" চাঁদ কিছু জোৎস্না বমি করে ঘুমোতে যায়। থাকে শুধু অন্ধকার। একটি বাধ্য হয়ে পা ফাঁক করে চিতিয়ে থাকা নিশ্চল দেহ। তার উপর সক্রিয় মাংসের পিস্টন ওঠে নামে, ওঠে ও নামে।"- ( দৌপদী, ১৯৭৭)।
বাঁকড়াঝাড় থানার আণ্ডারের এক জংলী গ্রামের দৌপদী মেঝেনের গল্প।অনেকবার পড়েছি। আজকের আধাসামরিক বাহিনীর ঘাতক চেহারার পর, হত্যার পর যেন আশ্চর্য সমাপতন লাগল। ১৯৭৭ নয়, এ যেন ২০২১ সালের কথা। দৌপদী হত্যা করা হয়নি। তার স্বামীকে খুন করেছিল রাষ্ট্রের ঘাতক বাহিনী৷ আর দ্রৌপদীকে রাতভোর 'বানিয়ে নেয়।' ২০২১ এর ভোটেও রাষ্ট্রের ঘাতক হামিদুল, সামিউল, মনিরুল বা আমজাদ কিংবা আনন্দ বর্মণ বানিয়ে নিয়েছে। হ্যাঁ। রাষ্ট্র তার বিপরীতে হাঁটা মানুষকে বানায়।
২০১১ সালে বস্তারে আদিবাসী শিক্ষকা সোনি সোরিকে জল- জঙ্গল- জমি রক্ষার জন্য ঘাতকেরা ' বানিয়েছিল।' মামলায় জেরবার করে, কারাগারে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে নিগৃহীতাকে ' অপরাধী ' বানিয়ে আটকে রেখেছিল। ২০১৩ তে সোনি জামিন পায়। এক ঘরোয়া সভায় সোনির কথা শুনছিলাম। কী নির্মম ছিল সেই দিনগুলো। আজও প্রতিদিন রাষ্ট্রের এই ঘাতকের দ্বারা দেশের অসংখ্য নারী ধর্ষিতা হন। নিরীহ নাগরিক মৃত্যুর কোলে ঢলে যান।
২০০৪ সালের ১১ জুলাই, আসাম রাইফেলের থাংজম মনোরামাকে ধর্ষণকরে খুন করে রাষ্ট্রের ঘাতক বাহিনী। নিগৃহীতা ও মৃতা মনোরমাকে তারা ' জঙ্গী' বলে দেগে দিয়েছিল। আজও যে নিরস্ত্র সহনাগরিকদের মৃত্যুর কোলে ঘুৃম পারিয়ে দেওয়া হল - রাষ্ট্রের বিবৃতিতে তারা নাকি 'মারাত্মক '।অতএব তাদের হত্যা বৈধ।
নির্বাচনের আগে থেকে এরাজ্যে ফোর্স এসেছে। বর্তমানে নাকি হাজার ৭০ আধা- সামরিক বাহিনীর জওয়ান এরাজ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। কি করছেন তারা? তাদের উপস্থিতি, পক্ষপাত আর সাধারণ নাগরিককে নিগ্রহের রোজনামচা - এই হল আজকের চালচিত্র। কয়েকদিন আগে হুগলিতে কিশোরীর শ্লীলতাহানি করায় জুটোপেটা খেয়েছিলেন জনৈক জওয়ান। না, তারপর তারা থামেনি। খবর হয়নি এমন ঘটনাও হয়ত কম না।
সংখ্যালঘু প্রধান এলাকায় ভোটদানে বাধা, ভোটরকে প্রভাবিত করার অভিযোগ ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের সব দফয়া শুনেছি। বিকিয়ে যাওয়া মিডিয়াতেও এক ঝলক দেখেছি। নির্দল প্রার্থীকে বা্কুড়ার বুথ থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করার ছবি এই তো এখনও অমলিন। যে গুণ্ডামো, পক্ষপাত আর নির্যাতনের ইতিবৃত্ত তারা প্রতিদিন নির্মান করেছে -- শীতলকুচি তারই এক প্রলম্বিত অধ্যায়।
যন্ত্রনির্ভরতার যুগে ছবি, ভিডিও যেখনে আকছাড় চালান হয়, সেখানে পাঁচজন নিরস্ত্র সহনাগরিকদের মৃত্যুর ৩ ঘন্টা পর কমিশনকে শুধু বিবৃতি দিয়ে থেমে যেতে হয় কেন? কোথায় পাথুরে প্রমাণ? না, রাষ্ট্রের কাছে প্রমাণ নেই। সাধারণ সংখ্যালঘু বাঙালি ভোটরকে ভোটদানে বাধা দিচ্ছিল এই বাহিনী। ভোট না দিতে পারার ক্ষোভে সোচ্চার হয়েছিলেন তারা। ভোট উৎসবের দিন ' ভোট দিতে দেওয়া হোক'- এই দাবি তোলায় রাষ্ট্রের ঘাতক বাহিনীর দ্বারা খুন হলেন পাঁচজন।গণতন্ত্রের উৎসবে এ এক দুর্মর লজ্জা।
বিবৃতির বদল হয়েছে ক্ষণে ক্ষণে। কোচবিহারকে বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বিস্মিত, শোকস্তব্ধ হয়েছেন দেশবাসী। এ কোন রক্ত ঝরানো গণতান্ত্রিক উৎসব? আরও বিস্মিত হতে হল, কেন্দ্রের ক্ষমতান্ধ দল আর তার অনুগামীরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে বৈধতা দিলেন। সেই সুরে কন্ঠ মেলালেন, ইনিয়ে বিনিয়ে খুনকে জাস্টিফাই করলেন - একদা নিজেদের বামপন্থী বলা একদল লোকজন। অথচ, তারা খেয়াল করেননি, সব কজন সহনাগরিকদের বুকে গুলি করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আছেন আরও অনেকে। এক নির্মম বধ্যভূমির উদযাপন উৎসব হল গণতন্ত্র।
চাঁদ আজও জোৎস্না বমি করে। মনোরমারা ফিরে আসে। হামিদুল, সামিউল, মনিরুলের রাষ্ট্রের দাবা খেলায় ' বানানো' হতে থাকে।রাষ্ট্রীয় হত্যার সমর্থনে ন্যারেটিভ নামে। দ্রৌপদীরা তবু ফুরায় না। বন্দুক উদ্যত রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের ঘাতকের চোখে চোখ রেখে তীক্ষ্ণ গলায় বলে চলে, চলতেই থাকে
-" কাপড় কী হবে, কাপড়? লেংটা করতে পারিস, কাপড় পরাবি কেমন করে? " শীতলকুচি কোন বিচ্ছিন্ন নাম নয়। রাষ্ট্র নামক শক্তির ক্ষমতা প্রাকাশে নিরস্ত্র সহনাগরিকের বধ্যভূমির নাম। অনাচারের সব আব্রু খসে যাওয়া এক জনপদের নাম। যেখানে সদ্য ১৮ পেরানো তরুণটি উদ্যত বেয়েনেটের সামনে নিথর হয়ে পড়ে থাকে এক তরুণ। তার আশেপাশে আরও চারটি তরতাজা লাস। যে নিরুচ্চারে বলে চলে -
" লেংটা করতে পারিস, কাপড় পরাবি কেমন করে? " এরপরও "যে... নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে আমি তাকে ঘৃণা করি।"
হ্যাঁ, 'দ্রৌপদী' মনে পড়ে, মনে পড়ি সোনি সোরি-কে । আরও অনেককেই মনে পড়ে
"শোকস্তব্ধ হয়েছেন দেশবাসী" - এটা ভাবা একদম ভুল। বাংলায় চারটে কাঙাল মরল না বাঁচল সেটা নিয়ে একটা অবাঙালীর কিছু এসে যায় না। আর অনেক বাঙালি তো এখন খুশিতে নাচছেন - অচ্ছে দিন অনেবালা হ্যাঁয়।