আমার এক বন্ধু রসিকতার রাংতায় মুড়ে বিষাদের কথা শোনাল সেদিন।
❝ভালো লাগছে না রে! কিচ্ছু ভালো লাগছে না।❞
একটু খুঁচিয়ে দিলাম, ❝কীরকম?❞
❝ছোটবেলায় খেলাধুলা শেষ করে সন্ধেবেলা ঘরে ফেরামাত্র মা যখন পড়তে বসিয়ে দিতেন তখন কিচ্ছু ভালো লাগত না। আজকাল অনেকটা এইরকমই...❞
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন ঢল নেমেছে সংক্রমণের, মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর তখন মনের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে এহেন অবসাদের সাথে তুলনা টেনেছিল সে। তুলনাটি সঙ্গত ছিল কিনা, সে নিয়ে তর্ক কালক্ষেপের নামান্তর। কারণ একই পরিস্থিতিতে অবসাদের রং-রূপ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান দপ্তরের হেলথ বুলেটিনে মানুষের বাঁচা-মরার হিসেব দেখতে দেখতে আমরা যে সবাই মাত্রা, রূপ ও আকার ভেদে একরকম বিষাদগ্রস্ত এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। এই দুঃসময় আমাদের স্ফুর্তি ও জীবনীশক্তি শুষছে। আর ক্রমেই তার পেট মোটা করছে। মনের আকাশে আঁধার নামছে। ঘুর্ণি ঝড়ের মত পাক খেয়ে উঠছে ভয়, এই বুঝি আমিও সংক্রমিত হয়ে গেলাম। মৃত্যুর মিছিল বুঝি আমাকেও হাতছানি দিচ্ছে।
মৃত্যু অমোঘ। ❝জন্মিলে মরিতে হইবে, অমর কে কোথা কবে।❞ কিন্তু কথা হল অতিমারি বা তৎজনিত কারণে স্বজন বা সহনাগরিকদের অকাল বিয়োগের জন্য যখন প্রস্তুতির অভাব থাকে তখন মৃত্যুকে স্বীকার করে নিতে মন বিদ্রোহ করে। মওকা বুঝে মনের ভেতর আজন্ম-পালিত, কুন্ডলী পাকিয়ে-থাকা জিজ্ঞাসাটাও গর্ত থেকে মুখ বের করে দেয়, মৃত্যু কী? কবিদের সৌজন্যে মৃত্যুর পোশাকি নাম 'চিরনিদ্রা'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো মৃত্যুর জানালা দিয়ে জীবনকে দেখার জন্য সওয়াল করতেন। জীবনানন্দ মৃত্যুতেই শান্তি খুঁজেছেন তাঁর নানা কবিতায়। কিন্তু গড়পরতা ধারণায় মৃত্যু হল অসাড়তা বা নিশ্চলতা, যে নিশ্চলতাকে মানুষ বীভৎসদর্শন দানবের থেকেও বেশি ভয় পায়। মৃত্যু যেন নিষ্ঠুর একটা খেলা। কাউকে অপছন্দ হলে ফেসবুকে বা ফোনে যখন খুশি ব্লক করে দেওয়ার মত মৃত্যুও মৃতকে ব্লক করে দেয় চিরতরে। কিন্তু মৃত্যুর ক্রূর দলন মৃতকে নয়, জীবিতকেই ক্লেশ দেয়। যে মরে যায় সে তো নিশ্চিহ্ন, কিন্তু জীবিতের যে একটা অপার রহস্যময় ও জীবন্ত মন আছে। যাকে নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্ত নেই। প্রিয়জনকে হারিয়ে তাই মানুষ শোকাচ্ছন্ন বা উন্মাদ হয়ে যায়।
তার মানে কি এই যে, করোনার অতিমারিতে শুধুমাত্র মৃত্যুর আতঙ্কই মানুষকে তাড়া করছে? যদি তাই হত তাহলে করোনাকে পরাজিত করে সুস্থ হয়ে যে-ব্যবসায়ী ভদ্রলোক বাড়ি ফিরেছিলেন তাঁর তো প্রয়োজন ছিল না দ্বিতীয় হুগলি সেতু থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার। ইনি তো মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েই বাড়ি ফিরেছিলেন। তারপরও কেন, কোন গূঢ় কারণে তিনি আবার মৃত্যুর জানালা দিয়ে স্বেচ্ছায় গলে গেলেন। পুলিশ তাদের মত ইনভেস্টিগেশন করছে। কিন্তু এই আত্মহননের পশ্চাতে মানসিক অবসাদই যে দায়ী তা অনুমান করার মত যথেষ্ট ভিত্তি আছে সাধারণের। হাসপাতাল থেকে চিকিৎসার পর ফিরে এসেছেন এমন অন্য এক পরিচিত রোগীর কথা জেনেছি যার কাছে হাসপাতালের দিনগুলি ছিল দুঃস্বপ্নের মত। যাঁরা কিছুক্ষণ আগেও মৃত্যুর সাথে যুঝছিলেন সেই সহরোগীদের উনি চোখের সামনে পটাপট মরে যেতে দেখেছেন। পাশের বেডে, কিংবা মাটিতে তাঁদের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন। সেই অভিশপ্ত দিনগুলি মন থেকে তাই কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছিলেন না। বাড়ি এসে নিঝুম হয়ে শুয়েছিলেন।
শুধু সেই ব্যবসায়ীই নন, গত একমাসে অনেকগুলি আত্মহত্যার সাক্ষী হয়ে রইল রাজ্য। বেলেঘাটার কুন্ডুবাগান এলাকা নিবাসী এক সত্তোরোর্ধ্ব ব্যক্তি, বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের শৌচাগারেই গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করলেন। শালবনীর কোভিড হাসপাতালের করোনা রোগী ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। তালিকা দীর্ঘ। এই আত্মহননগুলির মনোবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান প্রয়োজন। তাহলেই বোঝা যাবে যে, করোনায় প্রাণহানির বিকটতাই শুধু নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের উপর বর্ষিত চরম অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও মানুষকে চূড়ান্ত অবসাদ ও মানসিক বিকারের রাস্তায় ঠেলে দিচ্ছে।
ইতালির একটি গবেষক দলের সমীক্ষায় জানা গেছে কোভিডের মানসিক অভিঘাত কীভাবে সমাজের বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর উপর পড়েছে। ওঁরা বিশেষত কলেজ পড়ুয়া ও চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্য কর্মীদের কথা বলছিলেন। ছাত্রছাত্রীরা সেই গত বছরের মার্চ মাস থেকেই কলেজ যেতে পারছে না। কলেজে শিক্ষাগ্রহণের সমান্তরালে নিজেদের মধ্যে মেলামেশা বলে একটি বিষয় আছে, যার মাধ্যমে ছাত্ররা সামাজিক শিক্ষা ও আনন্দ লাভ করে থাকে। কিন্তু তারা আজ বঞ্চিত। ভার্চুয়াল ক্লাস যে কখনই মেলামেশার পরিপূরক হয় না এ-নিয়ে খুব বেশি বিতর্কের অবকাশ আশা করি নেই।
স্বাস্থ্যকর্মীরা যে অসম্ভব চাপে আছেন সে কথা বলাই বাহুল্য। মহামারিতে গণমৃত্যুর কথা ইতিহাসে পঠিত হলেও একসঙ্গে এত মৃত্যু যে তাঁদেরও একদিন চাক্ষুষ করতে হবে কেউই ভাবেননি। গতবছর যখন সারা বিশ্বে কোভিডের থাবা বসল অনেক চিকিৎসকই ভয় পেয়েছিলেন। কারণ শত্রু অজ্ঞাত। চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও বিস্তর মতভেদ। কিন্তু তাঁদের প্রাথমিক আতঙ্ক দূরীভূত হয়েছে। করোনা রোগীর চিকিৎসা নিয়েও খানিকটা মতৈক্যে আসা গেছে। ভ্যাকসিনও বেরিয়েছে। হয়ত ওষুধও আবিষ্কৃত হবে। কিন্তু সমস্যা হল এই যে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সেই থেকেই নিরবচ্ছিন্ন এক ঝুঁকির মধ্যে ডিউটি করে যেতে হচ্ছে। ফলত তাদের অধিকাংশই আজ শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তিতে (বার্ন আউট সিনড্রোম) ভুগছেন।
ছোটরা স্কুলে যেতে না পারায় ক্রমশ আত্মমুখী। একঘেয়েমি কাটাতে মন ঝুঁকছে গেমস-এ। উদ্বিগ্ন বাবা-মা শুধু নীরব দর্শক। তাঁদের সন্তানদের এই আচরণগত পরিবর্তনগুলো দেখা ছাড়া যেন আর কিছু করণীয় নেই। বাচ্চাদের মনোযোগে ঘাটতি হচ্ছে, খিটখিটে মেজাজ হয়ে যাচ্ছে। নরম শিশুমনের দখল নিচ্ছে অস্থিরতা, একাকিত্ববোধ, অস্বাচ্ছন্দবোধ।
লকডাউনের ফলে কর্মচ্যুতদের সমস্যা যত কম বলা যায় ততই ভালো। তাঁরা দোদুল্যমান, কিসে মরলে ভালো, ভাইরাসে নাকি অনাহারে! তাঁদের মনের খোঁজ অবশ্য কে-ই বা রাখছে।
অনেকেই প্রিয়জনের সাথে তাঁদের সামাজিক বিচ্ছেদ ও স্বাধীনতাহীনতাকে মানতে না পেরে চরম নিঃসঙ্গতাবোধের শিকার হচ্ছেন। কারণ কোভিডের মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব এবং বিভিন্ন সুরক্ষা বিধি কোভিডের শৃঙখল ভাঙছে ঠিকই কিন্তু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মত শিথিল করছে মানুষের আন্তসম্পর্কের বুননকে। সহমর্মিতার যে সহজাত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সচল ছিল সেটিও ধীরে ধীরে পঙ্গু হয়ে পড়ছে।
এবছর কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ আছড়ে পড়ার পর মৃত্যু ও সংক্রমণের সংখ্যাটাও এতটাই বেড়েছে, এতটাই সকলের নিকটতর যে, নিজের পরিবারের, বা বন্ধু বান্ধবদের, বা পাড়ার কাউকে করোনায় সংক্রমিত বা মরে যেতে দেখছি আমরা। কাছের মানুষ সংক্রমিত হয়ে পড়লে মনের উপর তার অভিঘাতটা নিঃসন্দেহে বেশি হয়। পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলছে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিমেষেই ছড়িয়ে পড়া গুজব বা ফেক নিউজ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে কিছুদিন আগে একটি খবর ছড়িয়েছিল যে, নোবেল জয়ী ফরাসী ভাইরোলাজিস্ট নাকি বলেছেন যে, যাঁরা টিকা নিয়েছেন তাঁরা আগামী দুবছরের মধ্যেই মারা যাবেন। পরে অনুসন্ধান করে জানা গেল খবরটি ভুয়ো।
এককথায় এই সর্বব্যাপী অবসাদের গ্রাসে মানুষের মন বিপন্ন। মন বিপন্ন হলে স্বাস্থ্যও বিপন্ন হয়। তাই মনের অসুখের নিরাময় প্রয়োজন। কিন্তু শুধু জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে মনকে সারিয়ে তোলা যায় না। তার কয়েকটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতি আছে। মানসিক অবসাদকে মোকাবিলা করতে সাইকোথেরাপি বা কাউনসেলিংয়ের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। আর যখন সমগ্র দেশ বা পৃথিবী এই অবসাদে কাবু হয়ে পড়ে তখন জনস্বাস্থ্যের সুস্থতার স্বার্থে তার প্রয়োজনীয়তা আরও নিবিড় ও অপরিহার্য গন্য হয়। এই কাউনসেলিং ও থেরাপিকে জীবনদায়ী পরিষেবার মর্যাদা দিলে খুব ভালো। আর তা প্রত্যেক করোনা রোগীকে বিনামূল্যে দেওয়া হোক। কাগজে ও টিভিতে মনোবিদের পরামর্শ প্রচারিত হোক। অনলাইন কাউনসেলিংয়ের আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। তবেই অবসাদে মোড়া এই দুঃসময়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হব আমরা। তবেই একটা ভঙ্গুর বিশ্বাসকে আবার জুড়ে দেওয়া সম্ভব হবে। আমরা ভাবতে পারব যে, শক্ত করে হাতগুলো ধরতে হবে। যাঁরা বেঁচে ফিরেছি, যাঁরা বাঁচার জন্য মুখে মাস্ক পরে ও অন্যান্য নিয়মবিধি মেনে লড়াই করছি, যাঁরা কোভিড মুক্ত পৃথিবীতে সামাজিক দূরত্ব ঘুচিয়ে একসাথে বাঁচার জন্য দৃঢ়-প্রত্যয়ী তাঁদের শৃঙখলটাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে হবে।