: মা, মা, বলো না মা, গুরুচণ্ডালি কী মা, গুরুচণ্ডালি কী? // :: চুপ করো, তোমার না জানলেও চলবে, তোমার বাবার ভাট মারার জায়গা /// সংজ্ঞা অনুযায়ী - একই গদ্য রচনায় সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ ঘটালে তাকে গুরুচন্ডালী দোষ বলে //// এ নিয়ে শি. চ. লিখে গেছেন, ভাবলাম সেটা শেয়ার করা উচিত - কার ব্যাগ কে গ্রহণ করল সেটা ভালো করে বোঝা দরকার ... ...
*** *** *** *** *** *** *** ***
সীতানাথবাবু ছিলেন সেকেন্ড পন্ডিত, বাংলা পড়াতেন। ভাষার দিকে তাঁর দৃষ্টি একটুও ভাসা-ভাসা ছিল না-ছিল বেশ প্রখর। ছেলেদের লেখার মধ্যে গুরুচন্ডালী তিনি মোটেই সইতে পারতেন না।
সপ্তাহের একটা ঘণ্টা ছিল ছেলেদের রচনার জন্যে বাঁধা। ছেলেরা বাড়ি থেকে রচনা লিখে আনত- একেক সময়ে ক্লাসে বসেও লিখত। সীতানাথবাবু সেইসব রচনা পড়তেন, পড়ে-পড়ে আগুন হতেন। ছাত্রদের সেই রচনা পরীক্ষা করা, সীতার অগ্নিপরীক্ষার মতোই একটা উত্তপ্ত বিষয় ছিল সীতানাথবাবুর কাছে। যেমন তাঁর তেমনি আমাদেরও। এত করে বকেঝকেও গুরুচন্ডালী দোষ যে কাকে বলে ছাত্রদের তিনি তা বুঝিয়ে উঠতে পারেননি-উক্ত দোষমুক্ত করা তো দূরে থাক।
সেদিনও তিনি ক্লাসসুদ্ধ ছেলের রচনা খাতায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখতে-দেখতে তাঁর চোখ লাল হয়ে উঠল, হাতের দু-রঙা পেনসিলের লাল দিকটা ঘসঘস করে চলতে লাগল খাতার ওপর- রচনার লাইনগুলো ফসফস করে লাল দাগে কেটে-কেটে তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। এর চেয়ে ছেলেদের চাবুকে লাল করা যেন সোজা অনেক-ছিল ঢের আরামের-আর তা করতে পারলে যেন গায়ের ঝাল মিটত তাঁর।
খাতাগুলো পাশে সরিয়ে রেখে তিনি বললেন - ‘এ আর কী দেখব! খালি গুরুচন্ডালী। কতবার করে বলেছি, হয় সাধুভাষায় লেখো, নয়তো কথ্যভাষায়। যেটাতেই লেখো তা ঠিক হবে। কিন্তু একরুনকমের হওয়া চাই। সাধুভাষায় আর কথ্যভাষায় মিশিয়ে খিচুড়ি পাকানো চলবে না। না, কিছুতেই না। কিন্তু এখনো দেখছি সেই খিচুড়ি-সেই জগাখিচুড়ি।’
গণেশ বললে - ‘আমি সাধুভাষায় লিখেছি স্যার।’
‘সাধুভাষায় লিখেছ? এই তোমার সাধু সাধুভাষা?’ সীতানাথবাবু গাদার ভেতর থেকে তার খাতাটা উৎখাত করেন - "কী হয়েছে এ? ‘দুগ্ধফেননিভ শয্যায় সে ধপাস করিয়া বসিয়া পড়িল’?"
‘দুগ্ধফেননিভের সঙ্গে - ‘কেন স্যার, ‘করিয়া’ তো দিয়েছি আমি। করিয়া কি সাধুভাষা হয়নি স্যার?’
‘কিন্তু ধপাস? ধপাস কী ভাষা? দুগ্ধফেননিভের পরেই এই ধপাস?’
গণেশ এবার ফেননিভের মতোই নিভে যায়, টুঁ শব্দটি করতে পারে না।
‘কতবার বলেছি তোমাদের যে, ভাষায় খিচুড়ি পাকিয়ো না। হয় সাধুভাষায় নয় কথ্যভাষায় - যেটায় হয় একটাতে লেখো। কিন্তু দেখো, আগাগোড়া যেন একরুনকমের হয়।
- গণেশের এই বাক্যটিতে তোমাদের মধ্যে নিখুঁত করে বলতে পারো কেউ?’
‘পারি স্যার।’ মানস উঠে দাঁড়াল। কিন্তু দাঁড়িয়েই মাথা চুলকোতে লাগল সে। ধপাস-এর সাধুভাষা কী হবে তার জানা নেই। খানিক মাথা চুলকে আমতা-আমতা করে সে নিজেও ধপাস করে বসে পড়ল। তার মানসে যে কী ছিল তা জানা গেল না। সরিৎ উঠে বলল, ‘কিসে বলব স্যার? কথ্য ভাষায়, না অকথ্য ভাষায়?
‘যাতে তোমার প্রাণ চায়।’
‘দুগ্ধফেননিভ শয্যায় আয়েস করে বসল।’
‘দুগ্ধফেননিভের সঙ্গে আয়েস?’ সীতানাথ বাবুর মুখখানা-উচ্ছের পায়েস খেলে যেমন হয় তেমনিধারা হয়ে উঠে : ‘ওহে বাপু! গুরুচন্ডালী কাকে বলে তা কি তোমাদের মগজে ঢুকেছে? মনে করুনো যে, যে-চাঁড়ালটা আমাদের এই স্কুলে ঝাঁট দেয়, সে যদি হেডমাস্টার মশায়ের সঙ্গে একাসনে বসে, তাহলে সেটা দেখতে কেমন লাগে? সেটা যেমন দৃষ্টিকটু দেখাবে, কতকগুলি সাধু-শব্দের মধ্যে একটা অসাধু-শব্দ ঢুকলে ঠিক সেইরকম খারাপ দেখায়, তাই না? সাধুভাষার শব্দ যে কথ্যভাষার শব্দের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসতে পারে না, সেই কথাই আবার অন্যান্য সাধু-শব্দের সঙ্গে মিশ খেয়ে বেশ মানিয়ে যেতে পারে। যেমন উদাহরণস্বরূপ - ’
‘বলব স্যার? এতক্ষণে আমি বুঝতে পেরেছি।’ বলে ওঠে গণেশ : ‘দুগ্ধফেননিভ শয্যায় আয়াস-সহকারে বসিল। কিম্বা উপবেশন করিল।- হয়েছে স্যার এবার?’
‘কিংবা আরও বেশি সাধুতা করে আমরা বলতে পারি - ’ নিরঞ্জন উঠে দাঁড়ায় : ‘আসন গ্রহণ করিল। কিংবা আসন পরিগ্রহ করিল।’
দীপক বলে, ‘সমাসীন হইল’ও বলা যায়।
‘আবার তুই এর মধ্যে সমাস এনে ঢোকাচিছস?’ গণেশ তার কানের গোড়ায় ফিসফিস করে, ‘এতেই কেঁদে কূল পাইনে, এর ওপর ফের সমাস?’
‘যেমন উদাহরণস্বরূপ - ’ সীতানাথবাবু বলতে থাকেন, কিন্তু তাঁর বলার মাঝখানেই পিরিয়ডের ঘণ্টা বেজে যায়। উদাহরণস্বরূপ প্রকাশের আগেই তাঁকে ক্লাস ছেড়ে যেতে হয়।
নিজের বক্তব্য আরেক দিনের জন্যে রেখে সমস্ত প্রশ্নটাই আমূল মূলতবি করে যান।
দিনকয়েক পরে গণেশ রেশন আনতে গিয়ে দেখল যে, সেকেন্ড পন্ডিত মশাইও সেই সরকারি দোকানে এসেছেন। লম্বা লাইনের ফাঁকে সীতানাথবাবুও দাঁড়িয়ে। সেই কিউয়ের ভেতর মহল্লার ঝাড়ূদার-নিশ্চয়ই সেখানে চন্ডাল-যেমন রয়েছে, তেমনি আছে পাড়ার গুন্ডারা। তারাও কিছু সাধু নয়। গুরুতর লোক। তাদের প্রচন্ডালই বলা যায় বরং। প্রচন্ড তাদের দাপট। পাড়ার সার এবং অসার-সবাই এক সারের মধ্যে খাড়া। একেবারে সমান সমান। রীতিমতোই গুরুচন্ডালী। সীতানাথবাবু ছিলেন সারির মাঝামাঝি। গণেশ অনেক পরে এসে শেষের দিকে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল সীতানাথবাবুকে। চন্ডালদের মধ্যে গুরুদেব-ব্যাকরণ বিরুদ্ধ এই অভাবিত মিলনদৃশ্য দেখে সে অবাক হলো। সত্যি বলতে সে-দৃশ্য অবাক হয়ে দেখবার মতোই।
সীতানাথবাবুর দৃষ্টি কোনোদিকে ছিল না। অজগরের মতো বিরাট লাইন যেন কচছপের গতিতে একপা- এক-পা করে এগুচ্ছে। কতক্ষণে রেশন নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরবেন, হাঁড়ি চড়িয়ে চান সেরে নাকে-মুখে দুটি গুঁজে পাড়ি দেবেন স্কুলে, সেই ভাবনাতেই সমস্ত মন পড়েছিল তাঁর।
সহসা এক বালকসুলভ তীক্ষ্ণকণ্ঠ তাঁর কানে এসে পিন ফোটাল। ফুটতেই তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন-‘স্যার, স্যার ! ব্যগ্র হোন কল্য।’ ‘ব্যগ্র হোন কল্য?’ শুনতে পেলেন তিনি। শুনেই তিনি পিছন ফিরে তাকালেন। দেখতে পেলেন গণেশকে। কিউয়ের শেষে দাঁড়িয়ে চিৎকার ছাড়ছে : ‘ব্যগ্র হোন কল্য।’
তার মানে? কেন তিনি ব্যগ্র হবেন? আর হন যদিবা তো তা কালকে কেন? ব্যগ্র যদি হতেই হয় তো আজকেই কেন নয়? এই মুহূর্তেই বা নয় কেন? আর, এই মুহূর্তে ব্যগ্র হয়েই বা কী হবে? কিউয়ের লাইন তো আর ছেলেদের খাতার লাইন নয় যে পেনসিলের এক খোঁচায় ফ্যাঁশ করে কেটে এগিয়ে যাবেন! যত তাড়াই থাক, যতই ব্যগ্র হন, আগের লোকদের কাটিয়ে এগুবার একটুও উপায় নেই এখানে। ফাঁড়ার মতোই অকাট্য এই লাইন। ফাঁড়ির মতোই ভয়াবহ।
‘স্যার স্যার-পুনরায়! পুনরায়! ব্যগ্র হোন কল্য! ব্যগ্র হোন কল্য!’ আবার সেই আর্তনাদ। সীতানাথবাবুর ইচ্ছে করে এক্ষুনি গিয়ে বেশ একটু ব্যগ্রভাবেই গণেশের কানদুটো ধরে মলে দেন আচ্ছা করে। বেশ করে মলে দিয়ে বলেন, ‘এই মললাম অদ্য। ফের মলব কল্য।’ কিংবা তুলে ধরে এক আছাড় মারেন ওকে। কিন্তু ওকে পাকড়াবার এই ব্যগ্রতা দেখাতে গিয়ে লাইনের জায়গা পা-ছাড়া করার কোনো মানে হয় না।
আস্তে-আস্তে এগিয়ে দোকানের ভেতর পৌঁছে রেশনের দাম দিতে গিয়ে তাঁর চোখ কপালের কানায় ঠেকল যেমন একটু আগে তাঁর কান চোখা হয়ে উঠেছিল। দ্যাখেন যে তাঁর পকেট মারা গেছে। পকেটের যেখানে টাকার ব্যাগটা থাকে, সেখানটা ফাঁকা। বৃথা হইচই না করে বিমুখে তিনি দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন।
‘স্যার, তখন আমি কী বলছিলাম? আমি অত করে বললাম, তা আপনি কানই দিলেন না। আদৌ করুনাপাতই করলেন না !’ গণেশ অনেকটা এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। দোকানের মুখে পৌঁছে মাস্টারের সম্মুখে পড়েছে। ‘কী বলেছিলে তুমি? তুমি তো আমায় কাল ব্যগ্র হতে বলেছিলে? আর এদিকে আমার আজ সর্বনাশ হয়ে গেল!’
‘কাল ব্যগ্র হতে বলেছি? মোটেই না। আমি বলেছিলাম আপনার ‘ব্যগ্র গ্রহণ করুনল’। আপনার পরেই যে লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল, সে হতভাগাই পেছন থেকে আপনার পকেটে হাত ঢুকিয়ে - ’
‘তা, ‘পকেট মারল’ বলতে তোর কী হয়েছিল রে হতমুখ্য?’ সীতানাথবাবুর সমস্ত রাগ এখন গণেশের ওপর গিয়ে পড়ে : ‘সোজাসুজি তা বললে কী হতো? তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো তোর? ‘পকেট মারছে সার’- বলতে কী আটকাচিছল তোমার পাপমুখে?’
‘ছি-ছি গণেশ!’ নিজের জিভ কাটে-‘অমন কথা বলবেন না স্যার! ‘পকেট মারছে’ - সে কথা কি আপনার সামনে উচ্চারণ করতে পারি? পকেট প্রহার করুনছে বললেও তো শুদ্ধ হয় না। আর বলুন, গুরুমশায়ের সামনে অমন চন্ডালের মতন ভাষা কী বলতে আছে-বলা যায় কী? ও কথা-অমন কথা বলবেন না স্যার। ব্যগ্র গ্রহণ করুনল বলেছি-জানি যে, তাও সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হয়নি, গুরুচন্ডালী একটুখানি যেন রয়ে গেছে; ভাবলাম, কতবার ভাবলাম, কিন্তু কী করুনব, ব্যাগের সাধুভাষা যে কী তা তো আমার জানা নেই স্যার। কিন্তু কিছুতেই ব্যাগের শুদ্ধটা মগজে এল না। এদিকে ভাবতে-ভাবতে ব্যাগসুদ্ধ নিয়ে সে যে সটকাল!’
( শিবরাম চক্রবর্তী )
ঃ-))