এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  আলোচনা  সমাজ

  • মনুসংহিতায় কী আছে? (১)

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | সমাজ | ১৪ মে ২০২১ | ৩০০০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • ভূমিকা : নিও-নর্মাল কে সি পাল

    নতুন শতাব্দীর দুটো দশক পেরিয়ে গেল। বিশ্বায়নের যুগে ঘরে বসে দুনিয়ার খবর - অডিও এবং ভিস্যুয়াল মাধ্যমে - আমরা পেয়ে যাচ্ছি। কথা চলছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে।দৈনন্দিন জীবনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে গেছে। নতুন কোন জায়গায় গেলে আমরা অচেনা লোকজনকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করি না। বরং মোবাইলে জিপিএস দেখে ঠিকমত পৌঁছে যাই আমড়াতলার মোড়ে।

    কিন্তু আচমকা চারদিকে শুনতে পাই যে এসবই নাকি ‘বেদে আছে’! সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের লাইভ টেলিকাস্ট করছিলেন। গণেশের নাকে হাতির শুঁড় প্লাস্টিক সার্জারি করে লাগানো হয়েছিল। রামায়ণের পুষ্পক বিমান আসলে প্রাচীন যুগের এয়ার ইন্ডিয়া।

    অথচ কেউ খেয়াল করেন না যে পৌরাণিক যুগে রাজপ্রাসাদেও ইলেকট্রিসিটি ছিল না। সর্বত্র দীপদান এবং মশালের আলো। এমনকি বৌদ্ধযুগেও বাসবদত্তা সন্ন্যাসী উপগুপ্তকে দেখছে প্রদীপের আলোয় – “প্রদীপ ধরিয়া হেরিল তাহার নবীন গৌরকান্তি”।

    আর পৌরাণিক যুগে তো সবাই যাতায়াত করেন গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়িতে, মানে পশুতে টানা শকটে বা রথে। তাই দেবতারাও সব বলদবাহন, ময়ুরবাহন, অশ্ববাহন, হস্তীবাহন এবং মকর বা সিংহবাহিনী, এমনকি মুষিকবাহনও।

    বাস্তববুদ্ধি ঘুলিয়ে দেওয়ার এ জাতীয় চেষ্টা যে কয়েক দশক আগেও হয়নি এমন নয়। যেমন সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য নয় পৃথিবী। এবং সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। তখন এসব শুনে বা কলকাতায়\ ও হাওড়া ব্রিজের গায়ে লেখাগুলো পড়ে আমরা সবাই হাসতাম, দেওয়াল লেখক কে সি পালকে কিছুটা প্রশ্রয়ের সুরে বলতাম পাগল। কিন্তু আজকাল অবস্থা বদলে গেছে। ওই কথাগুলো বলা হচ্ছে জোরগলায় ঢাক ঢোল পিটিয়ে।

    যেমন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসে পেপার গবেষণাপত্র পড়া হচ্ছে যে প্রাচীন যুগে ভারতে বিমান ব্যবস্থা ছিল। সেই বিমান অনেক উন্নত টেকনোলজিতে চলত। তাতে মোটরগাড়ির মত ‘ব্যাকগিয়ার’ ছিল। হাইকোর্টের বিচারপতি বলছেন ময়ূর হল খাঁটি ব্রহ্মচারী। তার চোখের জলে ময়ূরীর গর্ভ সঞ্চার হয়। বোকাবাক্সতে দেখছি এমন দাবি যে জ্যোতিষেও ক্যানসার সেরে যায়। বা পতঞ্জলি আশ্রমের ৭৫০ টাকার প্যাকেজে করোনা রোগী ১০০% সুস্থ হয়ে ওঠে। অন্যে পরে কা কথা, দেশের প্রধানসেবক নিজেই গণেশের শুঁড়কে প্রাচীন প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ বলে দাবি করছেন।

    এখন কেউ হাসতে সাহস করে না। এ নিয়ে প্রশ্ন করে না। করলেই আপনি হয় দেশদ্রোহী, নয় তো ভারতের সংস্কৃতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠের সেন্টিমেন্টে ঘা দিচ্ছেন।

    মনুর মূর্তি প্রতিষ্ঠা?

    খবরের কাগজ বলছে রাজস্থানে নাকি মনু মহারাজ বা মনুস্মৃতির প্রণেতা মহর্ষি মনুর মূর্তি স্থাপন করা হবে। তাঁকে দেখতে কেমন কেউ জানে না। কোথাও ছবিটবি দেখি নি। ইদানীং একটা মূর্তি প্রতিষ্ঠার হুজুক শুরু হয়েছে। সর্দার প্যাটেল, সাভারকর, শ্যামাপ্রসাদ, নাথুরাম গডসে হয়ে গেছে। এবার আমাদের প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্রের সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থের রচয়িতা মনুর পালা। যদিও দলিত সমুদায়ের বক্তব্য আমাদের সমাজে জাতপাতের ভাগাভাগি, ছোঁয়াছুঁয়ি এসব নাকি মনুস্মৃতিতে লিপিবদ্ধ, সেখান থেকে শুরু। তাই ওঁরা দেশের অদলাবদলি করে শাসন ক্ষমতায় থাকা বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে মনুবাদী পার্টি বলেন।

    ইদানীং দলিতদের উপর অত্যাচার বেশ বেড়েছে। অর্থাৎ আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন ভারতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের নামে যা খুশি বলাটা নিও-নর্মাল হয়ে গেছে। কারণ এর পৃষ্ঠপোষক হয়েছে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা। এর সামাজিক প্রতিফলন দেখছি বিশেষ করে তিনটে ব্যাপারে।

    এক হল খাদ্যাখাদ্য। ডাক্তার নয়, সরকার ঠিক করে দেবে আপনি কী খাবেন বা কী খাবেন না। শুধু তাই নয়, ফ্রীজে গোমাংস রাখা আছে এই সন্দেহে আদালতে না গিয়েই লোককে পিটিয়ে মারা হচ্ছে।

    দুই, নারীর কীসে ভাল তা অবলা কোমল ভারতীয় নারী বোঝে না। তার কেমন পোশাক পরা উচিত, কার সঙ্গে বন্ধুত্ব বা চলাফেরা করা উচিৎ, কাকে বিয়ে করা উচিৎ নয়, সব ঠিক করে দেবে পুরুষের বা যুবকের দল, থুড়ি রাষ্ট্র। অর্থাৎ ভারতীয় নারী কোনদিনই প্রাপ্তবয়স্ক হয় না। তার বিয়ে তো ঠিক করে দেবে তার বাবা-মা। এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি, এটাই ভারতীয় ঐতিহ্য। কাজেই প্রাপ্তবয়স্ক চাকুরে মেয়ে যদি অন্যধর্মের ছেলেকে ভালোবেসে, স্বেচ্ছায় বিয়ে করে তাহলে তার কথায় কান না দিয়ে তার বাবা-মা বা সমাজের কোন অতি উৎসুক যুবকের তরফে "জোর করে ধর্মান্তরণ করা হচ্ছে" অভিযোগ পেয়ে নতুন স্বামীকে জেলে পোরা যাবে। এটাই কয়েকটি রাজ্যে নতুন তৈরি ‘লাভ জিহাদ’ আইন।

    তিন, দলিতদের ভারতীয় সমাজে ঠিক জায়গা কোথায়? আম্বেদকর কি হিন্দু ধর্মের দলিতদের প্রতি ক্রুরতার প্রতিক্রিয়ায় কয়েক হাজার অনুগামীর সঙ্গে নাগপুরের দীক্ষাভূমিতে বৌদ্ধ হয়ে যান নি? আম্বেদকর যে কয়েক হাজার অনুগামীর সঙ্গে নাগপুরের দীক্ষাভূমিতে বৌদ্ধ হয়েছিলেন, সে কি হিন্দু সমাজে দলিতদের প্রতি হয়ে চলা ক্রুরতার প্রতিবাদে?

    সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে দলিত মেয়েটিকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে হত্যা করার বীভৎস ঘটনাটিকে মেয়েটির মৃত্যুপূর্ব জবানবন্দী সত্ত্বেও যেভাবে সরকারি পুলিশ, ডাক্তার ও কিছু মিডিয়া মিলে মিথ্যে, এবং নিহতের পরিবারের ‘অনার কিলিং’ বলে দাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল, তা আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

    তাহলে ভারতীয় বা হিন্দুসমাজের এই তিনটে বিষয়ের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্য কী? দেখুন, এখন আর একটি নতুন সত্য বা পোস্ট-ট্রুথ হল যাহা হিন্দু তাহাই ভারতীয়। বিশুদ্ধ বেদান্তদর্শন চর্চার সূত্রগ্রন্থে দেখছি বিভিন্ন মনু, গৌতম, পরাশর এবং যাজ্ঞবল্ক্য আদি বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রকে উল্লেখ করে বলা হচ্ছে — শূদ্রের নেই বেদ পাঠে বা শ্রবণের অধিকার। [1]

    আর মনুসংহিতায় নাকি আমাদের প্রাচীন আচার-বিচার, উচিত-অনুচিত মায় সিভিল ও ক্রিমিনাল কোড সবই লিপিবদ্ধ রয়েছে। এমনকি কলোনিয়াল যুগে বৃটিশরা এ নিয়ে বেশি খোঁচাখুচি করেনি। তাই হিন্দু কোড বিল রচিত হয়েছিল স্মৃতিশাস্ত্র বা সংহিতা বিশেষ করে মনুস্মৃতি মেনে। কেন? কারণ পরাশর, যাজ্ঞবল্ক্য ইত্যাদি অনেকগুলো সংহিতা থাকলেও মতভেদ হলে মনুর বিধানই বেদ-অনুসারী এবং মান্য বলে ধরা হয়।

    “মন্বর্থবিপরীতা যা সা স্মৃতির্ন প্রশসস্যতে”। যার ব্যাখ্যা মনুর সাথে মেলেনা তা স্মৃতিশাস্ত্রের মর্যাদা পাবে না। আবার ‘যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন তৎক্বচিৎ’। অর্থাৎ যা এই বইয়ে আছে তা অন্য স্মৃতিগ্রন্থেও আছে, আর যা এতে নেই, বুঝতে হবে তা কোথাও নেই।[2]

    কাজেই রাজস্থানে মহর্ষি মনুর মূর্তি স্থাপিত হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। মনুসংহিতাতে বাস্তবে কী বলা হয়েছে তা নিয়ে খতিয়ে না দেখেই বাজারে অনেক কথা বলা হয় । দেখা যাক, সংহিতার মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনুস্মৃতিতে বাস্তবে কী বিধান দেয়া আছে।

    বারোটি অধ্যায়

    এতে রয়েছে দ্বাদশ অধ্যায়।

    প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে সৃষ্টিতত্ত্ব। আরও বলা হয়েছে যে ব্রহ্মা এই শাস্ত্র মনুকে শিখিয়েছিলেন। (শ্লোক ১/৫৮)। মনু দশজন প্রজাপতি মহর্ষি (মরীচি, অত্রি, বশিষ্ঠ, নারদ, ভৃগু আদি) কে শিখিয়েছিলেন। এখন ভৃগু উপস্থিত জিজ্ঞাসু মহর্ষিদের শোনাচ্ছেন। (১/৫৯)।

    এতে কী কী আছে?

    প্রায় চল্লিশটির বেশি বিষয়ে এতে আলোচনা আছে । কিছু উল্লেখ করছিঃ পৃথিবীর উৎপত্তি, সংস্কারের নিয়ম, স্ত্রীসংভোগ, বিবাহের প্রকার, মহাযজ্ঞবিধি, শ্রাদ্ধবিধি, জীবিকা, খাদ্যাখাদ্য, সাক্ষীকে প্রশ্ন করার নিয়ম, স্ত্রীপুরুষের পারস্পরিক ধর্ম, মহপাতক, উপপাতক, প্রায়শ্চিত্ত, দন্ডবিধি, সম্পত্তির নিয়ম, বর্ণসংকর, বিভিন্ন বর্ণের আপদ্ধর্ম, দেশধর্ম, জাতিধর্ম ইত্যাদি। (১/১১৮)।

    এই তালিকাটি দেখুনঃ
    (১) সৃষ্টি থেকে প্রলয়
    (২) ভূগোল – আর্যাবর্ত, ইত্যাদি; ব্রহ্মচারীর গুরুকুলে পালনীয় বিধি
    (৩) গার্হস্থ্য আশ্রম, আট প্রকার বিবাহ, কন্যার লক্ষণ, শ্রাদ্ধের নিয়ম
    (৪) গৃহস্থের আচারসংহিতা
    (৫) খাদ্যাখাদ্য বিচার, বেদবিহিত হিংসাকে অহিংসাকে মানা
    (৬) বানপ্রস্থের আচার আচরণ
    (৭) রাজার আচরণ; করব্যবস্থা, সাম-দান-ভেদ ও দন্ডের প্রয়োগ
    (৮) দন্ড বিধি (পেনাল এবং ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড)
    (৯) স্ত্রীপুরুষ সম্পর্ক, উত্তরাধিকার (সিভিল ও সিভিল প্রসিডিওর কোড)
    (১০) বর্ণাশ্রম ধর্ম, তাদের আচার-আচরণ বিধি
    (১১) নিয়মের উল্লংঘন করলে প্রায়শ্চিত্ত ও শাস্তি
    (১২) শরীর উৎপত্তি, স্বর্গ ও নরক গমন, ব্রহ্মবেত্তার লক্ষণ

    এবার তিনটে কিস্তিতে মনুসংহিতা অনুযায়ী সমাজে শূদ্রের স্থান, নারীর স্থান ও খাদ্যাখাদ্য বিচার নিয়ে কথা বলব। আমি চেষ্টা করব এই স্বল্প পরিসরে মনুসংহিতার স্বরূপের বর্ণনা করে তিনটি ভাগে খাদ্যাখাদ্য, জাতিপ্রথা এবং নারীর অবস্থান নিয়ে উনি কি বলেছেন তা তুলে ধরতে। মনে হয় জাতিপ্রথা নিয়ে আগে কথা বলা উচিত। কারণ, ওটাই আমাদের সমাজের প্রাচীন কাঠামো। খাদ্যাখাদ্য বা নারীর অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে ওই কাঠামোকে মেনে।

    মনুসংহিতায় জাতিভেদ

    মনুসংহিতা কখনই শূদ্রদের মানুষের মর্যাদা দেয় নি। চারবর্ণের উৎপত্তি দেখুন।

    “লোকবৃদ্ধির জন্য (স্রষ্টা) মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য এবং চরণ থেকে শূদ্র সৃষ্টি করলেন।“ (১/৩১)

    মনু বলছেনঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য — এই তিন বর্ণ হল দ্বিজ, কারণ এদের পৈতে উপবীত হয়ে দ্বিতীয় জন্ম হয়। চতুর্থ বর্ণ শূদ্রের একই জন্ম (দ্বিজত্ব নেই); কোনও পঞ্চম বর্ণ নেই(১০/৪)।

    -- ব্রাহ্মণের কাজ বিদ্যাচর্চা, অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ।
    -- ক্ষত্রিয়ের লোকরক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন ইত্যাদি।
    -- বৈশ্যের কাজ পশুপালন, কৃষি, সুদে টাকা খাটানো, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন।
    -- শূদ্রের একটি মাত্র কাজ, বাকি তিনবর্ণের সেবা। (১/৮৮ থেকে ৯১)

    আবার মুখ বা উত্তমাঙ্গ থেকে উৎপন্ন এবং বেদজ্ঞাতা বলে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ। (১/৯৩) সৃষ্টির মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ বলে ১/৯৪ থেকে ১/১০৩ পর্য্যন্ত বর্ণনা করা হয়েছে।

    এবার জন্মের পর সন্তানের নামকরণ দেখুন।

    ব্রাহ্মণের নাম হবে শুভসূচক, ক্ষত্রিয়ের বলবাচক, বৈশ্যের ধনবাচক এবং শূদ্রের নাম নিন্দাবাচক হবে। এই চারবর্ণের উপনাম হবে যথাক্রমে শর্ম, বর্ম, ভূতি ও দাস। (যেমন শুভশর্মা, বলবর্মা, বসুভূতি এবং দীনদাস প্রভৃতি)। (২/৩১ এবং ৩২)।

    আজীবিকা এবং দৈনন্দিন জীবনে শূদ্রঃ দাসত্ব

    শূদ্র ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যেই ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে। প্রভু কর্তৃক অন্য দাসেরা মুক্ত হলেও শূদ্র দাসত্ব থেকে মুক্ত হয় না। দাসত্ব তার স্বভাবে রয়েছে (৮/৪১৩, ৪১৪)।

    উচ্চ তিন বর্ণের উপনয়ন হয়ে দ্বিজ বা দ্বিতীয় জন্ম হয়। শূদ্রের উপনয়নে অধিকার নেই, সে বেদপাঠের অধিকারী নয়। দ্বিজের মতো উপবীত বা অন্যান্য চিহ্ন ধারণ করলে শূদ্রের মৃত্যুদন্ড বিধেয় (৯/২২৪)।

    ব্রাহ্মণের তপস্যা হল জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের তপস্যা রক্ষা করা, বৈশ্যের তপস্যা কৃষি এবং গো-পালন, শূদ্রের তপস্যা দ্বিজগণের সেবা করা (১১/২৩৫)।

    কোন প্রকার সংস্কারে শূদ্রকে অধিকার দেওয়া হয় নি (১০/১২৬)। বর্ণত্রয়ের, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সেবাই শূদ্রের একমাত্র বৃত্তি। প্রভুর ফেলে দেয়া ছেঁড়া কাপড়, ছাতা, খড়ম ও তোষক প্রভৃতি শূদ্র ব্যবহার করবে। প্রভুর খাওয়া হয়ে গেলে পড়ে থাকা এঁটো খাবার তার ভক্ষ্য বা খাদ্য। (১০/১২৩,১২৫)

    যজ্ঞে পাওয়া জিনিষপত্র ব্রাহ্মণ কখনও শূদ্রকে দেবেন না (৪/৮০)। (পাওয়া জিনিষপত্র)

    শূদ্রের নিষিদ্ধদ্রব্য খাওয়ায় পাপ নেই, সে উপনয়নাদি সংস্কারের যোগ্য নয়, ধর্মে তার অধিকার নেই। (১০/১২৬)। দাসবৃত্তি থেকে শূদ্রের কোনও প্রকার মুক্তি নেই। “ন স্বামিনা নিসৃষ্টোঅপি শূদ্রোদাসাদ বিমুচ্যতে” (মেধাতিথির ভাষ্য)। মনু বলছেন যে শূদ্র সক্ষম হলেও ধনসঞ্চয় করবে না। কারণ শূদ্র ধনলাভ করলে গর্ববশে ব্রাহ্মণকে পীড়া দিতে পারে (১০/১২৯)। ব্রাহ্মণ কখনও শূদ্ররাজার রাজ্যে বাস করবেন না (৪/৬১)। যে পথ দিয়ে উচ্চবর্ণের লোকেরা যাতায়াত করেন, সেই পথে শূদ্রের মৃতদেহ বহন করা চলবে না (৫/৯২)।

    বিবাহ সম্বন্ধে মনুর বক্তব্য নিজের নিজের জাতে বিয়ে করাই ভাল, নইলে সন্তান বর্ণসংকর (বাস্টার্ড) হয়। তবে অনুলোম বিবাহ, অর্থাৎ যদি পিতা উচ্চবর্ণের মাতা নিম্নবর্ণের হয় তাহলে সিদ্ধ। তাতে সন্তানের জাত মায়ের থেকে উচ্চ কিন্তু পিতার থেকে নিম্ন হবে। সে পিতার ভাল গুণ পাবে। কিন্তু প্রতিলোম বিবাহ – মাতা উচ্চবর্ণের, পিতা নিম্নবর্ণের — অসিদ্ধ। এদের সন্তানের স্থান পিতার থেকে নিচে, এরা পিতার নীচ গুণ পাবে। যেমন শূদ্র ব্রাহ্মণীকে বিয়ে করলে সন্তান ‘নরাধম চন্ডাল’ হবে (১০/১৬)। এদেরই মনু আসল বর্ণসংকর মনে করতেন এবং বলতেন এটা বাড়লে রাজ্য ও সমাজ রসাতলে যাবে। ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্রনারীর গর্ভে জাত সন্তান ‘আর্য’ হয়, কিন্তু শূদ্র থেকে ব্রাহ্মণীতে উৎপন্ন সন্তান ‘নিকৃষ্ট’ হয় (১০/৬৭)।

    সুলেখক মনোরঞ্জন বেপারীর আত্মজীবনীমূলক “ইতিবৃত্তে চন্ডাল জীবন” বইটি পাঠককুলে সমাদৃত। কিন্তু চন্ডালদের প্রতি অমানবিক ব্যবহার মনুর বিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, দেখুন মনু কী বলছেনঃ

    চন্ডালদের আশ্রয় গ্রামের বাইরে। এদের ধন বলতে কুকুর ও গাধা। এদের জলপাত্র দিতে নেই। এদের খাবার দিতে হবে চাকরের হাত দিয়ে ভাঙা বাসনে। এরা পরবে শ্মধানের মড়ার কাপড়, লোহার গয়না, বইবে অনাথ শব, কিন্তু রাত্তিরে গ্রামনগরে ঘুরে বেড়ানো মানা। রাজাদেশে দন্ডিত ব্যক্তিদের বধ করা এদের কাজ — মানে আজকালকার জেলের ফাঁসুড়ে। (১০/৫১ –৫৬)।

    পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার সম্বন্ধে মনু বলছেন - দ্বিজ তিনবর্ণের পুরুষ চারজাতের নারীকেই বিয়ে করতে পারেন। উত্তরাধিকারে সমস্ত সম্পত্তির দশভাগ করে ব্রাহ্মণীর পুত্র চারভাগ, ক্ষত্রিয়ার পুত্র তিন, বৈশ্যার পুত্র দুই এবং শূদ্রার পুত্র একভাগ পাবে। যদি শূদ্রা ছাড়া অন্য স্ত্রীদের একটিও সন্তান না থাকে তবুও সেই সন্তান দশভাগের একভাগই পাবে, বেশি নয়। (৯/১৫৩, ১৫৪)। উচ্চ তিন দ্বিজ জাতির পিতার শূদ্রা স্ত্রীর পুত্রের সম্পত্তির অধিকার নেই, পিতা নিজের ইচ্ছেয় যা দেবে তাই (৯/১৫৫) অর্থাৎ ওই দশভাগের একভাগও আসলে শূদ্র-স্ত্রীর সন্তানের অধিকার নয়, লোকব্যবহার এবং আপার লিমিট মাত্র!

    জাতিভেদে অপরাধের শাস্তি

    -- ইচ্ছুক বা অনিচ্ছুক ব্রাহ্মণ নারীর সঙ্গে অবৈধ যৌন সংসর্গের অপরাধে মনু শূদ্রের মৃত্যুদন্ডের বিধান দিয়েছেন। কিন্তু ব্রাহ্মণের ‘অরক্ষিত’ ভার্যার সঙ্গে সহবাসে ‘লিঙ্গচ্ছেদ’ বিধান (৮/৩৭৪)। কিন্তু শূদ্রানারীর সঙ্গে অনুরূপ সংযোগের অপরাধে ব্রাহ্মণকে কিছু জরিমানা দিলেই চলবে (৮/৩৮৫)।
    -- যে অপরাধে অন্য বর্ণের প্রাণদন্ড বিধেয়, সেখানে ব্রাহ্মণের মাথা মুড়িয়ে দিলেই হবে (৮/৩৭৯)।
    -- ব্রাহ্মণের নিন্দা করলে শূদ্রের জিহ্বা ছেদন বিধেয়(৮/২৭০); কিন্তু শূদ্রের প্রতি ব্রাহ্মণ অনুরূপ ব্যবহার করলে সামান্য জরিমানা (৮/২৬৮)।
    -- ব্রাহ্মণকে চোর বলে গাল দিলে ক্ষত্রিয়ের সামান্য অর্থদন্ড, বৈশ্যের দেড়শ’ বা দু’শ পণ অর্থদন্ড, কিন্তু শূদ্রকে বধ করা হবে (৮/২৬৭)।
    -- শূদ্র যদি ব্রাহ্মণের গায়ে হাত তোলে তাহলে তার হাত কেটে ফেলা হবে, পদাঘাত করলে পা (৮/২৮০)।
    -- ব্রাহ্মণের সঙ্গে সমান আসনে বসলে তার কোমরে গরম লোহার ছ্যাঁকা দিয়ে নির্বাসিত করা হবে, অথবা তার নিতম্ব এমন ভাবে কাটা হবে যেন তার মৃত্যু না হয় (৮/২৮১)।
    -- ব্রাহ্মণের গায়ে থুতু দিলে শূদ্রের ঠোঁট কেটে ফেলা হবে। গায়ে মলমূত্র ফেললে তার লিঙ্গ কাটা হবে এবং বাতকর্ম করলে তার গুহ্যদ্বার চিরে দেওয়া হবে (৮/২৬২)।
    -- শূদ্র তিন দ্বিজজাতিকে জাত তুলে গাল দিলে শাস্তি হবে তার মুখে দশ-আঙুল মাপের জ্বলন্ত লোহার শলাকা ঢুকিয়ে দেওয়া (৮/২৭১)।
    -- আর শূদ্র যদি ব্রাহ্মণকে জ্ঞান বা ধর্মোপদেশ দেয় তাহলে রাজার নির্দেশে তার মুখে ও কানে গরম তেল ঢালা হবে (৮/২৭২)।
    -- ব্রাহ্মণ কর্তৃক শূদ্রহত্যা ‘উপপাতক’ মাত্র (১১/৬৬), অর্থাৎ সামান্য পাপ যা গোসাপ, প্যাঁচা, বেজি, ব্যাঙ বিড়াল, কুকুর বা কাক বধের তুল্য(১১/১৩১)। কিন্তু শূদ্র ব্রহ্মহত্যা করলে মৃত্যু বিধেয়।
    -- ব্রাহ্মণের ‘রক্ষিতা স্ত্রী’র সঙ্গে সঙ্গমে অন্য বর্ণের শুধু অর্থদন্ড হবে, কিন্তু শূদ্র এই অপরাধ করলে তার সর্বস্বহরণ করে মৃত্যুদন্ড বিধেয়।
    -- যদি ব্রাহ্মণ ভার্যা ‘অরক্ষিতা’ হন, তাহলে সেই নারী সঙ্গমকারী শূদ্রের খালি লিঙ্গচ্ছেদ হবে। (৮/৩৭৪)
    -- বিচারালয়ে শপথ নেবার সময় শূদ্রকে বলতে হবে যে মিথ্যা বললে সে সকল পাপের ভাগী হবে। এটা অন্য তিন বর্ণের প্রতি প্রযোজ্য নয় (৮/১১৩)।
    -- শূদ্রকে আদালতে স্ত্রী এবং সন্তানের মাথায় হাত রেখে দিব্যি গালতে হবে। এছাড়াও আছে জ্বলন্ত কয়লার উপর হাঁটানো বা জলে ডুবিয়ে রাখা। এ দুটো থেকে ও যদি না পুড়ে এবং না ডুবে ভেসে ওঠে তাহলে বুঝতে হবে যে শূদ্র সত্য কথা বলছে (৮/১১৪ এবং ১১৫)।

    ব্রাহ্মণের বিশিষ্ট স্থান

    মহাপাতকের ক্ষেত্রে মনু শারীরিক দন্ডবিধানের দশটি স্থান নির্দেশ করেছেন। কিন্তু সেটা ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য তিন বর্ণের জন্যে প্রযোজ্য। ব্রাহ্মণ অক্ষত দেহে দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন।। তাঁকে অর্থদন্ড দিতে হবে না। অন্য তিনবর্ণকে দোষের হিসেবে নির্বাসিত হওয়ার আগে আর্থিক এবং শারীরিক দন্ড ভোগ করতে হবে (৮/১২৩, ১২৪)।

    ব্রাহ্মণের মৃত্যুদন্ড হলে শুধু মাথা মুড়িয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। অন্য তিনবর্ণের ক্ষেত্রে শাস্তিটি প্রাণঘাতী হবে। সকল অপরাধে অপরাধী হলেও রাজা ব্রাহ্মণকে কখনও হত্যা করবেন না। তাঁকে তাঁর সমস্ত ধনসম্পদ সহ অক্ষত দেহে শুধু রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করবেন। পৃথিবীতে ব্রাহ্মণবধ অপেক্ষা গুরুতর অধর্ম নেই। সুতরাং, রাজা তার বধ চিন্তাই করবেন না (৮/৩৭৯, ৩৮০, ৩৮১)।

    ব্রাহ্মণ শূদ্রহত্যা করলে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ অন্য কোন ব্রাহ্মণকে একটি বৃষ ও দশটিশুক্লবর্ণ গাভী দান করবেন। বেড়াল, নেউল, চাতকপাখী, ব্যাঙ, কুকুর, গোসাপ, প্যাঁচা বা কাক মেরে শূদ্র হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করবেন(১১/১৩০, ১৩১)।

    জাতিকর্ম কি গুণদোষের ভিত্তিতে শ্রম বিভাজন, না জন্মজাত বৃত্তি?

    গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেনঃ চাতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।[3]

    গুণ ও কর্মের হিসেবে আমি চার বর্ণ সৃষ্টি করেছি।

    মনু বলছেনঃ নিজধর্ম বা নিজের জাতের যা জন্মসূত্রে নির্ধারিত কাজ তা’ ঠিকমত করতে না পারলেও ভাল, কিন্তু পরের ধর্ম সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হলেও ভাল নয় , অপরের ধর্মানুসারে জীবনধারণ করলেমানুষ তৎক্ষণাৎ জাতিভ্রষ্ট হয় (১০/৯৭)।

    খেয়াল করুন, ভগবদগীতাতেও ঠিক এটাই বলা হয়েছে।
    "শ্রেয়ান স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎস্বনুষ্ঠিতাৎ।
    স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্মো ভয়াবহঃ।" [4]

    অর্থাৎ কোন ব্যক্তির জন্মসূত্রে প্রাপ্ত জাতিধর্ম যদি নিকৃষ্টও হয়, তবু অন্য জাতির উন্নত ধর্ম পালনের চেয়ে নিজের জাতিধর্ম পালনে মৃত্যুবরণ করাই শ্রেয়। এখানে ধর্ম মানে অবশ্যই ধর্মশাস্ত্র (মনু, পরাশর, গৌতম আদি স্মৃতিশাস্ত্র) অনুযায়ী নির্দিষ্ট জাতিধর্ম। তখন ভারতবর্ষে অন্য কোন ধর্ম ছিলনা। যে অধম জাতির লোক উৎকৃষ্টজাতির কর্মদ্বারা জীবনধারণ করে, রাজা তাকে নির্ধন করে শীঘ্র নির্বাসিত করবেন(১০/৯৬)। অর্থাৎ শূদ্র যদি শাস্ত্র পড়ে পুরুতগিরি বা টোলে পড়ায়, অথবা অস্ত্রবিদ্যা শিখে যুদ্ধ করে তাহলে রাজা তাকে দেশছাড়া করবেন। ব্রাহ্মণের সেবাই শূদ্রের বিশিষ্ট কর্ম বলে কথিত হয়। এ ছাড়া সে যা করে তা নিষ্ফল হয় (১০/১২৩)।

    এই প্রবন্ধটি লেখার সময় আমার জনৈক বন্ধু রবীন্দ্রনাথের “ব্রাহ্মণ” কবিতাটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন — ব্যতিক্রমও ছিল।

    উক্ত কবিতাটির বহুপরিচিত কাহিনী অনুযায়ী মাতা ‘ভর্তৃহীনা জবালার’ গোত্রহীন পিতৃপরিচয়হীন পুত্র সত্যকাম যখন ঋষি গৌতমের কাছে অকপটে মায়ের ‘বহু-পরিচর্যার ফল’ হিসেবে নিজের জন্ম-বৃত্তান্ত বর্ণনা করেন তখন মহর্ষি গৌতম তাকে সত্যবাদিতার জন্যে ‘ব্রাহ্মণ” বলে স্বীকার করে নেন। কারণ এমন সত্যভাষণ কেবল ব্রাহ্মণের পক্ষেই সম্ভব! এই “জাবাল সত্যকাম” পরে উপনিষদের ঋষির সম্মান লাভ করেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই “প্রাচীনত্ব বা ঐতিহ্যমুগ্ধতা”র মধ্যে নিহিত রয়েছে একটি “আয়রণি”।

    একই কাহিনীর সম্পর্কে ব্রহ্মসূত্র কী বলছে দেখুনঃ

    ব্রহ্মসূত্রের প্রথম খন্ডের ত্রৃতীয় ভাগের নবম পরিচ্ছেদের বিষয় হল শূদ্রের বেদপাঠে বা অন্য সংস্কারকর্মে অধিকার আছে কি নেই? তাতে তৈত্তিরীয় উপনিষদের শ্লোক (৭.১.১.৬) উদ্ধৃত করে বৈদান্তিক বলছেন “শূদ্র যজ্ঞের অধিকারী নয়”। সূত্র ৩৫ শে জানশ্রুতি ও রৈক্কের গল্প উল্লেখ করে বলা হচ্ছে জন্মসূত্রে যে শূদ্র, সে সংস্কারের অর্থাৎ শাস্ত্র অনুযায়ী দৈনন্দিন পূজোপাঠের এবং উপনয়নের অধিকারী নয়।

    এবার ৩৭ নম্বর সূত্রের [5] ব্যাখ্যায় ছান্দোগ্য উপনিষদের শ্লোক (৪/৪/৫) উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে গৌতম জবালাপুত্র সত্যকামের ব্রাহ্মণজন্ম সম্বন্ধে নিসন্দিগ্ধ হয়ে তাকে শিষ্য বলে স্বীকার করে নিলেন।“কারণ কোন অব্রাহ্মণ এমন কঠিন সত্য উচ্চারণ করতে পারে না”। রবীন্দ্রনাথ তাই লিখলেন—“অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত , তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত”।

    একটা কথা; আজ দিল্লির উপকন্ঠে লাখো কৃষক প্রায় দু’মাস ধরে হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নীচে ধর্নায় বসেছেন। এই কৃষি হল বৈশ্যের কর্ম বা জাতিধর্ম। কিন্তু মনু কী বলছেনঃ

    “কৃষিকে কেউ কেউ ভাল মনে করেন। কিন্তু ওই পেশাটির সম্বন্ধে ভদ্রজনের মুখ থেকে কোন ভাল কথা শোনা যায় না। কারণ, যে কাঠের মুখে লোহা আছে তা জমিকে, এবং জমিতে যে প্রাণী আছে তাদের নষ্ট করে”। (১০/৮৪)।

    শূদ্রের পরিত্রাণ কিসে?

    মনু বলছেনঃ বেদজ্ঞ গৃহস্থ কীর্তিমান ব্রাহ্মণদের সেবা শূদ্রের স্বর্গাদিশ্রেয় লাভ জনক ধর্ম। এমন শূদ্র পরের জন্মে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মাতে পারেন। (৯/৩৩৪,৩৩৫)। অর্থাৎ শূদ্র ভাল কাজ করেও সোজা স্বর্গে যেতে পারবে না। তাকে আগে এই জন্মে পন্ডিত ও গুণী ব্রাহ্মণের সেবা করে পরের জন্মে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মাতে হবে -- তবে না।

    বাদ সেধেছেন আর এক ব্রাহ্মণ রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ‘দুরাশা’ গল্পের নায়িকা এক মুসলমান নবাবপুত্রী। সে ব্রাহ্মণ হবার চেষ্টায় সারাজীবন শাস্ত্র অধ্যয়নের পর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই উপলব্ধিতে পৌঁছয় যে ‘ব্রাহ্মণত্ব’ আসলে একটি অভ্যাস মাত্র। তাহলে পরিণাম?

    ‘মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে কোলে তুলে দাও নাই স্থান,
    অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান’। (রবীন্দ্রনাথ, “অপমানিত”)

    জাতিভেদ ধরে রাখতে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখুন

    শূদ্র যে রাজার সভায় ধর্মনিয়ে বিচার করে, তাঁর রাজ্য চোখের সামনে কাদায় বসে যাওয়া গরুর মত অবসন্ন হয়। যদি রাজ্যে শূদ্রের ও নাস্তিকের সংখ্যা খুব বেড়ে ব্রাহ্মণ গায়েব হয়ে যায়, তাহলে গোটা রাজ্যটাই দুর্ভিক্ষ ও রোগে শীঘ্র বিনষ্ট হয়। (৮/২১,২২)।

    লিস্টি আর লম্বা করতে চাই না। কিন্তু আজ যখন খোদ আমেরিকাতে “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” আন্দোলনে মার্কিন রাষ্ট্রের কিছু ইতিহাস পুরুষের স্ট্যাচু নিয়ে নতুন করে মূল্যায়নের প্রশ্ন উঠেছে তখন আধুনিক রিপাব্লিক ভারতে মনুর মূর্তি স্থাপন করার আগে একটু চিন্তা করলে হয় না? আমাদের সংবিধানে যে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আইনের চোখে সবাই সমান! কিন্তু যেভাবে এক যোগীর রাজত্বে দলিত নারীরা ধর্ষিত ও নৃশংস ভাবে নিহত হচ্ছে, চারদিকে ঘৃণার বিষবাষ্প, তখন বোধহয় আমাদের সবার আগে তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলা উচিত — “ক্ষমা করো”। পারব কি ?
    ==================================================

    [1] ব্রহ্মসূত্র; প্রথম ভাগ, ১/১/৩৮।
    [2] মনুস্মৃতি, ডঃ রামচন্দ্র বর্মা শাস্ত্রী; পৃঃ ৯।
    [3] ভগবদগীতা, ৪/১৩।
    [4] ভগবদগীতা, ৩/৩৫।
    [5] ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য অফ শ্রী শংকরাচার্য, অদ্বৈত আশ্রম, কলকাতা। ২০০৪। ( ১//৩/৯/৩৭)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Amit | 203.***.*** | ১৫ মে ২০২১ ০২:৪৩734391
  • খুব ভালো আর দরকারি লেখা রঞ্জনদা। যাদের মন বিষিয়ে গেছে তারা তো লস্ট কেস। কিন্তু যারা এখনো দোলাচলে ভোগেন সারক্ষণ হিন্দু মুসলিম নিয়ে তাদের কে পড়ানো দরকার। 

  • অরিন | 161.65.***.*** | ১৫ মে ২০২১ ০৫:৫৯734392
  • রঞ্জনবাবু, এসব পড়ে লোকে আবার না আইডিয়া পেয়ে বসে। এমনিতেই জনতার গুণের ঘাট নেই। 

  • Ranjan Roy | ১৫ মে ২০২১ ১১:১৪734395
  • বলতে ভূলে গেছি লেখাটা শীতকালে লেখা। আগে অশোক মিত্র প্রতিষ্ঠিত (বাংলাটা ঠিক লিখেছি?) "আরেক রকম" ডিজিটালে প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটায় সেই ছাপ রয়েছে। কিন্ত  মূল বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা অপরিবর্তিত। 

  • gg | 1.186.***.*** | ১৮ মে ২০২১ ১৫:০৬734411
  • ggg

  • গবু | 223.223.***.*** | ১৮ মে ২০২১ ১৫:৪৪734412
  • অরিনবাবু - এই আলোচনা থেকে এরকম একটা বক্তব্য আসতে পারে, যে মুসলমানদের যদি শরিয়া চলতে পারে তাহলে হিন্দুদের মনু স্মৃতি কি দোষ করলো?


    কিন্তু সেই ভয়ে আলোচনা বন্ধ করে দিলে তো আলোকমুখী কোনো আলোচনাই সম্ভব হবে না - কাজেই ওটা ভেবে লাভ নেই। 


    রঞ্জনদা - ভালো লাগছে, এগিয়ে চলুন

  • Ranjan Roy | ১৮ মে ২০২১ ২২:৫৬734414
  • আসলে আরও কিছু জুড়ে দেয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ল্যাদ খেয়ে--।


    পরের কিস্তি 'নারী'। তাতে কিছু জুড়ে দেবার ইচ্ছে।

  • অরিন | ১৯ মে ২০২১ ০৩:০৮734415
  • গবু , আমার কমেন্ট-টা হালকা চলে করা ছিল, রঞ্জনবাবু লিখবেন না কেন? না লিখলে আলোচনাই বা হয় কি করে? চলুক! চালিয়ে যান রঞ্জনবাবু ।

  • Ranjan Roy | ১৯ মে ২০২১ ১২:৩০734417
  • অরিন 


    আমি ঠিকই বুঝেছি।:)))

  • হীরেন সিংহরায় | ২১ মে ২০২১ ২৩:৪০734425
  • আপনাকে হাজার হাজার ধন্যবাদ। কত কিছুই যে জানতাম না। দুর্বার বিতর্কের মুখোমুখি হতে পারি জেনেও বলি মনুর জাতিভেদের মূল তত্ত্বের সঙ্গে আমার সংগ্রাম গ্রন্থের একাদশ অধ্যায় ( জাতি ও জনতা ) অসম্ভব মেলে - একটি সম্প্রদায় বিশেষের প্রসঙ্গে . 

  • হীরেন সিংহরায় | ২২ মে ২০২১ ০০:০৬734426
  • উপরের শ্রী গৰু প্রশ্ন করেছেন 


    'অরিনবাবু - এই আলোচনা থেকে এরকম একটা বক্তব্য আসতে পারে, যে মুসলমানদের যদি শরিয়া চলতে পারে তাহলে হিন্দুদের মনু স্মৃতি কি দোষ করলো?"


    এর উত্তরে ​​​​​​​হয়তো ​​​​​​​বলা ​​​​​​​যায় কোন ​​​​​​​আব্রাহাম ​​​​​​​পন্থী ​​​​​​​ধর্মে ​​​​​​​জন্ম দিয়ে সামাজিক ​​​​​​​অবস্থান ​​​​​​​নির্দিষ্ট ​​​​​​​হয় ​​​​​​​না। ​​​​​​​তাই ​​​​​​​মনু ​​​​​​​সংহিতা ​​​​​​​একেবারে ​​​​​​​অন্য ​​​​​​​সিলেবাসের ​​​​​​​বই। ​​​​​​​প্রসঙ্গত ​​​​​​​শরিয়ার ​​​​​​​অর্থ " জল ​​​​​​​কে ​​​​​​​যাবার ​​​​​​​পথ ​​​​​​​".

  • Dishery Malakar | ২৭ আগস্ট ২০২১ ১২:২৮734910
  • খুব প্রয়োজনীয় লেখা।চলতে থাকুক।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন