১.
সুদিনের বেইল-ঠিক-দুপুর। ঝাঁঝাঁ রোদের দিকে চোখ ঘোলা করে তাকিয়ে আছে সফুরা। অই দূরে দেখা যাচ্ছে তার মরদটা মূরা বেয়ে নামছে, আলু-ক্ষেতির বেড়া নাড়ছে ছাগলটা, এক ঝাঁইর কাঁটা-মারিশ শাক নিয়ে ঘুরছে ঘষা-মাজা চেহরার একটা মেয়ে, দুয়ার লেপা মাটি থেকে গোবরের ঘ্রাণ আসছে, ছাড়াছাড়া সবুজ ঘাসে অনেকদূর পর্যন্ত চলে গেছে জমিন ধরে মাটির আইল, আরো কত কী কী সব একচোখে অপলক তাকিয়ে আছে সফুরা। তার ঘোলা চোখ।
ঐ কোন না-দিকে তাকিয়ে থাকা সফুরার দৃষ্টি ধরে, মনে হওয়া ঘাসের, জামিনের, আইলের পথ ধরে, উঠানে এসে দাঁড়ায় মমিন। মূরা থেকে বয়ে আনা গাছের কচির গোছা নামাতে নামাতে যখন গজগজি মেরে কিঁয়ায় উঠে মরদটা, সফুরার বুক ধ্বক করে উঠে। তাড়াতাড়ি দিয়ালা থেকে নেমে মমিনের হাত ধরে। ঘরে তুলে ধরে ধরে। কপালে হাত রাখে। জ্বর মাপে। মমিনের পায়ের তালু তুলে দেখে, ফাটা-তজ্জাতজ্জা গোড়ালির নিচে আস্ত গাছের টুকরা ঢুকে গিয়ে দেবে গেছে অনেকটা।
২.
এই কারনে কেউ পাগল হবার নজির নেই লোকাল ইতিহাসে, তাই কেউ কেউ অবাক হয়। যদিও পায়ের দরদে পাগল হতেও পারে মানুষ। পায়ের তালুর রগগুলো ঐ মাথার সাথেই বিঁধে আছে বেশি। কিন্তু মমিনের মাথায় দোষ দেখা যাওয়ার অনুমান কারও কারও মনে আসে এই কারনে যে, পায়ে গাছের ফালা ঢুকার পর থেকে বাতাসের সাথে কথা বলার প্রবণতা ও পরিমাণ দুটোই বেড়ে গেছে তার। হামেশ-ক্ষণ নিজে নিজে গজগজ করে গোসসায় ফেটে পড়ছে।
বেইল-ঠিক-দুপুর থেকে বসে আছে মমিন, বড় বাজারের ফার্মেসির কাম্পাওন্ডারের আন্ডারে কম্পাওন্ডারগিরি শিখে লোকাল মানুষের মুখে মুখে ফেটে পড়া ডাক্তার আমির হামজা, প্রকাশ আইরঞ্জা ডাক্তরের অষুধের দোকানে। কিন্তু বেইল পড়ে গেছে পশ্চিমকূলে মুক্তার-হাজীর সুপারি বাগানের মাথায়, এখনো আইরঞ্জার আসার নিশান পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। পায়ের-মুরির টনটনানি নিয়ে দাঁতে দাঁত কষে খিছ মেরে বসে থাকে মমিন নিঝাপ-নিরালায়।
৩.
কিন্তু কারও কারও মনে ঐ অনুমান সন্দেহে রূপান্তরিত হতে টাইম লাগে না। যখন তারা দেখে আইরঞ্জা ডাক্তর আসার পর সে যখন তার চতুর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নাক-মুখ কুঁচকে মমিনের পায়ের পাতার গোড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। আর গুরুগম্ভীর টোনে একটার পর একটা সাওয়াল করে যায়- কী গাছের ফলা, কীভাবে ঢুকলো, দিনে খুঁট মারে বেশি না রাইতে -এইসব বেহুদা। আর মমিন বেকুব ব'নে চেয়ে থাকে।
এবং একে একে নিচের পাতা নামিয়ে চোখ, লম্বা করে বের করে জবান, তলপেটে চাপ দিয়ে আঁতি, স্টেথোস্কোপ দিয়ে বিমার-হার্টবিট, কব্জি চেপে মমিনের নাড়ি পরখ করে আইরঞ্জা। পরে এক পাতা প্যারাসিটামল ও ফলা ঢুকে যাওয়া পা-টা কয়দিন ঝুলিয়ে হাঁটার মহামূল্য পরামর্শটা দিয়ে বিদায় করে দেয়। তাজ্জব হয়ে কিছুক্ষণ নিরুদ্দেশ তাকিয়ে থাকতে থাকতে মমিন লুংগির গোছ হাতড়ে বের করতে থাকে ডাক্তারের ফীস।
তারপর নিজেকে নিজেই গজগজি মেরে বলে উঠে- হাঃ, চুদানির গা হাঃ, আজিয়াও একশ তোর ফেড়ত দিলাম, হাঃ।
এভাবে নিজেনিজে গজগজ করতে করতে মমিন যখন চলে যেতে থাকে, উপস্থিত সকলের চোখে বিষ্ময়, কার উপর রাগ ঝাড়ে মমিন, কার সাথে কথা কয়?
#ছোটগল্প