সদিচ্ছা থাকলে এড়ানো যায় যে কোনো অকল্যাণ
গৌতম চক্রবর্তী
(তুলে আনলাম আত্মনির্ভশীল ভারতের কোলাজ যেগুলো ঠাঁই পেয়েছিল সংবাদপত্রের এককোণে বছরখানেক আগে। ভারতীয় অর্থনীতি এবং বর্তমান শ্রমনীতি নিয়ে দ্বিতীয় দফা এবং আগত তৃতীয় দফার করোণা সংক্রমনের প্রাক্কালে তাই ফিরে দেখা এই সময়কাল গুরুচন্ডালীর খেরোর খাতায়। প্রথম পর্ব )
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে
গত বছরের ঘটনা। টুকরো খবরের কোলাজগুলো বেড়িয়েছিল বিভিন্ন সংবাদপত্রের স্বল্প পরিসরে চোখে না পড়ার মত খবর হয়ে। আসলে খবরগুলো কোন কেষ্টবিষ্টুদের খবর নয় যে খুশী হয়ে বিজ্ঞাপনের অর্থে এক শ্রেণীর সংবাদপত্রের তবিল স্ফীত হবে অথবা পেইড নিউজের অর্থে খবরের স্থানবিশেষ জায়গা পরিবর্তিত হবে সংবাদপত্রের পাতায়। তাই ছোট আকারের খবর জায়গা পেয়েছিল সংবাদপত্রের এক কোণায়। বিস্কুট খেয়ে দিন কেটেছিল আবদুল্লাহর। অভাবের সংসার। চার বছরের ছেলেটার মুখে দু'মুঠো ভাত তুলে দিতে মুম্বইতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়েছিলেন। লকডাউনে কাজ বন্ধ। টাকা পয়সা তেমন হাতে না থাকায় খাবার কিনে রাখতে পারেননি। সেই যে আটকে পড়লেন আর ছোট ছেলেটার মুখ দেখা হল না। মুম্বইয়ের চার্চগেট হাসপাতালে মারা যান আবদুল্লাহ শেখ। বয়স ৪০ বছর, বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা থানার মেদিনীপাড়া গ্রামে। শারীরিক দূর্বলতা সহ্য করতে না পেরেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। ক'দিন বাদে ছেলে হাবিবুর, বছর চব্বিশের স্ত্রী বিলকিস খাতুন এবং বৃদ্ধা মায়ের কাছে ফিরেছিল ঘরের একমাত্র রোজগেরে ছেলের নিথর দেহ। গত বছর লকডাউন শুরুর এক সপ্তাহ আগেই প্রথম কাজের খোঁজে পাঞ্জাবে গিয়েছিলেন মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের সুকুমার দাস। ভেবেছিলেন কিছু টাকাপয়সা জমানোর পর একেবারে পুজোর সময় বাড়ি ফিরবেন। অমৃতসরে একটি কম্বল তৈরির কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন। সেখানেই ১২ এপ্রিল আত্মঘাতী হন সুকুমার। টাকার অভাবে তাঁকে শেষ দেখাও দেখতে পাননি প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী ও দেড় বছরের শিশুসন্তান। মুম্বইয়ে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয় চাঁচলের কালীগঞ্জের সুলতান আলির। লকডাউনে মুর্শিদাবাদের দৌলতাবাদ থানার গঙ্গাপ্রসাদ গ্রামের ৮ জন শ্রমিক আটকে ছিলেন কেরলের ইয়ারনাকুলাম জেলার প্রেম্বানু থানার একটি সংস্থার কর্মস্থলে। আটকে ছিল জলঙ্গির ৪৫ জন শ্রমিক। ওই শ্রমিকেরা জানিয়েছিলেন একবেলা আলুসেদ্ধ-ভাত খেয়ে দিন কেটেছে তাদের।
আত্মনির্ভশীল (!) ভারতবর্ষের গল্প
আসলে এইগুলো সব নিছক সংবাদের কোলাজ। তার পরবর্তী খবরগুলি সেন্সার এবং ধামাচাপা দেবার চেষ্টায় কোন ত্রুটি রাখে নি শাসকদল এবং বশংবদ একশ্রেণীর মিডিয়া। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে বাস্তবতা এবং তথ্যের মধ্যেকার গরমিলটা নাঙ্গা হয়ে গিয়েছিল। ভারতবর্ষের কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতির বেআব্রু দশাকে খুল্লমখুল্লা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়েছিল সোস্যাল মিডিয়া এবং বিকল্প সাংবাদিকতার বেশ কিছু ভিডিও পোস্ট যেগুলি দেখলে পাষাণেরও হৃদয় গলে যাবে। সংকটের স্বরূপ কিঞ্চিত পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। করোনাকালের বাৎসরিক উদযাপনের সময়কালেও পরিস্থিতির পরিবর্তন তো হয়ই নি, বরং সংকট উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। মালনদী চা বাগানে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল সঞ্জয়ের সঙ্গে। ঝকঝকে চেহারা। বুদ্দিদীপ্ত কথাবার্তা। ওর কাছ থেকেই শুনলাম আত্মনির্ভশীল ভারতবর্ষের গল্প। সেই গত বছর পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, সড়কপথে, রেললাইন ধরে সঞ্জয়রা হেঁটেছিল। ভেবেছিল মরতে হলে বাড়িতে গিয়েই মরবে। কিন্তু পথ যেন আর কিছুতেই শেষ হয় নি। এই অনন্ত অসীম পথ সাত দিন ধরে এক নাগাড়ে হাঁটতে হাঁটতে হেঁটেই চলেছিলেন সঞ্জয় বেসরা, রাজু মুর্মুরা যাদের এই কিছুদিন আগেও দিন গুজরান হয়েছিল মালবাজারের দুটি পাতা একটি কুড়ির দুনিয়াতে। “অনেক আগেই মরে গিয়েছি। মনের জোরে শুধু প্রাণটা ছিল। ভেবেছিলাম বাড়ি গেলেই হয়তো মরে যাব। তবু নিজের বাড়িতে মরেও সুখ!” বলেছিলেন সাতকুড়ার কাঁটাতারের বাসিন্দা বুধু হেমব্রম যার ছেলে ঘটনাচক্রে আমার বিদ্যালয়েই পড়ে তিনিও হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলেন। আসলে ন্যূনতম মজুরির অভাব এবং কিছুটা শিক্ষার আলোকে আলোকিত হবার কারণে এইসব শ্রমিকেরা একটু বেশি অর্থ রোজগারের আশাতে পাড়ি দিয়েছিল গুড়গাঁও, চেন্নাই আবার কেউ বা ব্যাঙ্গালোর। আসলে ওঁরা আত্মনির্ভরশীল ভারতের আত্মনির্ভরশীল নাগরিক।
রাজ্যে কাজের অনিশ্চয়তা, তাই ভিনরাজ্যে পাড়ি
১৯৯১ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারত জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। ন্যাশনাল কমিশন অন রুরাল লেবার এর নথি থেকে জানা যায় এর মধ্যে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক ভিন রাজ্যে কাজ করতে যান এবং ৬০ লক্ষের কাছাকাছি সংখ্যক শ্রমিক নিজের রাজ্যেই ভিন জেলায় কাজ করেন। করোনা ভাইরাস নিয়ে সতর্কতার প্রেক্ষাপটে সামনে এসেছে ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও স্বাস্থ্য সঙ্কটের ছবিটা। দেশ জুড়ে লকডাউনের কারণে কর্মস্থলে আটকে বেঁচে থাকাটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। তার ফলে দেখা গেছে করোনাকালে রোগের ভয় উড়িয়ে ঘরে ফেরাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভারতে ভিন রাজ্যে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা উত্তরপ্রদেশ, বিহারে সবচেয়ে বেশি। বিহারের পরেই পরিযায়ী শ্রমিকের নিরিখে উল্লেখযোগ্য রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, হুগলি ও মালদহ থেকে লাখ লাখ শ্রমিক ভিন রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের কাজে যান। মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ শ্রমিককে দেখা যায় কেরল এবং চেন্নাইতে নির্মাণ কাজে যেতে। হুগলি ও মেদিনীপুর জেলার অনেক শ্রমিক বংশানুক্রমিকভাবে হিরে কাটার কাজ করেন মুম্বই ও গুজরাতে। গুজরাতে মার্বেল নির্মাণের সঙ্গেও যুক্ত মুর্শিদাবাদের অনেকে। নিজের রাজ্যে কাজের অনিশ্চয়তা, মালিকক্ষের অমানবিক দর কষাকষি ও যৎসামান্য পারিশ্রমিকে উপায় না দেখে বছরের পর বছর শ্রমিকেরা কেরলে, মুম্বই বা চেন্নাইয়ে কাটিয়ে দেন। তা ছাড়া মরসুমি কাজের অভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারো মাস চাষের কাজের পরিকাঠামো না থাকাতেও তাঁরা ভিনরাজ্যে যেতে বাধ্য হন। সেকেন্ডারি সেক্টর অর্থাৎ কারখানার কাজে তাঁরা কেউ কেরলের রবার কোম্পানিতে, প্লাইউড কোম্পানিতে, কেউ বা আহমদাবাদে কাপড় কারখানায় কাজ করেন। আর ‘টারশিয়ারি সেক্টরে’ চেন্নাইয়ে, মুম্বইয়ে তাঁরা ভবন নির্মাণের কাজে যান। অনেকে যান ভিন দেশে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়ে ভাবা হবে না কেন?
লকডাউনে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার অজুহাতে শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি দিতেও অস্বীকার করেছেন মালিকপক্ষ বা ঠিকাদার সংস্থার লোকজনেরা। হলদিবাড়িতে আমার পূর্ব পরিচিত রাজমিস্ত্রী জহিরুল গত বছর লকডাউনে অনেক কষ্ট করে বাড়ি ফিরে আসার পর তার কাছ থেকে শুনেছিলাম সংস্থার কাছ থেকে তিনি ১৫ হাজার টাকা পেতেন। এক টাকাও পাননি, তার উপরে কাজ হারিয়েছিলেন। কি করে সংসার চালাবেন সেই চিন্তায় ঘুম উবে গিয়েছিল তার। তার উপরেও ছিল ভিন রাজ্যে থাকা খাওয়ার অনিশ্চয়তা। আর ফিরে যায়নি জহিরুল। সামান্য জমিতে চাষবাস করে কায়ক্লেশে দিন কাটছে। বিরামহীনভাবে সাত দিনে সত্তর বছরের অভিজ্ঞতা হয়েছে শ্রমিকের কাজ করা সঞ্জয়ের। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি পরিপূর্ণ। কিন্তু হায়! বাড়ি ফেরার পর দ্বিতীয়বার আর জন্মভিটে ছেড়ে কোথাও যাবেন না বলে চা বাগানে দৈনিক ২০০ টাকা মজুরীর শ্রমিক সে। আক্ষেপ করে জানালো তিন ডবল মজুরি পেতো রোজ। কিন্তু তার সাফ কথা “এ বার যদি না খেয়েও মরি, তাও ঠিক। কিন্তু বিদেশে আর যাব না।” সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে থাকা ভিনদেশে ওরা যায়নি কখনও। কিন্তু তারপরেও ওরাই যেন ভিনদেশ থেকে করোনা বয়ে এনেছে ভারতে এমন দৃষ্টিতে সবাই দেখেছে ওদের। তাই ভয়ে লুকিয়ে খিদে পেটে নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে দু’পায়েই ভরসা করে হেঁটে ফিরেছে সঞ্জয়রা। সঞ্জয়ের আক্ষেপ আজকে এ রাজ্যে কলকারখানা বা শিল্পের সঠিক পরিকাঠামো থাকলে বা ডুয়ার্সের চা বাগানে ন্যূনতম মজুরী থাকলে তাদের মত শ্রমিকদের এভাবে ঘরছাড়া হতে হত না। অথচ, পরিযায়ী শ্রমিকদের বিস্তারিত কোনও পরিসংখ্যান নেই কেন্দ্র এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির কাছে। এই শ্রমিকদের ফিরিয়ে এনে সবার আগে তাঁদের কর্মসংস্থান এবং চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া উচিত রাজ্য সরকারের। শ্রম দফতরের তরফে তাঁদের সঠিক নথি তৈরি হোক যাতে যে কোনও বিপদে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো যায়। সবার জন্য ১০০ দিনের কাজ ও সরকারি ভাতার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করলে হয়তো ভিন রাজ্যে যাওয়ার এই ঝুঁকি নেওয়া কমানো যেতে পারে।
বাস্তবের রেখাচিত্র। ভালো লেখ।। কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে মজবুত এবং সামাজিক সুরক্ষা ছাড়া কোভিড বা জনজীবনের সংকটের মোকাবিলা করতে পারেনি।
দূর্বলতা নয়, দুর্বলতা হবে।