"ত্রাতা হিসেবে উদয় হও হে প্রভু"... আমার মতো এক ঘোর নাস্তিকও বিড়বিড় করে ফেললো, যখন বিরামহীন প্রবল বৃষ্টির মধ্যে গিয়ে রাত ন'টায় নামলাম চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশনে। হঠাৎ ঠিক হয়েছে, তাই তৎকালে ট্রেনের রিজার্ভেশনটা হলেও পছন্দসই হোটেল পাওয়া যায়নি। তাই কর্তামশাই সদর্পে ঘোষণা করলেন, "নো প্রব্লেম, চেন্নাই তো, গিয়েই হোটেল বুকিং করবো। আমি তো ওখানে চাকরি করে এসেছি!" অগত্যা... মনকে তখন প্রবোধ দিলাম, "এছাড়া উপায়ইবা কী?"
সেই দ্বিসাপ্তাহিক পূজা স্পেশাল ট্রেন তো প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা মত লেট। রাতে কোথাও অপরিচিত জায়গায় পৌঁছনো, তার মধ্যে আবার হোটেল বুকিং নেই! আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে, মেয়ে দিব্য আছে, ঝামেলা দেখলেই কানে ইয়ার ফোনটা গুঁজে রাখছে, ওকে কিছু শোনাতে গেলে আশপাশের লোকেরা হাঁ করে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
বিভ্রাট শুরু হলো ট্যাক্সি ধরা থেকেই, দক্ষিণ ভারতীয়রা এমন অদ্ভুত কায়দায় মুন্ডু হেলায় যে দেখেই একনজরে বোঝে কোন বঙ্গসন্তানের বাপের সাধ্যি তারা "হ্যাঁ" বলছে নাকি "না" বলছে? যাইহোক ভ্রমণসঙ্গী বইখানা থাকাতে এবং গুগল ম্যাপের সাহায্যে একটা হোটেল শেষপর্যন্ত জোগাড় হলো বটে, তবে গোল বাধলো খাওয়া নিয়ে। নবরাত্রি উপলক্ষে এদের নিজস্ব ভোজনালয়টি বন্ধ। ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে এগারোটা, সঙ্গে কোনও খাবার নেই, বাইরে মুষলধারে বর্ষণ, রাস্তায় জমা জল কলকাতাকে হার মানাবে। তবু বেরোতেই হলো, পাপী পেট কা সওয়াল! গত সাত-আট ঘন্টlয় পেটে ভারী কিচ্ছু পড়েনি, পেটে অত্যন্ত আবেগাভূত হরিনাম সংকীর্তন চলছে। অতএব খাদ্যানুসন্ধানে প্রায় মধ্যরাতে। কলকাতার উপকন্ঠে নিজের ঘরের সুখ ফেলে রেখে একটি ভ্রমণপিপাসু বাঙালী পরিবার হাঁটুসমান জল ঠেলে নির্বান্ধব চেন্নাইয়ের শুনশান পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে! হায় হায়, কর্তামশাইয়ের চেন্নাইয়ে চাকরি করে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বিলকুল মাঠে মারা! ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! সেই নবরাত্রি! সম্পন্ন দোকানপাট সব নিশ্ছিদ্র বন্ধ!
এদিক ওদিক তাকিয়ে অবশেষে তুলনায় ছোট ও সাধারণ মানের একটা খাবারের দোকান খুঁজে পাওয়া গেলো এবং তারাও দোকান বন্ধের তোড়জোড় করছে। মালিকটি একটু নরম মনের। আমাদের হিংলিশ বিবরণী শুনে তিনি একটি ছোকরা কর্মচারীকে ডেকে দুর্বোধ্য ভাষায় নির্দেশ দিয়ে আমাদের ইশারায় বসতে বললেন এবং খানিক বাদে পরমঠা নামে কিম্ভুত এক বস্তু মারকাটারি ঝাল আচার সহযোগে তিন প্লেট এসে হাজির হলো। রাত সাড়ে বারোটায় নাকের ও চোখের জল সামলাতে সামলাতে ভোজনপর্ব সমাধা হলো। আর যথারীতি খাবার আসার আগের মূহুর্ত পর্যন্ত কর্তামশাই এইসমস্ত কিছু হয়রানির জন্য আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করে দিলেন ----- যেমন ট্রেন লেট ------ ট্রেন সিলেকশনে ভুল ছিলো। আগে হোটেল বুকিং হয়নি ------ প্ল্যানিংটা করতেই আমি দেরী করেছি! খাবার শেষ ----- কারণ জামাকাপড় দশদিনের জন্য দুটো সেটই যথেষ্ট, সুতরাং আর লাগেজ না বাড়িয়ে ট্রলী ব্যাগের বাকী ফাঁকা অংশটায় নাকি খাবার ভর্তি করা উচিৎ ছিলো! এতক্ষণ চুপচাপই ছিলাম, কিন্তু আর সহ্য হলো না, ভাবলাম এবার একটা যুৎসই উত্তর দিই , "আর বৃষ্টিটাও কী আমার জন্যই নাকি?" মেজাজটা আমার চড়েই ছিল এবার গলাটাও চড়লো।
এইসময় টেবিলের তলা দিয়ে মেয়ে পা দিয়ে খোঁচা মারলো। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি দোকানের মালিক থেকে কর্মচারী সবাই মোটামুটি বত্রিশ পাটি দন্তব্যাদন করে আমাদের ঝগড়াটা দিব্যি উপভোগ করছে। ভাষা বুঝছে না তো তাতে কী? উত্তেজনাটা বেশ ভালোই বুঝছে। তারপর সেইসময় কানে যা শুনলাম তাতে আমি পুরো কিস্তিমাত! আমার জুলাই মাসে জন্ম এবং আমি সাথে আছি তাই নাকি শেষ অক্টোবরেও এত বৃষ্টি!
সেদিন থেকে বাড়ী ফেরা পর্যন্ত আরও তেরো দিন কর্তামশাইয়ের সঙ্গে বাক্যালাপ পুরো বন্ধ রইলো। গোটাটা ট্রিপ জুড়ে মেয়ে মেসেঞ্জারের কাজ করে গেলো। যদিও পরেরদিন থেকেই সম্ভবতঃ কর্তামশাই নিজের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্তের উদ্দেশ্যে বারবার আমার পছন্দের খাবার-দাবার কিনে বারবার মেয়েকে দিয়ে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, কিন্তু বরফ গলাতে পারেননি, বলাই বাহুল্য! তবে বেড়ানোটি কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত হয়নি। বরং অপেক্ষাকৃত তাড়াহুড়োবাজিটা কম হওয়ায় বেশ গুছিয়ে ছবি তোলা এবং স্থানমাহাত্ম্য কাহিনী উপভোগ করা গেছে।
এইফাঁকে এই ঝগড়ার সুফলটুকু চুপিচুপি সকলকে বলি... চুটিয়ে ইচ্ছেমত শপিং করলাম বিনা কোনো রোক-টোকে। আমার রোষকষায়িত নেত্রের চাহনিতে সেবার কর্তামশাই কলকাতার উপকন্ঠে নিজেদের বাড়িতে ফেরা পর্যন্ত এক্কেবারে ক্লিন বোল্ড!
-----------------------------------
© সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী