শ্বাস তো নেব বুক ভরে, বিশুদ্ধ বাতাস পাব তো
( এক অসহনীয় সময়কাল চলছে। মানুষ বড়ই কষ্টে আছে। চারিদিকে অসহায়তা, আতঙ্ক, উদ্বেগ। করোনা জনিত সংকটের কারণে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা সংকটজনক আকার ধারণ করেছে। গুরুচন্ডালির কলামে তারই বিভিন্ন আঙ্গিকে পর্বভিত্তিক আলোকপাত। আজ প্রথম পর্ব)
কেউ কেউ না হয় সু-বাতাস পাচ্ছি, কিন্তু সকলেই কি শুদ্ধ বাতাস পাচ্ছি ?
বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শুদ্ধ বাতাস টেনে নেওয়ার এমন সুযোগ তো পাওয়া যায়নি বহু বছর। গ্লোবাল কার্বন প্রোজেক্ট প্রকাশিত পরিসংখ্যান জানাচ্ছে বিশ্ব জুড়ে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমেছে পাঁচ শতংশেরও বেশি। কারণ, করোনা অতিমারির প্রকোপে গোটা বিশ্ব কার্যত স্তব্ধ। সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকার প্রথম দুইয়ে থাকা চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একাধিক দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়েছিল ব্যাপক হারে। তাইএই দেশগুলির শিল্পাঞ্চল বন্ধ ছিল, লকডাউনের কারণে রাস্তায় গাড়িও চলেনি। স্বাভাবিকভাবেই দূষণকারী গ্যাস, কণার মাত্রা কমেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, লকডাউন শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই ভারতের বহু শহরের বাতাসে দূষণকারী নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ অনেকটাই কমে গিয়েছে। দূষণ সংত্রান্ত খবরে সর্বদাই লাইমলাইটে থাকে দিল্লি। সেখানকার বাতাসেও পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ২.৫ কমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া বিপদসীমারও নীচে নেমে গিয়েছে। ভারতীয় শহরগুলির বাতাসে দূষণের মাত্রা মাপা হয়েছে সেন্টিনেল ফাইভ পি ট্রেপোমি কৃত্রিম উপগ্রহের সংগ্রহ করা তথ্য থেকে। বিশ্লেষিত তথ্য থেকে তৈরি পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে আশাপ্রদ। তবে প্রশ্ন রয়েই যায় এ দেশে কত জনের প্রকৃতির ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠা উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে? উত্তর খুঁজতে গেলে সামনে আসে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন।
অসংগঠিত পরিযায়ী শ্রমিকদের বাসস্থানের দূষণ নিয়ে ভাববে কে?
বিজ্ঞানীরা বারেবারে সাবধান করছেন প্রকৃতির এই সুস্থ হয়ে ওঠা সাময়িক। লকডাউন উঠে গেলেই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে শিল্পের চাকা ঘোরাতে হবে জোরের সঙ্গে। চাপ বাড়বে অর্থনৈতিক পিরামিডের নীচের ধাপে থাকা মানুষজনের উপর। লাগামছাড়া বেসরকারিকরণ চেন রিয়্যাকশনের মতো তৈরি করবে আরও বেশি অসংগঠিত শ্রমিক, আরও বেশি পরিযায়ী শ্রমিক যাঁদের মাথা গোঁজার ঠাই হবে হাউসহোল্ড পলিউশনের আঁতুড়ঘরেই। যেখানে ব্যালকনি তো দূর অস্ত, ছোট ঘুলঘুলি দিয়ে বাতাসের ঘরে ঢুকতেও অনুমতি প্রয়োজন, কলকারখানার ধোঁয়া বা গাড়ির ধোঁয়া ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশ-সহ দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশে পরিবেশ দূষণে বড় ভূমিকা পালন করে বাড়ির আভ্যন্তরীণ দূষণ হাউসহোল্ড পলিউশন। ভারতের মতো দেশে বহু মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন। তাঁদের বাসস্থানের পরিবেশ অবর্ণনীয়। সে বাড়িতে রান্নাঘরের জন্য আলাদা জায়গা নেই। রান্নাঘরে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় কাঠ, ঘুঁটে, গুল, কেরোসিন। ঘরের ভিতরকার বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। জ্বালানি হিসেবে অনেক সময়ই থার্মোকল বা প্লাস্টিকের প্যাকিং বাক্স। ফলে, তৈরি হয় পলিসাইলিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন ও ফর্মালডিহাইডের মতো বিষাক্ত পদার্থ। এ ছাড়াও রয়েছে ঘরের ভিতরের বাতাসে অ্যাসবেসটস, সিলিকার কণার উপস্থিতি।একটা ছোট ঘরেই গাদাগাদি করে থাকার ব্যবস্থা। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা অসহনীয়। তার মধ্যে জল সরবরাহ ব্যবস্থা, শৌচাগার ও বর্জ্য ফেলার জায়গা অপ্রতুল।
প্রকৃতির বার্তাকে আমল না দেওয়ায় মানুষ অস্তিত্বের সঙ্কটের সীমান্তে
পৃথিবী এখন ‘রাস্টিকেট’ পর্ব চালাতে শুরু করেছে। মানুষের সংখ্যা লাগামছাড়া বেড়েছে। তাই মানুষ নিজের প্রয়োজনে এমন অনেক কাজই করছে যা প্রকৃতি অনুমোদন করে না। বনাঞ্চল কেটে বসতি হল, কৃষিজমি হল। মানুষ তাঁর প্রয়োজনীয়তার সীমাকে সীমিত করতে পারল না। স্লোগান হয়ে পড়ল মানুষের ‘গিভ মি মোর’। কলকারখানা, যানবাহনের ধোঁয়ায় আকাশ ছেয়ে গেল। কত পাখি, কত প্রাণ হারিয়ে গেল। মানুয় খোঁজও রাখল না বরফ গলে জল কত দূর এগোলো। প্রকৃতির বার্তাকে আমল না দেওয়ায় আজ মানুষ অস্তিত্বের সঙ্কটের সীমান্তে দাঁড়িয়ে। মৃত্যু চোখ রাঙাচ্ছে আর মানুষ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করছে। মানুষকে শেষ পর্যন্ত ভরসা রাখতেই হবে প্রকৃতির উপর। মানবিকতা ও মানবিক বিজ্ঞানের চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর কিছুই হতে পারে না। ক্ষমতার গর্ব করতে গিয়ে নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে শক্তিধর দেশগুলোকে নভেল করোনা ভাইরাসের কাছে। অদেখা এক শত্রু দেশ ও সীমার বাছবিচার করেনি। সব জাতির মানুষকে করোনা সঙ্কট এক আকাশের নিচে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতির চেয়ে কড়া হেডমাস্টারমশাই সম্ভবত আর কেউ নেই। প্রথমে একটু আধটু বেয়াদবি সহ্য করবে তারপর বকুনি-কানমলা। সে সব না শুনলে বিতাড়ন করে দেবে। কলকারখানা ও যানবাহনের ব্যবহার করোনা পরিস্থিতিতে এতটাই কমে গিয়েছিল যে পরিবেশ তার শুদ্ধতা ফিরে পেতে শুরু করেছিল। শহরের গাছে অনেক নাম না জানা পাখি এসেছিল। যে কাকলি বহুবছর শোনা যায়নি বদ্ধ ঘরের জানালা থেকে মানুষ শুনতে পেয়েছে সে সব। দলে দলে প্রজাপতি এসেছে নীল আকাশের বিশুদ্ধতায়। এই রোগ, জরার পৃথিবীতেও মানুষের মন ভাল করে দিয়েছে। সমুদ্রতটে মানুষের খোঁজ নিতে দলবেঁধে এসেছে ডলফিনেরা। এই শুদ্ধতা কি বজায় রাখতে পারবো আমরা?
সাবধানতা আর সচেতনতার বিকল্প নেই
বিপর্যয় মানুষকে সাবধানী করে, সচেতন করে। কিন্তু সেই অর্জিত সচেতনতা আমরা অচিরেই হারিয়ে ফেলি। আজ করোনা ভাইরাস রুখতে মানুষ সচেতন। ওষুধের দোকানগুলোয় প্রতি ১০ জনে অন্তত তিন জন স্যানিটাইজারের খোঁজে আসছেন। বাজারে মাস্ক অমিল হয়ে পড়েছে। কদিন আগেও মানুষ এ সবের হদিস রাখত না। প্রশ্ন হল, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ভাবনাকে আমরা কবে জীবনের অঙ্গ করে নেব? সরকারের বিভিন্ন দফতরে প্রবেশপথে এবং আর্থিক লেনদেনের কাউন্টারে স্যানিটাইজার রাখা হচ্ছে। কিন্তু পুরসভা ও পঞ্চায়েত পরিচালিত শৌচাগারে ঠিকমতো জলের ব্যবস্থাই রাখা হয় না, স্যানিটাইজার তো দূর অস্ত। বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশনের টিকিট কাউন্টারগুলোতে এই ব্যবস্থা খুব কাম্য। নির্মল বাংলা, নির্মল বিদ্যালয়, স্বচ্ছ ভারত অভিযানকে আমরা কতটা নিজের জীবনে ঠাঁই দিয়েছি? শুধু রাষ্ট্রের মুখের দিকে তাকিয়ে এবং অভিযোগের আঙুল তুলে রাখলে কি আমরা বিপর্যয় এড়াতে পারব? শহরের শিক্ষিত পরিবারে হয়তো খাবার আগে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়ার প্রচলন হয়েছে। কিন্তু বাইরে থেকে এসে ক’জন মানুষ হাত-পা পদ্ধতি মেনে ধুয়ে ঘরের অন্যান্য সামগ্রী স্পর্শ করেন? আজ না হয় নোভেল করোনা ভাইরাস একটা আতঙ্কের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু আরও তো অনেক বিষয় আছে যা রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার মতো। রোগ, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই মানুষের। কিন্তু সুঅভ্যাস মানুষকে অনেকটাই বিপন্মুক্ত রাখতে পারে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অন্তত রোগকে মহামারীর আকার ধারণ করার বীভৎসতায় পৌঁছতে দেয় না। কিন্তু সময় থাকতে সচেতন না হয়ে মানুষ রোগে আক্রান্ত হলে কৃতকর্মের জন্য নিজেকে অভিশাপ দেওয়া ছাড়া কিন্তু আর কোন উপায় থাকবে না।