দুপুরে ফোন পেয়েছিলাম। খেতে বসব। আমার জনৈক পরিচিত। আক্রান্ত ব্যক্তিটি বিপন্ন হয়ে ফোন করেছিলেন। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বছর চল্লিশের মানুষটি যে কোভিড পজেটিভ জানতাম।লক্ষণ তাই বলছিল।রিপোর্ট এল পরে । ব্যবসা করেন। আজ বোধহয় দিন সাতেক হল। শরীরাকি সমস্যা ফুটে বের না হলেও জ্বর জারি বা ফ্লুর সংক্রমণ হয়েছিল দিন কয়েক আগে। তারপর ফার্মেসি থেকে ইচ্ছেমতো ও অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ আনিয়ে খেয়েছেন। কাজ হয়নি। বার বার বলার পরও তিনি শোনেননি। চিকিৎসকের কাছে না যাওয়া বা চিকিৎসার প্রতী অনীহা কোন বৈপ্লবিক অবস্থিতি থেকে নয়। বলাবাহুল্য গাঁটের কড়ি না গুণতে চাওয়া।আর একটু দেখি, অন্তত খরচটা বাঁচুক। চেকভের 'গুজবেরি' গল্পটা পড়তে পড়তে বার বার লক্ষ্য করেছিলাম, মৃত্যুশ্যায় শুয়ে থাকা এক বণিক, মরবার আগে একবাটি মধু চেয়েছিলেন। সেই মধু দিয়ে সমস্ত ব্যাঙ্কনোট আর লটারির টিকিট খেয়ে ফেলেছিলেন। ইভান ইভানিচ মন্তব্য করেছিলেন - টাকা ভোদকার মতোই মানুষকে খামখেয়ালী করে তোলে।' তার প্রমাণ বারে বারে পেয়েছি।
শেষে শুকনো কাশির দাপটে স্থানীয় চিকিৎসকের কিছু ওষুধ খাচ্ছিলেন। গত কয়েকদিন আগে তার শারীরিক অবস্থার খোঁজ করতে যেতে হয়েছিল। চিকিৎসক কোভিড টেস্ট করতে বলেছিলেন। বাড়িতে স্ত্রী, ছোট বাচ্চা, মা, বাবা। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। কিন্তু পক্ষাঘাতে বিছানায় আছেন। কোথায় টেস্ট হয় জানতে চাইলে বলি খোঁজ নিয়ে বলব। ফিরে খোঁজ নিয়ে দেখাগেল ৪ তারিখ পর্যন্ত সরকারী হাসপাতালে পরীক্ষা বন্ধ। ৪ তারিখ সকালে স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি, এখানে টেস্ট হচ্ছে না। পাশের হাসপাতালে হচ্ছে। তবে ওখানে সকাল থেকে লাইন পড়ে। সুতরাং আজ সম্ভব নয়। অসুস্থ ব্যাক্তিটিকে বিষয়টি খুলে বলি। তখন তিনি বেসরকারি ল্যাব থেকে টেস্টের জন্য খোঁজ নিতে বলেন। সাংবাদিক বন্ধুর থেকে একজনের নাম্বার জোগাড় করে পরীক্ষার খরচ জেনে নেই। অসুস্থ ব্যক্তিটি জানান, তার বন্ধু তাদের আর একটি ল্যাব থেকে পরীক্ষা করাতে বলেছে। করচ কম। অন্তত উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি যখন বেসরকারি ল্যাব থেকে টেস্ট করতে উদগ্রীব, বুঝি বিষয়টি সিরিয়াস। ৪ তারিখ সন্ধ্যায়, তিনি জানান, তাদের পরিচিত ল্যাব কর্মীটি বলেছেন, সেই ল্যাব থেকে টেস্ট করাতে দেরি হবে, খরচটাও বেশি। পূর্ববর্তী ল্যাবের কর্মীটিকে পরদিন স্যাম্পেল নিয়ে যেতে বলি। ঠিকানা পাঠিয়ে দেই। খবর নিয়ে জানতে পারি ৫ তারিখ স্যাম্পেল নিয়ে গেছে।
৬ তারিখ, ফের তাদের বাড়ি যাই। গত কয়েকদিন, গণমাধ্যম ও ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা চিকিৎসক সংগঠন, বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থার নির্দেশিকা গুলো বলে আসি। জানতাম, তার কোনটাই পালন করবে না।আর সেগুলো মানার মতো পরিস্থিতিও নেই। আক্রান্ত ব্যক্তির মা কয়েকদিন আগে জ্বর থেকে উঠেছেন। দুর্বলতা কাটেনি। সেই পরিস্থিতিতে তার দাদা সশস্ত্রীক শ্বশুরবাড়ি যে গেছেন, বাড়ির পরিস্থিতি ঠিক না হলে তিনি ফিরবেন না। সুতরাং পরিস্থিতি সামলানোর লোক থেকেও নেই। ৬ তারিখ ব্যক্তিটির জ্বর স্থিতিশীল। বলাভালো কমে গেছে। তবে প্রচণ্ড দুর্বলতা, শুকনো কাশি আর হালকা দমবন্ধ হয়ে আসার সমস্যা লক্ষ্য করে। চিকিৎসককে ফোন করতে বলি।তখনও রিপোর্ট আসেনি।
দুপুরে তার কাছ থেকে ফোনটা এসেছিল। দমবন্ধ লাগছে। পার্লস অক্সিমিটারের খোঁজ করতে হল। এলাকতেই একটি পরিবারের কম- বেশি সবার কোভিড হয়েছিল। তারা সেরে উঠেছেন। তাদের ফোন করে অক্সিমিটারের খোঁজ করায়, উত্তর এল নেই তো। অথচ অসুস্থতার সময় রোজ অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল মাপতে দেখেছি। মনে পড়ল, বন্ধু অমিতের কথা। ফোন করার অল্প সময়ের মধ্যে সে হাজির। অমিত কোভিডের ঝঞ্ঝাট পার করেছে সদ্য। তবু এল। অক্সিজেন স্যাচুরেশন মেপে দেখা গেল ৯০ এর কাছাকাছি। দেখলাম, মানসিক ভাবে ভেঙে পরেছেন লোকটা।
গিয়ে দেখা গেল মূল বাড়ির বাইরে গোডাউনে বিছানা করে তার কোভিড আইসোলেশন। ঘরটায় জানালা নেই। শুনলাম, রাতে তিনতালার ঘরে শুতে যান। সারাদিন এখানটাই তার আশ্রয়। পরিচিত চিকিৎসককে ফোন করে বিষয়টি বলায়, তিনি প্রন পজিশনে যাওয়ার কথা বলেন( এটা নিয়ে অনেকে হয়ত বিতর্ক করতে পারবে। ইমপিরিক্যাল অভিজ্ঞতা ছাড়া কোন পরীক্ষা নির্ভর প্রমাণের কথা জানিনা)। গোডাউনের আস্থানায় একটি বালিশ থাকলেও, দুটির অভাব। বাড়িতে গিয়ে আরও দুটো বালিশ চাইতে কোন উত্তর এলনা। শুনলাম, লকডাউনের আশঙ্কায়, তার দাদা ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা ভেবে ফিরেছে।জানি পাশের গোডাউনে সে বসা, অথচ নিরাসক্ত । শেষে অসুস্থ লোকটি গোডাউন থেকে নিজেই ধীরে ধীরে হেঁটে বাড়ির কাছে যান। বাড়ির বাকি সবাই স্থানুর মতো স্থির। কি করতে হবে তা যেন কেউ স্থির করতে পারছে না।
বলতে বাধ্য হলাম, এমন একজন অসুস্থকে একটা আলোবাতাসহীন গোডাউনে ফেলে রাখা কেন? ভিতর থেকে উত্তর এল তাহলে উপরের ঘরে যাক। বিছানাপত্র নিয়ে উপরে উঠি। বহুদিন ঘরটায় কেউ থাকেনি। ধুলো আছে। ধুলো ঝেড়ে বিছানা নামিয়ে জানালা খুলতে হলো। ঘরে পাখাও লাগানো নেই। কারণ, এটি ব্যবহার হয়না। নীচ থেকে টেবিল পাখাটা আনার কথা বলায়, একজন পাখা নেওয়ার কথা বলে। কিছুক্ষণ বাদে একহাতে পাখা নিয়ে ঘেমে নেয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে অসুস্থ লোকটি উপরে এসে ধপকরে বিছানায় বসে পড়ে। সিঁড়ির নীচে দূর থেকে বাড়ির লোকগুলো দেখে, একজন অসুস্থ লোক পাখা হাতে হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে। হাঁপিয়ে বসে নিয়ে একটু স্থির হওয়ার পর প্রন পজিশনের ছবি দেখিয়ে, তেমটা করতে বলি।পাখাটা চালানো হয়। কিছু সময় থাকার পর তার কিছুটা স্বস্তি হয়। ডা স্বপন জানাদাকে ফোন করাতে, ফোনে তিনি রোগীর সাথে কথা বলেন।চটজলদি পরামর্শ ও ওষুধের নাম লিখে নেই। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় লক্ষ্য করি লোকটির দাদা যেখানে সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, আমাকে নামতে দেখে পড়িমরি করে সরে গেল। বাড়ির অন্যরাও দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলেছে। মৃত্যুভয় কি মানুষকে ভোদকার মতো কিংকর্তব্য বিমূঢ় করে তোলে? নাকি সরিয়ে ফেলে কাছের লোকের থেকেও? তাই কাছের মানুষকে তীব্র অসুস্থতা নিয়ে হাতে পাখা বয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দেখেও নির্বাক করে দেয়? করে তোলে দর্শক। গোডাউনের বাতাসহীন ঘরটাকে বরাদ্দ করে তাদেরই পরিবারের অসুস্থ মানুষকে সময় গুজরান করার জন্য ছেড়ে দিয়ে প্রমাদ গোনেন।
ওষুধ এনে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা গেছে। স্থির ও মূক হয়ে যাওয়া সেই পরিবারের লোকগুলোকে কঠিনভাবে বলতে হয়েছে, উপরের অব্যবহৃত ধুলোর ঘরটা নয়, নীচের একটা ঘর অসুস্থ লোকটির জন্য খুলে দেওয়া হোক। আর ফ্ল্যাস্কে গরম জল দেওয়া হোক। কারণ, তার কাশিটা বেশ বেগ দিচ্ছে। ফ্ল্যাস্কের কথা জিজ্ঞেস করতে উত্তর এসেছিল - ফ্ল্যাস্কে বাচ্চারা জল খায়। ওটা কি আমরা দিতে পারি? বিস্ময়ের ঘোর লাগল। বাজার পাশে, দরকারে বাচ্চাদের জন্য একটা ফ্ল্যাস্ক কি এরা কিনতে পারবে না? পরিবারের অসুস্থ লোকটার জন্য একটু গরমজল বরাদ্দ করা যাবে না? কিংবা দরকারে একাধিকবার জলটা গরম করা যাবে না? জলটা গরম বা ঠাণ্ডা থাকলে তা কোন মৃতসঞ্জীবনী হয়ত হয়ে উঠবে না।কিন্তু এই কাজটার মধ্যে থাকে পারিবারিক অসুস্থ লোকটির সাথে অপরদের সংযুক্তির সূত্র। মৃত্যুর আশঙ্কা অন্যদের সাথে এই সংযুক্তির পরিসরকে ছিন্ন করেছে।ফলে অসুস্থ লোকটিও একাকীত্ব, নিরাপত্তাহীনতা বা কাউকে পাশে না পাওয়ার আতঙ্কে ম্রিয়মাণ। মনে হয় কাছের লোকগুলোরও সংযুক্ত হতে না পারার পেছনে কোথাও এক অন্তর্লীন ভয়, হিসেব- নিকেষ কি কাজ করেছে। ঠিক জানিনা। মানবিক বোধটুকু আমরা এভাবে কি হারিয়ে ফেললাম? কাছের লোকের যন্ত্রণায় অন্যদের সহমর্মিতাও থমকে গেছে যেন। ক্রমাগত যে ভয়ের আবহ তৈরি করার, জ্বলন্ত গণচিতার ছবি দেখানোর এক পৌনঃপুনিক প্রচার চলছে তার ফলই বোধহয় দুঃসময়ে নিজের লোকগুলি পর হয়ে যাওয়া। কোথাও যখন কিছু নেই, তখন পরিবার, সমাজের লোকগুলোর মানসিক ভাবে কাছাকাছি থাকাটা কতটা জরুরি ছিল। কিন্তু দূরত্ব বেড়েগেল বিস্তর।
ফেরার পথে স্বরটা কঠিন করে অন্যদের বলতে হল, আরও অসুস্থতা বাড়লে তিনতলা থেকে কে রোগীকে নামাবে? লোকটির অসুস্থতার খবরটুকু উপর থেকে কে নীচ অবধি বয়ে আনবে? জরুরি দরকারে কাউকে ডাকলে অন্যরা শুনতে পেয়ে সাড়া দেবেন তো?
তখনও রিপোর্ট আসেনি। বেসরকারি ল্যাবের কর্মীকে ফোন করে তাড়া দিতে সন্ধ্যার পর প্রত্যাশিত পজেটিভ রিপোর্ট এল। রাতে খবর নিয়ে জানা গলে, নীচের একটা রুম অসুস্থ লোকটির জন্য বরাদ্দ হয়েছে। তিনি উপর থেকে নীচে নেমে ঘরটিতে ঠাঁই পেয়েছেন। রিপোর্ট আসার পর হাসপাতালে বেডের খোঁজ খবর করতে হল। তার মাঝে একটা দরকারে তার দাদার থেকে খবর নিয়ে জানা গেল, এখন লোকটির অবস্থা অনেকটা স্থিতিশীল, দমবন্ধ ভাবটা অনেকটা কমেছে। কিন্তু তার নিজের নাকি গলার কাছে ব্যথা ব্যথা করছে। বুঝলাম ভয় পেয়েছে। আপাতত আজ বেড জনিত খোঁজ- খবর করার জন্য আর এগোতে হয়নি। কাল কি হবে জানিনা? আরও যদি অসুস্থ হন কে তবে এগিয়ে আসবে সেটি অসুস্থ লোকটি বা অপর লোকগুলো জানে না। জানেনা বলেই, এক অন্তর্লীন ভয় মনের আদিগন্ত ছেয়ে রয়েছে মানুষগুলোর। যে ভয় থেকে হয়ত কাছের লোকগুলোর বিপদেও মানুষ নিস্পৃহ এক শীতলায় দাঁড়িয়ে আজ শুধুই দ্রষ্টা হতে পারে! এই ভয় মানুষ কতদিন বয়ে বেড়াবে উত্তর অজানা। সামাজিক পরিসর ছেড়ে দিলাম, পারিবারিক পরিসরের পারষ্পরিক সহানুভূতির বোধটুকুও ভয়ের ঊষরভূমি পার করে কবে সরস, স্বাভাবিক হয়ে উঠবে ঠিক জানিনা?