১৬৫৪ সালে অক্সফোর্ডের কুইন্স লেনে সার্ক জবসন নামে জনৈক ব্যবসায়ী তাঁর বসত বাড়িতে একটি ব্যবসা খুললেন, তুরস্কর বাইরে ইউরোপে প্রথমবার । বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, কারণ বাড়ির একতলার একটি প্রশস্ত ঘরে জবসন অটোমান আর ইংরেজ এই দুটো প্রথাকে এক করে মিশিয়ে একটি কফি হাউস খুলে বসলেন ।
সে ঘরটায় জবসন কয়েকটা টেবিল আর চেয়ার রাখলেন, দোকানের ছেলে ছোকরারা খরিদ্দারের জন্যে এক নতুন ধরণের পানীয় সার্ভ করতো, তার নাম ক্যাফে, দুটো বেশি পয়সা দিলে অবিশ্যি তারা জুতো পালিশ ও করতো । এর আগে ঐভাবে কফি পাওয়া যেত না
তবে শুধু কফি নয়, জবসনের দোকানে আরো একটা ব্যাপার ছিল ।
সে দোকানে একটা বড় টেবিলে জবসন তাঁর খদ্দের দের পড়ার জন্য খবরের কাগজ রেখে দিতেন । তখন কার দিনে খবরের কাগজ অবিশ্যি সব জায়গায় পাওয়াও যেত না, আর জনসন তাই লোক ডাকবার জন্যেই খবরের কাগজ কফির দোকানে রেখে দিতেন । এক পেনি দিলে দোকানে ঢুকতে দিতো, দু পেনির কফি । কল্পনা করুন আজ থেকে ৩৫০ বছর আগের দৃশ্য,লোকজন কফির কাপ হাতে খবর কাগজ পড়ছেন ।
জন সামারভিল বলছেন, "আধুনকি পৃথিবীর জন্ম হচ্ছে জবসনের কফি হাউসে ", তার মানে? সে একটা অভ্যাসের জন্ম, খবর পড়ার অভ্যাস । খবরের কাগজে খবর পড়ার পর মনে হয় না, তারপর কি হলো, তারপর কি হলো, ব্যাপারটা প্রেসে ছাপা খবরের কাগজ আর যতদিন না সেই কাগজ মানুষের কাছে পাঠাবার একটা বন্দোবস্ত না হয়েছে, সম্ভব ছিল না যে । কোথায় তখন পাবলিক লাইব্রেরি?
বড় শহরের টাউন স্কোয়ারে এই কফি হাউস ই সে আমলের জনতার দরবার! আরব বলুন,উত্তর আফ্ৰিকা বলুন, প্রাচীন যুগের কফি হাউস গুলোতে সব বড় বড় হল, তাতে মাটিতে ফরাস আর গালিচা পাতা, রাতে বাতি জ্বালিয়ে এল দেওয়া হচ্ছে, আর ধূমায়িত কফি! কবির দল, পন্ডিতের দল জড়ো হচ্ছেন, মানুষ তাঁদের কাছ থেকে কবিতা শুনছে, আলোচনা হচ্ছে, সে এক আশ্চর্য্য নাট্যশালা বলা চলে । ইস্তানবুলে ১৬০০ সাল নাগাদ প্রায় ৬০০ কফি হাউস ছিল, তার একটা মস্ত কারণ ইসলামে মদ নিষিদ্ধ, কফি নিয়েছে সেই পানীয়ের জায়গাটা । আর সেই সব কফি হাউসে শুধু কফি পাওয়া যেত না, উপরি হালুয়া, তামাক, চকলেট, আফিম, নাপিত এসে দাড়ি আর চুল কমিয়ে দিচ্ছে গল্প করতে করতে, আড্ডা মারতে মারতে দাবা খেলছেন, কফি খাচ্ছেন, হুঁকোয় টান দিতে দিতে , সে এক মহা জমজমাট ব্যাপার স্যাপার ।
তো তুর্কির এই কফি কালচার কালক্রমে ভেনিস ভিয়েনা,প্যারিস হয়ে ১৭০০ সাল নাগাদ পৌঁছলো ইংল্যান্ডে , যে সময়কার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম । কিন্তু ইংরেজ আর প্রাচ্যের কফি হাউসের একটা মস্ত তফাৎ ছিল খবরের কাগজে । তুর্কির কফি হাউসে আপনি কি না পেতেন, তবে সবটাই সার্বজনীন । ইংরেজ সেখানে খবরের কাগজ রেখে ব্যাপারটা কে ব্যক্তি মানুষের একান্ত আপন ও পারস্পরিক আলাপচারিতার একটা জায়গা করে ফেললো, এই জায়গাটিতে একটা মস্ত তফাৎ ।
ভাবুন ব্যাপারটা ।
যে সময়ের কথা বলছি, সময় কাটানোর পাবলিক জায়গা বলতে তখন রেস্তোরাঁ , পাব, প্রাইভেট ক্লাব । প্রাইভেট, এলিট দের জড়ো হবার জায়গা , আমি জনতার সেখানে বড় একটা জায়গা নেই । কফি হাউস সেই কালচারটির থেকে স্বতন্ত্র, এবং শুরু থেকেই । কফি হাউস এমন একটা পাবলিক জায়গার সূত্রপাত করলো যেখানে এক ই সঙ্গে যে কেউ গিয়ে কফি খাচ্ছেন, খবরের কাগজ পড়ছেন একা একা , আবার চিন্তা করবার অবকাশ পাচ্ছেন, আড্ডা মারবার সুযোগ পাচ্ছেন, এই ব্যাপারটা এর আগে কিন্তু ছিল না । কফি হাউস আমার আপনার জায়গা, এলিটিজম এর ব্যাপারটা নেই । কফি হাউসের সেই ট্র্যাডিশন অবশ্য আজও বজায় আছে ।
১৭০০ সালে অবশ্য কফির কোয়ালিটি কিছু আহামরি ছিল না, আরব থেকে কফির বিন নিয়ে এসে এরা জলে ফুটিয়ে কফি তৈরী করতো, আরো ১০০ বছর পরে প্যারিস এ পারকোলেটর আবিষ্কৃত হবে, তারপর কফির জয়যাত্রা ।
কিন্তু সেটা তো কথা নয়, কথা হচ্ছে কফি হাউস আর খবরের কাগজ আর আড্ডা নিয়ে । কফি আর খবর আর তাকে কেন্দ্র করে আড্ডা । এই যে ইয়ুর্গেন হাবার্মাসের ভাষায় "পাবলিক স্ফিয়ার" (১), এই ব্যাপারটা কফি হাউস না হলে তো আর সম্ভব ছিল না ।
কিন্তু সেটাও আর রইলো না । আজকের দিনে কফি হাউসের সেই ব্যাপারটা নেই, আর এই যে ধরুন যে যার মতন করে নিজের মতন খবর সংগ্রহ করে নিচ্ছে, একটা পাবলিক স্পেস নেই, এতে করে এক ই ভৌগোলিক পরিসরের মধ্যে একেকটা সমান্তরাল ন্যারেটিভ তৈরী হচ্ছে, কে জানে এর ভালো খারাপ ।
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, :-) । তা হোক, কফি হাউস আজও আছে, এখনো সেখানে গিয়ে ফোনে , ট্যাবলেটে , কাগজেও খবর পড়াই যায় । কফি হাউস "নাগরিক" কথাটির একটা গভীর দ্যোতনা একদিন দিয়েছিল, যেখান থেকেই হয়ত নাগরিক পরিসরের মধ্যেই গণতন্ত্রের বীজ নিহিত ছিল । এই কথাটা কফি হাউস মনে পরিয়ে দেয় ।
(অনুপ্রেরণা, Tim Wu : How the humble coffee house birthed modern media and society (২) )
---
(১) https://partiallyexaminedlife.com/2016/03/02/jurgen-habermas/
(২) https://marker.medium.com/how-the-humble-coffee-house-birthed-modern-media-and-society-9aae996bc7bc
বেশ লাগলো। আমি সব শহরেই কফি হাউস খুঁজে বেড়াই। দিল্লি জবলপুর ভোপাল কানপুর লক্ষনৌ। লক্ষনৌয়ে হজরতগঞ্জের সেই প্রবাদপ্রতিম কফিহাউস (যা কুমারপ্রসাদের স্মৃতিচারণে জীবন্ত) তখন প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি দরজা ঠেলায় মোম্বাতির আলো হাতেএকজন এসে দরজা খুললো --হানাবাড়ির মত। ইলেক্ট্রিক লাইন কাটা। বৃদ্ধ মুসলমান ভদ্রলোক ধূলো ঝেড়ে একটা চেয়ারে বসতে দিল। তখন বেলা তিনটে মে মাস। আমি আধো অন্ধকারে ঘামছি। পনের মিনিট পরে কফি এল। কোনরকমে খেলাম , ওঁর মুখে কোন শব্দ নেই।
তারপর একটা পঞ্চাশটাকার নোট ধরিয়ে পালিয়ে এলাম। জানি খুচরো নেই।
আপনি সময় পেলে দার্শনিক হাবারমাসের সম্বন্ধে একটু লিখুন না। আমি অধ্যাপক শ্রাবণী ভৌমিকের বইয়ে সামান্য জেনেছি। দর্শন নিয়ে আপনার লেখা পড়তে ভাল লাগবে।
পড়তে ভালো লাগল। বিভিন্ন শহরের কফি হাউস নিয়ে সিরিজ হলে ভালো হয়।
:-), কি দারুণ গল্প রঞ্জনবাবু!
শুধু ভাবছি নিভু নিভু আলোয় লক্ষ্নৌ--এর কফিহাউস, সে কেমন আশ্চর্য অভিজ্ঞতা! একটা অতীতকে স্পর্শ করা!
হাবারমাস! ওরে বাপরে! সে কি আমার কম্ম, রঞ্জনবাবু, ভাল লোককেই ঠাউরেছেন, :-)
এটা থাকুক। http://gametheory.tau.ac.il/arielCafe/arielSiteTbl_ind.asp.
b, আপনার তোলা লিস্ট টা দেখলাম। ক্রাউড সোর্সিঙ্গ করলে যা হয়, হাবিজাবি কিছু কাফের নাম রয়েছে লিস্ট টায়, যেমন নিউ জিল্যন্ডে Cafe 101, :-)