বইয়ের নামঃ Blood Island – An oral History of Marichijhapi Massacre
লেখকঃ দীপ হালদার
Herper Collins Publishers India
অ্যামাজন বিনিময় মূল্যঃ 316 ভারতীয় টাকা (পূর্ণ মূল্যঃ ৩৯৯ টাকা)
মরিচঝাপির ঘটনা যখন ঘটে তখন আমি দশম শ্রেণী , তখনও নই ষোল।
ওই বয়সে কোন রাজনৈতিক সচেতনতা থাকার কথা নয়, আমার ওই বয়সে বরং গাভাস্করের ১৭৪ বলে ৩৬ রান নিয়ে ক্ষোভ , কিম্বা কলকাতা ফুটবল লীগের নাগরদোলা নিয়ে উৎসাহ বেশী ছিল। শিব- দুর্গা পাশা খেলছেন, সেই রকম ঝিম ঝিমে গ্রীষ্মের দুপুরের রোদ্দুরে মফস্বল শহরে কাগজ আসত, আর আমি সেই কাগজওয়ালা কাকুর জন্য ঠায়, উৎসুক বসে থাকতাম। মরিচঝাপি নামটা পড়েছিলাম আনন্দবাজারে কয়েক বার বোধহয় - কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আনন্দবাজারে রিপোর্ট করেছিলেন সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত- বাঙ্গালী তখনো ধুতি- পাঞ্জাবী পরেই সাংবাদিকতা করত এবং প্রায়শই সেই পাঞ্জাবীর হাতা থাকত গোটান। কিন্তু, ১৯৭৮-৭৯, মানে সত্তরের হাড়-হিম সন্ত্রাস আর প্রতিকারহীন নৈরাজ্যকে দূরে সরিয়ে রেখে সাতাত্তরের পূর্ব গগনে রচনা করেছে সূর্যোদয়ের নতুন ভোর- মেহনতি মানুষের বামফ্রন্ট সরকার। সত্তরের “মানু”দার সরকারে প্রিয়-সুব্রত-সোমেনের নেতৃত্বে ঘাতক-বাহিনীর জল্লাদেরা শাস্তি পাবে, এমন প্রত্যাশার ডালপালা। সেই স্বপ্নঘোরের দিনে বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে ন্যূনতম অবিশ্বাসকে ষড়যন্ত্র ভাবা যেত। তাই, আবপ সমেত যে কটি মিডিয়া হাউস লিখছিল অল্প-স্বল্প - তাদের সবাইকে চিহ্নিত করে হুমকি দেওয়া হল (প্রাক্তন সাংবাদিক নিরঞ্জন হালদার তাঁর মৌখিক সাক্ষ্যে জানিয়েছেন সে কথা- শুধু রিপোর্ট করার “ অপরাধে” সরকারী গোপন নির্দেশে তাকে নাকি সাংবাদিকতা থেকে সরিয়ে ডেস্ক-জব দেওয়া হল) । তারপর, সময়ের প্রলয়পয়ধিজলে ধীরে ধীরে স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল মরিচঝাপি। পুরো রাজ্যবাসীর। আমারও।
দীপ হালদারের এই বইটি সেই পুরনো স্মৃতি জলে ধুয়ে দিল । ইতিমধ্যে কিছু খুবই সামান্য লেখালিখি হয়েছে এবিষয়ে। দ্য হাংরী টাইড- অমিতাভ ঘোষের লেখা একটি উপন্যাস এসেছে- সুনীল গাঙ্গুলী সমেত কয়েকটা ছোট গল্প- কিন্তু দিনের শেষে সেগুলো তো ফিকশন ।“ নৈঃশব্দের অন্তরালে গণহত্যার এক কালো ইতিহাস” – লিখেছিলেন জগদীশ মন্ডল। আরো গাংচিল-এর মত কিছু পত্র- পত্রিকা, যারা মরিচঝাপি নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করেছে। কিন্তু, অন্তত, পু্রো গণহত্যাটি যেভাবে সংগঠিত হয়েছিল রাতের অন্ধকারে – সেই তুলনায় এই সব প্রয়াস যৎসামান্য। ১৬ই মে ১৯৭৯, যেদিন মরিচঝাঁপিতে দন্ডকবন থেকে আগত উদ্বাস্তু বিতাড়ন শেষ হল, সেদিন আসলে কী ঘটেছিল? প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রায় কারুরই নেই। সেই সব স্বপ্ন-দেখা এবং স্বপ্ন-ভঙ্গের শেষে কিছু মানুষ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের খুঁজে বার করা প্রায় অসম্ভব কাজ, যারা বাঁচতে পেরেছিলেন তারা প্রায় সবাই ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন । দীপ একজন তদন্তমূলক সাংবাদিকের মত খুঁটে খুঁটে সেই কাজটি করেছেন- তাই দীপের এই বইটি সেই রাজনৈতিক ভাষ্যের দিক থেকেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
“মৌখিক সাক্ষ্য”-কে কি ইতিহাস বলা যাবে? অতীতে, বিশেষত, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় , ‘মৌখিক সাক্ষ্য “ ভিত্তিক নন-ফিকশন ইতিহাস লেখা হয়েছে বিদেশী ভাষায় কিন্তু, বাংলায় তা কম । ‘ওরাল টেস্টিমনি’-র প্রবক্তাদের মতে মৌখিক সাক্ষ্য হল মূলত একটি ‘লিসনিং আর্ট’ বা ‘শ্রুতি শিল্প’। সাংবাদিক দীপ এই বইখানিতে সেই সূত্রধরের কাজ করেছেন প্রায় নিখুঁতভাবে।
বইটির প্রথম অংশে দীপ ব্যাখা করেছেন ১৯০৫-র বঙ্গভঙ্গ থেকে দফায় দফায় বাংলা ভাগের ইতিহাস এবং তদ্বজনিত উদ্বাস্তু সমস্যা - বোঝাতে চেয়েছেন মরিচঝাঁপির প্রেক্ষিত। কিন্তু, এই বইটির আসল প্রাণ হল ন’জন মানুষের সাক্ষ্য, যারা কোন না কোন ভাবে মরিচঝাপির সাথে জড়িত ছিলেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। এতে রয়েছে , ওই দ্বীপে বসবাসকারী মনা গোলদার ,সন্তোষ সরকার, সফল হালদাররা- যারা শুনিয়েছেন সময়ের কসবায় হারিয়ে যাওয়া তাদের জীবন- সংগ্রামের সেই করুণ অংশটুকু, যেখানে উদ্বাস্তুরা মনুষ্যের পরিত্যক্ত বিষ্ঠার মত পরিত্যাজ্য ও ঘৃণ্য, যেখানে মেহনতি সরকারের পুলিশের মসমসে বুটের তলার কিভাবে পিষে গিয়েছিল তাদের মেহনতে গড়ে তোলা স্বপ্নের দুনিয়া ।
জ্যোতির্ময় মণ্ডল শুনিয়েছেন কোন এক সুখচাঁদের গল্প। যিনি বাংলাদেশ থেকে দন্ডকারণ্য ও মানা ক্যাম্প হয়ে , বিহারের কাটিহার হয়ে মরিচঝাঁপি পৌঁছেছিলেন। এই সুখচাঁদের কাহিনীতে বোঝা যায় কেন এত হাজার মানুষ সুদূর দন্ডকারণ্য ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন মরিচঝাঁপি-র অনিশ্চয়তায়।“ সুখচাঁদ আপনার বাবার নাম- নয় কি?” দীপের এই প্রশ্নের উত্তরে জ্যোতির্ময় শুধু স্মিত হেসেছিলেন, কোন উত্তর দেননি। তার সেই গূঢ় হাসিতে মরিচঝাঁপির অনেক প্রেক্ষাপট থেকে পালিয়ে বেড়ানো উদ্বাস্তুদের আতঙ্কের – বহুধা মাত্রা পরিষ্কার হয়।
সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের সাক্ষ্য আছে, সম্ভবত প্রথম সাংবাদিক যিনি মরিচঝাঁপি পৌঁছেছিলেন , ১৯৭৮ সালের ২রা মে। এবং তারপর, বহুবার। তিনিই প্রথম দেখেছিলেন কিভাবে চোখে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে হাজার হাজার মানুষ – শিশু, বৃদ্ধ, নারী পুরুষ নির্বিশেষে- ডিঙিতে নদী পার হয়ে, নদীর পাড় ধরে প্রায় ছোটার ভঙ্গীতে ছুটে চলেছেন দ্বীপের দিকে। এবং , তারপরে বিদ্রোহী শিশুর ছড়িয়ে থাকা পুতুলদের মত বিধ্বস্ত মরিচঝাঁপি ।
সাক্ষ্য দিয়েছেন এই সংক্রান্ত সরকারের সাথে মামলার উকিল শাক্য সেন। মরিচঝাঁপি মানুষদের সাথে হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোর্টে গিয়েছিলেন “আমরা বাঙ্গালী” নামের একটি রাজনৈতিক দল (আমাদের যৌবনে এদের সমন্ধে অনেক শুনেছি- দলটির এখনো কোন রাজনৈতিক কার্যকলাপ কি আছে?)। শাক্য তাদের হয়ে মামলা লড়েছিলেন এবং কোর্টের নির্দেশে তিনি ১৬ই মে-র পরে মরিচঝাঁপি দর্শন করার খুব কম ব্যতিক্রমী মানুষদের একজন।তিনি জানিয়েছেন, সেদিন , তান্ডবের পরে কিভাবে পড়ে ছিল মানুষের পোড়া ঘরদোর, আধপোড়া পাঠ্যপুস্তক, জ্বলে যাওয়া স্কুল ঘর আর বিধস্ত হয়ে যাওয়া হাসপাতাল । ভেঙ্গে যাওয়া উনুনের পোড়া কাঠ- অঙ্গারের কালো- হতভাগ্য মানুষগুলোর সংসার খেলার সাক্ষী আর সাক্ষী মেহনতি সরকারের পুলিশের অত্যাচারের। ১৯৭৯ সালের ২৬শে জানুয়ারী যখন বামফ্রন্ট সরকার মরিচঝাঁপি-র চারপাশে প্রথম দফায় , দ্বীপের মানুষদের জল- খাদ্য না দিয়ে ভাতে মারার ব্যবস্থা করেন, সেই সময় থেকে শাক্য আইনী লড়াই লড়ে আসছেন। শাক্য শুনিয়েছেন সরকার ও এডভোকেট জেনারেল স্নেহাংশু আচার্য-এর তার আইনী ডুয়েলের অংশ বিশেষ। শুনিয়েছেন জ্যোতিবাবুর বিশিষ্ট বন্ধু ও বিচারক বি সি বসাক কিভাবে নস্যাৎ করে দেন মানবাধিকারের যুক্তি। বিচারক বসাক জানান, মরিচঝাঁপি সংরক্ষিত বনাঞ্চল (সরকার কোর্টে মৌখিক ভাবে এটা জানিয়েছিল) , কাজেই সেখানে কোন মানুষের বসবাসের অধিকার নেই। বাস্তবে, মরিচঝাঁপি গণহত্যায় সরকারী ভাষ্যও এটাই ছিল। ১৯৭৯ সালে ১৭ই মে যখন তখনকার তথ্যমন্ত্রী তথ্য কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে “মরিচঝাঁপি মুক্ত” বলে সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণা করবেন, তখন তিনিও এই যুক্তি সাজিয়েছিলেন। যদিও, অনেক পরে জানা যাবে, মরিচঝাঁপি কখনোই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে ছিল না (আর পাঠক, ইতিহাসের মজা দেখুন, সেই তথ্য মন্ত্রীই যখন আরো তিরিশ বছর পরে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন , ২০০৯ সালে নয়াচরে প্রোমোটারি করতে চাইবেন- যা আদতে একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল)।
মনা গোলদার, সুখরঞ্জন বাবু, শাক্য সেন , সফল হালদার-দের সাক্ষ্য পড়ে টুকরো টুকরো চিত্র দিয়ে পুরো ঘটনাটা পাঠকের সামনে সরকারী সন্ত্রাসকে নগ্ন করেছে। মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তু আগন্তুকরা আসার অল্পদিনের মধ্যেই জায়গাটা সাফসুতরো করে বাসযোগ্য করে তুলেছিল। বেশ কিছু নলকূপ বসিয়েছিল। তবে নোনা জলের জন্য সেই অতি অগভীর যন্ত্রগুলো কার্যকর হয়ে ওঠেনি। দরকার ছিল সরকারি সাহায্যের। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার তো প্রথম থেকেই বাম। তাই রায়মঙ্গল এবং আরও দু’টি নদী পেরিয়ে ওঁদের পানীয় জল এবং খাদ্য আনতে হতো। দ্বীপে ছোট ছোট গাছ ছাড়াও কিছু মোটা বেড়ের বড় গাছ ছিল। ঝড়ের কবল থেকে ওইগুলিই দ্বীপটিকে সুরক্ষা দিতে পারত। কিন্তু জীবিকার প্রয়োজনে কিছু গাছ কেটে ওঁরা ডিঙ্গি নৌকো বানিয়েছিলেন। মাটির রাস্তা ঘাট প্রস্তুত করেছিলেন। ছাউনি দিয়ে স্কুলবাড়িও তৈরি হয়েছিল। কলকাতার এক ইঞ্জিনীয়ার সুব্রত মুখারজীর সাহায্যে হ্যান্ড-পাম্প বসিয়ে গভীর নলকূপের ব্যবস্থা করে ফেলা হয়েছিল কিছু দিনের মধ্যেই ।
গোলমালটা লাগল ঠিক এমন সময়েই। শুরু হয়ে গেল মিথ্যাপ্রচার। বড় বড় পুলিশ কর্তার আগমন ঘটল। ১৯৭৮-র শেষ দিকে অখন্ড চব্বিশ পরগণার পুলিশের ‘সামন্ত’তন্ত্র ব্যারিকেড তৈরি করল। যাতে মরিচঝাঁপির মানুষজন বাগনা, কুমিরমারি ইত্যাদি অঞ্চল থেকে পানীয় জল আর খাদ্যসংগ্রহ করতে না পারেন। হাইকোর্ট মানবাধিকার রক্ষার্থে পুলিশের এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে রায় দিল। তখন খাদ্যপানীয় সংগ্রহের দেরি ঘটিয়ে আস্তে আস্তে মানুষগুলোর শক্তিক্ষয় করিয়ে দেওয়া হয়। হোক না আদালত অবমাননা। কখনো দ্বীপের একমাত্র জলের উৎসটিতে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা খেয়ে বিষ-ক্রিয়ায় ছটফট করে মারা গিয়েছে শ-খানেক শিশু। তারপর এল সেই ভয়ংকর দিন। মে মাসের এক গভীর রাতে দু’শো পুলিশ আর সাধারণ নৌকোয় দু’হাজার ক্যাডার দিয়ে ঘিরে ফেলা হলো মরিচঝাঁপি। আগুন দেওয়া হলো বাড়িগুলোতে। উদ্বাস্তু বোঝাই কিছু নৌকো ডুবিয়ে দেওয়া হলো। আর কিছু শিশু , বৃদ্ধ, নারী নির্বিশেষে – এবং আত্র সাথে উদ্বাস্তু নেতাকে ধরে বেঁধে আনা হল হাসনাবাদ রেলওয়ে স্টেশনে। কিছু আগুনে পোড়া মানুষ নদীর মধ্যে কুমীরের পেটে চালান হল । রাতের অন্ধকারে ধর্ষিতা হলেন অনেকে। শোনা যাচ্ছিল ব্যাপক গুলির আওয়াজ অন্ধকারে- “কড়াক পিং, কড়াক পিং...” । সমস্ত বুক পুড়ে যাওয়া ফণিবালা এবং আরও কিছু আধপোড়া ধ্বস্ত মানুষের সন্ধান পেয়েছিলেন সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত ঝাড়গ্রামের কাছে দুধকুন্ডিতে তিনদিন পরে ।
দীপের এই বইটির একটি ত্রুটি হচ্ছে যে সরকারী দিকের ভাষ্য বলা লোকের অভাব। তাহলে, অন্তত বিতর্কিত বিষয়ে ভারসাম্য থাকত। অবশ্য, ‘মরিচঝাঁপি অপারেশন’-এর দায়িত্বে থাকা তৎকালীন চব্বিশ পরগনার আরক্ষাধ্যক্ষ অমিয়কুমার সামন্ত যে তাঁকে সাক্ষাৎকার দিতে চাননি, সে কথাও উল্লেখ করতে ভোলেননি দীপ। অমিয়বাবু ঠিক কোন ‘বোধ’ থেকে বিরত রইলেন তা জানা যায়নি । সাক্ষাৎকার নেওয়া যেতে পারত জ্যোতিবাবুর তখনকার ম্যান ফ্রাইডে স্বরাষ্ট্রসচিব রথীন সেনগুপ্ত সাহেবের ।
৯টি সাক্ষ্যের মধ্যে সরকারের দিকের একমাত্র সাক্ষী বাম আমলের সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী কান্তি গাঙ্গুলী। সাংবাদিক দীপ যখন উল্লেখ করেছেন, যে সরকারী শরিক রাম চ্যাটারজী জ্যোতি বাবুর নির্দেশে, ৭২-৭৭ কংগ্রেস জমানায়, দন্ডকারণ্যে গিয়ে উদ্বাস্তুদের নিজেই পশ্চিমবাংলায় আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলেন (আমরা ক্ষমতায় ফিরলে আপনাদের বাংলায় জায়গা দেব- এমনটাই ছিল প্রতিশ্রুতি, যা অনেকেই জানিয়েছেন। বস্তুত, সেই আশ্বাস থেকেই হয়ত এত হাজার লোকের পশ্চিম বাংলায় আগমন এবং সেই বিশ্বাস থেকে বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস – যা এই বইটির উপজীব্য)। কান্তিবাবু স্বীকার করেন যে ওভাবে উদ্বাস্তু খেপানো ভুল হয়েছিল। কিন্তু, সেখানে কোন বড় গণ্ডগোল কিছু হয়েছিল , তা তিনি স্বীকার করেননি স্বাভাবিকভাবেই। এই ঘটনা আদতে কোনদিনই প্রশাসনিক বা বামদের দলগত স্বীকৃতি পায়নি।
এই পর্বের শেষ সাক্ষী ছিলেন দলিত মানুষদের নিয়ে সংগ্রাম করা ও লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী।
ঠিক কতজন মানুষ নিহত হয়েছিলেন? ১৯৭৯-র ২৪ এপ্রিল ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, জনতা সংসদীয় দলের সম্পাদক মুরলী মনোহর জোশী মরিচঝাঁপি নিয়ে যে প্রতিবেদন পেশ করেন তাতে অন্তত ৭২ জনের না খেতে পেয়ে বা খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর কথা বলা হয়েছিল। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের ছেলে জগদীশচন্দ্র ‘মরিচঝাঁপি: নৈঃশব্দের অন্তরালে’ বইতে ১৯৭৯-র ৩১ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যুর কথা, আর ২৪ জানুয়ারি থেকে না খেতে পেয়ে, পচা খাবার খেয়ে বা বিষ মেশানো জল পান করে প্রায় ৩৭৬ জনের মৃত্যুর কথা বলেন। মনোরঞ্জন ব্যাপারী ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’-এর ‘মরিচঝাঁপি’ পর্বে অন্তত দু’হাজার লোকের মৃত্যু ও দুশো মহিলার ধর্ষিত হওয়ার কথা বলেছেন। এই বইতে কেউ কেউ নিখোঁজ মানুষ সমেত সংখ্যাটি কয়েক হাজারের কাছাকাছি রেখেছেন। আর, প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তিবাবু জানিয়েছেন, বড়জোর আট- দশ জন মানুষ মারা গিয়েছেন।
কিন্তু, ঠিক কি কারণে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার এমন আচরণ করেছিলেন?ওপার বাংলা থেকে বহু মানুষ যাদবপুর থেকে কুপার্স ক্যাম্প- পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় কলোনি করেছেন। তাদের তো বামেরা উৎখাত করেনি? শাক্য সেন বলেছেন- জ্যোতিবাবুর ইগোর লড়াই থেকে। প্রাক্তন সাংবাদিক নিরঞ্জন হালদার তাঁর মৌখিক সাক্ষ্যে বলেছেন, বাম নেতারা বুঝতে পারছিলেন যে, ওপার বাংলা থেকে আসা এই নমশূদ্ররা নিজের জীবনযাত্রায় এতটাই স্বাধীন ও আত্মনির্ভর, যে এঁরা বামেদের চিরস্থায়ী ভোট ব্যাংক হবেন না। তাই, সেই ভোটের জটিল অংক থেকে বিজয়গড়- যাদবগড় কলোনি রয়ে যায় কিন্তু, ‘মরিচঝাঁপি হারিয়ে যায় মানচিত্র থেকে। আর, মনোরঞ্জন ব্যাপারী ‘মরিচঝাঁপি অপারেশন’ দেখেছেন উচ্চ- বর্ণের হিন্দুদের , দলিত ও নমশূদ্রদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত হিসেবে। বিশুদ্ধ ক্রোধে তিনি উচ্চারণ করেন , “জ্যোতি বসু একটি শুয়োরের বাচ্চা” - এই ঘটনার মূল কান্ডারীকে চিহ্নিত করেন তিনি এভাবেই । মনোরঞ্জন বাবুর তত্ত্ব আরো জোর পায় যখন দেখি জননেত্রী ২০১১ সালে , ‘মরিচঝাঁপি গণহত্যার তদন্ত করবেন- এই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও , আজও একটা তদন্ত কমিশন-ও বসেনি ( অন্তত আমার জানা নেই)। তাহলে কি ছোটলোক- ভদ্রলোকের ফারাকটা ঘোচেনি কোন জমানাতেই?
‘মরিচঝাঁপি অপারেশন’ বাম সরকারের প্রথম পাপ, বাম রাজনীতিতে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। দশ হোক বা দশ হাজার- এই ঘটনা থেকে বাংলায় মেহনতি মানুষের সংখ্যা প্রথম কমতে থাকে। ৪০ বছর পরে, যা হয়ে যাবে মাত্র ৭ শতাংশ। বাকীরা হয়ে যাবেন হয় হিন্দু, নয় মুসলমান!
(জীবনে প্রথম বইয়ের রিভিউ লিখলাম। ভুল – ত্রুটি পাঠকেরা মাপ করবেন। আবার , উৎসাহ পেলে কখনো সখনো আবার ভালো লাগা বইদের নিয়ে। )
সমীক্ষকের আবেগ ও সংযম দুটোই ভাল লেগেছে। একই সঙ্গে বইটির সীমাবদ্ধতা, অর্থাৎ সরকারপক্ষের বয়ানের স্বল্পতাও আপনি তুলে ধরেছেন। আরও সমীক্ষা করুন , নতুন বইয়ের এবং অজানা বিষয়ের সন্ধান দিন; পড়ব।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা নবরূপে গুরুর বড় আকর্ষণ এই সাপ্তাহিক পুস্তক সমীক্ষা। সব সমীক্ষার মান সমান নয়, হতেই পারেনা। কিন্তু খবর পাই অজানা বইয়ের। এই রিভিউ থেকে খোঁজ পেয়ে কিছু পর্তুগীজ স্প্যানিশ ও রাশিয়ান সাহিত্যের বই (অবশ্যই ইংরেজি আনুবাদে) কিনেছি। গুরুকে ধন্যবাদ।
এই লিংকটা থাকুক - https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=18168
আমার ঐ চিন্টুবাবুর লেখাটাই ভালো লাগে।
অন্যগুলো কি তাহলে পেইড রিভিউ?
পরের রিভিউ গুলোও আসুক এখানে . সব কটা একসঙ্গে থাকুক .