ছোটবেলায় যখন লেখা পড়া শুরু করেছিলাম তখন বই খুললেই প্রথমে সংবিধান এর প্রস্তাবনা দেখে দেখে মুখস্ত হয়ে গেছিল। তাতে সমানাধিকার এর কথা থাকত। বর্তমান শাসক শ্রেণী ধর্মীয় মেরুকরণ ও জাতপাত নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে এই সমানাধিকার এর ব্যাপারটাই গুলিয়ে দিতে চাইছে। যে রাষ্ট্রে সাক্ষরতার হার খুব সন্তোষজনক নয় তাদের কত শতাংশ মানুষ যে এটা বুঝবে সন্দেহ। আমাদের দেশে বিলটি (সিএবি, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল) খুব কম লোকেই পড়েছে বেশিরভাগ লোকেই কিন্তু শাসক বিরোধী বক্তব্য শুনে বিভ্রান্ত এমন অবস্থায় ২০১৯ সালের ১১ই ডিসেম্বর গভীর রাতে পাস হয়ে গেল। বিলের উদ্দেশ্য ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অবৈধ অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ রয়েছে। মুসলিমদের জন্য এখানে কোন সুযোগ রাখা হয় নি। শাসকশ্রেণী বোঝাল এতে হিন্দুদের কোন অসুবিধা নেই খালি ঘুসপেটিয়াদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে, ওহ কি মজা। বিধি বাম।
৩১শে আগস্ট ২০১৯ আসাম এনার্সির তালিকা থেকে দেখলাম ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ। পাঠক এতটুকু শুনেই অবাক হচ্ছেন আর একটা তথ্য পেশ করি তার মধ্যে ১২ লক্ষ হিন্দু বাঙালির। আপনি ভাবলেন বিজেপি তো হিন্দু দের কিছু করবে না বেছে বেছে মুসলিম দের তাড়াবে, আজ্ঞে না এরকম কোন দিবাস্বপ্ন দেখলে এখুনি বেরিয়ে আসুন। বাংলার এক গো নেতা সেদিন বললেন এনার্সি হলে নাকি ২ কোটি লোকের নাম বাদ যাবে। এই আনন্দে রামভক্ত হনুভক্ত গোসন্তানরা যদি আনন্দে আমোদে ফেটে পড়ে কিছুদিন বাদে এনআরসি লাগু হলে তাদের কয়েকজনের নাম বাদ যায় তাহলে কারা বাঁচাবে? যেমনটা আসামে বিজেপি নেত্রী ববিতা পাল এর নাম বাদ গেছে। ইনি কিন্তু এনআরসির পক্ষে জোরদার প্রচার চালিয়েছেন।
সিটিজেন আমেন্ডমেন্ট আইন চালু হলে কতজন বাঙালি নাগরিকত্ব পাবে? মাত্র ৩১ হাজার ৩১৩ জন। এর ভেতরে আপনার নাম থাকবে তো? কিছুদিন আগেই টাকলুভাই বললেন যে আধার ভোটার নাকি নাগরিকত্বের পরিচয় নয়। মানছি আধার শুধু পরিচয় কখনোই নাগরিকত্ব নয়। তাই বলে ভোটার কার্ড ???? উনি আরো বলেন অত্যাচারিত হয়ে যে এসেছে সে হিন্দু হলে তার হিন্দুত্বের প্রমান দিতে হবে। এরা কখন কি বলে মানুষ কে বিভ্রান্ত করে দেবে আপনি সেই বিভ্রান্তির মধ্যেই নিজ দেশে নিজেই বিদেশি হয়ে যাবেন ধরতে পারবেন না। খুব সুচতুর গেম প্ল্যান কষে এগোচ্ছে আরএসএস এন্ড কোং। মানুষের বেসিক চাওয়া শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থান চাকরি এগুলো থেকে নজর ঘুরিয়ে দিতেই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, ৩৭০ ধারা, নাগরিকত্ব, দেশীয় সংস্থা বিক্রি আর বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিস্কার যেমন গরুর দুধে সোনা, মহাভারতে ইন্টারনেট, হাঁস জলে অক্সিজেন ছাড়ে এরকম কত কি। যে নাগরিকরা বৈধ ভোট দিয়ে গেরুয়া বাহিনীকে ক্ষমতায় আনল আজ তারাই দাবী করছে আপনি নাগরিক নন। বাহ চমৎকার, এই তো গোলওয়ালকর, সাভারকারদের শিক্ষা। দিল্লির নির্বাচনী ফলাফল পরিষ্কার মানুষ জাতপাত, ধর্মের রাজনীতি পছন্দ করছে না। হেঁয়ালি ছেড়ে পরিষ্কার কথায় আসি ধরুন আপনার পরিবারের ৪ জনের নাম বাদ গেছে এবার নিয়ম মতো আপনাকে কাগজপত্র নিয়ে ১২০ দিনের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আপীল করতে হবে নিজেদের ভারতীয় প্রমান করার জন্য। সেখানকার রায় আপনার বিপক্ষে গেলে হাইকোর্ট কিংবা সুপ্রিম কোর্ট। হাইকোর্টে আবেদন করতেই লাগবে ১৯ থেকে ২০ হাজার টাকা জনপ্রতি। সুপ্রিমকোর্ট ছেড়েই দিলাম এবার বলুন তো দিন আনা দিন খাওয়া সংসারে ৪ জনের যদি এরকম অবস্থা হয় আপনার মৃত্যু ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা থাকবে কি?? রাতের ঘুম উড়িয়ে আপনাকে পুরে দেবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। সেখানে আপনারা কেউ একসঙ্গে থাকতে পারবেন কিনা সন্দেহ । যারা আসামের হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেয় নি তারা কি করে বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেবে?? বিজেপির বাবার ও ক্ষমতা নেই দেবার আইনের নিয়ম অনুযায়ী। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা যায় যে শরণার্থী ও নাগরিকত্ব এক জিনিস নয়। একজন নাগরিক সে যে যে সুবিধা পাবে একজন শরনার্থী সেগুলো পাবে না। ভোটদান এর সুযোগ, শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থান এগুলোর কোন দাবী একজন শরনার্থী করতে পারে না। রাষ্ট্রের দয়া ভিক্ষা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন এত মানুষ যে নাগরিকত্ব হারালো এরা যাবে কোথায়??? উত্তর খুব সহজ - ডি ক্যাম্প। খুব সস্তা শ্রম এখন সারা বিশ্ব জুড়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে পুঁজিবাদের কল্যানে। নাম মাত্র বা বিনামূল্যে হাড়ভাঙা খাটিয়ে নাম মাত্র খেতে চিকিৎসা দিয়ে আপনাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে। যে ক্যাম্পগুলো জার্মানিতে হিটলার শুরু করে গেছিলেন সেই একই কায়দায় নাম পাল্টে ডিটেনশন ক্যাম্প হয়ে ফিরে এসেছে। এখনো সময় আছে গর্জে না উঠলে সর্বনাশ। একনজরে দেখে নি আসাম এর বাদ পড়া জনজাতি গুলির পরিসংখ্যান-
বাঙালী হিন্দু ৬.৯০ লাখ
পুর্ব বাংলা বংশোদ্ভূত মুসলিম ৪.৮৬ লাখ
গোর্খা ৮৫,০০০
অসমীয়া হিন্দু ৬০,০০০
কোচ রাজবংশী ৫৮,০০০
গরিয়া মরিয়া দেশি ৩৫,০০০
বোরো ২০,০০০
করবি ৯,০০০
রাভা ৮,০০০
হাজং ৮,০০০
মিসিং ৭,০০০
অহম ৩,০০০
গারো ২,৫০০
মাতাক ১,৫০০
ডিমাসা ১,১০০
সোনোয়াল কাছারি ১,০০০
মারান ৯০০
বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ২০০
নাগা ১২৫
হামার ৭৫
কুকি ৮৫
থাডো ৫০
বাইট ৮৫
ভারতের নাগরিক তারাই যারা ১৯৭১ এর আগের দলিল ও ঠাকুর্দার ভোটার লিস্টে নাম দেখাতে পারবে। মোট দশটা প্রমাণপত্র। '৭৬ এর বন্যায় অনেক মানুষের অনেক কাগজপত্রই নষ্ট হয়ে গেছে তারা পারবেন তো কাগজ দেখাতে? ওপার বাংলায় মুসলিমদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন সেই FIR কপিও দেখাতে হবে। যারা এসে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন সেই সংখ্যা কত? ৩১ হাজার ৩১৩ জন। আর সারা ভারত জুড়ে কতজন বিদেশি নাগরিকত্ব পাবেন ৩১ হাজার সেই ৩১৩ জন। কি মজা না।
NRC আতঙ্ক গ্রাম-শহরে ছড়িয়ে পড়ছে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়ও নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী চিত্রটা ভয়াবহ:
এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে NRC শহীদ: ২২জন !
১) মিলন মণ্ডল, মুর্শিদাবাদ ১৬/৯/১৯
২) অন্নদা রায়, ময়নাগুড়ি, জলপাইগুড়ি ১৮/৯/১৯
৩) মন্টু সরকার, বালুরঘাট, দ: দিনাজপুর ২০/৯/১৯
৪) আমেনা/আলেয়া বেওয়া, হিঙ্গলগঞ্জ, উত্তর২৪পরগণা ২১/৯/১৯
৫) মন্টু মন্ডল, বসিরহাট, উ:২৪প: ২০/৯/১৯
৬) নায়েব আলী, শাসন উত্তর ২৪প:২১/৯/১৯
৭) কালাচাঁদ, ফলতা, দক্ষিণ ২৪প:২১/৯/১৯
৮) কামাল হোসেন, বসিরহাট, উ:২৪প: ২২/৯/১৯
৯) সোলেমান সরকার, ইটাহার,উ: দিনাজপুর
১০)শ্যামল রায়, ধুপগুড়ি, জলপাইগুড়ি ২৪/৯/১৯
১১) আরজিনা বিবি, কোচবিহার, ২৪/৯/১৯
১২) সাবির আলী, জলপাইগুড়ি ২৪/৯/১৯
১৩) সামসুল হক, দিনহাটা, কোচবিহার, ২৪/৯/১৯
১৪) তসলিমা বিবি, স্বামী-আকবর গাজী, হিঙ্গলগঞ্জ, উ:২৪প: ২৫/৯/১৯
১৫)মায়া বর্মন,দিনহাটা, উত্তর দিনাজপুর, ২৫/৯/১৯
১৬) গিয়াস উদ্দিন, হরিহরপাড়া, মুর্শিদাবাদ, ২৬/৯/১৯
১৭) কমল ঘোষ, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান, ২৭/৯/১৯
১৮) আমজাদ আলী খান, সিমলাপাল, বাঁকুড়া, ২৭/৯/১৯
১৯) রফিক খান, গড়বেতা, পশ্চিম মেদিনীপুর, ২৭/৯/১৯
২০) আলাউদ্দিন তরফদার, বাদুড়িয়া,উ: ২৪পরগনা ৩০/৯/১৯
২১) উমারানি মুখোপাধ্যায়, আসানসোল, ১৩/১০/১৯
২২) সুলতান মিয়া, আলিপুরদুয়ার, ১৪/১০/১৯
তথ্যসূত্র -
(১) উইকিপিডিয়া (এনআরসি)
(২) বিভিন্ন সময়ের এইসময় পত্রিকা
(৩) আবাপ - ১/৯/২০১৯
(৪) https://www.sabrangindia.in/article/over-7-lakh-hindus-among-those-excluded-nrc-leaked-data-suggests
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।