এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভোটের হাওয়ায় লাগল নাচন

    Subhecchha Baidya লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ এপ্রিল ২০২১ | ১১৯২ বার পঠিত
  • ভোটের সময় আমজনতা অদ্ভুত সহনশীল হয়ে পড়ে। অন্য সময়ে কন্ডাকটর (কনসার্টের নয়, বাসের) ভুল করেও দুটাকা বেশি ভাড়া বলে ফেললে চলন্ত বাসেই তার ওপেনহার্ট সার্জারি, অথবা, মেট্রোরেলে কেউ প্রিয়জনের দিকে একটু প্রেমপ্রেম চোখে তাকালেই সভ্য সমাজের পরিপাটি করে আঁচড়ানোতে 'ঝাঁট' জ্বলে যায়। সুড়ঙ্গের ভিতরে অসভ্যতামি বরদাস্ত করা যায় না। বসন্তের ললিতরাগে কী যেন ব্যথা জেগে ওঠে। কিন্তু সহনাগরিক গুলি খেয়েছে শুনলে তার ভালোবাসার কেঁদো বাঘ আর বেরতে চায় না কিছুতেই।

    'ভোটের সময় এসব হয় একটু আধটু' - এই শেষ কথা বলে যাব আমি চলে। দৈনিক বলছে - বাবা মায়ের কোল থেকে বাচ্চা ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেছে সেনা, বাচ্চা নিখোঁজ। আমরা ভাবছি- কোন যেন একটা সিনেমায় ছিল এরকম একটা শট! উফফ, শেষে বাচ্চাটাকে পাওয়া গেছিল ঘাড় মটকে কোন একটা ডাস্টবিনে। মনেই হচ্ছিল না প্লাস্টিকের খেলনা বাচ্চা; এমন ডিরেক্টর।স্যাটাস্যাট হোয়াটসাপে লোককে খোরাক পাঠাচ্ছি - দিলুবাবু ইজ দ্য নিউ জ্ঞানপ্রকাশ। তার কথার অবশ্য কম বেশি সারাবছরই উতল আঁচল, এলোথেলো চুল! ছোটদের সামনে আবার বেশি খুনোখুনির খবর চালাতে নেই। ওরা এসবে কী শিখবে! এক সকালে হঠাৎ বড় হয়ে জানবে সমাজে পটাপট মানুষ খুন হয় ভোট উৎসবে, কেউ অবশ্য জানার আগেই খুন হবে। আজটেক সভ্যতায় নাকি নরবলির উৎসব হত, স্প্যানিশরা গিয়ে অদ্ভুতভাবে তা রদ করে। কীভাবে? সেই আজটেকদের কেটে ঝুলিয়ে দিয়ে। এ বড় হাস্যকর।

    হাসি এক বিপজ্জনক জিনিস। যার পায় তার থামতে চায় না, যার পায় না সে লাফিং গ্যাসের প্রভাব কমে গেলেই আবার ব্যাজার। হাসতে না জানলে বগল বাঁকা। ছোট থেকেই আমি বেশ নামকরা স্কুল-কলেজে পড়েছি। সেখানে কিছুমাস্টারমশাই ছিলেন ছাত্ররা হাসলেই তাঁরা বেদম মারতেন। কী এক আদিম রাগ কাজ করত সেই শিক্ষকদের। ধরা যাক কেউ অসহযোগ আন্দোলনে গান্ধীর অহিংস মনোভাব পড়াতে পড়াতে ক্ষেপে গিয়ে এমন মারলেন যে উপরে জেনারেল মাইকেল ও'ডায়ার নিজের নাইট উপাধি ত্যাগ করলেন। বাচ্চাগুলো হয়ত কারো পেনসিল বা টিফিনবাক্স লুকিয়ে রেখে মুচকি হাসছে, টার্গেট করা হল। ছেলেগুলো মার খাওয়ার আগে পর্যন্ত হাসত, মার খাওয়ার পরে দম নিতে চাইত। তারপর ঘাম মুছে জল খেয়েমাস্টারমশাই আবার পড়াতেন। কৈশোরের কিশলয় এভাবে পর্ণে পরিণত হয়। দেখতে শুনতে শেখে। বাছতে শেখে। মার খেয়ে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে অদ্ভুত সাফাই গাওয়া হত, যেমন- 'এ বাবা, আমি কী আর মারার জন্য তোর চোখে ডাস্টার দিয়ে খোঁচা মেরেছি? এ তো নিছক বাড়ির লোকের মতই শাসন করতে' অথবা 'আমি কি আর জানতাম মাটিতে ফেলে মাথায় কিল মারার তিনদিন পরে ওর জ্ঞান আসবে?' ইত্যাদি প্রভৃতি।

    এবারে ভোটের কথায় আসছি। 'লজ্জা' নামক একটা ব্যাপার একটা সময়ে আমাদের সমাজে ছিল। সৃষ্টিকর্তার স্পষ্ট আদেশ ছিল - আর যা খুশি খাও, জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ো না। শাসক ভালোমতই জানে জ্ঞানবৃক্ষের ফল হল কাতুকুতু বুড়ো। অবশ্য শাক দিয়ে মাছ ঢাকা মানেই সভ্য হওয়া নয়, গন্ধ ঠিকই পাওয়া যায়। আমার এক বন্ধু একবার সমকামী লোকজনকে নিয়ে নোংরা রসিকতা করার পর জানতে পারে যে তার সামনের বন্ধুটিও সমকামী। আমি ভাবলাম প্রথমজন লজ্জায় কুঁকড়ে যাবে, পাতালপ্রবেশ করবে। দেখি ও দ্বিগুণ কনফিডেন্স নিয়ে বলছে 'তুইও শালা গে, শালা কোনদিন জানব আমার বাবাও গে'। সে যাকগে! এদিকে কবি বলে গেছেন- 'A poet could not but be gay', সুতরাং তোমারি গে হে পালিছ স্নেহে - এসব বলে আর 'পেগের পরে পেগ জমেছে' গেয়ে আসর মাতানো যায়। এসবের কোনো পোয়েটিক জাসটিস নেই।

    উপরের ব্যাপারগুলো থেকে আমরা জানলাম যে সবই করা যায়। এর মধ্যে যদিও ধর্ষণ ধরা হয়নি। ফিজিক্স পড়তে গিয়ে 'সব ঘর্ষণ ধর্ষণ নয়, কিন্তু সব ধর্ষণই ঘর্ষণ' নামক রসিকতায় ক্লাসরুম মাতানো শিক্ষকও দেখেছি। সুতরাং এটাও করা যায়। মাথায় ঢুকতো না এসব।

    মেসেজ ফরোয়ার্ড করতে করতে আমরা কখন যে পেছনের দিকে চলে এসেছি আজকে তা বরং খেয়াল করার মত। এরই মধ্যে সাধ্বী প্রজ্ঞা বলছেন - সতীদাহ প্রথা আমাদের সংস্কৃতি, তারপর মানুষকে বিমান থেকে নামিয়ে দিয়ে তার সিট কেড়ে নিচ্ছে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত পড়ুয়াদের উপর গুলি চালানোর পর দুষ্কৃতিকে পুলিশ নিরাপত্তা দিচ্ছে গাড়িতে তুলে। হাথরাসের মেয়েটির বাবাকে গুলি খেয়ে মরতে হচ্ছে ধর্ষণের বিচার চেয়ে। এদিকে আমরা রোজ ফরোয়ার্ডে খেলছি আর সেমসাইড করে মন গড়া ম্যাচ জিতছি। চোখে ঠুলি পরানোর এই উৎসবে আমরা সবাই সপরিবারে মেলার মাঠের ধুলো আর জিলিপি খেয়ে হেঁচে মরছি। বাংলায় ভোটের সময় শীতলকুচিতে পুলিশের গুলিতে অকারণে প্রাণ গেল কয়েকজনের। দিলীপ হেসে হেসে বলছে 'নিহতরা বুঝেছে গুলি কত গরম, বিরোধীতা করলে সারা বাংলায় এটা হবে'। টাক চুলকে সায়ন্তন বলছে আরো ষোলোটা নাকি হবে সামনের দফায়। বাবুদের পারিষদ দল দুটাকার পরিবর্তে সুন্দরভাবে সাফাই গাইছেন। জওয়ানদের রাইফেল ধরে টানার পরে নাকি তারা গুলি করেছে মানুষগুলোকে। জওয়ানদের নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে এক চোঁয়া আবেগ কাজ করে। ডাক্তার, কৃষক, বিজ্ঞানী, লেখক, শিক্ষকদের বেলায় আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে। আমার এক আত্মীয়ের বাচ্চা 'বড় হয়ে কী হতে চাস' প্রশ্নের উত্তরে বলত 'ফাইটার প্লেনের পাইলট'। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, স্টার্টআপ এবং অবশেষে এখন 'এতদিন যায়নি জানা ফিরছি কত গ্রহের ফেরে'তে এসে আটকেছে। সে যাই হোক, গোলমাল অন্য জায়গায়। আইটি সেলের এই পারিষদগণের লেখাগুলো এক করে দেখা গেল বয়ান হুবহু এক। সেই Amicable solution কেস। কিছু সাধারণ মানুষের মৃত্যুরউপর রচনা লিখছে ঘাতকদের কাছে ভাড়া খাটা অন্য কিছু সাধারণ মানুষ, এরাও দিনের শেষে বাড়ি ফিরে যায়।

    এবার, একটাই কথা বলার। ভোটটা খুবই জরুরি। অনেক ভেবেচিন্তে ভোট দিন। আম্বানির কাছে দেশ বিক্রি হলে নিজের গাছের ফল পাড়তে হলেও 'শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়' বলে কাঁদতে হবে। একটা বন্ধু ছোটবেলায় আমার গামছা খুলে দিয়েছিল সেই রাগে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনার মানে হল দুজনেই ন্যাংটো হয়ে গোলপার্কে দাঁড়িয়ে রোদ মাখা। বনগাঁ লোকাল ফাঁকা পেতে হলে ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের ডিটেনশন ক্যাম্পে না পাঠিয়ে বনগাঁ লোকালের সংখ্যা বাড়াতে হয়। কর্মসংস্থান বাড়াতে বেসরকারীকরণ না করে সরকারী দপ্তরের ফাঁকা পদগুলো ভরার পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়। নারীসুরক্ষার বাতেলা দিয়ে অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড না বানিয়ে নিজেদের শোধরাতে হয়, নারীরাও আমাদের সহনাগরিক - এরকম ভাবতে হয়।

    অনেক বকেছি, এবার শেষ করি। একটা বন্ধু আগে আমাকে প্রায়ই বলত যে, সে নাকি বুঝতে পারে না কসাইরা কীভাবে প্রেম করে, খুব জোর দিয়ে ও বলত 'সারাদিন রক্ত মেখে কীভাবে তারা রাতে ঘুমায়, ঘুম কি আসে????'... ইত্যাদি পেঁচো জটিল তত্ত্ব। এই বাজারে সে প্রবলভাবে বিজেপির পক্ষে দাঁড়িয়ে সওয়াল জবাব, মিম করছে। ধর্ষণ, থেঁতলে মারার মত রক্তারক্তি কেসগুলোও সাপোর্ট করে আইটি সেলের মিথ্যাচার শেয়ার করে চলেছে। একদিন বিকেলে ওকে ফোন করে কিছুতেই আর পাই না। এদিকে আমার তো খুব দরকার। আধঘন্টা পরে ফোন করে বলল 'ভাই বল রে, বিকেলে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।'
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন