এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ক‍্যাকটাস 

    Bijoy Hansda লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৯ জানুয়ারি ২০২১ | ১০৬৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ঘড়িতে সকাল আটটা । রান্নাঘর থেকে মা ডাক দিল দেবু.. ও দেবু .. খোকা ও খোকা.. আরে, ওঠ, আজ না তোর ইন্টারভিউ। বালিশের তলা থেকে উঁকি দিয়ে দেখি সূর্য মহাশয় কোন সকালে উঠেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম।

    দেবু আমার ডাক নাম। দেখলাম জানালার মধ্য দিয়ে সূর্যের কিরণ এসে পড়েছে পড়ার টেবিলে। টেবিলের মধ্যে আহামরি তেমন কিছু নেই। একটা খাতা তাতে ঘুমের ঘোরে রাত্রে লেখা কিছু অস্পষ্ট জড়ানো কয়েকটি লাইন। যা স্বয়ং বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের পক্ষেও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব নয়। টেবিলে ছড়ানো কিছু কাগজ, পুরানো ম‍্যাগাজিন, মুখভাঙা কলম, আর, একটি ডায়েরি। হঠাৎ ঘড়িতে চোখ পড়তে দেখলাম পৌনে ন’টা বাজতে চলেছে। শোয়ার ঘর থেকে ব্রাশ নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যে স্নান সেরে নিলাম। ঠিক যেমন প্রত‍্যেকদিন ময়না পাখিটা যেভাবে আমাদের পুকুরে স্নান করে সেই ভাবে। পোশাক পরে তৈরি হচ্ছি, এমন সময় মা এসে বলল, “খাবার খাবি না”?

    আমি বললাম, “না”।

    বাইরে থেকে বাবার গলার আওয়াজ এল, “দেবু, তুই এখনো তৈরি হোস নি? তোর দ্বারা কিছু হবে না। তোর যা মতি-গতি, তাতে নাপিত ছাড়া আর কিছুই হবি বলে মনে হয় না”।

    মা আমার পক্ষ নিয়ে বলল, “আজকের দিনে না বকলেই নয়?”

    মা বাবাকে প্রণাম করে বেরোচ্ছি, এমন সময় মা বললেন, “দেখ খোকা, ভালো করে সব প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করবি, ভয় পাবি না”।

    একথা গত পাঁচ বছর ধরে শুনে আসছি আজও তার ব‍্যতিক্রম হল না। সাইকেল নিয়ে তীরের গতিতে পৌঁছলাম বকুলতলা বাসস্টপে। কিছুক্ষণ পর যে বাস এলো তাতে বাদুড়ঝোলা ভিড়। আর কোনো উপায় না দেখে কোনোমতে বাসে উঠলাম। প্রায় একঘন্টা পর সিকদারপাড়া বাস স্টপে নেমে এক ব‍্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলাম, “দাদা বিবেকানন্দ ভবন কোন দিকে বলতে পারেন?”

    হাত নেড়ে বললেন, “ওই যে দূরে বড় বট গাছটা দেখতে পাচ্ছেন তার ডান দিকে পাশের বড় পাকা বাড়িটা”।

    তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগারোটার সময় উপস্থিত হলাম গন্তব্যস্থলে। বারোটার সময় ইন্টারভিউ। আমার মতো আরও বেকার যুবকযুবতী চাকরির আশায় এসেছে ইন্টারভিউ দিতে। কিন্তু তারা বোধহয় জানে না সরকারি চাকরি হল সোনার হরিণ। সহজে ধরা দেবে না কারো হাতে।

    পাঁচ জনের পর আমার ডাক পড়ল। ভেতরে গেলাম। একজন মোটা গোঁফওয়ালা অফিসার জিজ্ঞেস করল - কী নাম আপনার?

    “মানিক পাল”।

    “বাবা”?

    “সুব্রত পাল.. মা অঞ্জলি পাল.. গ্রাম আনন্দপুর”।

    রোগা চশমা পরা অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, “কোনো সুপারিশ আছে?”

    “না। আমার জ্ঞান, যোগ্যতা, কাজ করার দক্ষতা আছে”।

    “হ‍্যাঁ। কিন্তু সুপারিশ থাকলে সরকারি চাকরি পেতে সুবিধা হয় এটা তোমার জানা ছিল না? শুধু জ্ঞান আর দক্ষতায় কিছু হয় না”। মোটা গোঁফওয়ালা অফিসার বললেন, “আপনি এখন আসতে পারেন”।

    বাইরে চেয়ারে বসে ভাবলাম এটাও বোধহয় হল না। তাছাড়া লোকে বলে বাংলা নিয়ে পড়লে কোনো ভবিষ্যত নেই। হতাশ হয়ে বসে আছি, এমন সময় দারোয়ান জানালেন, বিকেল চারটের সময় নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। তাই অপেক্ষায় রইলাম।

    যথাসময়ের মধ্যে লিস্ট ঝোলানো হল নোটিশ বোর্ড-এ। ভিড় ঠেলে দেখলাম তিন নম্বরে নাম আছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাড়ি ফিরলাম। চাকরি পাওয়ার খবর বাড়িতে খুশির জোয়ার নিয়ে এসেছে।

    তারপরের দিন অফিসের একজন সদস্য আমার কাজ বুঝিয়ে দিলেন। কেরানির চাকরি হলেও সরকারি চাকরি। নিজেকে বোঝালাম, কোনো কাজ'ই ছোটো নয়। এক এক করে সহকর্মীদের সঙ্গে আমার পরিচয় হল। দেখতে দেখতে কেটে গেল আট মাস। আমি আর পূর্ণিমা প্রায় প্রতিদিন একসঙ্গে বাড়ি ফিরে আসি। ওর বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে আরও পাঁচ কিলোমিটার দূরে নবাবগঞ্জ গ্রামে। ও, হ‍্যাঁ, পূর্ণিমা মিত্রের পরিচয় দেওয়া হয়নি। ও আর আমি একসঙ্গে কাজ করি, সেই সূত্রে পরিচয়। তারপর কখন যেন বন্ধুত্ব প্রেমের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে বুঝতে পারি নি। সাহস করে বলেই ফেললাম একদিন মনের কথা। পূর্ণিমা কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমার হাঁটু কাঁপছে এই ভেবে, যে কী উত্তর আসবে পূর্ণিমার দিক থেকে।

    পূর্ণিমা চোখ তুলে লাজুক হেসে বলল, “তোমার কথা ফিরিয়ে দেব এতবড় স্পর্ধা আমার আছে?”

    শুরু হল জীবনের এক নতুন অধ‍্যায়। বাড়িতে বাবা মাকে জানালাম আমাদের সম্পর্কের কথা। কেউই আপত্তি করলেন না। পূর্ণিমার বাড়ির দিক থেকেও কোনো আপত্তি নেই। ঠিক হলো পুজোর পর বিয়ে হবে। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে পূর্ণিমা বলল, “কাল নার্সারি থেকে গোলাপ আর নয়নতারা ফুলের চারা এনে দেবে তো?”

    বললাম, “দেব”।

    যথারীতি রবিবার গোলাপ আর নয়নতারা ফুল গাছের সঙ্গে একটা ক‍্যাকটাস গাছও নিয়ে গেলাম।

    পূর্ণিমা অবাক, “এ কী! এ তো ক‍্যাকটাস গাছ! এতো কাঁটা ভর্তি গাছ!”

    আমি বললাম, “রেখে দাও না। তাছাড়া একবার লাগিয়ে দিলে অনেক দিন বাঁচে। জল দশ মাসে একবার দিলেও হবে। কেন না এর শিকড় অনেক গভীরে চলে য়ায়”।

    পূর্ণিমা দু’শো টাকা এগিয়ে দিল আমার দিকে।

    আমি বললাম, “কি এটা”?
    "চারাগাছ কেনার টাকা।"
    “না না থাক না”।
    “পরে তখন সময় বুঝে সুদ সমেত ফেরত দিও”।

    সামনে দূর্গাপূজো তাই বোনাস সহ পনেরো দিনের ছুটি। কথা হল অষ্টমীর দিন ঠাকুর দেখতে বেরোবো। আর দেখা হয় নি পূর্ণিমার সঙ্গে। একবারে দেবীর বোধনের দিন ফোন করলাম পূর্ণিমাকে। কিন্তু ফোন লাগছিল না। পরে তার মাকে ফোন করে জানলাম পুজোর পোশাক কিনতে বাজার গিয়েছে। রাত্রি আটটার সময় ফোন এল পূর্ণিমা বাড়ি ফেরে নি। লাইট নিয়ে মাকে জানিয়ে পূর্ণিমার বাড়িতে উপস্থিত হলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অধীরে আগ্রহে অপেক্ষা করছে পূর্ণিমার জন্য তার মা। চোখে মুখে আতঙ্কের চিহ্ন । এই চিহ্ন আমার বুকের ভিতর কাঁপিয়ে তুলল । পূর্ণিমার বাবা নেই বলে পাশের বাড়ির বিমলকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম পূর্ণিমার খোঁজে। বাড়ি থেকে দু’ কিলোমিটার দূরে রাস্তার ধারে একপাটি জুতো পড়ে থাকতে দেখলাম। তার কিছু দূরে আর একপাটি। তার বাঁদিকে ঝোপের মধ্যে লাইটের আলো পড়তেই দেখলাম পূর্ণিমা নগ্ন অবস্থায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। যা দেখলাম কল্পনাতীত। স্তন যুগল দাঁতের কামড়ে রক্তাক্ত। সারা শরীর ও মুখে নখের আঁচড়ের দাগ। যোনিদেশ থেকে রক্ত মাটিতে পড়ে চাপ হয়ে আছে। পাশে দোকান থেকে কিনে আনা নতুন নীল রংয়ের শালোয়ার কামিজ। ভাবিনি কখনো দেখতে হবে এই অবস্থায় পূর্ণিমাকে। দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হল। দুই দিন পর পূর্ণিমার জ্ঞান ফিরলে ঘটনাবৃত্তান্ত শুনে পূর্ণিমার মাকে নিয়ে থানায় ডাইরি করলাম।

    পূর্ণিমা ঘুমের মধ্যেও হঠাৎ হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে বলতো, “ওই যে কারা যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি বাঁচতে চাই, আমি বাঁচতে চাই”। পূর্ণিমা কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। এক অজানা আতঙ্কের ভয় ঘিরে ধবেছে চারিদিক থেকে। পুরুষ মানুষকে দেখলেই ভয়ে লুকিয়ে যেত খাটের তলায়। আর বলত, “আমাকে ছেড়ে দাও, আমি বাঁচতে চাই, আমি বাঁচতে চাই"। কাউকে যেন বিশ্বাসই করতে পারত না। পূর্ণিমা মাঝে মাঝে আমাকে দেখেও চেঁচিয়ে উঠত। অবশেষে দীর্ঘ লড়াই এর পর বাড়ি ফিরল পূর্ণিমা। থানার বড়সাহেব ফটিকবাবুর তৎপরতায় দোষীদের যথোপযুক্ত সাজা হল। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করল পূর্ণিমা। কিছুদিন পর সে অফিসে যেতেও শুরু করল কিন্তু অফিসে জানাজানি হতেই সবাই কেমন যেন আড় চোখে দেখতে শুরু করলো পূর্ণিমাকে। পূর্ণিমাকে নিয়ে অফিসের অন্দরে কানাঘুষো কিছু কথা উঠতে থাকলো।

    মা আমাকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন, “পূর্ণিমার সঙ্গে আর মেলামেশা করবি না”। মায়ের কথাটা শেলের মতো বুকে এসে বিঁধল। হৃৎপিণ্ড থেকে গরম রক্ত নাড়ি ফুলিয়ে ছুটে চলেছে সারা শরীরে। গলার ধমনী রক্তের চাপে মোটা হয়ে আমার নিশ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করল। নিজেকে সামলে আমি বলতেই পারতাম আজকে পূর্ণিমার সঙ্গে যা ঘটেছে, তার জন্য কোনো ভাবেই পূর্ণিমা দায়ী নয়। কিন্তু আমি কোনো কিছুই বলতে পারলাম না মায়ের মুখের উপরে। শুধু মাথা নাড়িয়ে বললাম, “আচ্ছা”।

    অফিসে জানাজানি হতেই সবাই কেমন যেন আড়চোখে দেখতে শুরু করলো পূর্ণিমাকে। আর আমিও না চাইতেও পূর্ণিমাকে এড়িয়ে যেতে লাগলাম।

    একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে পূর্ণিমা বলল, “কী ব‍্যাপার? আমাকে এড়িয়ে চলা হচ্ছে যে?”
    দূর থেকে হাওয়ায় ভেসে আসছে গানের কথা - “তুমি অন্য কারোর গল্পের নায়িকা”

    *** ***তুমি অন্য কারোর গল্পের নায়িকা – অনুপম রায়

    আমি বললাম, “এমনি”।
    “এমনি”?
    “হ‍্যাঁ । এমনি। আমার তাড়া আছে”।
    “দু’ মিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো সময় নেই?”
    “আমাদের বিয়ে নিয়ে কী ভাবলে? কবে বিয়ে করছি আমরা”।
    “সে আর সম্ভব না”।
    “কেন সম্ভব না? তুমি বলেছিলে পুজোর পর আমরা বিয়ে করবো”।
    “হ‍্যাঁ, তখন পরিস্থিতি আলাদা ছিল। এখন আলাদা পরিস্থিতি”।
    “আমার এই পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী ? আমাকে কে এই পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড় করিয়েছে?”

    আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না । শুধু জীবন্ত মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

    “ও বুঝেছি পূর্ণিমার চাঁদে আজ গ্রহণ লেগেছে তাই কি তুমি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ?”
    শুধু বললাম, “সম্ভব নয়”।
    “ বেশ। এই আমাদের শেষ দেখা!”

    চলে যেতে উদ‍্যত হচ্ছি পেছন থেকে পূর্ণিমা ভাঙা গলায় বলল, “সাবধানে বাড়ি যেও”।

    দেখলাম আকাশের চাঁদকে কালো মেঘে ঢেকে দিল। বাড়ি ফিরে ভাবলাম পূর্ণিমার কথা। আমি কী সত্যিই ভালোবাসতে পেরেছিলাম পূর্ণিমাকে? কেন মেনে নিতে পারলাম না পূর্ণিমাকে? কোনো দোষ তো ছিল না পূর্ণিমার? তাহলে কী বাড়ির চাপে পূর্ণিমাকে মেনে নিতে পারলাম না? নাকি সমাজের বুক থেকে কাজলের থেকেও যে কালির দাগ লেগেছে শরীরে সেই দাগ থেকে বাঁচতে তার থেকে দূরে সরে এসেছি? পাহাড় থেকে যে নদী সৃষ্টি হয়ে সমুদ্রের অভিমুখে যাত্রা করেছিল, হঠাৎ গতিপথ হারিয়ে মরুভূমিতেই শুকিয়ে গেল ঠিক তেমনি সমাজের কঠিন নিষ্ঠুর নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে ছোট্টো সম্পর্ক কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কখন যেন আমার অজান্তেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। সারারাত বসে রইলাম নিঝুম রাত্রির অন্ধকারে।

    কেটে গেল দীর্ঘ দশ বছর। পঁচিশ বছরের মানিক আজ পঁয়ত্রিশ । বেশ কয়েকদিন ধরে অর্থকষ্টের মধ্যে আছি। এর মধ্যেই আবার পূজো এলো। গ্রামের ছেলেরা আমায় ধরে বসেছে এবারে দূর্গাপুজোর বোধনের দিনে বিশেষ অতিথি আসবে, আর অতিথি আপ‍্যায়নের দায়িত্বে আমাকে থাকতে হবে। না বলতে পারলাম না।

    আমি জিগ‍্যেস করলাম, “কে আসছেন?”

    তপন বলল, “নারী কল‍্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান দোলন চক্রবর্তী। মানিকদা, মনে করে কিন্তু ঠিক ছটার সময়”। আমি যথাসময়ে রীতিমতো নুতন ধুতি পাঞ্জাবি পরিধান করে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে চেয়ারম্যান ম‍্যাডামকে আপ‍্যায়ন করতে প্রস্তুত। চেয়ারম্যান ম‍্যাডাম আসতেই কেমন যেন হুড়োহুড়ি লেগে গেল। আমি ফুলের তোড়া নিয়ে চেয়ারম্যান ম‍্যাডামের হাতে দিতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম! শুধু অস্পষ্ট ভাবে বললাম, “পূর্ণিমা!”

    পাশ থেকে বাদল বলল, “মানিকদা, ফুলের তোড়াটা দাও”।

    আড়ষ্ট হাতে এগিয়ে দিলাম ফুলের তোড়া। মাইকে ঘোষনা হল চেয়ারম্যান দোলন চক্রবর্তী দেবীর আরতিতে অংশ নেবেন।

    বাদল বলল, “মানিকদা, দাঁড়িয়ে আছো যে আরতি দেখবে না? চলো চলো শুরু হলো বলে”।

    দেখলাম পঞ্চপ্রদীপ হাতে নিয়ে পুরোহিত ঠাকুরের সঙ্গে আরতিতে অংশ নিয়েছে পূর্ণিমা।

    সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলাম, যে মেয়ে আজ থেকে দশ আগে আজকের দিনেই বোধনের দিন বিসর্জন হয়েছিল বলে ভেবেছিলাম, আজ তার হাতেই দেবীর পঞ্চপ্রদীপ। যে মেয়ে দেবীর বোধন সে দিন চাক্ষুষ করতে পারেনি সেই মেয়ে আজ দেবীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে। যে সমাজ তাকে সেদিন ধর্ষিতা নারী অপবাদ দিয়ে দূরে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল সেই সমাজই তাকে আজ সাদরে গ্রহণ করে নিল। আজ যদি গ্রহণ করে নিল সে দিন কেন গ্রহণ ক‍রতে পারল না এই সমাজ? তাহলে কী আজ যে পদে পূর্ণিমা আসীন সেই পদের জন‍্যই কী সমাজ তাকে গ্রহণ করলো? আর যদি না এই পদে আসীন হতো তাহলে কী পূর্ণিমাকে মেনে নিত না এই সমাজ? একটা উচ্চ পদ কী মানুষের অন্তর বাহির বিচার করতে পারে?

    আর আমি... আমিও তো আর পাঁচটা মানুষের মতো গড্ডালিকা প্রবাহে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম পূর্ণিমাকে। সেদিন শেষ রাতে সে এসে ছিল আমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে। আর আমিও কিনা আর পাঁচটা মানুষের দলে ভিড়ে গেলাম। পূর্ণিমার দিকে চোখ পড়তেই লক্ষ করলাম পরণে লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে ঠিক যেন দেবী-মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। চলে যাওয়ার সময় বাড়ির ঠিকানা দিয়ে গেল।

    তার কয়েকদিন পর বাড়িতে না জানিয়ে পূর্ণিমার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, “কোন মুখে দাঁড়াবো পূর্ণিমার সামনে? পূর্ণিমা কী আমার মুখ দেখতে চাইবে? তার প্রতি যে অবিচার করেছিলাম এর পরেও কী সে আমাকে ক্ষমা করতে পারবে? নাকি শিয়াল কুকুরের মত তাড়িয়ে দেবে? যদিও বা সে আমাকে ক্ষমা করে আমি কী নিজেকে নিজের কাছে ক্ষমা করতে পারবো?" হাজার প্রশ্ন ভীড় করে আসছে মনের মধ্যে। উপস্থিত হলাম পূর্ণিমার বাড়িতে।

    দারোয়ান আটকে বলল, “কাকে চাই? আজ ম‍্যাডাম ব‍্যস্ত আছেন, কারো সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না”।

    আমি বললাম, “পূর্ণিমা মিত্রের সঙ্গে দেখা করতে চাই”।

    “এখানে পূর্ণিমা মিত্র বলে কেউ থাকে না”।

    আচ্ছা, দোলন চক্রবর্তী?

    “হ‍্যাঁ”।

    আমি কার্ডটি দেখাতে দারোয়ান একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে বেরিয়ে গেল ।

    তার মিনিট দশেক পরে পূর্ণিমা ঘরে ঢুকল। আমি চেয়ার ছেড়ে বিহ্বল ভাবে তাকিয়ে আছি। আমি কিছু বলার আগেই পূর্ণিমা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে মেঘ ভাঙা বৃষ্টির মতো অঝরে কেদেঁ চলল।

    বললাম, “তোমার দুঃখের দিনে আমার এই কাঁধ দিতে পারিনি ক্ষমা করে দিও। ভুল করেছিলাম সেদিন তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে। এখন তুমি তো সে পূর্ণিমা নেই। সেই পূর্ণিমা ভেঙে চুরে নতুন ভাবে পুর্ণজন্ম হয়েছে দোলনরূপে”।

    দোলন বলল , “আমি তোমার কাছে এখনো সেই পূর্ণিমা হয়েই বাঁচতে চাই”।

    পূর্ণিমা জানাল, “শেষ সাক্ষাতের পর আশার তরী যখন সমাজের পারিপার্শ্বিক চাপে দুঃখের অতল সাগরে ডুবল, তখন মনে হল জীবন রেখে লাভ কী? মা’ও কয়েকদিন পর আমার চিন্তায় দেহ ত‍্যাগ করলেন। আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম। তখন আমাকে নবজীবন দান করলেন নারী কল্যাণ সমিতির পূর্ববর্তী চেয়ারম্যান নিলু ভৌমিক। শেখালেন লড়াই করা মন্ত্র। তারপর থেকেই শুরু হলো বেঁচে থাকার লড়াই। সমাজ কখনো নারীর প্রাপ্য আধিকার দেয় নি। নারীকে নিজের অধিকার নিজে বুঝে নিতে হয়েছে”।

    বলতে বলতে নিয়ে গেল পাশের বাগানে। দেখালো একটি পুরানো ক্যাকটাস গাছ । বলল, “মনে পড়ে এই ক‍্যাকটাস গাছ? তুমি আমাকে দিয়েছিলে। ক্যাকটাস গাছ যেমন শত কষ্টের মধ্যেও রুক্ষ মরুভূমিতে মরু আগুনের তাপে ঝলসেও দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে, ঠিক তেমনি আমিও ওই ক‍্যাকটাস গাছের মতো সমাজের শত বাধা-বিপত্তির মাঝেও দাঁড়িয়ে আছি মাথা উঁচু করে”।

    আমি দাঁড়িয়ে আছি মূর্তির মত হয়ে। আমি শুধু একটি প্রশ্ন করেছিলাম – “তুমি কি এখনো আমাকে ভালোবাসো?”

    “হ‍্যাঁ। এ ভালোবাসা অনন্তকাল ধরে বয়ে চলছে”।

    আমি জিগ‍্যেস করলাম, “তুমি কী করে পারলে আমাকে এত সহজে ক্ষমা করে দিতে?”

    পূর্ণিমা বলল, “তোমাকে আমি দোষ দেব না। তুমি তো আমাকে ত‍্যাগ করো নি। আমাদের সমাজ আমাকে ত‍্যাগ করেছে । সমাজ যেখানে আমাকে মেনে নিতে অস্বীকার করলো সেখানে তোমাকে দোষ দেব কী করে?”

    অবাক হয়ে গেলাম কঠিন নিষ্ঠুর বাস্তব কথা শুনে।

    হঠাৎ অনুভব করলাম সর্বাঙ্গ শরীর জ্বালা করছে। বুঝলাম সেদিন পূর্ণিমাকে ফিরিয়ে যে অন‍্যায়, যে পাপ করেছিলাম তা আজ পূর্ণিমার পবিত্র ভালোবাসা তাপে পুড়ে যাচ্ছে তাই সর্বাঙ্গ শরীর জ্বলছে। বললাম, “আজ আসি তাড়া আছে”।

    পূর্ণিমা বলল, “সেদিনও বলেছিলে তাড়া আছে। আজ কীসের তাড়া? ভয় নেই। আজ আর তোমার মান সন্মান হারানোর ভয় নেই”।

    তারপর আলমারি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা বের করে বলল, “এটা নিয়ে যাও তুমি এখন কষ্টে আছো”।

    “না। এ টাকা আমি নিতে পারবো না”।

    পূর্ণিমা বলল, “মনে পড়ে গোলাপ, নয়নতারা ও ক‍্যাকটাস গাছের দু’শো টাকা আমার কাছে পাবে যা তোমায় এখনো দেওয়া হয় নি। বলেছিলাম না সুদ সমেত ফিরিয়ে দেব? ভাব না তাই ফিরিয়ে দিচ্ছি”।

    আমি কখনো ভাবিনি দু’শো টাকা সুদ সমতে এই ভাবে ফিরে পাবো।

    পূর্ণিমা বলল, “আমার শেষ ইচ্ছে পুরণ ক‍রবে?”

    “তোমার কোনো ইচ্ছেই পুরণ করতে পারি নি। আর তোমাকে দেবার মতো কিছুই নেই আমার। আজ আমি নিঃস্ব। বলো কি চাই তোমার?”

    “তোমার আর্শীবাদ”।
    পায়ে ছুঁয়ে প্রণাম করে বলল, “আর্শীবাদ করো আমি যেন জীবন-যুদ্ধে জয়লাভ করে সমাজের অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়াতে পারি”।

    কম্পন রত ডান হাত তুলে মাথা রেখে বললাম, “নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে সমাজ সেবার যে ব্রত তুমি নিয়েছো তা যেন তোমার পূর্ণ হয়”।

    অনুভব করলাম পূর্ণিমার অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে আমার পায়ে এসে পড়ছে।

    পূর্ণিমা বলল, “প্রথমবার ও শেষ বারের মতো আমার দেবতার পা ধুইয়ে দিলাম চোখের জলে”।

    বাড়ি থেকে বেরিয়ে সবে দু’পা এগিয়েছি পেছন থেকে পূর্ণিমা ডাকল, “মানিক !”

    পেছন ফিরে তাকালাম।

    পূর্ণিমা ছলছল চোখে বলল, “আর কোনো দিন আমার বাড়িতে এসো না। আমি চাই না আমার জন্য তোমার বিবাহিত জীবনে বিপর্যয় নেমে আসুক”।

    সশব্দে দরজা আমার মুখের উপর বন্ধ হয়ে গেল। বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সূর্যের প্রখর তাপের মধ্যেও ক‍্যাকটাস গাছটি তখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ।
    ----------
    ***তুমি অন্য কারোর গল্পের নায়িকা – অনুপম রায়
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন