বৃষ্টির মাইথন
সুজিত বসু
স্মৃতির ঝাঁপি খুললে বেরোয় গল্পগুলো দামী
সোনার চেয়েও অনেক দামী, হয়তো খাঁটি হীরে
গল্পগুলোর নাম দেবো না, থাক তারা অনামী
নাম না জানা গল্পগুলো থাকুক মনের নীড়ে
পুরোনো সেই দিনের কিছু গল্প চলুন শুনি
শুনবেন না?আমি তেমন কেউকেটা নই বলে?
নাই বা হলাম বিখ্যাত আর নাই বা হলাম গুণী
ছাইচাপা সব স্মৃতির আগুন উঠবে দেখুন জ্বলে
মাইক্রো মিনির চল ছিলনা, জিনসেরও তো নয়
লজ্জামাখা শাড়িই তখন ঢাকতো যুবতীর
বরতনু, বান্ধবীকে সম্বো্ধনে ভয়
‘’তুমি’ বলে ডাকবো ভাবলে লজ্জা দ্বিধার ভিড়
বন্ধু এসে জানান দিল করছে সবাই বলাবলি
মাইথনে টুর, শিল্পা যাবে, রত্না, বর্ষা যেতেও পারে
অতর্কিতে মনের মধ্যে ভেসে উঠলো গানের কলি
‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’
কয়েক দিনেই জানতে পারি সত্যি এবার মাইথনে টুর
শিল্পা বর্ষা অপর্ণা আর রত্না যাবে সঠিক খবর
চতুর্দিকে কেকাধবনি, মন যেন আজ সত্যি ময়ূর
হঠাৎ যেন দোল এসেছে, রঙ আবিরের বৃষ্টি অঝোর
বাস ছাড়ল ঠিক সময়ে, ফুরিয়ে আসছে তখন বিকেল
ঝলমলানো শাড়ির আভায় বাসের মধ্যে আলোর মেলা
নিষ্ঠুর এক ঘোষণাতে নিভলো আলো, বাস হলো জেল
হঠাৎ যেমন বৃষ্টি এলে ময়দানে হয় স্থগিত খেলা
জেলের মধ্যে পৃথক যেমন পুরুষ নারী কয়েদীরা
এখানে সেই একই নিয়ম, এক অধ্যাপক জানিয়ে দিলেন
ডান সারিতে উদ্দামতা, বাম সারিতে সলাজ ব্রীড়া
গভীর রাতে হয়না যাতে স্পর্শনিবিড় ভাব লেনদেন
নিরানন্দ সবাই তবে বিশেষ ভাবে যারা যুবক
কোনো সুদূর কল্পনাতেও ছিল না এই সম্ভাবনা
সবাই পেলাম যন্ত্রণাময় হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ শক
গানের কথাই সত্যি তবে, ভালোবাসা এক যাতনা
ইতিউতি তাকায় সবাই, লোকদেখানো সজীবতা
ডান সারিতে যদিও সবার বামদিকে এক একাগ্র ঝোঁক
বুঝতে যাতে না পারা য়ায়, বলছে তারা ফালতু কথা
পিছন সিটে পাহারা দেয় aধ্যাপকের সতর্ক চোখ
আবহাওয়া তরল করে বান্ধবীদের সুরেলা গান
যৌবনে যে মউ ঝরে তা স্পষ্ট করেন মাধুরীদি
মন যে আমার কেউ চিনেছে আরতিদি বিশদ জানান
গান গেয়ে মন জানাজানি তখন ছিল এই তো রীতি
সুপ্রিয়াকে মন থেকে আজ সরাতে যে হবেই জানি
কে বসবে তা বুঝছে সে কি, পেরিয়ে গেছি সহ্যসীমা
কাঁটার মতো বিঁধছে পাশে না বসতে পারার গ্লানি
রাজহংসী গ্রীবায় শুধু অহংকারের তেজ গরিমা
চলতে চলতে সন্ধ্যে হলো, খানিক পরে রাত ঘনালো
সবাই আমরা তলিয়ে গেলাম নিবিড় গভীর ঘুমের দেশে
মধ্যরাতে চমকে জেগে দেখতে আমি পাইনা ভালো
মুখ যে তখন আচ্ছন্ন তমসাময় কৃষ্ণকেশে
আমার পাশে মানবী না স্বপ্নে দেখা আফ্রোদিতি
ঘুমের ঘোরটা কাটলে বুঝি তারই মাথা আমার কাঁধে
যে আছে মন জুড়ে আমার, বদলায় সে পরিস্থিতি
বুঝতে পারি তলিয়ে যাচ্ছি অনিশ্চিতের গহীন খাদে
প্রেমে পতন সবাই বলে, উত্থান তো কেউ বলে না
তলাতে আর ভয় কি যখন অভয় দিচ্ছে সাহসিনী
দুরেই ছিল কল্পনাতে, আজ মনে হয় ভীষণ চেনা
অনেক বছর পরেও দ্বিধা, ভুল করেছি কি করিনি
সকালবেলা যাত্রা শেষে মাইথনে এক মেঘলা আকাশ
পছন্দসই সঙ্গী নিয়ে যে যার মতো ঘুরতে থাকি
সেতুর উপর আমার জন্য প্রতীক্ষাতে যে সর্বনাশ
সারাজীবন কষ্ট দেবে বুঝতে পারি তার কথা কি
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে জড়িয়ে ধরে আফ্রোদিতি
শাড়ির নিচে প্রস্ফুটিত মনভোলানো উপত্যকা
অনেক বছর পরেও মনে উজ্জ্বল সেই দিনের স্মৃতি
বৃষ্টিমুখর ঘেরাটোপের মধ্যে আকুল সখী সখা
সঙ্গিনী তার পাপড়ি খোলে, সাড়া দিলাম সে আহ্বানে
রঞ্জনী নয় চাকের মধু-র স্বাদই পেলাম ওষ্ঠাধরে
প্রথম ঠোঁটে ঠোঁট মেলানোর হর্ষ কি তা সবাই জানে
চুম্বনে যে বিষাদ থাকে তা জেনেছি অনেক পরে
ঘষা কাচের দেওয়াল তুলে বর্ষা জড়ায় স্নেহের চাদর
মাটির ভিজে গন্ধে সোঁদা পাগল করা মাদকতা
বৃষ্টি থামলে হঠাৎ কাটে মদির নেশার নিষিদ্ধ ঘোর
এবার বাড়ি ফেরার পালা, ফুরিয়ে আসছে আমার কথা
কলেজ খুললে অধ্যাপকের কাছে যাওয়ার কঠিন আদেশ
“ছি ছি বাসের মধ্যে রাতে দেখালি তুই কি সিনেমা”
বুকটা তখন দুরুদুরু, সুখের স্মৃতির নেই কোনো লেশ
‘নিজেকে কি রাজেশ ভাবিস, বান্ধবীকে ভাবিস হেমা! !
ভাবছি এবার তোর মামাকে সরাসরি গিয়েই বলি
পড়াশুনোয় ফাঁকি দিয়ে ভাগনে করে প্রণয়ালাপ
বান্ধবীকে বসিয়ে পাশে বাসের মধ্যে ঢলাঢলি
ভাবছিল সে অন্ধকারই ঢেকে রাখবে তার সব পাপ’
কি আর বলবো, নেই যে তখন পায়ের নিচে শক্ত জমি
পরাশ্রয়ী বলেই তখন সহ্য করি সব অপমান
ধরবে না এই অশক্ত হাত জানি তখন কেউ মরমী
প্রতিশ্রুতি দিতেই হলো বুকের মধ্যে বেঁধে পাষাণ
চেষ্টা সে খুব করেছিল অনেকবারই কাছে আসার
দূরের থেকে দেখতে পেলেই পালিয়ে গেছি অন্তরালে
মানসচোখে দেখতে পারি রক্তশূন্য মুখ যেন তার
গুলিবিদ্ধ পশুর মতো গোপন করি মুখ আড়ালে
অনেক বছর পরে ভাবি যদিই কোনো মন্ত্রবলে
চিত্রপটটা বদলে যেত, জীবন বইতো অন্য বাঁকে
হয়তো আসতো ঘূর্ণিঝড় আর আসতো বিপদরূপী কুমির
সেই মানসী থাকলে পাশে এড়িয়ে যেতাম যে কৌশলে
তা ভেবে আর কিই বা হবে, ঘর শধু আজ অশান্তিনীড়
নিস্তরঙ্গ পানসে জীবন চাই না বলবো বিধাতাকে !
নামটা কিন্তু বলিনি তার, একটা কোনো নাম বেছে নিন
আজ নিশ্চয় পরস্ত্রী সে, এবং হয়তো সে জননী
নাম বলা তাই ঠিক হবে না, তার কাছে থাক আর একটু ঋণ
অস্পষ্ট দেখবো তাকে, শুনবো মৃদু পদধ্বনি
সুখের সঙ্গে জীবন দিল অন্তবিহীন শোক
মধুর স্মৃতির সঙ্গে দিল তিক্তকষায় শিক্ষা
এবার নতশিরে অনুতাপের কথাই হোক
এই কবিতার উদ্দেশ্য হয়তো ক্ষমাভিক্ষা।