এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • Beauty is truth, truth beauty-মানে কী গুরু? ভক্করচক্কর?? 

    Feroz Ahmed লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৬ অক্টোবর ২০২০ | ৬০২৬ বার পঠিত
  • কীটসের 'Beauty is truth, truth beauty-' নিয়ে দুনিয়াজোড়া পাঠকসমাজে মাতামাতি যত বেশি বুঝাবুঝি যেন ততটাই কম। এই পংক্তিটি নিয়ে বাঘা বাঘা ক্রিটিকদের মধ্যে বিংশ-একবিংশ শতকজুড়ে বিতর্কও কম হয়নি। নিচের উইকিপিডয়া লিংকটিতে গোছানোভাবে সেই বিতর্কের বিবরণ দেওয়া আছে।

    'Beauty is truth, truth beauty-' নিয়ে বিতর্কের উইকিপিডিয়া নিবন্ধের লিংক:
    https://en.wikipedia.org/wiki/Ode_on_a_Grecian_Urn (Critical response অংশ পড়ুন)

    সাধারণভাবে ভেবে দেখলে কীটসের 'Beauty is truth, truth beauty-' কথাটির কোনো অর্থ হয়না। ক্রিটিকদের অনেকেই এই মত পোষণ করেন, যেমন:

    Bridges believed that the final lines redeemed an otherwise bad poem.

    Sir Arthur Quiller-Couch responded with a contrary view and claimed that the lines were "a vague observation – to anyone whom life has taught to face facts and define his terms, actually an uneducated conclusion, albeit most pardonable in one so young and ardent." (উপরের লিংক থেকে উদ্ধৃত)

    Quiller-Couch এর বক্তব্য সোজা বাংলায় বললে মোটামুটি এরকম হয়:

    "জীবনে যারা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে আর যাদেরকে লাথি-গুঁতো খেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়েছে তাদের কাছে এটি (Beauty is truth, truth beauty) নিতান্তই একটি অর্থহীন পর্যবেক্ষণ- সত্যিকার অর্থে এটা নির্বুদ্ধিতাজাত কথা। যাহোক, অর্বাচীন কবির কাঁচা আবেগ বিবেচনায় তাকে ক্ষমা করা যায়।"

    বাপরে বাপ!

    'Beauty is truth, truth beauty-' পংক্তিটিকে কেউ আবার 'ছদ্ম-বিবৃতি' বলে একরকম (অব)মূল্যায়ন করেছেন। যেমন:

    A. Richards, an English literary critic who analysed Keats's poems in 1929, relied on the final lines of the "Ode on a Grecian Urn" to discuss "pseudo-statements" in poetry:

    "Pseudo-Statements" বা 'ছদ্ম-বিবৃতি' বিষয়টিকে সহজ বাংলায় এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- "এমন গালভরা উক্তি যার মধ্যে কোনো সারবত্তা নেই"। "pseudo-statements" দিয়ে লেখক আসলে কিছু বোঝাতে চান না, লেখার খাতিরে কিংবা একটা পরিস্থিতি তৈরির খাতিরে শুধুই একটা বিবৃতি দিতে হয় তাই সেটি লিখে দেন- সেটি দ্বারা আদৌ কোনোকিছু বোঝাতে চান না, সেটির আদৌ কোনো অর্থও হয় না। A. Richards-এর মতে 'Beauty is truth, truth beauty-' হলো সেই ধরনের একটা "pseudo-statements" যেটা কীটস তার Ode on a Grecian Urn কবিতার শেষভাগে এসে প্রবল আবেগ সামলাতে না পেরে আর সুন্দরের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় জারিত হয়ে ফস করে বলে ফেলেছেন- বিশেষ কোনো অর্থজ্ঞাপন ছাড়াই।

    এই দু'জন মহারথী ক্রিটিকের কথা এক হিসেবে সত্যি। কারণ আমরা সাধারণ পাঠক 'Beauty is truth, truth beauty-' নিয়ে যতই মুগ্ধতা প্রকাশ করি না কেন। আসলে কথাটির অর্থ তেমন কিছু বের করতে পারি কিনা জানিনা। উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। 'Beauty is truth, truth beauty-' উক্তি অনুযায়ী ধরা যাক, 'ফুলটা সুন্দর' তার মানে 'ফুলটা সত্য', 'প্রকৃতি সুন্দর' অতএব 'প্রকৃতি সত্য', ' Grecian Urn সুন্দর' [এই নিবন্ধে এরপর থেকে গ্রেসিয়ান আর্ন-কে 'ভস্মাধার' (ভস্ম বা ছাই রাখার পাত্র)-ও বলা হবে] অতএব, 'ভস্মাধার সত্য'। এখন 'ফুল সত্য', 'প্র্রকৃতি সত্য', 'ভস্মাধার সত্য'- এসব কথার কী মানে? এগুলোর আদৌ কী কোনো অর্থ হয়?

    এরপর উইকিপিডিয়ার লিংকটিতে টি.এস এলিয়টের বক্তব্য সম্পর্কে এভাবে বলা আছে:

    Poet and critic T. S. Eliot, in his 1929 "Dante" essay, responded to Richards:

    I am at first inclined to agree ... But on re-reading the whole Ode, this line strikes me as a serious blemish on a beautiful poem, and the reason must be either that I fail to understand it, or that it is a statement which is untrue. And I suppose that Keats meant something by it, however remote his truth and his beauty may have been from these words in ordinary use. And I am sure that he would have repudiated any explanation of the line which called it a pseudo-statement ... The statement of Keats seems to me meaningless: or perhaps the fact that it is grammatically meaningless conceals another meaning from me.

    এলিয়ট তবু স্বীকার করেছেন যে, কীটসের এই বিখ্যাত পংক্তিটির কোনো 'অর্থ থাকলেও থাকতে পারে' অথবা এটা 'অসত্য'ও হতে পরে (either that I fail to understand it, or that it is a statement which is untrue)। তিনি বলেছেন, কীটস হয়ত 'সত্য' ও 'সুন্দর' শব্দদুটির সাধারণ ব্যবহার থেকে অনেক অনেক দূরবর্তী কোনো অর্থে সেগুলোকে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু এলিয়ট তা বুঝতে পারেননি।

    সমালোচক John Middleton Murry-র বক্তব্য হলো: My own opinion concerning the value of those two lines in the context of the poem itself is not very different from Mr. Eliot's.

    ইনিও এলিয়টের মতো নিজের না বোঝার দায় স্বীকার করার ভান করে মূলত কীটসের উপরেই দায় বর্তিয়েছেন।

    তবে সমালোচক Cleanth Brooks পূর্ববর্তীদের থেকে আরও খানিকটা অগ্রসর হয়ে বরং কীটসকে মৃদুভাবে সমর্থন করার চেষ্টা করেছেন। যেমন:

    Cleanth Brooks defended the lines from critics in 1947 and argued:

    We shall not feel that the generalization, unqualified and to be taken literally, is meant to march out of its context to compete with the scientific and philosophical generalizations which dominate our world. 'Beauty is truth, truth beauty' has precisely the same status, and the same justification as Shakespeare's 'Ripeness is all.' It is a speech 'in character' and supported by a dramatic context.

