চারিদিকে পঁচাগন্ধ। মিষ্টি জলের পুকুরের মাছ মরার গন্ধ এখনও ঝাঁঝালো। আঁতাপুর প্রাথমিক স্কুলটির মেঝে এখনও জলের নীচে। গ্রামে ঢোকার ঢালাই রাস্তাটির মাটি অনেক জায়গায় ধ্বসেগেছে। দুর্যোগের দিন রাস্তা জলের নীচে তলিয়ে গেছিল।গতকাল থেকে জল নামতে শুরু করেছে। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য প্রশান্ত নায়কের হতাশা -" এখনও আমরা কিছু পাচ্ছি না। আমাদের হাতপা বাঁধা।" কবে সরকারি সাহায্য পাওয়া যাবে তিনি জানেননা। স্থানীয় একটি কমিউনিটি কিচেন থেকে রান্নাকরা খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বাড়ি বাড়ি।একদল তরুণ কাজ করছেন৷ ওদের কয়েকজন বন্ধু সোনারপুর আর মালদা থেকে এসেছে। এই সমস্ত গণ-উদ্যোগই মানুষগুলোকে আপাত চাহিদা মেটালেও প্রয়োজনের তুলনায় যা সামান্য।ত্রাণ বিলি দরকার তার থেকেও দরকার প্রশ্ন তোলা।স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে এতবছর বাদেও কেন লোকগুলো চরম বঞ্চনার শিকার? ঐতিহাসিক এরিক হবসবম তাঁর ' ইন্টারেস্টিং টাইমঃ এ টুয়েন্টি সেঞ্চুরি লাইফ' আত্মজৈবনিক বইয়ের অন্তিমে এসে শুনিয়েছিলেন -" Social injustice still needs to be denounce and fought. " আসলে লড়াই ছাড়া বঞ্চিতের কোন কিছু পাওয়ার নেই, না লড়ে অধিকার আদায় হয়না - এই কথাটা এই সর্বস্বান্ত লোকগুলো না বুঝবেন, ততদিন বিপর্যয়ের পর একটু সহযোগিতার আশানিয়ে বসে থাকবেন, মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবেন। পঞ্চায়েত কাজ না করলে, ব্লক সেচদপ্তর হাত তুলে না নিলেও তাঁদের নির্বাকই থাকতে হবে। অসরকারি উদ্যোগ তাদের মুখাপেক্ষী করেই রাখবে। উন্নয়নের মডেলের বিরুদ্ধে একটি প্রশ্ন না তুলে - 'দান-ধ্যানে'র পূর্ণ কাজে তারা ব্যস্ত থাকবেন, লোকগুলোকে মগ্ন রাখবেন।
হেনরি জর্জ এই উন্নয়নের মডেলকে 'প্রগেস অ্যাণ্ড প্রভার্টি ' বইয়ে দেখিয়েছিলেন, উন্নয়নের ফলে একশ্রেণির জীবনাযাত্রার মান যতটা বেড়েছে,তার থেকে অনেক বেশি কমেছে। দরিদ্র বেড়েছে। সুন্দরবনের মানুষের সমস্যা দরিদ্র, অপুষ্টির৷ রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিকল্পনাহীন উদাসীনতার।আর জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে স্থায়ী সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা না করার।
মানুষের দিকে সাহায্যের বাড়াই, সেই সাথে মনে রাখি বনঅঞ্চলে অকারণ ' ভ্রমণ উদযাপনে'র সাথে ' ত্রাণ' কাজ করতে গিয়ে দূষণ ছড়ানো বন্ধ করার কথা।আর মুখাপেক্ষী লেকগুলোর মাঝে প্রশ্ন তোলা, এটাই এক এবং একমাত্র সমাধান নয়। রাষ্ট্রের দীর্ঘ স্থায়ী পরিকল্পনা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা আর ধ্বংস হয়ে যাওয়া ম্যানগ্রোভকে রক্ষা করলে আগামী দিন 'সাইক্লোনের টেকস- বুক' এ অবস্থিত এই দ্বীপগুলোর জনজীবনকে হয়ত আরও সুস্থিত জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।