ভিনদেশে কর্মরত শ্রমিকদের প্রতি মানবিক হোক রাষ্ট্র
গৌতম চক্রবর্তী
(তুলে আনলাম আত্মনির্ভশীল ভারতের কোলাজ যেগুলো ঠাঁই পেয়েছিল সংবাদপত্রের এককোণে বছরখানেক আগে। ভারতীয় অর্থনীতি এবং বর্তমান শ্রমনীতি নিয়ে দ্বিতীয় দফা এবং আগত তৃতীয় দফার করোণা সংক্রমনের প্রাক্কালে তাই ফিরে দেখা এই সময়কাল গুরুচন্ডালীর খেরোর খাতায়। দ্বিতীয় পর্ব )
করোনাকালে ভারতের বর্ণাশ্রমে নতুন বিভাজন?
শিকড় উপড়ে গেলে যেমন গাছ বাঁচে না, তেমনই শ্রমিক বেঁচে না থাকলে সমাজ বাঁচে না। সমাজ না থাকলে রাষ্ট্রের কল্পনাও করা যায় না। করোনা এসে ভারতের বর্ণাশ্রমে নতুন বিভাজন দেখিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ সমাজে দু’টি শ্রেণি। ধনী আর দরিদ্র। কে কোন ধর্ম সম্প্রদায়ের, কোন বর্ণের, কোন জাতের সেই খোঁজ আর রাখে নি কোনও পক্ষ। করোনাকালে অর্থনৈতিক যে প্যাকেজ তাতে ধনী আর দরিদ্রের বিভাজনে ব্যস্ত থেকেছে রাষ্ট্র। তাই ধনীর জন্য স্পেশাল প্যাকেজ আর দরিদ্রদের জন্য বিনা পয়সাতে বাড়ি ফেরার রেল টিকেট। বিভাজনে স্পষ্ট, যাঁরা তুলনামূলকভাবে ধনী তাদের জন্য আছে সরকার, সরকারি বিমান, সুপার স্পেশালিটি চিকিৎসা। আর দরিদ্রেরা হল পরিযায়ী শ্রমিক যারা রাস্তা তৈরি করে, ফসল ফলায়, ধনীর বাড়ির রান্না করে, ধনীর শিশুদের দেখভাল করে, ধনীদের সব আরাম, আয়েশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে। এদের জন্য আছে সরকারের উদাসীনতা, অবজ্ঞা। একদল রাতে ঘুমান আর একদল রাতে চোরের মত হেঁটে বাড়ি ফেরে। অপরাধী না হয়েও খেসারত দেয়। এরাই সমাজের মূল শিকড়। করোনা সেই শিকড়টাকে উপড়ে দিয়েছে। তাই শিকড় ঘরমুখী দেখেছিলাম আমরা। অগণিত মানুষ সামান্য আয়ের সন্ধানে পাড়ি দিয়েছিল এ রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে। এক সময় মনে হয়েছিল এটাই পথ। এখন সব বদলে গিয়েছে। পাশাপাশিভাবে নিজের রাজ্যে কাজ না পেয়ে আবার ঘরছাড়া হয়েছেন বহু মানুষ। পাশাপাশিভাবে একশো দিনের প্রকল্পে , নদীতে পাথর ভেঙ্গে বা চা বাগিচায় অস্থায়ী শ্রমিক হিসাবে কর্মরত হয়ে অথবা নদী থেকে বালি বা পাথর তুলে কাজে নেমে পড়েছেন অনেকেই।হয়তো কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কর্মসংকোচন নীতির কারণে এটাই ভবিতব্য।
দেশকে সচল রাখার কারিগরদের প্রতি এ কি রাষ্ট্রীয় বঞ্চনা?
করোনাকালের প্রথম দফাতে ঘরমুখী জনস্রোত জনস্রোত প্রমাণ করেছিল দেশকে সচল রাখে ভিন্নধর্মী পেশার শ্রমিকেরা। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কলকারখানাগুলো এতদিন যাদের কাছে ভালবাসার ছিল, সেই কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। শ্রমিক পথে নেমেছে দাবি আদায় করার জন্য নয়। বাড়ি ফেরার জন্য। রাজনৈতিক নেতার আবেদন নিবেদন, ঢক্কানিনাদ আর নানাবিধ সুবিধার ঘোষণা টিভির পর্দায় শুনে গৃহবন্দি মানুষ ভেবেছে এদের জন্য কিছু একটা হচ্ছে বটে। কিন্তু যাদের জন্য এই ঘোষণা তারা কী পেল আর কী পেল না সে কথা শোনার কেউ ছিল না। তাই সকলেই মারণ ভাইরাসের আতঙ্কে শুধু হেটেই গেছে। শ্রমিকদের এই পদযাত্রা দেখে আমরা দুঃখ পেয়েছি, হতাশ হয়েছি। শ্রমিকেরা প্যাকেজ চায় না। ন্যূন্যতম খাদ্য আর স্বাস্থ্যপরীক্ষা চায়। ওদের স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে দেশের স্বাস্থ্যও ঠিক থাকবে। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ হেঁটে ক্লান্ত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে কেমন করে? তাই দেশের স্বাস্থ্যও খারাপ হচ্ছে দ্রুত। বিহারের অনেক শ্রমিক মহারাষ্ট্রে যান রিকশা চালাতে, ‘মজদুরি’ বা দিনমজুরি করতে। প্রতিদিন যুঝতে হয় জাতি-বর্ণ, ধর্ম-ভাষা বিদ্বেষের সঙ্গে। রাজস্থানে মালদহের শ্রমিক আশরাফুলকে পুড়িয়ে মারার নৃশংস ভাইরাল ভিডিয়ো আমরা এখনও ভুলে যাইনি। দিল্লি, মুম্বই, কেরলে বাংলাদেশি বলে উঠতে-বসতে হেনস্থা করা হয়। অযথা মামলায় ফাঁসানো হয় বাঙালি শ্রমিকদের। অথচ জেলায় বা রাজ্যে ঠিকমত মজুরি মেলে না বলে ভিন রাজ্যে শ্রম দিতে যান শ্রমিকেরা পেটের দায়েই। সবাই ওদের সন্দেহের চোখে দেখে। মনে করে, ওরাই বুঝি করোনার ধারক-বাহক।
শ্রমিকেরা রাষ্ট্রের মূল ভিত, এই সহজ সত্য স্বীকার করে না রাষ্ট্র
শ্রমিকেরাই রাষ্ট্রের মূল ভিত। সমাজ তথা রাষ্ট্রের হিতের জন্য এই শ্রমিক সম্প্রদায়কে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। কিন্তু এই সহজ সত্যটা স্বীকার করে না রাষ্ট্র। তাই সব সম্প্রদায়ের শ্রমিকদের প্রতি চলছে নির্বিচার অর্থনৈতিক শোষণ। কার্যত শ্রমিকদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে। গতবছরের লকডাউনে শ্রমিকদের বাড়ি ফেরাতে রাষ্ট্রের যে কোনও সদর্থক ভূমিকা ছিল না সে তো আমরা কেন্দ্র এবং রাজ্য চাপান উতোরে দেখেছি। ‘বিদেশ’ এর আগেও অনেকবার গিয়েছে ওরা। কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা আগে তাদের হয়নি বা এমন দূর্দশায় আগে পড়তে হয়নি। রোদে পুড়ে গিয়েছে শরীর। চোখ কোটরে গিয়েছে। আগুনে ঝলসানো দেহের চামড়া। শরীর থেকে ঠিকরে বার হয়েছে তাপ। তবুও মাইলের পর মেইল হেঁটেছে ওরা। জানালেন বসতি অঞ্চল থেকে দূরে পাহাড়ি এলাকায় তাঁদের থাকার জায়গায় কেরল সরকারের ত্রাণ পৌঁছচ্ছে না। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক বলে মিলছে না রেশনের সুবিধাও। মালিকপক্ষের তরফে এর মধ্যে একবার গাড়িতে বেশ কিছু চাল, আলু, তেল, সয়াবিন পাঠানো হয়েছিল। সংবাদপত্রে জেনেছিলাম ক্রান্তিরহাটের সুভাষ রায় তাঁর দুই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে কেরলে গিয়েছিলেন। তিনবেলা রান্না করত অন্য শ্রমিকদের জন্য। ছ'মাস হয়ে গিয়েছিল সেখানে, বাড়ি ফেরার টিকিটও কাটা হয়ে গিয়েছিল। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপায় ছিল না। একটা ঘরেই ১০-১৫ জন মিলে গাদাগাদি করে থাকত এই শ্রমিকেরা। কিন্তু লকডাউনে ট্রেন বাতিল হয়ে যায়। সেও ফিরতে পারেনি। প্রাণহীন দেহ রাজপথেই লুটিয়ে পড়েছিল। স্ত্রী বাতাসী একাই এখন মাঠের কাজ দেখাশোনা করে। পড়শির সাহায্য নিয়েই কৃষিকাজ করে। একাই জমিতে সেচ দেয়। প্রতি সপ্তাহে রেশনের লাইনে দাঁড়ায়।
রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকলে পরিকল্পনাও উপযুক্ত হয়
কথায় আছে, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকলে পরিকল্পনাও উপযুক্ত মানের হওয়া প্রয়োজন। যদি আবারো তৃতীয় ওয়েভে সবকিছু ছারখার হবার উপক্রম হয় তাহলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আটকে থাকা শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াক সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সরকার কেন্দ্রীয় সহযোগিতায়। খাদ্য সরবরাহ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করুক। বিশাল অঙ্কের আর্থিক প্যাকেজের সামান্য কিছু খরচ করলেই তা সম্ভব। কী করা যেতে পারে? যে যে রাজ্যে শ্রমিকেরা রয়েছে, তাদের সেখানেই থেকে যাওয়ার নির্দেশ দিতে হবে। তারপর সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নির্দেশ দিতে হবে যেন শ্রমিকদের মাথা গোজার আশ্রয় এবং নূন্যতম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারও খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের ব্যবস্থা করবে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে। স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে শ্রমিকদের লালারস সংগ্রহ করে কতজন করোনা আক্রান্ত তার হিসেব বার করতে পারবে সরকার। এইভাবে আক্রান্তদের তুলে এনে কোয়রান্টাইন সেন্টার বা কোবিড হাসপাতালে এনে চিকিৎসা করলে হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়ে শ্রমিকদের বাড়ি ফিরতে হবে না। এ কাজে সময় নিশ্চয়ই বেশি লাগবে, তবে কাজের কাজটা হবে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল, মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের টাকা এই খাতে ব্যয় করা হোক। এতে আর্থিক ক্ষতিও সরকারের হবে না। কিন্তু এই সাধারণ পরিকল্পনা না নিয়ে যেভাবে কেন্দ্র রাজ্য দ্বৈরথ হয়, যেভাবে আর্থিক প্যাকেজের নামে গালভরা ঘোষণা হয় তাতে শ্রমিকদের কতটুকু উপকার হচ্ছে তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।