আসলে ওঁদের উৎসাহ ছিল বাজার অর্থনীতির একটি ইউনিট (micro economics)--উপভোক্তা হোক বা উৎপাদক--কে দূরবীক্ষণের নীচে ফেলে তার গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা। উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রমাণ করা যে বাজারের অদৃশ্যশক্তি যে সবকিছুকে শুধু সাম্যাবস্থায় (ইকুইলিব্রিয়াম) নিয়ে আসে তাই নয়, শেষ বিচারে শ্রমিক/মালিক সবাইকে তাঁদের উৎপাদনে যোগদানের ভিত্তিতে উপযুক্ত পুরষ্কার দিয়ে সমাজে ন্যায়ের শাসনকে শক্তপোক্ত করে।
এদিকে লর্ড কেইন্সের যোগদান হল বাজারের (মার্কেট সিস্টেম) অর্থব্যবস্থায় সাম্য ফিরিয়ে আনার "অদৃশ্য হাত"এর ক্ষমতার তত্ত্বকে খারিজ করা এবং আয়বৃদ্ধির ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে প্রভাবী চাহিদা কীভাবে পূর্ণ রোজগারকে (ফুল এমপ্লয়মেন্ট) প্রভাবিত করে তা খুঁটিয়ে দেখা।এই বিশ্লেষণ অবশ্যই অল্পকালীন। ওঁর বিখ্যাত উক্তিটি হল—ইন দ্য লং রান, উই আর অল ডেড!
আবার মার্ক্সের অধ্যয়নের অভিমুখ হল সমগ্র পুঁজিবাদী অর্থনীতির (macro-economics) চালিকাশক্তিকে খুঁজে বের করা। সেই অর্থে মার্ক্সের অধ্যয়ন এক দীর্ঘকালীন গতিশীলতার (long term dynamics) বিশ্লেষণও বটে।
এক, তিরিশের দশকের বিশ্বজোড়া মন্দার ফলে দেখা গেল বাজারের চাহিদা/যোগান দাঁড়িপাল্লার ওঠানামার পেছনে কোন অদৃশ্য নিয়ন্তা নেই আর বাজারের ভরসায় ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার দিন শেষ।
দুই, নবগঠিত সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের সাতশালা পরিকল্পনার সফলতা সকলের চোখ টানল সংকটমোচন হিসেবে রাষ্ট্রের ভূমিকার দিকে।
এদিকে কেইন্স তাত্ত্বিক ভাবে বাজারের অন্ধশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে কল্যাণকারী রাষ্ট্র (welfare state) ব্যবস্থার মডেল তৈরির ভিত্তি স্থাপন করলেন। ক্রমশঃ রাষ্ট্রের অর্থনীতির বা পুঁজির বৃদ্ধির (গ্রোথ) জায়গায় বিকাশ (ডেভেলপমেন্ট) শব্দটির গুরুত্ব বাড়ল এবং গড় রাষ্ট্রীয় আয় (ন্যাশনাল ইনকাম) বা সমগ্র ঘরোয়া উৎপাদন (জিডিপি) আর্থিক প্রগতির বড় মাপকাঠির স্বীকৃতি পেল। এরপরে অন্য অনেক সূচক , যেমন মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক ( যাতে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ব্যয় , ভোজনে পুষ্টি ও ক্যালোরি) সামনে এল।
তিন, এইসব ব্যববহারিক টোটকার প্রয়োগের পাশাপাশি মার্ক্সের পুঁজির ও শ্রমের গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিশ্লেষণ অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি পেল।
জোয়ান রবিনসন লেবার থিওরি অফ ভ্যালু বা উৎপাদনে মূল্য সৃজনে শ্রমের বিশিষ্ট ভূমিকার তত্ত্ব না মানলেও মার্ক্সের অর্থনীতির বাকিটুকু মানেন। আর্থিক শোষণের তত্ত্বটূকু মানেন। [2]
কেউ কেউ মার্ক্সের পুঁজির শক্তির বিশ্লেষণের পদ্ধতিতে প্রথম ও দ্বিতীয় ডিগ্রির অ্যাপ্রক্সিমেশন টেকনিকের প্রয়োগ প্রথমে ধরতে পারেন নি।
(পল সুইজি[3] ও মরিস ডব[4] এগুলো পাখিপড়ার মত করে বুঝিয়ে দিয়েছেন)।
এর পরে এল মার্ক্সের ক্যাপিটাল গুডস/ কন্জিউমার গুডস ( উৎপাদক পণ্য ও উপভোগ পণ্য) আদি দুই সেকটর মডেলে র ট্রান্স্ফর্মেশন প্রবলেম বা ভ্যালু ও প্রাইস (মূল্য ও দাম) এ অনায়াস বিচরণ/পরিবর্তনের সমস্যা।
এর সবচেয়ে সফল সমাধান করলেন বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালি থেকে প্রাণ নিয়ে কেম্ব্রিজে পালিয়ে আসা প্রতিভাবান মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ পিয়েরো স্রাফা তাঁর Production of Commodities by means of Commodities[5] গ্রন্থটিতে;( বইটি অন্তর্জালে পাওয়া যায়।)
কিন্তু এহ বাহ্য। মার্ক্সের দর্শন সবকিছুর ব্যাখ্যা করে ডায়নামিক ভাবে, পরিবর্তন ঘটানোর আশায়। তাই পুঁজি গ্রন্থটি শুধু পুঁজিবাদী অর্থনীতির নাড়ি দেখে রোগনির্ণয় করে ক্ষান্ত নয়, সে পথ দেখায় পরিবর্তনের। ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী সমাজের মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে নতুন সমাজ গঠনের যেখানে প্রথমে শ্রমিক শ্রেণী ও পরে সমগ্র মানবজাতি উত্তীর্ণ হবে নিয়ন্ত্রিত থেকে নিয়ন্তার ভূমিকায়।; হবে মজুরিদাস থেকে মুক্ত স্বাধীন মানুষ।
এই বইয়ের প্রথম প্রকাশনের ৫০ বছর পরে নতুন সোভিয়েত রাষ্ট্র জন্ম নিল; ব্যক্তি পুঁজি বাজেয়াপ্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় পুঁজি হল। আমরা জানতাম এ হল প্রথম হাঁটি হাঁটি পা পা। স্বপ্ন দেখেছিলাম যে অচিরেই আমাদের জীবত্কালেই "মিলাবে মানবজাত"। কিন্তু তার পরেও এক্শ বছর কেটে গেল। স্বপ্ন সফল হল না। লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ বা মুমুর্ষু পুঁজিবাদ রক্তবীজের বংশধর হয়ে দেখা দিল। মে দিবসে শিকাগোর হে মার্কেটে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত "আট ঘন্টা কাজের দাবি" আজ এক অলীক রূপকথা।
তাই এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্লেষণ দরকার গলদ কোথায়?
এই সামান্য লেখাটি এক অক্ষম প্রচেষ্টা মাত্র। আশা আছে, যোগ্য লোকজন আলোচনার রাশ ধরে তাকে একটি উপলব্ধিতে পৌঁছতে সাহায্য করবেন। এই মাত্র।
ব্ছর পঞ্চাশেক আগে অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় একটি প্রবন্ধে দাস ক্যাপিটাল গ্রন্থটি সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন--'বহু আলোচিত, কিন্তু স্বল্পই পঠিত'। কথাটি বোধহয় আজ আরও বেশি সত্যি।
আমাদের প্রজন্মও মার্ক্সের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের পাঠ নিয়েছে দুটি চটি বই থেকে--"মূল্য দাম মুনাফা" এবং "মজুরি দাম মুনাফা" থেকে-- যা আসলে ক্যাপিটালের প্রথম খন্ড লেখার সময় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে মার্ক্সের দুটি বক্তৃতা মাত্র।(যেমন হিন্দুধর্মের অধিকাংশ অনুগামীরা গীতা পড়েই সন্তুষ্ট, উপনিষদের ধার দিয়েও যান না।)আমার মত মোল্লার দৌড়ও মসজিদ পর্য্যন্ত!
(১) অ্যাকাডেমিক ইকনমিক্স উৎপাদনের জন্যে ভূমি, শ্রম, পুঁজি ও সংগঠন-- এই চারটিকে উপাদান হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু মার্ক্সের মতে কেবল শ্রমশক্তিই হল আসল উৎপাদক। কারণ কেবল শ্রমশক্তিরই ক্ষমতা রয়েছে নিজের আবশ্যিক উপভোগের চেয়ে অতিরিক্ত (সারপ্লাস) উৎপাদন করবার। শুধু ভূমি, পুঁজি ও সংগঠন নিজে একলা একলা ভোগ্যবস্তু বা মূল্য ( ধরুন ব্যবহার মূল্য) সৃষ্টি করতে পারেনা।এইক্ষমতা স্পষ্টতঃ শুধু শ্রমশক্তিরই আছে।
(২) প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মালিকশ্রেণী মুনাফা কামায় বাজারের চাহিদা-যোগানের ওঠানামা বা অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে বেশি দামে জিনিস বিক্রি করে। কিন্তু মার্ক্স দেখিয়েছেন যে তা নয়; ওটা মাত্র অল্পকালীন ঘটনা, অতিরিক্ত মুনাফা বা ফাটকার ফল। আসলে স্বাভাবিক মুনাফার (নর্মাল প্রফিট) মূল নিহিত রয়েছে উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যেই; পণ্যদ্রব্যের মধ্যে সমাহিত গড়পড়তা সামাজিক শ্রমের সমান মূল্যে বিক্রি করেই; অর্থাৎ পণ্যটির শ্রমশক্তির সমতুল্য দামে বিক্রির মধ্যেই; বেশি দামে বিক্রি করে নয়।
এখানে মার্ক্স কাঁচামাল যন্ত্রপাতি শ্রমশক্তি--সবগুলোকেই বিশ্লেষণের সুবিধার জন্যে একটি কমন ডিনোমিটারে পরিবর্তিত করে নিয়েছেন। তাহল সেগুলো উৎপাদনের জন্যে আবশ্যক গড়পড়তা সামাজিক শ্রমশক্তি।
এইখানে কিন্তু অ্যাকাডেমিক ইকনমিক্সের দীর্ঘকালীন স্থিতিতে নর্মাল প্রফিট এর অবধারণা প্রায় তাই বলছে, যা মার্ক্সের পূর্ববর্তী রিকার্ডো আদি অর্থনীতিবিদ বলছিলেন -- অর্থাৎ, দীর্ঘকালে দাম ও উৎপাদন ব্যয় সমান সমান হয়। আর এর মধ্যেই থাকে নর্মাল প্রফিট। কাজেই মার্ক্স খুব উদ্ভট কিছু বলছিলেন না।
(৩) কিন্তু মার্ক্সের মৌলিকতা হল উনি দেখিয়েছেন যে শ্রমিক পায় শ্রমশক্তির বদলে মজুরি। কতটুকু ? যতটা মূল্য সে দেয় বা উৎপাদন করে, ততটুকু? আদৌ নয়। তাকে দেওয়া হয় তার জীবনধারণের জন্যে সামাজিক ভাবে নির্ধারিত যতটুকু মূল্য দরকার --ঠিক ততটুকু।
দেখা যায় যে কোন একটি দেশে একটি নির্ধারিত টেকনলজি (ক্যাপিটলের ব্যবহার) ও সামাজিক ভাবে খেটে খাওয়া মানুষের জন্যে আবশ্যক মূল্য উৎপাদন করতে কমবেশি আদ্দেক শ্রমসময় লাগে। বাকিটা সময় মজুরের শ্রম উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনে ব্যয় হয়। এই অতিরিক্ত সময়ে উৎপাদিত মূল্য বা উদ্বৃত্ত মূল্যই হল মুনাফার আধার। ওই মুনাফার বাঁটোয়ারা হিসেবে জমির মালিক পায় ভাড়া, পুঁজির মালিক পায় সুদ এবং সংগঠনের বা অন্তেপ্রেনেউরের পুরষ্কার হল লাভ।
এখানে নিও-ক্ল্যাসিকাল অর্থনীতি ইউলারের পার্শিয়াল ডেরিভেটিভ এর সাহায্যে দেখায় যে যদি জমি, পুঁজি, মজুর ও সাংগ্ঠনিক মালিককে তাদের সীমান্ত উৎপাদনের (মার্জিনাল প্রোডাক্টিভিটি) হিসেবে মোট উৎপাদনের বাঁটোয়ারা করে দেয় তাহলে উদ্বৃত্ত কিছুই থাকে না। এবং এই বিতরণটি ন্যায় সংগত হয়। দেখুনঃ
ধরা যাক , P হল উৎপাদনের সমগ্র আউটপুট, এবং p হল তার ইনপুটের সমন্বয়ের একটি হোমোজিনিয়াস ফাংশন, অর্থাৎ জমি (X ), পুঁজি(K) ও শ্রমের (L) এক ফার্স্ট অর্ডার হোমোজিনিয়াস ফাংশন— p = f(X, K, L)। তাহলে ইউলার থিওরেম অনুযায়ী
P= X.dp/dx + K.dp/dK+ L. dp/dL।
এখানে, dp/dx = জমির প্রান্তিক উৎপাদকতা ; X. dp/dx = জমির প্রান্তিক উৎপাদকতাকে গোটা জমির পরিমাণ দিয়ে গুণ করে যা পাই, অর্থাৎ উৎপাদনে জমির যোগদান। তাহলে জমির মালিককে যদি খাজনা বাবদ X. dp/dx এর সমান মূল্য ধরে দেওয়া হয় তা এই তত্ত্ব অনুযায়ী ন্যায়োচিত হবে।
একইভাবে, dp /dL = শ্রমের প্রান্তিক উৎপাদকতা; L. dp /dL মানে উৎপাদনে সমগ্র শ্রমের যোগদান যা শ্রমের প্রান্তিক উৎপাদকতাকে শ্রমের সম্পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে গুণ করে পেলাম। এখন এই L. dp /dL এর সমান মজুরি যদি সব শ্রমিকদের দিয়ে দেয়া হয় তাহলে নালিশের কি আছে? বাপু, তোমরা এই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যা দিয়েছ, তাইতো পেয়েছ!
একইভাবে dp/dK হল পুঁজির প্রান্তিক উৎপাদকতা; তাহলে K.dp/dK হল সমগ্র পুঁজিকে তার প্রান্তিক উৎপাদকতা দিয়ে গুণ করে যা পাই, অর্থাৎ পুঁজির সমগ্র উৎপাদকতা। তাই K.dp/dK এর সমান অংশ পুঁজির মালিকদের দিলে তা হবে ন্যায়োচিত সমগ্র মুনাফা।
কারণ, এসবের যোগফল অর্থাৎX.dp/dx + K.dp/dK+ L. dp/dL হল মোট উৎপাদন P এর সমান। কাজেই এভাবে সমগ্র উৎপাদন বা আউটপুট ওই অনুপাতে সমগ্র ইনপুট মালিকদের ( ভুস্বামী, পুঁজিপতি ও শ্রমিক) মধ্যে বন্টন করে দিলে অবশেষ আর কিছুই থাকবে না। সবাই তাদের প্রান্তিক যোগদানের অনুপাতে ভাগ পেয়েছে।
অর্থাৎ, যদি সমগ্র উৎপাদন জমি, শ্রম, পুঁজি, সংগঠনের সমন্বয়ের ফল হয় তবে সেই উৎপাদন খাজনা, মজুরি, সুদ ও লাভ হিসেবে ওদের মধ্যে বন্টনের ভিত্তি হওয়া উচিত প্রত্যেকটি উপাদানের প্রান্তিক উৎপাদকতা--তাহলেই কারও কোন নালিশ থাকবে না।
যুক্তিটির মধ্যে রয়েছে মস্ত বড় ফাঁক। ষাটের দশকের রুশী অর্থনীতিবিদেরা তা ধরে ফেলেছিলেন।
মজুরির কথাই ধরুন। মজদুরের প্রান্তিক উৎপাদকতা হল শেষ নিযুক্ত মজদুরটির শ্রমে মোট উৎপাদন কতটুকু বাড়ল। এখন একই দক্ষতা সত্ত্বেও একের পর এক মজদুর নিযুক্ত হলে প্রান্তিক মজদুরের উৎপাদকতা ক্রমাগত কমতেই থাকবে। এর জন্যে সে দায়ী নয়। দায়ী হল অর্থনীতির একটি বেসিক নিয়ম-- প্রান্তিক উৎপাদনের ক্রমহ্রাসমান নিয়ম ( Law of diminishing returns) -- উৎপাদনের অন্য উপাদানগুলি স্থির রেখে কোন একটির বিনিয়োগ বাড়ালে উৎপাদন বাড়বে, কিন্তু ঘটমান দরে।
(জোয়ান রবিনসন অধ্যাপক স্যামুয়েলসনের সঙ্গে আলোচনায় দেখিয়েছিলেন প্রান্তিক মজদুরের উৎপাদকতার হিসেব কষতে যেহেতু ক্যাপিটালকে 'স্থির' ধরা হয়, তাই ওটিকে আদৌ প্রান্তিক মজদুরের উৎপাদকতা বলা সংগত নয়। উদাহরণস্বরূপ, তিনজন মজুরকে যদি দুটো কোদাল দিয়ে কাজ করতে হয়, তাহলে শেষ মজুরটির উৎপাদকতা কমবেই।)[6]
অথচ, একটি নির্দিষ্ট ধরণের শ্রমশক্তির জন্যে সবাইকে একটি গড় মজুরি দেওয়া হয়, কখনই এক একজনকে তার উৎপাদকতা অনুযায়ী আলাদা আলাদা মজুরি দেওয়া হয় না। ফলে যখন মালিক শ্রমিকদের প্রান্তিক শ্রমিকটির উৎপাদন ক্ষমতার হিসেবে মজুরি দেবে তখন স্বভাবতই আগের শ্রমিকদের (যারা প্রান্তিক ও গড় উৎপাদকতার চেয়ে বেশি উৎপাদন করেছে) ন্যায্য পাওনার চেয়ে কম মজুরি দেওয়া হবে, এবং বাকি উদ্বৃত্ত উৎপাদন মালিকের পকেটে অতিরিক্ত লাভ হিসেবে পড়ে থাকবে।
কারণ, সংগঠক-মালিকের মুনাফা হল সবাইকে দিয়ে শেষ পড়ে থাকা অংশটি (residual)।
এসব ছেড়ে আবার মার্ক্সের মূল আলোচনায় আসি। উনি এবং বহু পরে শ্যুমপেটার উৎপাদনে টেকনিক্যাল উন্নতির ফল নিয়ে আলোচনা করেছেন। মার্ক্সের মতে যত প্রযুক্তির উন্নতি হবে তত শ্রমশক্তির জীবনধারণের জন্য আবশ্যক মূল্য উৎপাদনের সময় কমবে। পুরনো প্রযুক্তিতে যতটুকু সময়ে (ধরুন চার ঘন্টা) একটি নির্দিষ্ট মূল্য উৎপাদিত হত, এখন । মানে বিংশ শতাব্দীর শেষে, দুই বা তিন ঘন্টাতেই সেই পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু শ্রমিক তো একটি নির্দিষ্ট শ্রমসময় ( ধরুন আট ঘন্টা) ধরে উৎপাদন করতে চুক্তিবদ্ধ। ফলে একই মজুরিতে সে আরও বেশি সময় মালিকের জন্যে উদ্বৃত্ত উৎপাদন করতে পরিশ্রম করছে।
কিন্তু মার্ক্স আয়রন ল' অফ ওয়েজে বিশ্বাস করতেন না। সমসাময়িক সমাজতন্ত্রীরা ভাবতেন যে জীবনধারণের জন্যে আবশ্যিক মূল্যের সমপরিমাণ মজুরি পেলেই যথেষ্ট। এর বেশি চেয়ে আন্দোলন করে লাভ নেই। কিন্তু মার্ক্স দেখিয়েদিলেন যে মালিক বাস্তবে শ্রমিকের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত মূল্যের পুরোটাই আত্মসাৎ করছে। তাই ট্রেড ইউনিয়নের লক্ষ্য হবে ক) মজুরি বৃদ্ধির জন্যে এবং খ) কাজের ঘন্টা কমানোর জন্যে লড়াই করা।
ক) এর ফলে মালিকের আত্মসাৎ করা উদ্বৃত্ত মূল্যের কিছুটা শ্রমিক ফিরে পাবে, আর খ) এর ফলশ্রুতিতে মালিকের জন্যে উদ্বৃত্ত মূল্য নির্মাণে ব্যয়িত শ্রমিকের শ্রম কিছুটা কমবে।
মার্ক্স সেই সময়ের এম্পিরিক্যাল ডেটা নিয়ে দেখিয়েছেন যে মজুরি বাড়লেই জিনিসের দাম বাড়বে এমন আশংকা অমূলক। বাস্তবে দাম বাড়ে অনেকগুলো কারণে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের নীতিরও বিশেষ ভূমিকা থাকে। তবে মজুরি বাড়লে মালিকের মুনাফার হার কিছুটা কমে, মার্ক্সের তাই অভীষ্ট।
এদিকে শ্রমিকশ্রেণীর জীবনধারণের স্তর বা গড়পড়তা আবশ্যক মূল্যের অনুমান দেশকাল নির্ভর। সেই সময়েই এবং এখনও আম্রিকা ও দ্বিতীয় বিশ্বের দেশের শ্রমিকদের ন্যুনতম জীবনযাত্রার মান ও তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকদের মান সমান নয়।
আবার প্রযুক্তিগত উন্নতি উন্নততর ভোগ্যপণ্যের নির্মাণের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যেও নতুন নতুন আবশ্যকতা বা চাহিদা তৈরি করে।
আজ একটি বেসিক মোবাইল শ্রমের সচলতার বৃদ্ধি ও উন্নত কম্যুনিকেশনের কারণে সাধারণ মজুরের জীবনেও আবশ্যক বস্তু।
পুঁজি ও শ্রমের সংঘর্ষ বা শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমে অচিরেই শ্রমশক্তি বিক্রির আবশ্যক সময় কমানো,--মার্ক্স যেমন চেয়েছিলেন যে একটি সামাজিক ভাবে নির্ধারিত গড় চুক্তিবদ্ধ সময়—তা’ দু'দশকের মধ্যে বাস্তব হল । সম্ভব হল শিকাগোর হে মার্কেটের রক্তরাঙা লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, যার পুরোভাগে ছিলেন নারীশ্রমিকেরা। আটঘন্টা কাজের সময় নির্ধারিত হল আর শ্রমিক পেল আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ও রক্তে রাঙা লাল পতাকা।
এদিকে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন হয়ে গেল ট্রেড ইউনিয়নের মুখ্য কাজ। শুধু নমিনাল ওয়েজ বা টাকার মূল্যে মজুরি বৃদ্ধি নয়, আবশ্যক দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, বোনাস, স্বাস্থ্য/শিক্ষা/মাতৃত্ব/ মাগ্গীভাতা/ অবসরের সুবিধা/ পিএফ/ পেনশন/বীমা ইত্যাদি সুবিধা আদায়ের মাধ্যমে রিয়েল ওয়েজ বৃদ্ধির লড়াইয়েও তৎপর হল শ্রমিকশ্রেণী।
কিন্তু "পুঁজি" রচনার দেড়শ' বছর পরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে ত উন্নতি হয়েছে তা মার্ক্স দেখে যেতে পারেন নি। এর ফলে শ্রমিকের জীবনে এসেছে বিশাল পরিবর্তন। যে পরিমাণ ভোগ্যদ্রব্য আজ নিত্য জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা অভাবিত। ডিজিটাল ও ন্যানো টেকনলজির যুগে দক্ষ শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। পশ্চিম ইউরোপের সমাজবাদী আন্দোলনের প্রতিফলনে ও কেইনসের নীতির প্রত্যক্ষ এবং মার্ক্সের পরোক্ষ প্রভাবে কিছু দেশে প্রচলন হয়েছে কল্যাণকারী রাষ্ট্রের অবধারণার। অনেক দেশে রাষ্ট্র দায়িত্ব নিচ্ছে বেকার যুবকের ও অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধের এবং সমস্ত নাগরিকের বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রদান করার।
তাতে ডাস ক্যাপিটাল কথিত পুঁজিবাদের মূল সমস্যা, অর্থাৎ শ্রমিকের দ্বারা উৎপন্ন উদ্বৃত্ত মূল্যে ক্রমশঃ শ্রমিকের অংশীদারী কমে যাওয়া, উৎপন্ন বস্তু ও উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা, ফলে মানুষের সমাজবিচ্ছিন্ন একাকী নিউরোটিক হয়ে যাওয়া এসব কি শেষ হয়ে গেছে? না শুধু আড়াল হয়েছে?
একটু খতিয়ে দেখুন। শুধু আইটি ইন্ডাস্ট্রির কথাই ধরুন, বিশ্বে ভারতীয়দের জন্যে নাকি এই ক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদা রয়েছে।
এখন আইটি কর্মীদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে কাজ করতে হয়, ঘরে বসেও অনেক সময় করা যায়। জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত। কোথায় দেড়শ' বছর আগের কারখানার ভোঁ শুনে লাইন দিয়ে অস্বাস্থ্যকর ফ্যাক্টরি শেডে ঢোকার দিন? চার্লি চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমসে দেখানো ভেড়ার পালের দিনগত পাপক্ষয় কি আজ ঠাকুমার ঝুলিতে সেঁধিয়ে গেছে?
--উঁহু, প্রোজেক্টের কাজে কেউ কেউ বিদেশে ঘুরে আসেন বটে, ছ'মাসে ন'মাসে; হয়ে যায় লোন নিয়ে বাড়ি গাড়ি।
কিন্তু, কিছু সুবিধের বদলে ওই সিনেমায় দেখানো 'বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং' আজ আরও বড় সত্যি। কথায় কথায় হায়ার অ্যান্ড ফায়ার পলিসি আজ আরও বেশি নির্মম।
কারণ, আইটি সেক্টরে ট্রেড ইউনিয়ন? ইন্ডাস্ট্রিয়াল রাইটস? হাসালেন মশাই। এইভাবে এই সেক্টরে প্রোডাকশন প্রসেস থেকে আইটি শ্রমিকেরা হয়ে যান আরও বেশি বিচ্ছিন্ন,।
আর কাজের সময় কমানো? মার্ক্স যে দেখিয়েছিলেন উন্নত প্রযুক্তির ফলে আবশ্যক মূল্য নির্মাণে আবশ্যক সময় কমবে, তাই ট্রেড ইউনিয়নের দাবি শুধু মজুরি বৃদ্ধি নয়, কাজের সময় কমানোও হওয়া উচিত।
কিন্তু, কমা তো দূরের কথা, পুঁজি লেখার পরবর্তী দেড় শতকের মধ্যে অর্জিত আট ঘন্টা কাজের অধিকার আমরা হারিয়েছি। শুধু আইটি কেন, ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য সেক্টরে সামান্য ক'টি টাকা অ্যালাউন্সের নামে ধরিয়ে কাজের সময় বাড়িয়ে ১২ ঘন্টা করে দেওয়া হয়। সবাই মেনে নেয়, যেন এটাই স্বাভাবিক।
মার্ক্স দেখিয়েছিলেন যে Capitalist production also has a “general tendency” to extend the working day.। আর The increased productivity generated by capitalist development means that capital can in fact simultaneously concede increased “real wages” and increase the rate of exploitation.
বেড়েছে কি রিয়েল ওয়েজ বা বাস্তব মজুরি? আর একই সঙ্গে বেড়েছে কি শোষণের দর? বা শ্রমিকের কাজের সময়ে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরির অনুপাত?
কোন সন্দেহ নেই যে বর্তমান শতাব্দীতে বাস্তবিক মজুরি ও জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। হয়ত আমরা এতেই সন্তুষ্ট হয়ে তাকিয়ে দেখতে চাইনা যে উন্নত প্রযুক্তির ফলে এবং কাজের সময় বাড়ানোর ফলে উদ্বৃত্ত মূল্যের অনুপাত কতখানি বেড়েছে।
এই নিয়ে দাঁড়ি টানার আগে একটু সমসাময়িক এম্পিরিক্যাল স্টাডির দিকে তাকানো যাক।
৪)পুঁজি গ্রন্থের ২২তম অধ্যায়ে মার্ক্স দেখিয়েছিলেন যে উন্নত পুঁজিবাদী দেশে গড় মজুরির দর অন্য দেশগুলোর চেয়ে বেশি হয়; কিন্তু গড় মজুরি-ব্যয় ( unit labour cost) কম হয়। কারণ উচ্চ উৎপাদকতার দর বাড়তি মজুরির দরের থেকে বেশি হয়।
মার্ক্স তাঁর পুঁজি গ্রন্থে এংগেলসের দেওয়া সমসাময়িক অধ্যয়নের ভিত্তিতে শোষণের দর (rate of exploitation) ১০০% ধরেছিলেন।
কিন্তু বর্তমান বিশ্ববাজারে স্ট্যাটিসটিক্যাল তথ্যের ভিত্তিতে ফ্রেড মোসলে বলছেন যে আমেরিকায় শোষণের দর ৩০০% ছুঁয়েছে[7]। মিশেল হাসন এর বিশ্লেষণও বলছে যে শোষণের দর বেড়েছে। যদিও শ্রমিকেরা ২০১২তে যে পরিমাণ পণ্য কিনতে পারছে তা শুধু পুঁজি রচনার দিনগুলোতেই নয়, বিগত সত্তরের দশকেও অসম্ভব ছিল।
তাহলে? ফিরে এসেছে পুরনো মদ নতুন বোতলে নতুন লেবেল লাগিয়ে। আরও কড়া, আরও নির্মম। নিশ্চিত নয় কাজের সময়, নিশ্চিতি নেই রোজগারের। দুর্বল হচ্ছে শ্রম আইন, গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ডে দেয় সুদের হার। সরকার পিছিয়ে যাচ্ছে তার কল্যাণকারী ভূমিকা থেকে। শিক্ষা ও চিকিৎসায় বাড়ছে পুঁজির অনুপ্রবেশ; সুবিধাগুলো ক্রমশঃ চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
একে কী বলব? ল' অফ নেগেশন অফ নেগেশন? নাকি মার্ক্স কথিত ইতিহাসের নির্মম পুনরাবৃত্তি--- প্রথমে ট্র্যাজেডি, পরে প্রহসন?
কেউ কি ঠিক ঠিক জানি? ২০১৭ সালে নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষে বিভিন্ন বামপন্থী বড় ছোট অনেক দলের ( কমিউনিস্ট, মার্ক্সিস্ট, মাঅর্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট, মাওইস্ট ) লেখায় হরদম চোখে পড়ছে একটি পংক্তি--'নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগোতে হবে'।
কিন্তু সেই শিক্ষা বলিতে কবি কী বুঝিয়াছেন তা কোথাও স্পষ্ট করে চোখে পড়ে না।
দুটো কথা মনে হয়।
১৯১৯ সালে চারদিকে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দিয়ে ঘেরা সোভিয়েত শিশুরাষ্ট্রকে সাময়িক ভাবে গ্রহণ করতে হয়েছে NEP বা নতুন আর্থিক নীতি। নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহারিক দিক দিয়ে হয়ে উঠেছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের অনুকরণ। নির্বাচিত গণ মিলিশিয়ার বদলে পেলাম সেই মাইনে পাওয়া যান্ত্রিক পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী।
একই ভাবে ব্যক্তি পুঁজি বাজেয়াপ্ত হলেও পুঁজির মালিক সমাজ হল না, হল রাষ্ট্রযন্ত্র। শ্রমিক পুঁজির মালিক না হয়ে মজুরি-দাস হয়েই রইল। ক্রমশঃ উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হল মানুষ, যার উদ্বৃত্ত শ্রমের মালিক সমাজ না হয়ে হল রাষ্ট্র, বকলমে অ্যাপার্তচিকিদের সুবিধাভোগী শ্রেণী তৈরি হল। অর্থাৎ পুঁজির সামাজিকরণ না হয়ে হল রাষ্ট্রীকরণ, বাস্তবে এল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ।
এই বিশ্লেষণ আরও বড় পরিসরের অপেক্ষা রাখে।
কিন্তু, আমরা বামপন্থীরা, কি পহেলা কদম হিসেবে শুধু মজুরি বৃদ্ধির বদলে কাজের ঘন্টা কমানোর দাবিতে সোচ্চার হতে পারি না? সেই চার দশক আগের শিকাগোর মতন?
===================================================
[ লেখাটির প্রাথমিক খসরা ২০১৮ সালে দেবাশিস দত্ত সম্পাদিত অপরজন লিটল ম্যাগে বেরিয়েছিল। বর্তমান নিবন্ধটি কিঞ্চিৎ সংশোধিত হয়েছে।]
[1] বম বাউয়ের, “কার্ল মার্ক্স অ্যান্ড দ্য ক্লোজ অফ হিজ সিস্টেম” (১৮৯৬)।
[2] জোয়ান রবিন্সন, “ অ্যান এসে অন মার্ক্সিয়ান ইকনমিক্স” (১৯৪২)।
[3] পল সুইজি, “থিওরি অফ ক্যাপিটালিস্ট ডেভেলপমেন্ট”(১৯৭০) ।
[4] মরিস ডব, “ স্টাডিজ ইন দ্য ডেভেলপমেন্ট অফ ক্যাপিটালিজন” (১৯৭৬)
[5] পিয়েরো স্রাফা, “ প্রোডাকশন্স অফ কমোডিটিজ বাই মীন্স অফ কমোডিটিজ” (১৯৬০)।
[6] জোয়ান রবিন্সন , “ দ্য সেকেন্ড ক্রাইসিস অফ ইকনমিক থিওরি এন্ড আদার রাইটিংস”, ত্রিবান্দ্রমের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ দ্বারা প্রকাশিত, ১৯৭৫।
[7] প্রফেসর ফ্রেড মোসলে,” মানি এন্ড টোটালিটি”, ২০১৬।