    ইনি বলতে চেয়েছেন কীটসের এই 'সুন্দরই সত্য, সত্যই সুন্দর' বক্তব্যটিকে সাধারণীকরণ (Generalize) করার দরকার নেই, এটিকে 'দার্শনিক সত্য' বা 'বৈজ্ঞানিক সত্য'র সাথে একপাল্লায় মাপার দরকার নেই। এটি মূলতঃ একধরনের speech 'in character'. মোটাদাগে স্পিচ 'ইন ক্যারেক্টার' হলো এমন 'বক্তব্য' যেখানে লেখক তার রচনার (কবিতা, নাটক, উপন্যাস) মধ্যে একটি তীব্র, সংঘাতময় অথবা আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি করেন এবং সেই পরিস্থিতিতে কোন একটি 'character' 'চরিত্র' বা 'পাত্র-পাত্রীর' মুখে একটি 'বক্তব্য' সেঁটে দেন বা তাকে দিয়ে এমন একটি বক্তব্য বলিয়ে নেন যে বক্তব্যটিকে ঐ পরিস্থিতিতে জীবনঘনিষ্ঠতার মাপে আপততঃ হলেও সঠিক বলে মনে হয়। এটিই হলো- speech 'in character'. এই স্পিচ 'ইন ক্যারেক্টার' যে সবসময় 'বৈজ্ঞানিক সত্য' বা 'দার্শনিক সত্য' হবে তার কোনো মানে নেই। যেমন: সেক্সপিয়রের 'Ripeness is all.' আবার ইউটিবে বাংলায় ডাবিং করা 'কাইশ্যা' নামের একটা মজার ভিডিও পেয়েছিলাম (যদিও শিল্পরুচিজাত কিছু নয়)। এই ফানি মুভিতে মাঝে মাঝে এমন হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যেখানে কাইশ্যা বলে 'জীবনটা বেদনা'। তখন সেই পরিস্থিতিতে, সেই মুহূর্তের জন্য 'জীবনটা বেদনা' কথাটিকে মজার উপায়ে (in funny ways) 'সত্য' বলে মনে হয়। কিন্তু 'জীবনটা বেদনা'- বক্তব্যটি দার্শনিকভাবে বা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। এগুলো speech 'in character'.

    আবার কবি-লেখকরা তাদের লেখায় বিভিন্ন কাল্পনিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। সেইসব পরিস্থিতি বা ঘটনা একধরনের 'সম্ভাব্যতা' মাত্র। যেটি আগে কখনও না-ও ঘটে থাকতে পারে। তবে মানবজীবনের ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় সেরূপ ঘটা 'সম্ভব'। এমন 'সম্ভাবনাপূর্ণ' সত্যকে বলা হয় 'Poetic Truth'. কীটসের 'Beauty is truth, truth beauty' সেই ধরনের Poetic Truth-ও হতে পারে।

    Cleanth Brooks "Beauty is truth, truth beauty-" কে speech 'in character' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। স্পিচ 'ইন ক্যারেক্টার' হলো এমন 'বক্তব্য' যেখানে লেখক তার রচনার (কবিতা, নাটক, উপন্যাস) মধ্যে একটি তীব্র, সংঘাতময় অথবা আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি করেন এবং সেই পরিস্থিতিতে কোন একটি 'character' 'চরিত্র' বা 'পাত্র-পাত্রীর' মুখে একটি 'বক্তব্য' সেঁটে দেন বা তাকে দিয়ে এমন একটি বক্তব্য বলিয়ে নেন যে বক্তব্যটিকে ঐ পরিস্থিতিতে জীবনঘনিষ্ঠতার মাপে আপততঃ হলেও সঠিক বলে মনে হয়। যাহোক, সমালোচক Hugh Kenner এটিকে speech 'in character' ধরে নিয়ে এভাবে মূল্যায়ন করেছেন:

    Hugh Kenner, in 1971, explained that Keats "interrogates an urn, and answers for it, and its last answer, about Beauty and Truth, may seem almost intolerably enigmatic".

    To Kenner, the problem with Keats's Beauty and Truth statement arises out of the reader's inability to distinguish between the poet, his reflections on the urn, and any possible statement made by the urn. He concluded that Keats fails to provide his narrator with enough characterization to be able to speak for the urn. (উইকিপিডিয়া থেকে)

    এখানে Hugh Kenner এটাও বলেছেন যে, কীটস যে 'চরিত্রের' মুখে "Beauty is truth, truth beauty-" সেঁটে দিয়েছেন সেই 'চরিত্র'টিকে ভালোভাবে গড়তে (Develop করতে) পারেননি। ফলে, পাঠকের কাছে বিষয়টা বিভ্রান্তিকর থেকে গেছে।

    যেসব প্রাজ্ঞ সমালোচক "Beauty is truth, truth beauty-" কে speech 'in character' ধরে নিয়েছেন তাঁরা বোঝাতে চান যে, এই কবিতার বর্ণনাকারী কবি (কীটস) নিজে নন, বরং কীটস এখানে একটা 'চরিত্র' তৈরি করেছেন যে কি-না সেই গ্রীসীয় ভস্মাধারটি (Grecian Urn) দেখে মুগ্ধ হয়ে কবিতা রচনা করছে। তাঁদের মতে, 'আসল কবি' কীটস এখানে ভিন্ন আরেকটি 'কবি-চরিত্র' অথবা 'দর্শক-চরিত্র' তৈরি করেছেন। সেই বানোয়াট 'কবি' বা 'দর্শক' চরিত্রটিই এখানে "Beauty is truth, truth beauty-" বক্তব্যটি প্রকাশ করেছে। তার মনে হলো "Beauty is truth, truth beauty-" একটি স্পিচ 'ইন ক্যারেক্টার'।

    আসলে, আমরা যারা প্রাচ্যের পাঠক তাদের পক্ষে পশ্চিমা সমালোচকদের এইসব 'কারিগরি জটিলতাগুলি' বোঝা বেশ কঠিন। Hugh Kenner ধারণা করেছেন: কবিতার আসল কবি কীটস তো একটা বানোয়াট কবি চরিত্র তৈরি করেছেন, আবার সেই বানোয়াট কবি সেই গ্রীসীয় ভস্মাধারকে দিয়ে 'Beauty is truth, truth beauty' উক্তিটি করিয়ে নিয়েছেন। তবে Hugh Kenner পাশাপাশি এই মতও প্রকাশ করেছেন যে, আসল কবি কীটস সেই বানোয়াট 'কবি' বা 'দর্শক' চরিত্রটিকে ভালোভাবে গড়তে (Develop করতে) পারেননি। ফলে, সবমিলিয়ে পাঠকের কাছে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে যে, আসলে কে এই 'Beauty is truth, truth beauty'- বক্তব্যটি দিয়েছে; 'আসল কবি' কীটস, নাকি বানোয়াট 'কবি' বা 'দর্শক' চরিত্র নাকি 'গ্রীসীয় ভস্মাধার' নিজে?- এই হলো সমালোচক Hugh Kenner এর মতামত।

    এসব 'কারিগরি জটিলতা'র বাড়বাড়ন্ত আমাদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়। আমার মতে, এখানেই প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য। পাশ্চাত্যের প্রাজ্ঞ সমালোচকগণ এখানে কবিতাটির 'কারিগরি' (গঠন, শৈলী, তত্ত্ব ইত্যাদি) দিকের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে সেখানেই আটকে থেকেছেন। আমার মতে, এখানে একটা সহজ জিনিসকে সহজভাবে বুঝলেই আরেকটু এগুনো যায়। ধারণা করি, কীটস এখানে Hugh Kenner কথিত ভিন্ন কোনো 'কবি' বা 'দর্শক' চরিত্র তৈরি করেননি। কবিতার বর্ণনাকারী স্বাভাবিকভাবেই কীটস স্বয়ং। কীটস এখানে সেই গ্রীসীয় ভস্মাধারের মাধ্যমে 'Beauty is truth, truth beauty' কথাটি বলিয়ে নিয়েছেন। এখানে তো জটিলতার কিছুই নেই।

    প্রকৃত জটিলতা যেখানে বেঁধেছে সেটা হলো: কীটস যখন গ্রীসীয় ভস্মাধারের মাধ্যমে 'Beauty is truth, truth beauty' কথাটি বলিয়ে নেন তখন সেটি বাস্তবপক্ষে তো 'Beauty' ও 'Truth' সম্পর্কে স্বয়ং কীটসেরই 'বক্তব্য'। তাই নয় কি? এখন, পাশ্চাত্যের প্রাজ্ঞ সমালোচকদের অসুবিধার জায়গা হলো 'Beauty is truth, truth beauty'- কথাটিকে যদি কীটসের বক্তব্য কিংবা কীটস-সমর্থিত বক্তব্য বলে ধরা হয় তাহলে 'Beauty is truth, truth beauty' কথাটি পাঠকের সামনে একটি 'তত্ত্ব' বা Theory হিসেবে হাজির হয়। এটাই হলো পাশ্চাত্যের প্রাজ্ঞ সমালোচকদের মধ্যে এতসব বিতর্কের 'আসল রহস্য'। তাঁরা 'Beauty is truth, truth beauty' কথাটিকে কোনোভাবেই একটি 'তত্ত্ব' বা Theory হিসেবে মানতে পারছেন না। তাই তাঁরা 'Beauty is truth, truth beauty' কথাটিকে Theory-র মর্যাদা থেকে খারজি করার জন্য এবং 'Beauty is truth, truth beauty' বক্তব্যটিকে একরকম 'ফালতু' বা 'গুরুত্বহীন' করে তোলার জন্য নানা 'কারিগরি' উপায় খুজেছেন। 'Beauty is truth, truth beauty'- কথাটিকে কখনও Speech 'in character' কখনও 'Poetic Truth' ইত্যাদি অভিধা প্রদান করে এটিকে Theory- মর্যাদা থেকে খারিজ করার চেষ্টা করেছেন। আমার মতে, এই প্রচেষ্টার কারণ হলো, 'Beauty is truth, truth beauty'-কে একটি 'তত্ত্ব' বা Theory হিসেবে তারা কোনোভাবেই সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারছেন না- আগামাথা খুঁজে পাচ্ছেন না। কারণ হলো, বস্তবাদী আবহের মধ্যে থেকে প্রাজ্ঞ সমালোচকগণ যত ভিন্ন ভিন্ন কথাই বলুন না কেন একটা কথার ব্যাপারে তারা সবাই একমত, যে কথাটি Quiller-Couch বলেছিলেন। (এটির উল্লেখ আগেও করা হয়েছে) Quiller-Couch বক্তব্য সোজা বাংলায় বললে মোটামুটি এরকম হয়: "জীবনে যারা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে আর যাদেরকে লাথি-গুঁতো খেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়েছে তাদের কাছে এটি (Beauty is truth, truth beauty) নিতান্তই একটি অর্থহীন পর্যবেক্ষণ- সত্যিকার অর্থে এটা নির্বুদ্ধিতাজাত কথা।"

    এবার আসা যাক মিলিয়ন ডলার প্রশ্নে।

    এই প্রশ্নটাই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের জায়গা। পাশ্চাত্য কখনই Beauty is truth, truth beauty কথাটিকে তার নিজের জায়গা (বস্তবাদ) থেকে সঠিকভাবে বুঝতে, ব্যাখ্যা করতে এমনকি মানতেও পারবে না। এটা কোনো দোষারোপের বিষয় নয়, এটা বাস্তবতা, পশ্চিমের বাস্তবতা। আর আমরা Beauty is truth, truth beauty কথাটিকে আমাদের জায়গা (ভাববাদ) থেকে সুন্দর একটা Theory হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারি বা পারব, এটা আমাদের বিশেষ কোনো গুণ নয়, এটাই প্রাচ্যের বাস্তবতা। অন্যদিকে, Beauty is truth, truth beauty কথাটিকে যদি আমাদের প্রাচ্যধারায় একটি Theory হিসেবে তুলে ধরা যায় তাহলেই তো আর সেটি কার বক্তব্য- 'কীটসের' নাকি 'বানোয়াট চরিত্রের' নাকি 'গ্রীসীয় ভস্মাধারের' সেই বিতর্কেরও আর দরকার হয় না। তখনে সেটিকে স্বয়ং কবি 'কীটসের' বক্তব্য হিসেবে মানতে অসুবিধা থাকে না। কারিগরি জটিলতাপূর্ণ বিতর্কেরও অবসান হয়।

    Ode on a Grecian Urn-এর শেষ স্তবকে "Beauty" বলতে কবি কী/কাকে বুঝিয়েছেন তা নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার অবকাশ আছে। আর একারণেই তার "Beauty is truth, truth beauty" বাণীটির উপযুক্ত মূল্যায়ন হয়নি বলে আমার মনে হয়, যদিও এ নিয়ে মুগ্ধতার কোনো কমতি নেই।

    বেশিরভাগ সমালোচক ধরে নিয়েছেন এখানে Beauty বলতে Grecian Urn কে বুঝানো হয়েছে। অবশ্য "O Attic shape! Fair attitude!" কিংবা "Thou, silent form" এর দিকে মনোযোগ দিলে মনে হয় যেন Beauty বলতে Grecian Urn-কেই বুঝানো হয়েছে। এগুলো থেকে জোরালোভাবেই যেন মনে হয় Beauty বলতে "শিল্পবস্তু"টিকে অর্থাৎ Urn-কে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এভাবে বুঝলে তা কবিতার মর্ম অনুধাবনে আমাদেরকে ভুল পথে চালিত করবে। আর দুঃখজনকভাবে সেটাই ঘটেছে। কবিতার শিরোনামে যতই Grecian Urn শব্দগুলো থাকুক, আর কবিতার মধ্যে যতই O Attic shape! Fair attitude! কিংবা Thou, silent form ইত্যাদি থাকুক, কবি Beauty বলতে কখনই Grecian Urn বা "শিল্পবস্তু"টিকে বোঝাননি, বরং "শিল্পের বিষয়বস্তু"কে বুঝিয়েছেন। Grecian Urn হলো সেই "শিল্পবস্ত" যার আশ্রয়ে "শিল্পের বিষয়বস্তু" দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, এবং Grecian Urn-টি সেই "বিষয়বস্তু"কে যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চালন করছে- "শিল্পবস্তু"টির গুরুত্ব কবি এতটুকুই দিতে চেয়েছেন। কিন্তু আসল সৌন্দর্য্য হলো "শিল্পের বিষয়বস্তু"। আর কীটস সেটাই বুঝাতে চেয়েছেন।

    "শিল্পবস্তু" বা Grecian Urn-এর গায়ে অঙ্কিত যৌবন, উদ্দামতা, বাঁশির সুরে মনের আনন্দ প্রকাশ, প্রেমিক-প্রেমিকার কাছাকাছি থাকা, ধর্মপালন উপলক্ষ্যে মানুষের যুথবদ্ধতা বা একত্র জীবনযাপন- ইত্যাদিকেই কবি "সুন্দর" (Beauty) বলেছেন, Grecian Urn-কে নয়।

    আর Truth বলতে অবশ্যই কোনো "বৈজ্ঞানিক সত্য" বুঝাতে চাননি। একজন কবির কাছে "বৈজ্ঞানিক সত্য"র প্রত্যাশা করার কোনো অর্থ হয়না। কীটস এখানে বলেছেন "মানবিক সত্য"র কথা। আর এই "মানবিক সত্য" ইত্যাদি বিষয়গুলো পাশ্চাত্যের পক্ষে বোঝা কঠিন, বুঝলেও তারা এগুলো নিয়ে বেশি গভীরে যেতে পারেন না কিংবা যেতে চান না। কিন্তু প্রাচ্য আবার এ নিয়েই থাকে। যাহোক, কীটস এখানে মানবজীবনের সুখ-দুঃখ, যৌবন-জরা, প্রেম-অপ্রেম ইত্যাদির পরমমূল্য নির্ণয় করতে চেয়েছেন। জীবনে সুখ যেমন আছে দুঃখও আছে যৌবন আছে তেমনি জরা ব্যাধিও আছে। আবার যৌবন, প্রেম, সুখ ইত্যাদিই বরং ক্ষণস্থায়ী; জরা, ব্যাধি, দুঃখ ইত্যাদিই বেশি। তাহলে জীবনে প্রেম 'সত্য' নাকি 'অপ্রেম' সত্য? 'সুখ' সত্য নাকি 'দুঃখ' সত্য? যৌবন সত্য নাকি জরা সত্য?- এটাই হলো কীটসের প্রশ্ন। আর উত্তর হলো: আমরা 'যৌবন' 'সুখ' 'প্রেম' 'যুথবদ্ধ জীবন' ইত্যাদি নিয়েই 'শিল্প' করি। এগুলোকেই 'সুন্দর' হিসেবে তুলে ধরি এবং 'সুন্দর' বলে মনে করি- যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। অতএব, জীবনে যতই জরা-ব্যাধি থাকুক তবুও 'যৌবন' হলো 'সত্য'। যতই অপ্রেম থাকুক 'প্রেমই সত্য'। যতই যুদ্ধ-মারামারি-কাটাকাটি থাকুক তবুও মানুষের 'যুথবদ্ধতা' বা একসাথে মিলেমিশে থাকার বিষয়টিই 'সত্য'।

    শিল্পে যদিও মাঝেমাঝে আমরা 'অসুন্দর' আঁকি বা দেখাই কিন্তু সেটা 'বিপরীতভাবে' সুন্দরকে তুলে ধরার জন্যই। যেমন শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীনের নিচের ছবিতে দুর্ভিক্ষের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে যেখানে একজন মুমুর্ষু নারীকে ডাস্টবিনের পাশে মৃতপ্রায় দেখানো হয়েছে। নারীর স্তন শুকিয়ে গেছে, পেট চিমসে গেছে, বুকের খাঁচা বেরিয়ে পড়েছে- এরকম একটি ছবি নিজে সুন্দর নয় কিন্তু দর্শকের মধ্যে 'সুন্দর' এর বোধ জাগায়। দর্শক এরকম ছবি দেখে বেদনার্ত হয়। মানবতার দুর্দশা দেখে মনে মনে কামনা করে- 'এরকম হওয়া উচিত না'। দর্শক সিদ্ধান্ত নেয়, "মানুষ সবসময় ভালো থাকুক, দু'মুঠো খেয়ে পরে সুস্থ থাকুক"। দর্শক এই সিদ্ধান্ত আসে 'সৌন্দর্য্যবোধ' থেকে এবং সেই সিদ্ধান্ত 'সত্য'। কীটস মূলত এটাই বোঝাতে চেয়েছেন।

    আর জীবনের অনেক বড় বড় কিছু সিদ্ধান্ত এই "Beauty is truth, truth beauty" অবলম্বনেই করা। যেমন: "চুরি করা ঠিক না", "মানুষ খুন করা ঠিক না" ইত্যাদি। এসব কথা যদিও ধর্মের কথা কিন্তু রাষ্ট্রেও সেটি পালিত হয়। মনে রাখতে হবে, ধর্মের সব কথা রাষ্ট্র গ্রহণ করে না। অথচ "চুরি করা ঠিক না" কিংবা "মানবহত্যা ঠিক না"- এ নিয়ে তেমন বেশি বইপুস্তক লেখা হয়নি। যেমনটা লেখা হয়েছে "গণতন্ত্র কেন ভালো" কিংবা "সমাজতন্ত্র কেন উত্তম" এসব নিয়ে। "গণতন্ত্র কেন ভালো" এ নিয়ে যত বই লেখা হয়েছে তা একজীবনে পড়ে কেউ শেষ করতে পারবে না বলেই মনে হয়। অথচ "মানবহত্যা ঠিক না" নিয়ে তেমন কোনো বইপুস্তক না লেখা হলেও সেটি সমাজে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত বিষয়। কারণ এগুলো এত বেশি 'সত্য' যে এ নিয়ে বেশি না লিখলে-বললেও চলে। এর পিছনে হয়ত উপযুক্ত কারণ আছে। এর কারণ হলো, মানুষ সমাজে ও রাষ্ট্রে একত্রে মিলেমিশে "সুন্দরভাবে" বাঁচতে চায়। আসলে, এটাই শেষকথা ও চূড়ান্তবিচার- "সুন্দরভাবে" বাঁচা। ফলে, শেষে এসে দেখা যায় সেই "সুন্দর"ই "সত্য"।

    এভাবে কীটসের কথিত শুধুই একটি কথার-কথা কিংবা ফেলনা কথা কিংবা "স্পিচ ইন ক্যারেক্টার" নয়। এটা এমন এক মানবিক 'সত্য' যার ব্যবহারিক কার্যকারিতা আছে।

    আর কীটসের এই বাণী প্রাচ্যে আমরা যেভাবে বুঝি পাশ্চাত্য এই বোঝাবুঝিকে অনেকটাই "কষ্টকল্পনা" বা Far-fetched idea মনে করে। এখানেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পার্থক্য।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন