মাঝে মাঝে ছোট পানু রূপকথা বুনতো এক আনতনয়না হুর তাকিয়ে আছে পাপ-পূণ্যে বোনা পৃথিবীর দিকে, ভাবছে কোন পিতার কথা কিংবা কোন বীরকে যে ক্রমাগত কেটে চলেছে পাপের একানব্বই হাজার বিকট মাথা। সেই নারী বাগানের এক কোটি ফুল তুলে নিলে যার দুটো নতুন চোখ হয় আর পুরনো চোখ খুলে ও সাজায় সিংহাসন। যত চোখ রাখবে ততই উজ্জ্বল হবে মানুষের জন্য তার তপস্যার মসনদ। সেই দিঘল অপেক্ষার থেকে কতইবা দীর্ঘ পানুর পিতার জন্য এই অপেক্ষা! এভাবেই একদিন পানুর মনে হয় বেহেশতের ফুল খসে গেলে কখনো, ভীষণ বৃষ্টি হয়। সে এক অন্যরকম বৃষ্টি, হুরের কন্ঠি থেকে খসে পড়া ফুল ভেঙে পৃথিবীতে নামে একেকটা হুহুর ফোঁটা।
সময়ে, মুজবান হকের একই হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যে ধাতস্ত হয়েছিল জয়তুন। ফিরে আসবে এই ভরসায় কিংবা চার পাঞ্জাবীর সুরতে ফেরেশতাই মা-ছেলেকে দেখে রাখছে- এই বিশ্বাস ওকে সান্ত্বনা দিয়েছে, দিয়েছে সাহস। আর পানু বুঝতে শিখেছে আব্বা ফুটে ওঠে ঠিকই, তবে সে গাছের নাম রহস্য। কেননা ওদের কখনোই জানা হতো না কোথায় হারিয়ে যেত মুজবান হক। ওসব প্রকাশে গুরুর নিষেধ ছিল। জয়তুন তাই হাওয়ায় পাঞ্জাবী দাঁড়িয়ে গেলে, স্বামীর মঙ্গল কামনায় নফল নামাজ পড়তো। ছেলেকে বলতো কাঠের ফ্রেমের মাথায় চারটে টুপিও টাঙিয়ে দিতে। 'উনি গায়েবি হইছেন'- ঘটনা প্রচার করতে ছোট পানু মসজিদে ছোটতো, দোয়া চাইতে। তখন খুব দেখতে আসতো লোকে। টহলরত কাঠের সেনাপতিদের প্রতি শ্রদ্ধা, বিনয়ে, ভয়ে ঘুরপাক খেত মহল্লার মানুষ। কখনো সখনো মানতের সুতো পড়িয়ে, মানতের শাক-মাছে পাঞ্জাবীতে বাসনার আঁশটে গন্ধ তুলে জয়তুনের ষোলরকম গজগজানি শুনতো।
লোকদের আগ্রহে ভাটা পড়তে পড়তে আবার ঠিকঠাক ফিরে আসতো মুজবান হক। মহল্লার কোন একটা কাঁটাওয়ালা গাছ কিংবা এমন গাছ যার নিচে সভ্যতা গড়েছে অঢেল কাঁটা ঝোপ তার ডালে বসে থাকতে দেখা যেত তাকে। মুজবান হককে নামাতে গিয়ে হুজ্জত পোহাতে হতো মহল্লার মানুষদের। লোকে বলতো পরীরা ওকে অমন বেকায়দায় নামিয়ে দিয়ে যায়। পাঞ্জাবীগুলো তখন সরে যেত। মুজবান হক ভোরে মহল্লার ঘুমগুলো ভাঙার আগে, পুকুরের পানি অপবিত্র হওয়ার আগে, জলে ভাসিয়ে, প্রথম রোদে শুকিয়ে, শেষ রোদ বরাবর বসে ভাঁজ করে, ন্যাপথালিনের গুটির ঘ্রাণে মাখোমাখো করে সিন্দুকে তুলে রাখতো পাঞ্জাবীগুলো আবার এক হারিয়ে যাওয়া দিনের সম্ভাবনায়। আর কাঠগুলো নিয়ে মুজবান হক আবার হয়ে যেত এই মহল্লার একমাত্র কাঠ খেলনার কারিগর। অনেক বছর পরে মহল্লার নতুন ডাক্তার খেলনা দেখে বলেছিল 'এই কাজের সাথে তুলনা চলে একমাত্ৰ চান্নাপাতান খেলনার। যে খেলনার জন্য টিপু সুলতান পারস্য থেকে কারিগর আনিয়েছিল।'
অবশ্য ততদিনে উল্টে যায় ক্যালেণ্ডারের অনেক পাতা যেখানে ছিপ হাতে বসে থাকে একেকটা তারিখ আর বিহ্বল ঘটনার টোপে আটকে ফেলে এইসব জীবন। এমনই এক তারিখে মুজবান হক ফেরেনি আর, তারিখবন্দী পাঞ্জাবীতে ন্যাপথালিনের গন্ধ লাগেনি আর। এমনই এক তারিখে পানু দেখেছে খেলনা ঘরে ঝুলন্ত মাছ হয়ে গেছে ওর মায়ের আকুল মুখ। পানুর উঠোনে জন্ম হয়নি কোন তাবিজ গাছের। শুধু তারিখ থেকে তারিখে বেসামাল ছুটতে ছুটতে মহল্লার লোকেদের হঠাৎ খেয়াল হয়- পাঞ্জাবীগুলো কবে থেকে যেন আর নেই, হয়ে গেছে চারটে আমলকী গাছ। মহল্লারই কেউ একজন তখন বলেছে 'ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর সদা বিরাজমান এই গাছে। এর প্রতি শাখায়, প্রতি পাতায় ঋষি, দেবতা ও প্রজাপতিগণ বাস করেন।' একটা সময় পরে আমলকী গাছগুলো শুধুমাত্র আমলকী গাছ হয়েই মহল্লার জীবনগুলোতে বাতাস ছড়িয়ে গেছে। ভেলকিবাজি দেখতে
নয়, সময়ে অসময়ে শিশু, গর্ভবতী, অসুখে পড়া মানুষ গোপনে অস্বস্তি আর অস্তিত্ব জানান দিয়েছে আমলকীর খোঁজে। আর প্রতিবারই শুনেছে বড়োবেলার ছোট পানু খেলনা ঘরে ঠুক-ঠাক করছে ঠিক মুজবান হকের মতন। যেন জানান দিচ্ছে ঐতিহ্যকে সাজিয়ে নয়, ধারণ করতে হয়।
আর পানু যেন আমলকী গাছ ঘেরা যাদুর ভেতর খেই হারিয়ে ফেলা এক বামন দৈত্য। নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ ওরা পায়নি, তবু মহল্লার বাসিন্দাদের মনে হতো পৃথিবীর সবথেকে ছোট পুরুষ মানুষ এই পানু, শরীরে রোদজ্বলা তেজ। তাই কৌতূহলী, উদার, শয়তান- ওকে উৎপাত করার সাহস হতো না কারোরই। শুধু ইসলামপুরের খেলনার কারখানা থেকে অর্ডার নিতে মাইক্রোবাস আসলে ওরা সমারোহে ভিড় জমাতো পানুর বাড়ির সামনে, ভাঙাচোরা ডাকঘরের পাশে ঠাট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পানুকে ঘিরে।
তবে একদিন উৎপাত শুরু হয় এই বাড়িতে। সেবার মহল্লায় খবর রটে বারেক চানের উঠতি মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা। 'বাপ কে' জিজ্ঞেস করলে দ্বিতীয় দফা মারের পরে মেয়ে পানু পানু বলে জ্ঞান হারায়। প্রথমটায় বাড়ির মানুষ ভেবেছিল বুঝি পানি চাইছে, রহস্য উন্মোচন হলে লোকের মাথায় তড়াক করে নামে একশ রকম দা। আমলকী, খেলনার প্রলোভন দেখিয়ে 'দুই ফুইট্যা' পানু বদমাশী করেছে! হতে পারে ওদের গভীরে ঘটে গেছে সহজ চিরন্তন আকর্ষণ, যে আকর্ষণ লক্ষ প্রজাপতির হয়, ফড়িংয়ের হয়, পাখিদের হয়। বুঝি হুহু করা হঠাৎ বৃষ্টির দিনে, যেদিন হুরের কন্ঠি থেকে খসে যায় বেহেশতের ফুল, আমলকী নিতে আসা মেয়ে খানিকটা ভিজে অনেকখানি ভিজে যাওয়া এড়াতে চাতালে দাঁড়িয়েছিল। খেলনা ঘর থেকে বেরিয়েছিল পানু, হাতে তার সদ্য শেষ করা কাঠের লাল স্ট্রবেরি। ছোট্ট পুরুষকে দেখে কেমন এক ঘোর হয় মেয়ের, না ঠিক ঘোর নয়। মেয়ে তাকে আবিস্কার করে, আবিষ্কার করে উপহার টকটকে স্ট্রবেরী, তারপর দিনে দিনে ভ্রমণ…
চেরোকী আদিবাসীরা পৃথিবীকে এক পুরনো গল্প দিয়েছিল- পৃথিবীর প্রথম নারী একদিন ভীষণ ঝগড়ার পরে রাগ করে বেরিয়ে যায়। পৃথিবীর প্রথম পুরুষ বাঁধা দেয়নি তাকে। তারপর রাগ পড়ে এলে, নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঘর থেকে ছুটে যায় ঠিকই অথচ কোথাও খুঁজে পায় না স্ত্রীকে। ধুকপুক নিয়ে পুরুষ প্রার্থনা করে 'ঈশ্বর আমি যেন ওকে হারিয়ে না ফেলি, আমাকে একবার বলার সুযোগ দাও বড়ো যে ভালোবাসি তাকে।' কাতর প্রার্থনায শুনে দয়াময় ঈশ্বর অনেক অনেক দূরে চলে যাওয়া অভিমানীর পথে ব্লুবেরি ফুটিয়ে দিলেন, অভিমানী মেয়ে খেয়াল করে না। তারপর ঈশ্বর একে একে ফুটাতে থাকেন ব্ল্যাকবেরী, হাকলবেরী, না, মেয়ের চোখে পড়ে না ঈশ্বরের আয়োজন। শেষে ঈশ্বর পথের পাশে ফুটিয়ে দিলেন স্ট্রবেরী। লাল বিস্ময়ে চমকে গেল মেয়ে, থমকে গিয়ে মুখে দিল বিস্ময়, নিমেষে অভিমান রাগ মিলিয়ে গেল গোধূলির দিকে। কী যে এক হুহু বুকে উঠে তার! আঁচলে স্ট্রবেরী নিয়ে ফিরে যায় পেছনের পথে, যেখানে ছুটে আসছে আরেক হুহু। পথ হারিয়ে যায়, ভালোবাসা হারায় না, ফুটে থাকে একেকটা লাল হুহুর বাঁকে। হয়ত এমনই হুহুর বাঁকে পানু আর মেয়ের হয়েছিল দেখা। কাকতালীয়ভাবে মেয়ে আবিষ্কার করেছিল উজ্জ্বল স্ট্রবেরী। পানুর জন্য কোনদিন কোন ঘটকের আসার দায় ছিল না। তাই ওরা মিশে গিয়েছিল পাখি আর পোকাদের ভিড়ে।
নিশ্চিত জবরদস্তি নাকি দু'দিকের সাড়ায় সেই রহস্য অনিশ্চিত থেকে যায় কেননা মহল্লার মানুষের চিচিং ফাঁক বলতে অস্বস্তি হয়। বামনের শক্তিই বা আর কতটুুুকু যে এই ধিঙি মেয়ে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি- ভাবলেই বারেক চানের মাথা গরম হয়ে যায়। বামনের সাথে বিয়ের সমাধান মনঃপুত হয় না বলে জ্বালা আরো গভীর হয়। আর তরুণেরা যারা যৌবনকে, নারীকে আবিষ্কার করতে উম্মুখ অথচ যাদের মাত্র পাঁচ আনা সুখ মেলে গোপনে কেনা বই আর ফোনের ঘোলমাখা অভিজ্ঞতায় তারা কল্পনা করে থৈ পায় না কী করে ঐ দু-আড়াই ফুট মানুষটাকে দিয়ে সম্ভব হয় সুখেল বীজ ফোটানো! হলোই বা সম্ভব, এত পানিপ্রার্থীর ভিড়ে কেন বামনকেই বেছে নিতে হবে মেয়ের! ওদের কবুতর পুরুষত্বে আঘাত করে ঈর্ষার ছুরি। আমলকী গাছের বাড়িতে ঈর্ষারা ভাঙচুর করে। পানুকে ছাতু করা হয়েছে শোনা যায় কিন্তু ছাতুর ধরন বুঝা যায় না। শুধু সে রাতে বারেক চানের মেয়ের চিৎকার শোনা যায়। হয়ত বাবা ওকে আবার মারে কিংবা সন্তানের ভবিষ্যৎ বা পানুর জন্য ভাবনায় শিৎকার ভেসে ওঠে। হয়তবা ওর মা ব্লাউজে আটকানো ঐ হুহু বুক থেকে টেনে বের করে আনে লুকানো টুকটুকে স্ট্রবেরী, তাই এত যন্ত্রণা ওর।
না, খেলনার কারিগর বামন পানুকে ক্যাচালের নিরপেক্ষ দলে থাকা কৌতুহলী আমরা দেখতে পাই না। বরাবরের মতই। তবে মহল্লার ছোট ছোট পোলাপানরা এক সকালে একটি ঘটনার বয়ান দেয়- আমলকী গাছে ঝুলে আছে সারে সারে কাঠের খেলনা, যেন ক্রুশবিদ্ধ যীশু। দূরে তখন উথলে ওঠেছে একটা নতুন কান্না। আমলকী গাছের ক্রশবিদ্ধ খেলনারা বামন যীশু হয়ে দোল খেতে থাকে- আছি আছি আছি।