এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বিনোদ

    Pradip Ray লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৩ নভেম্বর ২০২০ | ৬৮০ বার পঠিত
  • সন্ধ্যে থেকেই টিপ টিপ বৃষ্টি। বছরের এ সময়টা বেশ মনোরম। না শীত, না গরম। আকাশ মূলতঃ মেঘলা। হাওয়া কম। টুকটাক করে স্থানীয় স্তরে এক আধ পশলা বৃষ্টি হয়ে যায়। দুপুর তিনটে সাড়ে তিনটের সময় বৃষ্টি রোদ গায়ে মেখে বেরোতে দিব্য লাগে। উৎসব শেষ হয়েও কোথাও যেন তার রেশ রেখে গেছে।

    ছোট্ট একটা ড্রিঙ্ক বানিয়ে মিউজিক সিষ্টেমে একটা নিখিল ব্যানার্জী চালিয়ে, আলোটা একটু কমিয়্‌ রিক্লাইনিং চেয়ারে শরীরটাকে ছেড়ে দিলাম। এবারে ফিরে যাওয়ার আগে মেয়ে এটা জোর করে কিনে দিয়ে গেছে। তখন আপত্তি করলেও গত কয়েকমাসে এটার প্রতি এক রকমের মায়া পড়ে গেছে। বিশেষতঃ এ রকম গোমড়া মুখো দিনে। এ সময় অতীত বড্ড বেশী জ্বালায়। আমার প্রাক্তন স্ত্রী, ছেড়ে যাওয়া বন্ধু বান্ধব, লেক ক্লাবে সন্ধ্যে বেলার আড্ডা, প্রথম শোনা দেব্ব্রতের গান - এই সব গুলো উপভোগ করার জন্য মনে হয় এই ধরনের একটা চেয়ার খুব মানানসই।

    হুইস্কিতে ছোট একটা চুমুক দি। বাহারী, কাট গ্লাসের। মিতার কাটলারির প্রতি দুর্বলতা ছিল। আমাকে কোন রকম তোয়াক্কা না করেই দুপুরবেলা বেরিয়ে এগুলো কিনে কিনে আনত। তখন তেমন করে খেয়াল না করলেও আজ এই একলা খাঁ খাঁ বাড়িতে, ছিমছাম সাজান ঘরে, দোলান চেয়ারে বসে, মৃদু আলো ও সেতারের পটভূমিকায়, মেয়ের রেখে যাওয়া সিংগল মল্টে ছোট ছোট চুমুক দেওয়ার সময় এই কাটলারি গুলোর জন্যে আমার ছেড়ে যাওয়া স্ত্রীকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম।

    সেতারটা ঝালায় পৌঁছেছে। পিলু আমার খুব প্রিয় রাগ। মিতারও। দুজনে একসাথে অনেকদিন শুনেছি। রবীন্দ্র সংগীত আর নিখিল ব্যানার্জীর সেতার ছিল আমাদের সমর্মমিতা ও দুর্বলতার জায়গা।

    নিখিল ব্যানার্জীর এটাই বৈশিষ্ট যে উনি বাজনাটাকে টান টান বাজিয়ে যান। সঙ্গতিয়াকে কতটা ছাড়তে হবে এটা ওনার আপাত বিবেচ্য নয়। আমার কাছে এটা বড় আকর্ষণীয়।

    বিনোদের মধ্যেও সঙ্গী নির্বাচন ও বর্জনের ক্ষেত্রে এই নিরাসক্তি লক্ষ্য করেছিলাম। হঠাৎ ওর কথাটা মনে আসতেই চোখটা মুদে এলো। গতকাল ফোনটা প্রায় এসময়েই এসেছিল। অন্যপ্রান্ত তেকে ঈথারে ভেসে আসা সেই অপ্রিয় কিন্তু অবশ্যম্ভাবী ও প্রত্যাশিত অমোঘ সংবাদ। বিনোদ আর নেই! তখনই পুরো অতীতটা পারম্পর্যের পরোয়া না করে এক টানে স্মৃতির গোড়ায়।।

    -২-

    ৫৯এর উত্তাল আন্দোলন। স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে নানা পর্বে খাদ্য আন্দোলন এরাজ্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে। বিশেষত, ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন। ঘটনাক্রমে ১৯৪৩ সালের নিদারুণ দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষের অসহায় মৃত্যুর পর তেভাগা আন্দোলনের মধ্যে মানুষ যখন নতুন জীবন খুঁজছিল। গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলন, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, মধ্যবিত্ত কর্মচারী আন্দোলন, শরণার্থী আন্দোলন, স্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য আন্দোলন, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাসের দাবিতে আন্দোলন — প্রতিটি গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার যেন তিনি মূর্ত প্রতীক।

    খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকে প্রায় লাগাতার হলেও খাদ্য সঙ্কট বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছায় ১৯৫৮-’৫৯ সালে। একদিকে খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক ঘাটতি অন্যদিকে সরকারের ভ্রান্ত খাদ্যনীতির কারণে চোরাকারবারীদের স্বর্গরাজ্য। খোলাবাজার থেকে চাল প্রায় অদৃশ্য। ভেঙে পড়ে রেশনব্যবস্থা। কালোবাজারে চালের দাম আকাশ ছুঁতে থাকে।প্রসঙ্গত, ১৯৫৭-র নির্বাচনের ফলাফলে অবিভক্ত সি পি আই কেরালাতে রাজ্য সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। এরাজ্যে সেবার সম্মিলিত বামপন্থী নির্বাচনী কমিটির মধ্যে একতাবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল সিপিআই ছাড়াও পিএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি এবং মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক। এসইউসি দু-একটি ছোট দলকে নিয়ে গঠন করেছিল ‘ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট’। খাদ্য আন্দোলন প্রসঙ্গে রাজ্যের এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটাও খেয়াল রাখতে হবে।৬০ এর দশক থেকেই পৌনঃপুনিক রাজনৈতিক ডামাডোল ও আলোড়ন একটা ক্রিসেন্ডোতে উঠছে। বেটোফেনের সিম্ফনীর মত। এর সাথে সাথেই রাজ্যব্যপী খাদ্য আন্দোলন। বয়ঃসন্ধি কাটিয়ে উঠেই দেখি উত্তাল সময়। বারাসত বসিরহাটে গুলি, অফুরান মিটিং মিছিল। এর সাথে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে র‍্যালী, গোপন আলোচনা; শহরের বিপ্লবী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের কেরিয়ার সর্বস্বতাকে ব্যঙ্গ করে রাখী চুড়ি প্রেরণের মত অপমানজনক ঘটনা ততদিনে ঘটে গেছে।

    এ সময়ই বিনোদের সাথে প্রথম দেখা। বিনোদ মফঃস্বলের ছেলে। চেহারা কথা বার্তায় কোন আলাদা বৈশিষ্ট্য নেই। আরও অনেকের মত সাধারন ভাবেই ওর সঙ্গে আলাপ।

    -৩-

    নিখিলবাবুর সিডিটা শেষ হয়ে গেছিল। আর একটা চালিয়ে দিলাম। বাগেশ্রী। প্রথম রাতের রাগ।
    মনে আছে বিনোদের সাথে আলাপটা এই ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের সুত্র ধরেই গাঢ় হয়ে ওঠে। আশ্চর্য হয়ে ছিলাম মফঃস্বলের ছেলে হওয়া সত্বেও রাগসঙ্গীতে, বিশেষতঃ পাশ্চাত্য রাগসঙ্গীতে ওর জ্ঞান ও জানার স্পৃহা দেখে। আমার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথই শিক্ষক। ওঁর গান ধরেই দেশজ গান, ভাটিয়ালী, দক্ষিনী, বাউ্‌ল রাগ বিন্যাস, পাশ্চাত্য গানের চলন ইত্যাদির জগতে পা রাখা। পরে কিছু বন্ধু ও প্রেসিডেন্সীর গানপ্রেমী দলের সৌজন্যে একটু এগোই। নিজের ইচ্ছে ও উদ্যোগটাও ছিল। কিন্তু বিনোদের রীতিমত বনেদী ও চর্চিত শিক্ষা।

    অতএব আমাদের বন্ধুত্বের অগ্রসরের অনুঘটক পাওয়া গেল। চাঁদনী রাতে বিস্ববিদ্যাল্যের বিস্তীর্ন মাঠে শুয়ে গানালোচনার সাথে সাথে ওঁর কথা শুনতাম। গান কবিতার পাশাপাশি ওর অন্তর্লীন একটা ক্ষোভ, যা ক্রমশঃ ক্রোধের রূপ নিচ্ছে, তার পরিচয় পেতাম। চারপাশের অস্থিরতায় ওর দিশাহারা ভাবের সাথে আমার মত বিনিময় চলত। ব্যক্তিগত ভাবে আমার প্রেসিডেন্সীর তিন বছরে, সুকান্ত সুভাষ তেভাগা তেলেঙ্গানা অনুশীলন যুগান্তর ইত্যাদির প্রভাবে, ওগুলো ছাড়িয়ে আরও কিছু করার ইচ্ছা প্রবলতর হতে থাকে।

    -৪-

    যাদবপুরের প্রথম বছরটা খুব দ্রুত। সব নতুন নতুন ছেলে মেয়ে। কলকাতা, অন্যান্য জেলা, ভারতের অন্যান্য রাজ্য, এমনকি কিছু ভিনদেশী। মিলিয়ে মিশিয়ে। সবার সাথে আলাপ, উনিভারসিটির গলি ঘুঁজি চেনা, বিভিন্ন বিভাগ, ক্যান্টিন, ক্লাব, খেলা ধূলোর মাঠ ছাড়াও আবৃত্তি, ডিবেট, গান বাজনা নাটকের জায়গাও পাওয়া গেল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্লাব বা ইউনিয়ন রুমগুলোর সাথেও পরিচয় হল। বাকি রয়ে গেল কিছু গলতা, ছেলেমে্যেদের মেপে নেওয়ার জায়গা গুলো আস্তে আস্তে চেনা। দিনগুলো একেবারে ঝড়ের গতিতে। এর মাঝেই পিরিয়ডিকাল সেমেস্টার এর ভ্রুকুটি। মাঝে মাঝেই ছোটখাটো র‍্যাগিং শুনতাম। পড়াশুনোর চাপ ক্রমশঃ বাড়ছিল। সাপ্লিমেন্টারী ব্যাক ইত্যাদি প্রভৃতি শব্দের সাথে সম্যক পরিচয় এ সময় হল। রাশিরাশি সাপ্লি কয়েকজনকে বেশ চাপেই ফেলে দিল। কিছুদিন ঘাড়গুঁজে পড়ে কোনক্রমে সেকেন্ড ইয়ার।

    আমাদের পারস্পরিক পরিচয় এবার গোষ্ঠীবদ্ধ হতে আরম্ভ করল। দেশ ও রাজনীতি নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করে দেওয়া আমরা কয়েকজন এক ডালে জুটে গেলাম।

    -৫-

    শেলফ থেকে পুরোনো হলদেটে সাদাকালো একগুচ্ছ ছবি নামিয়ে আনলাম। আজ এগুলো এলবামে ঢোকাব। সিডিতে সেতার পালটে এবার অবধারিত পুরোনো সেই দিনের কথা। দেবব্রতের অসাধারন স্বরপ্রক্ষেপ ও ব্যারিটোন আওয়াজে ঘরটা গমগম করছে। প্রিয় গানগুলো পছন্দ করে পরপর সিডিতে ঢুকিয়েছি। আমার স্মৃতির সাক্ষী। গ্লাসে আর এক টুকরো বরফ নিলাম। কৌটোয় সামান্য আলুভাজা ছিল। ফ্রীজে একটু সসেজ। মাইক্রোয় ঢুকিয়ে প্লেটে সাজিয়ে নিলাম। অল্প শসা আর পেঁয়াজ কুচি ।শরীরটা এলিয়ে আবার পেছিয়ে যাই।

    দ্বিতীয় বছরে বিনোদের আর একটা পরিচয় পাওয়া গেল। গত এক বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওর সাংগঠনিক ক্ষমতার অল্পবিস্তর পরিচয় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছাড়িয়ে খুব দ্রুত তার অভিমুখ বৃহত্তর শিক্ষাক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়া তখন অবধারিত। বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাস অল্প স্বল্প পড়তে শুরু করেছিলাম। তখনই জানতে পারি যে এই উপমহাদেশে তথা পশ্চিমবঙ্গে বিশের দশকে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উদ্যোগে কিছু নির্বাসিত ভারতীয় ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ শহরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (সি.পি.আই) গঠন করেন। এদিকে বিশ ও ত্রিশের দশকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তরুণদের বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে প্রধানত সন্ত্রাসবাদী রূপ পরিগ্রহ করে। ব্রিটিশ নাগরিক ও পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। অনেক সন্ত্রাসবাদী তখন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন, অনেককে জেলখানায় ফাঁসি দেয়া হয়। তদুপরি, শত শত কর্মী বছরের পর বছর জেলখানায় আটক থাকেন এবং অনেককে দ্বীপান্তর দন্ড দিয়ে আন্দামানে পাঠানো হয়। জেলখানায় আটক এই সন্ত্রাসবাদীরা কমিউনিস্ট পত্রপত্রিকা পাঠের সুযোগ পান এবং অনেকে কমিউনিস্ট দলে যোগ দেন।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। পার্টি এক পর্যায়ে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দিলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তা অনুমোদন করে। ১৯৫০ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এক পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি নির্বাচিত হয়। ১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত পার্টির একটি খসড়া কর্মসূচিতে জাতীয় বুর্জোয়া এবং সামন্ত ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি হিসেবে ব্যাপকভিত্তিক ফ্রন্ট গঠনের আহবান জানানো হয়। পার্টি সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করে নেহরু সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে শুরু করে এবং সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। সোভিয়েত মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের পর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভক্তির কারণে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও বিভক্ত হয়ে পড়ে। ভারতীয় কমিউনিস্টদের একাংশ একটি নতুন দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গঠন করে এবং চীনের নীতিকে সমর্থন জানায়।

    পশ্চিমবঙ্গেও সেই সময় একটা রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের সূচনা পরিষ্কার।বহুদিনের কংগ্রেসী শাসন পরিবর্তন হয়ে বামপন্থী শক্তি মাথা চাড়া দিচ্ছে।বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারনে পশ্চিমবঙ্গ বামপন্থী আন্দোলনের ধাতৃভূমি হয়ে উঠেছিল। বাস্তুহারা দের আগমন, ক্রমশঃ তাদের পায়ের তলার মাটি খুঁজে পেয়ে এবং শিক্ষাঙ্গনে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার পাশা পাশি মূলতঃ বামপন্থী পথে এবার তারা আস্তে আস্তে বৃহত্তর শাসন ব্যবস্থায় ভাগ নেওয়ায় উৎসাহিত হয়ে উঠল।

    শিক্ষাক্ষেত্রে আমরাও আস্তে আস্তে তৈরী হচ্ছিলাম। এই যে্রকম সচরাচর হয়। ইউনিয়নে যোগ দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা, নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আলোচনা, নতুন নতুন গান, কবিতা অভিনয়, স্থানীয় স্তরে কিছু এগিয়ে থাকা মানুষের সংস্পর্শে আসা ইত্যাদির মাধ্যমে চেতনার সমৃদ্ধ হওয়া শুরু হল। বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারা যাচ্ছিল যে পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ ও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এক নতুন আদর্শ, নতুন বিশ্বাস ক্রমশঃ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। ভিয়েতনাম, কিউবা, আলবেনিয়া, সবর্ণ। চে, কাস্ত্রো, হো ইত্যাদি সম্বন্ধে কফি হাউস ক্যান্টিন ও বুদ্ধিজীবি সমাজে উত্তেজিত তুফান উঠছে। নতুন নতুন দর্শন তখন পৃথিবীকে প্রায় আড়াআড়ি ভাগ করে দিচ্ছে।

    এবং মাও ৎসে তুং। একটা অঘোষিত ঝড়ের মত এই নাম ও আনুষঙ্গিক কার্যকলাপ সত্য অসত্য কল্পনা মিলিয়ে মিশিয়ে সর্বত্র আশার নতুন সূর্যের হদিশ দিচ্ছে। আমাদের কাছেও সেই সব কাহিনী এসে পৌঁচ্ছছিল। মানুষ চিরকালই বীরের পূজারী। সে বীরত্ব নিঃস্বার্থ হলে তো আর এক কাঠি। চেতনায় বিদ্রোহ বিপ্লবের বীজ রোপন হয়েছিল সেই চার অধ্যায়, ঘরে বাইরে, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, যুগান্তর অনুশীলনের হাত ধরে। কিছু তার পড়ে। অনেকটা শুনে্। ঐ অন্য ধরনের তাত্বিক বইও তখন গোগ্রাসে গিলছি। মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিনের সাথে সাথে সেই সময়ের সাহিত্য সমাজ সংস্কৃতির খবর ও নিচ্ছি। একই সাথে নিজের দেশের ইতিহাস, দেশ বিভাগ, র‍্যাডক্লিফ লাইন। কাশ্মীর তেলেঙ্গানা তেভাগা ইত্যাদিও কেমন যেন নতুন শিহরন পাঠান শুরু করে দিয়েছে।

    -৬-

    হুইস্কির গ্লাসে আলতো একটা চুমুক দিলাম। মনে পড়ে গেল প্রথম মদ্যপান করার দিনটা। প্রণব বলে আমাদের এক সহপাঠী পকেটে চ্যাপটা একটা বোতল মাঝে মাঝেই আনত। সশ্রদ্ধ কিন্তু লোলুপ এবং ঈর্ষাণ্বিত চোখে ওর দিকে চেয়ে থাকতাম। টিফিনের সময় লাইন দিয়ে আমরা যখন ক্যান্টিনে লুচি ঘুগনি কিনছি, ও তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেই চ্যাপটা বোতল থেকে গলায় ঢালছে।

    জিনিসটা মদ বা মাল বলে জানতাম। খাইনি তখনও। মিটিমিটি ইচ্ছে হলেও প্রকাশ করিনি বা ওকে বুঝতে দিইনি। প্রণব কিন্তু চালাক ছেলে। ও ঠিকই বুঝতে পারত আমাদের মনের কথা। একদিন আমাদের কয়েকজনকে আলাদা ডেকে জানতে চাইল একটু চেখে দেখব কিনা। এও জানাল ভাল লাগলে ও আর দু একটা বোতল নিয়ে আসবে।

    সেই আমাদের প্রথম অমৃত সেবন। মা-গরুর বাঁট থেকে বাছুরের দুগ্ধপানের মত। স্বাদটা ভাল লাগল না। কিন্তু প্রণবের কথামত আর একটু সেবা করার লোভও ছাড়তে পারলাম না। ফলতঃ এরপর প্রণবের ক্রমাগত বোতল আনয়ন ও আমাদের ঢুক ঢুক পান।

    যাই হোক যে কথায় ছিলাম। আমাদের পুরোনো দিনের কথা। বিনোদের কথা। সংগঠন বেড়ে ওঠার কথা। তখন ভাবনা কিভাবে সংগঠন আরও বাড়ান যায়। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য কলেজেও এই ঝোঁকটা দেখা যাচ্ছে। আমরাও পিছিয়ে নেই। কলেজ রাজনীতিতে সক্রিয়তা বাড়িয়ে ছাত্র নির্বাচন এ অংশ নেওয়া হল। কোথাও জিতলাম; কিছু আসনে হারলাম। আমাদের কয়েকজনের হাত ধরে যে সংগঠন গড়ে উঠছিল, স্বাভাবিকভাবে তার নেতৃত্ব দেবার দায়িত্ব আমাদের ওপর বর্তাল।

    পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে গলিতে, বিভিন্ন জেলায় ও প্রদেশে ছোটখাট সংঘর্ষ কিন্তু এ সময় শুরু হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হোল। বামপন্থী বা প্রায়-বামপন্থী অকংগ্রেসীরা এই প্রথম রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতায় এল। বিরোধী দল থেকে প্রাক অভিজ্ঞতা বিহীন ক্ষমতার অলিন্দে এসে প্রথম থেকেই ঠোকাঠুকি শুরু। খেয়োখেয়ি, অসূয়া, চাপা অসন্তোষ,বীতশ্রদ্ধ দিকভ্রান্ত সাধারন মানুষ।

    -৭-

    আচ্ছা মিতা কী আমায় এজন্যেই ছেড়ে চলে গেল! আমাদের দুজনেরই কোন পুর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রাথমিক ভালবাসা ভাললাগার সময় কাটতে না কাটতেই পারস্পরিক দোষারোপ কাদা ছোঁড়া ছুঁড়িতে আমাদের জীবন দুর্বিষহ নরক হয়ে উঠছিল। ততদিনে আমাদের প্রথম সন্তান কিছুটা বড়। ও নির্বাক আতঙ্কে ফ্যালফ্যাল চোখে আমাদের এই অদ্ভূত আচরণ লক্ষ্য করে। এসময়ই সন্তানের মুখ চেয়ে আমরা মিলিত সিদ্ধান্তে আলাদা হয়ে যাই।

    যে কথায় ছিলাম। ভাঙ্গা গড়ার মধ্যে দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সরকার চলছিল। তাতে অগ্নিসঞ্চার করল উত্তরবঙ্গের ছোট্ট একটা গঞ্জ। বহুদিন যাবৎ বহু অসন্তোষ, ঘৃণা, বষ্ণনার বারুদ স্তুপীকৃত ছিল। ছোট এক স্ফুলিঙ্গ তাতে দাবানল এনে দিল।

    ১৯৬৭ সালের মে-জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গে এক কৃষক অভ্যুত্থান ঘটে এবং কমিউনিস্ট পার্টির কিছু ভিন্ন মতাবলম্বী নেতার নেতৃত্বে সশস্ত্র চাষীরা এক ‘সমান্তরাল প্রশাসন’ কায়েম করে এবং কয়েকজন জোতদারের জমি বলপূর্বক দখল করে নেয়।

    এই লাভাস্রোতে খড়কুটোর মত ভেসে যেতে লাগল সারা দেশ। বিশেষতঃ ছাত্র যুবসমাজকে আকর্ষণ করার জন্য ঐ আন্দোলন ছিল অমোঘ; তাদের দিশেহারা ক্রোধ, অবুঝ মনন, যৌবনের অতৃপ্তি-সম্পৃক্ত জীবন থেকে মুক্তির পথ লাভের আশায়। তত্ত্বকথা ছেড়ে, হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ার ও শ্রেণী শত্রুকে ধ্বংস করার আহ্বান ছিল আকুল পাগল করা। সর্বোপরি ছিল দেশবাসীকে এক নতুন সমাজ দেওয়ার স্বপ্ন। আমরা কয়েকজনও এই সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে মেতে উঠি। নামমাত্র সঙ্গতি নিয়ে লেখাপড়ায় জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করলাম। মনে রাখলাম বিপ্লবী পার্টি গড়ার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে সংগ্রাম গড়ে তোলা। একাজে হাত না দেওয়া পর্যন্ত বিপ্লব শুধু মুখে স্বীকার করা হল। তাঁরা হলেন কথায় বিপ্লবী। আমাদের বিপ্লবী পার্টি গড়ে উঠবে কর্মক্ষেত্রে বিপ্লবী দ্বারা। এভাবে না দেখলে পার্টি হবে একটি কচকচির আড্ডাখানা।

    -৮-

    প্রায়ান্ধকার ঘরে আন্দাজে ভর করে মাঝখানে 'তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়' চালিয়ে ছিলাম। শেষ হতে সাম্প্রতিক কালের স্বাগতার 'অন্ধকারের উৎস হতে' চালিয়ে দিলাম। গানবাজনাগুলো খুব ইঙ্গিতবাহী মনে হচ্ছে। বিলম্বিতে শুরু করে ঝালায় পৌঁছান, পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন, হঠাৎ সব কিছুর সমা্প্তি; এবং জ্ঞানের উৎসে নতুন সূর্যের আলো, নতুন কান্ডারি - জীবনটা একরকম মন্দ কাটল না।

    আমি আর বিনোদ ঐ নতুন পথে সম্পূর্ণ ভাবে আত্মনিবেদন করলাম। পড়াশুনোর পাট চুকল; শহরের পথ প্রান্তর থেকে ক্রমশঃ বিপ্লবী বৃত্তে; গ্রামগ্রামান্তরে। মূল স্রোতে আর ফেরা হল না।
    চলার পথে অনেক বাঁক, অনেক ঘাত প্রতিঘাত। বিপদ, প্রেম, পলায়ন; ধুন্ধুমার তর্কবিতর্ক; মনে হাজারো সংশয়। কত কত বন্ধু বিচ্ছেদ; নতুন করে আবার, বারবার শুরু। যে ঝড় ঊঠেছিল তা শেষ হল বড্ড তাড়াতাড়ি। যাওয়ার পথে মুড়িয়ে দিয়ে গেল অনেক মহীরুহ ও সম্ভাবনাময় শিশু গাছ।

    শেষ বেলায় এসে দেবব্রতর ঐ গানটা আবার চালাই। চোখ দুটো বন্ধ করে চেয়ারে শরীর টাকে হেলিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে। একলা আমি এখন। খুব বলতে ইচ্ছে করছে 'আয় আর একটি বার আয়রে সখা প্রাণের মাঝে...'।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন