সেদিন হোয়াটসঅ্যাপে দুটি মেসেজ পেলাম:
দুই মহিলা শিক্ষক দিবসে আমাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন;
একজন বৈজ্ঞানিক , আর একজন অধ্যাপিকা
মজার কথা এই যে আমি কখনো শিক্ষকতা করিনি,
তবে অতীতে এঁদের গবেষণায় কিছু সাহায্য করেছিলাম
এঁরা সেটা মনে রেখে মেসেজ পাঠিয়েছেন ;
হঠাৎ আপনার কথা মনে পড়লো স্যার;
ফোনটা তুলে আপনার নম্বর ডায়াল করলাম
উত্তরে একটা কাঁপা গলা ভেসে এলো;
কিছু বলার আগে মন ফিরে গেল সেই সোনাঝরা দিনে
কলেজের ছোট ঘরে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে আপনি
হাতে চক আর ডাসটার, বোর্ডে অজস্র সমীকরণ
জানালার খড়খড়ি দিয়ে শেষ বিকেলের মরা আলো আপনার মুখে আঁকছে
অপরূপ কারুকার্য
বোর্ডে লাটটুর ছবির উপর হাত রেখে একাগ্র আপনি বোঝাচছেন তার জটিল গতি
কিন্তু আমাদের মনও তখন আরেক দুরন্ত লাটটু
অবাধ্য চোখ চলে যাচ্ছে সহপাঠিনীর খসে পড়া আঁচলের দিকে
সেখানে উঁকি দিচ্ছে রহস্যময় গিরি কন্দর উপত্যকা
আমরা তো তখন সবে যৌবনের প্রবেশ দ্বারে
মনও তখন অরণ্যের বাধাহীন হরিণ
আজ বুঝি সেদিন ভুল করেছিলাম, আরো মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল আপনার পড়ানোতে
আপনি কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করতেন বোঝানোর জন্য
আসলে আপনারও তো সেই প্রথম অধ্যাপনা
ধীরে ধীরে সম্পর্কটা আরো সহজ হতে লাগলো, শুধু শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না
হয়ে উঠলো আরো যেন গভীর কিছু
আপনার মেসে যাতায়াত শুরু করলাম
কত সহজ করে বোঝাতেন পদার্থ বিদ্যার জটিল সূত্র গুলি
তারপর পাড়ার চায়ের দোকানে চায়ের সঙ্গে গরম অমলেট
পরে দেশ বিদেশের বহু শহরে বহু অমলেট খেয়েছি, আমি নিজেও এখন বানাতে পারি
কিন্তু জানেন স্যার সেই স্বাদ আর কখনো পাই নি
আসলে সেই অমলেটে অনুপান থাকতো আপনার আন্তরিক ভালোবাসার সুগন্ধ আর হয়তো আমাদের যৌবনের তীব্র ঝাঁজ,
তা আজ আর আমি পাবো কোথায় !
এখনও মনে আছে আপনি উপহার দিয়েছিলেন ফাইনম্যানের সেই বিখ্যাত লাল মলাটের পদার্থ বিদ্যার বই;
আপনার সেই উপহারকে ধ্বংস করেছে সময়
যদিও আমি আবার কিনেছি, মলাটের রঙ কিন্তু অন্য;
অক্ষরগুলো যদিও একই আছে , পড়তে গেলেই কিরকম ঝাপসা হয়ে যায়
আসলে এই বইতে তো আর আপনার শুভেচ্ছা মিশে নেই
তাই সব অস্বচ্ছ হয়ে যায়
আরো মনে আছে গড়বেতায় আপনার মায়ের হাতের পোস্ত বড়া
পরে দোকানেও খেয়েছি, বাড়িতে বউও বানায়, কিন্তু কোথায় যেন কিছুটা ফাঁক থেকে যায়
যদি আর একবার খাওয়াতেন স্যার
জানি আপনার মা আর নেই, কিন্তু বউদি তো আছেন
আপনি পাশে থেকে মিশিয়ে দেবেন যৌবনের সেই বিস্মৃত প্রীতির অনুপান
অনেক বছর তো কেটে গেল, আপনার স্মৃতিও ধূসর হয়ে এসেছিল
নামী সংস্হার বৈজ্ঞানিক হয়ে মনে হয়তো একটু অহংকারও হয়েছিল
আমার গবেষণাপত্র গুলো তো বিদেশের বহু জার্নালে ছাপা হয়েছে
তাই দম্ভ কানে কুমন্ত্রণা দিত
মফস্বলের ছোট কলেজের অধ্যাপকের কথা ভুলে যা
যেমন আমরা ভুলে যাই কে আমাদের হাঁটতে শেখালো,কে পরিচয় ঘটালো অক্ষর আর সংখ্যার সঙ্গে
কিন্তু এখন জীবননদী দ্রুত ছুটছে মোহনার দিকে
ক্রমে ঘুচে যাচ্ছে ব্যবধান
মেসেজ দুটি ধুয়ে দিল বিস্মৃতির পলিমাটি
মনে করালো আপনাকে শ্রদ্ধা জানানোর কথা
জানি না আর কতদিন জানাতে পারবো
ভালো থাকবেন স্যার
হয়তো স্বার্থপর মনে হবে তবু বলবো
আপনি চলে গেলে যে আমারও যাওয়ার ঘন্টা বেজে যাবে
আর শেষ হয়ে যাবে সেই সব উজ্জ্বল দিনের সোনালি স্মৃতি
সেই শেষ বিকেলের আলোর আবিরে আপনার মুখে কারুকার্য
জামায় চকের রুপোলি গুঁড়ো, ব্ল্যাকবোর্ডে গ্রীক অক্ষরের সুরম্য দৃশ্যাবলী
ভালো থাকুন স্যার, ভালো থাকুন।