@b, লেখাটাকে খেরোর খাতায় নিয়ে গেছি, একটু ভাল করে লেখার আছে, বেশ কয়েকটি বিষয়, এইখানে দেখতে পাবেন,
পরের অংশ (২ য পর্ব):
---------
এখানে যে কথাটা বিশেষ করে বলার, দেশের প্রতিটি নাগরিকের একই রকমভাবে সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, সমাজ বা দেশে যে ধরণের ধনসম্পদ সকলের উপভোগ করার কথা, সেখানে তারো আর চার পাঁচ জনের মতই সমান ভাগ থাকা উচিৎ, এইটাই নৈতিক | ধরুন সরকার (স্থানীয় সরকার, কাউনসিল, ইত্যাদি) পরিচালিত একটি পার্ক, সেখানে গরীব বড়লোকের সমান যাতায়াতের অধিকার থাকা চাই, নৈতিকতার খাতিরে শুধু নয়, সুস্থ সমাজে বসবাস করার এইটাই সর্বাগ্রে বিবেচিত শর্ত। বেঁচে বর্তে থাকার ক্ষেত্রেও , বা চিকিৎসা পাবার ব্যাপারটাও একই, মানুষের কাছে অর্থের তারতম্য হতে পারে, এই তারতম্য যেন তার স্বাস্থ্যের অধিকার অর্জন করার ক্ষেত্রে, অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায় । এই যে স্বাস্থ্যের অধিকার লিখলাম, সেটা তার মানে আসলে মানুষের স্বাস্থ্য পরিষেবা নাগালে পাবার অধিকার, সমান অধিকার | এটা নাগরিক সাম্যের, সমতার প্রশ্ন।
বেশ। স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা চলছে, আপনি প্রশ্ন করতে পারেন যে পরিষেবায় নাগাল পাবার ব্যাপারে বৈষম্য যে রয়েছে (নাকি নেই), বুঝবো কোন উপায়ে?
একটা মনগড়া গল্প দিয়ে শুরু করি। রামবাবু আর শ্যামবাবু পাশাপাশি বাড়িতে থাকেন। দুজনেরই এক অসুখ। রামবাবুর ডায়াবিটিস আছে দীর্ঘকাল ধরে, ওষুধ নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে বেশ কয়েক বছর চলল, ভদ্রলোক ছোটখাট একটি দোকানে কাজকর্ম করেন, কোনমতে দিন গুজরান হয়। রামবাবুর পাশের বাড়িটি শ্যামবাবুর, তিনি বড় বেসরকারী আপিসের চাকুরে, মোটা মাসমাইনে। শ্যামবাবুরও ইদানীং কয়েক সপ্তাহ হল ডায়াবিটিস ধরা পড়েছে, শ্যামবাবুও রামবাবুর মতন ওষুধ নিয়ে চালান, তবে সে তেমন আহামরি কিছু নয়। তিন মাসে একবার ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে দিব্যি চলছে। ডাক্তারের যা ফি, রামবাবুর দেবার ক্ষমতা নেই, কাজেই তিনি প্রাইভেট ডাক্তার নিয়ম করে দেখান না, সময় সময় প্রেসক্রিপশনে মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে যা পড়ে, সেইটুকুই | দিব্যি চলছিল, একদিন রামবাবু লক্ষ করলেন, তাঁর ইদানীং শ্বাসকষ্ট হয় । ডাক্তার দেখাতে পারলে ভাল হত, কিন্তু ডাক্তারের ফি'র কথা ভেবে চেপে গেলেন। সরকারী হাসপাতালে যেতে পারতেন, কিন্তু গেলে দিনের বেলা আউটডোরে যেতে হয়, সারাদিন কাজে কামাই করলে খিটখিটে মালিক হুমকি দিয়ে রেখেছেন কাজটি যাবে, কাজেই সরকারী হাসপাতালে গিয়ে যে সস্তায় দেখিয়ে আসবেন তারও জো নেই। এই করে রামবাবুর আর চিকিৎসা হল না, একদিন সাংঘাতিক অবস্থা, রাস্তায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলেন, পাড়ার লোকে ধরাধরি করে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে এল। তারপর দিন দশেক যমে মানুষে টানাটানি, কোনমতে বিস্তর টাকাকড়ি খুইয়ে (তার বেশ কিছু অংশ অবশ্য সরকারী খরচায় গেল) ভদ্রলোক বাড়ি ফিরে এলেন বটে, কিন্তু এতে করে যা ধার দেনা হল, তাতে বেচারী আরো গরীব হয়ে গেলেন।
গল্পটা না হয় বানানো, তবু কতগুলো ব্যাপার নজর করুন। রামবাবুর আর শ্যামবাবুর দুজনেরই এক রকমের অসুখ, রামবাবুর অবস্থা শ্যামবাবুর চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশী সিরিয়াস, ডাকতার দেখানোর প্রয়োজনও তাই বেশী, তবু যেহেতু অর্থাভাব, পারলেন না, আর শ্যামবাবুর সে বালাই নেই। তার মানে যেটা দাঁড়ায়, সমাজে স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবার ব্যাপারে কে কতটা অসুস্থ তার ভিত্তিতে অগ্রাধিকার হল না, কার কাছে কত সম্পদ (টাকা পয়সা, ধনসম্পদ) তার ভিত্তিতে মানুষের চিকিৎসার বন্দোবস্ত হল। শুধু তাই নয়, এই যে বৈষম্য, এর ফলে রামবাবুর যে অসুখটি প্রাথমিক চিকিৎসা কি আউডোরে দেখালে চলে যেত, সেটি হল না, ফলে শেষমেষ শুধু তাঁর ভোগান্তি তাই নয়, স্বাস্থ্য দপ্তরেরও ভর্তি করে চিকিৎসার পেছনে অনেকটা খরচা হল (যেটা এড়ানো যেত) | এই ব্যাপারটি equity র সমস্যা। কারণ সরকারী হাসপাতাল, চিকিৎসাব্যবস্থা তো রয়েছে, যেটা নেই (আপাতভাবে), সরকারী তরফে রামবাবুদের মত মানুষদের জন্য আলাদা করে সরকারী তরফে চিকিৎসার বন্দোবস্ত "করিয়ে দেওয়া" | সরকারী তরফে সকলের সমান সুলভ মূ্ল্যে চিকিৎসা করার বন্দোবস্ত করার ব্যাপারটি সমতার প্রশ্ন, আর আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা রামবাবুদের মত মানুষদের জন্যে আলাদা করে কিছুটা সুবিধে করে দিয়ে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে দেওয়া যদি যেত, সেটিকে আমরা ইকুইটেবল বলতাম।
আমরা সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি এর পরিপ্রেক্ষিতে দেখব। এখন সমাজের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষের সামাজিক সুরক্ষা, যাতে তাঁরা সুস্থ সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারেন, আরো দারিদ্র্যের মধ্যে না পড়েন, এটি কার দেখার দায়িত্ব? সাধারণভাবে একটি গণতান্ত্রিক দেশে এই দায়িত্ব সে দেশের সরকারের ওপরেই বর্তায়। সাধারণভাবে সরকারী তরফে তিন রকমের ব্যবস্থা করা হয় - সামাজিক বীমার ব্যবস্থা (বার্ধক্য ভাতা, বেকার ভাতা, বিনামূল্যে চিকিৎসার বন্দোবস্ত, এ নিয়ে পরে আরো বিস্তারিত লিখছি), সামাজিক সহায়তা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য যোজনা, ক্যাশ ট্রানসফার), আর লেবার মারকেট রিফরম (ন্যূনতম মজুরী, মালিকের তরফে বীমার বন্দোবস্ত করা, কাজের জায়গাটিকে নিরাপদ করে তুলতে আইনগত ভাবে বাধ্য করা)।
এর পেছনে দারিদ্র্য দূর করার একটা বড় ভূমিকা আছে, আর গরজও আছে কিছুটা| তার আলোচনায় sustainable ডেভেলপমেন্ট goal নিয়ে আলোচনা করা যাক। তারপর দেখা যাক, পৃথিবীতে কে কোথায় দাঁড়িয়ে, আর কোভিড১৯ এর প্রকোপে কি বারোটা বাজতে চলেছে।
তৃতীয় পর্ব
----------
কথা হচ্ছিল দারিদ্র নিয়ে, দেশের ও দশের উন্নয়ন নিয়ে | উন্নয়ন বললে কোন কথাটা মনে হয়?
উন্নয়ন বলতে কি শুধুই ঝাঁ চকচকে মল, হাসপাতাল, আবাসন, ফ্লাইওভার, হাইওয়ে, এয়ারপোর্ট, বুলেট ট্রেন, গাড়ীর সমারোহ?
না কি দুনিয়া জুড়ে উন্নয়ন, বড়লোকি, গরিবীয়ানা, পরিবেশ ধ্বংস, মানুষের রোগভোগ, নতুন নতুন মহামারী, সমস্ত কিছু পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে এক সমাপতনে জড়িত, সেটাও? এই উন্নয়ন স্থায়ী হতে পারে? হওয়া সম্ভব? কারণ তার পাশাপাশি যত গরীব মানুষের সংখ্যা বাড়বে, তত শারীরিক, মানসিক, সামাজিক রোগভোগ বাড়বে, তত সমাজে মানসিক সমস্যা বাড়বে, তত পরিবেশের বারোটা বাজবে, যত পরিবেশ ধ্বংস হবে, তত উষ্ঞায়ণ তার করাল গ্রাসে আমাদের ফেলবে, তত মহামারী ভয়ংকর আকার ধারণ করবে, সব মিলিয়ে সে এক অকহনীয় সমস্যা |
মোট কথা, তাই যদি হয়, মানবসভ্যতার টিকে থাকার মেয়াদ আর কতদিন?
আর একটু এগিয়ে, আমাদের শেষ অবধি যদি টিকে থাকতে হয়, তাহলে সত্যিকারের উন্নয়নকে দীর্ঘায়িত করতেই হবে। আর সেটা করতে গেলে জগৎ জোড়া দারিদ্র্যকে দূর করা, আর গরীব, এবং গরীব নন, উভয় তরফের মানুষের সমাজ রক্ষার একটা বন্দোবস্তও করতে হয়, প্রকৃতি এবং পরিবেশ বাঁচিয়েই |
কেননা অর্থাভাব ও দারিদ্র্যের সঙ্গে অমানবিক জীবনযাপন, রোগভোগ, মৃত্যুর, ও শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক | গরীব মানুষ নানান কারণে অস্বাস্থ্যে-কুস্বাস্থ্যে ভোগেন। বেশীর ভাগ গরীব মানুষ অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে বসবাস করতে বাধ্য হন, যেমন ধরুন বস্তি বা ঝুপড়ির মধ্যে, যার জন্য ঘিঞ্জি পরিবেশে শ্বাসনালীজনিত রোগ, যেমন ধরুন টিবি, বা নিউমোনিয়া মারাত্মক রকমের সমস্যা। পৃথিবীর দরিদ্রতম অঞ্চলে, গরীব দেশগুলোতে ম্যালেরিয়া, টিবি, আর এইডস এর মারাত্মক রকমের প্রাদুর্ভাব | শুধু তাই নয়, অর্থাভাবে পড়ে গরীব মানুষ এমন সমস্ত ব্যাপারে সংকটাপন্ন হন, যে এক থেকে আরেক, ক্রমশ পাকেচক্রে পড়তে থাকেন। ধার দেনায় ডুবে যান বহু লোক, সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে অনেকের কাছে, নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, অবসাদ জনিত অসুখ, মানসিক অসুখে ভুগতে থাকেন, এদিকে ওষুধ কেনার পয়সা নেই, কারো কাছে যে চিকিৎসা করাতে যাবেন বা নিদেন পক্ষে সরকারী হাসপাতাল থাকলেও শেষ পর্যন্ত পৌঁছন আর হয়ে ওঠে না | ঝড় ঝাপটায় ঘরবাড়ি লণ্ড ভণ্ড হয়ে গেলে সারিয়ে নেবার পয়সাও থাকে না বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে | বিপজ্জনক জীবন। এমন সব কাজকর্ম করে দিন গুজরান করতে হতে পারে, যাতে শরীর আরো খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক | এ তো গেল যাঁদের কিছু গায়ে গতরে খেটে কিছু কাজ জুটেছে, বহু লোকের আবার সেটুকুও জোটে না, এদিকে ধরুন প্রজন্ম ধরে দারিদ্র্য, ফলে লেখাপড়া দূরস্থান, হাতে কলমে কিছু কাজ যে করে বা ব্যবসা করে দিন চালাবেন, তারও উপায় নেই | এ তো ধরুন যাদের ট্র্যাডিশনালি সাধারণ ভাবে গরীব বলে মনে করি তাদের অবস্থা।
এর বাইরে, বিশেষ করে কোভিডের এবং কোভিডের মত অসুখের কল্যাণে আরেক দল মানুষ যাঁরা গরীব মানুষ বলে গণ্য হন না, আগামী বেশ কয়েক বছরের মধ্যে গরীব হতে চলেছেন, এঁরা পরিভাষায় "নব্য গরীব" | এঁরা এতদিন বা এককালে গরীব ছিলেন না, করে কম্মে খেতেন, হাতে যাহোক অর্থও আছে বা ছিল, অন্তত দিন চলে যেত, লেখাপড়া জানেন, গরীব বলতে যে মানুষের ছবিগুলো মনে ভেসে ওঠে, এঁরা তা নন।চলছিল একরকম, এর মধ্যে কোভিড১৯ এর জেরে চাকরীটি গেল, ব্যবসাপাতিও তথৈব, কাজকর্ম শিকেয়, কেউ ব্যবসায়ে গণেশ ওল্টালেন, আবার কেউ কেউ চাকরী যাবার পর আর চাকরী জোটাতে পারলেন না, যা জমিয়ে ছিলেন, কলসি গড়িয়ে জল খেতে খেতে তাও একদিন শেষ, কালক্রমে দারিদ্র-সীমার নীচে স্থান সঙ্কুলান | এঁরা নিরক্ষর নন, এঁদের স্বাস্থ্যগত অসুবিধে নেই, তথাপি এঁরা আর চার পাঁচজন গরীব মানুষের মতনই সামাজিক দুর্বলতার পাল্লায় পড়ে গেলেন।
এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে দেখা যাক, সামাজিক সুরক্ষা আর তাকে মাপযোক করার প্রশ্নটা ।
তার আগে sustainable development goal সম্পর্কে দু-চার কথা বলে নেওয়া যাক |
(ক্রমশ )