রাষ্ট্র এবং ন্যায় ও সমতা
জন রলস (১৯২১ –২০০২)[1] বললেন যে এই হিতবাদ বা ইউটেলিটারিয়ান তত্ত্ব ধরে নিয়েছে যে রাষ্ট্রের সংস্থাগুলো সব ঠিকঠাক এবং সুব্যবস্থিত। ফলে গড়পড়তা সুখ বা কল্যাণসাধন সহজেই সম্ভব। কিন্তু ওই আনন্দ ও কষ্টের ধারণা খুব সীমিত। এতে বাদ পড়ে যায় মানবজীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা ও অনুভূতি যা আমাদের সন্তোষ বাড়াতে পারে—যেমন, জ্ঞানের পিপাসা, স্বাধীন চিন্তা, ব্যক্তিগত উন্নতি এবং শিল্পের আনন্দ ।
আবার নৈতিক প্রশ্নে শুধু ফলাফল নিয়ে মাপতে গেলে মুশকিল আছে। ‘এন্ড জাস্টিফায়েজ মীন্স’ বা উদ্দেশ্য মহৎ হলে যেকোন পন্থা মেনে নেয়া যায় – সবসময় ঠিক নয়।
ধরুন, উন্মত্ত জনতা অন্য সম্প্রদায়ের কাউকে চুরি, গোহত্যা বা ছেলেধরার বা খুনের অভিযোগে ধরে এনেছে। এখানে ব্যক্তিটির দোষ সন্দেহাতীত নয় । কিন্তু জনতা চাইছে হাতে গরম ন্যায়। থানায় রয়েছে অল্প পুলিশ, তারা কি করবে? না বাঁচালে মবলিঞ্চিংর চোটে লোকটি মারা যাবে । কিন্তু একজনকে বাঁচাতে গিয়ে গুলি চালালে একাধিক লোক মরবে। তারপর দাঙ্গায় দুই সম্প্রদায়ের আরও লোকজন মারা যাবে। এখানে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি পুলিশ প্রশাসন কী করবে?
এখানে ইউটিলিটিয়ান থিওরি মানলে যা কম -সে- কম দুঃখ দেবে তাই করা উচিত, অর্থাৎ লোকটিকে উন্মত্ত জনতার থেকে ছিনিয়ে আনা উচিৎ নয় । একেবারে ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় মৈত্র মহাশয়ের অ্যাকশন!
কিন্তু ব্যাপারটা এত সরল নয়। পালটা উদাহরণ দেখুন।
যদি কাল জানাজানি হয়ে যায় যে অপদার্থতা ঢাকতে রাষ্ট্র একজন নিরপরাধের বলি চড়িয়েছে? তার প্রতিক্রিয়া?
রলস আরও বলেন যে রাষ্ট্র যদি পক্ষপাতহীন না হয় তাহলে নাগরিক কী করে তার থেকে ন্যায়পূর্ণ ব্যবহার আশা করতে পারে? ফলে রাষ্ট্রের সম্পদ বিতরণে মোট প্রান্তিক সন্তোষ বেড়ে গেলেও বেশির ভাগ লোকের হিত কমে যেতে পারে।
এটা যেন রলস আজকের ভারতের কথা বলছেন। আমাদের জিডিপি বাড়ছে, আমরা বড় মুখ করে বলছি। কিন্তু জিনি সূচক বাড়ছে—মানে অসাম্য বাড়ছে। ভারতের শীর্ষ ১% ধনীর হাতে গোটা দেশের সম্পত্তির ৭৩% বা নীচের দিকের ৭০% জনসংখ্যার সম্পত্তির চারগুণ। এটা অক্সফ্যামের অধ্যয়ন যা ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের সামনে ২০১৮তে পেশ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে ভারতের বিলিওনারদের সম্পত্তির পরিমাণ সরকারের একবছরের বাজেটের চেয়ে বেশি।[2]
রলস জোর দিলেন দুটো বিষয়ে।
এক, রাষ্ট্রকে পক্ষপাতহীন হতে হবে। তার জন্যে আগে রাজনৈতিক সংস্থাগুলোকে ঠিক করতে হবে। এক বিশেষ অর্থে আমরা সবাই সমান। আইনের চোখে সব নাগরিক সমান বললেই হবে না। দেখতে হবে কেউ যেন জন্মসূত্রে বা অন্য কোন ভাবে প্রাপ্ত ধনবল অথবা সামাজিক মর্যাদার জোরে রাষ্ট্রের কাছে বেশি সুযোগ না পায় । অথবা তার জন্যে সে যেন তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। ধরা হোক আমি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে চাই বা আমি কোন ধর্মে দীক্ষিত হতে চাইনা। তাতে যেন রাষ্ট্রের থেকে আগে যেসব অধিকার ও মর্য্যাদা পাচ্ছিলাম তা যেন অটুট থাকে।
হবস, লক , রুশো এবং কান্ট মনে করতেন --সমান এবং মুক্তমনা নাগরিকদের নিয়ে শিক্ষিত উদার এবং পারস্পরিক সহযোগিতামূলক আধুনিক সমাজ গড়ে তোলা রাষ্ট্রের লক্ষ্য; এর সঙ্গে রলস জুড়ে দিলেন—ন্যায়পরায়ণ রাজনৈতিক কাঠামোর শর্ত।
উনি আরও বলেন যে এর জন্যে দরকার মোট আয় বা জিডিপি বা গড়পড়তা সন্তোষ বৃদ্ধির হিসেব কষা ছেড়ে সবচেয়ে বঞ্চিত বা পিছিয়ে পড়া মানুষটির দিকে নজর দেওয়া।
দুই, রলস চিহ্নিত করেছেন খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, সমান সুযোগ, জাত-ধর্ম-ধনবল নির্বিশেষে সমান সম্মান ইত্যাদি পনেরটি জিনিসের একটি ঝুলি যাকে উনি বলছেন প্রাইমারি গুডস। যদি রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককে অন্ততঃ ওই প্রাইমারি গুডসের প্রাপ্তিটুকু সুনিশ্চিত না করতে পারে তাহলে সেটা ‘ন্যায়পরায়ণ’ (ফেয়ার) নয়।
রাষ্ট্র এবং সাম্যঃ ক্যাপাবিলিটি বা সক্ষমতার তত্ত্বঃ
চিন্তা এখানেই থেমে যায়নি। অমর্ত্য সেন (১৯৩৩)[3] এবং মার্থা নুসবাম (১৯৪৭)[4] রলসের ন্যায়ের এবং রাষ্ট্রের বিমূর্ত ধারণার পরিবর্তে আনলেন বাস্তব দুনিয়ায় ‘ক্যাপাবিলিটি’ বা সক্ষমতার ধারণা। এঁরা বলছেন শুধু আজকে কোন ব্যক্তি সমাজের বা জীবনযাপনের কোন স্তরে আছে ( অমর্ত্য সেনের ‘বিইং) দেখলে চলবে না দেখতে হবে মানুষটির কী কী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল এবং তার জন্যে রাষ্ট্র কী ভূমিকা পালন করছে। যেমন যে পরিযায়ী শ্রমিকটি কাজ ও বাসস্থান হারিয়ে দিশেহারা সে সামান্য খিচুড়ি ও ঘরে ফেরার ট্রেনভাড়া পেলেই রাষ্ট্রের কল্যাণকারী ভুমিকায় পঞ্চমুখ হবে; অন্য কোন বিকল্প সম্ভাবনার কথা ভাববে না।
মার্থা তুলে ধরেছেন দশটি মাপকাঠি ( যার মধ্যে যে কোন রাজনৈতিক সংস্থায় পদের জন্যে প্রার্থী হওয়ার, নিজের পছন্দ মত ভালবাসার, বা খেলতে পারার অধিকার সামিল) যা ওঁর মতে মানুষের পূর্ণতার ন্যুনতম শর্ত (থ্রেশহোল্ড লিমিট)। মার্থা এই সূচীকে অন্তিম মনে করেন না । বরং দেশকালের বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে বিস্তৃত করতে চান।
এঁদের এই সক্ষমতার তত্ত্বের মূলে ওতপ্রোত রয়েছে দুটো ধারণা।
এক, আমার ভালো থাকার বা হিতসাধনের অধিকার একটি প্রাথমিক এবং নৈতিক ব্যাপার।
দুই, এই নিজস্ব হিতসাধনের স্বাধীনতাকে বুঝতে হবে ব্যক্তির মধ্যে নিহিত সম্ভাবনা এবং সেটা নিয়ে সে কী করতে চায় এবং তার জন্যেও রাষ্ট্র তাকে কতটুকু সুযোগ দিচ্ছে তার ভিত্তিতে।
এইভাবে অমর্ত্যরা গড়ে তোলেন ইউটেলেটিরিয়ান ধারণার পালটা একটি তত্ত্ব যা মানুষের হিতসাধনে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে আরও বিস্তৃত করবে। [5]
সমতা ও স্বাধীনতাঃ
অমর্ত্য প্রশ্ন তোলেন ‘সমতা’ বা ইকুয়ালিটির প্রচলিত ধারণা নিয়ে । বলেন কোন একটি মাপকাঠিতে সাম্য অন্যদিকে অসাম্যের সৃষ্টি করে।
যদি সবার আয় সমান করে দেওয়া হয় তাহলে তাদের জীবনযাত্রার মান অ-সম হবে। যেমন দিল্লি, মুম্বাই ও কোলকাতায় একই মানের বাড়ির ভাড়া বা দামে আকাশ পাতাল তফাৎ। আবার যদি সবার আবাসন সমান করে দেওয়া হয় তাহলে তাদের আয় সমান হবে না । কাজেই ব্যক্তিকে পছন্দ করার স্বাধীনতা দিতে হবে। কেউ হয়ত শহরে নয় গ্রামে থাকতে চায়; কেউ সারাজীবন ছবি আঁকতে চায়।
অমর্ত্যের মতে রলসের সমান সুযোগের ধারণাটিতে সক্ষমতার প্রশ্নটিকে বাদ দিয়ে কেবল সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্থার ‘ন্যায়পরায়ণতা’র দিকে বেশি জোর দেওয়ায় সমাজ ও রাজনীতিতে ব্যাপ্ত অসাম্য চাপা পড়ে যায়। যেমন ভারতে ‘আরক্ষণ’ প্রশ্নে কেবল ‘মেধা’র পক্ষে যাঁরা ওকালতি করেন তাঁরা সমান খেলার জমির প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। অসাম্যভিত্তিক সমাজে জন্ম নেওয়ার ‘দোষে’ কেউ কেন শাস্তি পাবে?
অমর্ত্যের চোখে সাম্যের ধারণায় ব্যক্তিমানুষের ফ্রীডম (স্বাধীনতা) এবং অটোনমির ( স্বাতন্ত্র্য) ধারণা নিহিত। তাই সাম্যভিত্তিক সমাজে ফ্রীডমের ছবি তুলে ধরতে উনি মার্ক্সের ‘জার্মান ইডিওলজি’ থেকে উদ্ধৃত করেন মাছ ধরা, শিকার করা, সমালোচনায় মেতে ওঠা নিয়ে সুপরিচিত প্যারাগ্রাফটিঃ
“ (যেখানে সমাজ সুনিশ্চিত করবে এমন পরিস্থিতি) যাতে আমি সকালে একরকম ও বিকেলে আরেকরকম কাজ আমার ইচ্ছে মত করতে পারি”[6]।
স্পষ্টতঃ লেনিনের “রাষ্ট্র ও বিপ্লব” লেখাটিতে “শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বে” পরিচালিত এক পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে ছবি ফুটে ওঠে তার থেকে এঁদের কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা একেবারে ১৮০ ডিগ্রিতে দাঁড়িয়ে।
ন্যায় ও সমতা নিয়ে আরও কিছু কথা
মানুষ কীসে সমান? সমতার ধারণা কি ন্যায়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ? নাকি এক স্বয়ংসম্পূর্ণ নৈতিক আদর্শ ?
এর উত্তর বোধহয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের বর্বর অসংবেদনশীল ব্যবহারের ফলে জনৈক কালো মানুষের মৃত্যুতে যে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বলে জন-আন্দোলনের জোয়ার, তাদের বক্তব্যে রয়েছে।
‘গায়ের রঙ্গে পোষাকে আসাকে বা ধর্ম ভাষার ভিত্তিতে এক নই , কিন্তু আদমের পুত্র হিসেবে কিছু অধিকার আছে। আমাদের গুণতির মধ্যে ধরতে হবে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’।‘ উই অ্যাকনলেজ , রেসপেক্ট অ্যান্ড সেলিব্রেট ডিফারেন্সেস অ্যান্ড কমনালিটিজ’।[7]
তাই করোনার সময় দর্শকশূন্য মাঠে টেস্ট ম্যাচ খেলতে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ডের প্লেয়াররা এক হাঁটু গেড়ে বসে মুঠো করা হাত তুলে ধরে । একসময়ের প্রবাদপ্রতিম বোলার মাইকেল হোল্ডিং বলেন–রাজনীতিকে বাদ দিয়ে শুদ্ধ নিরপেক্ষ ক্রিকেট অলীক কল্পনা। [8] এটা কি ‘শুদ্ধ নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে’র ধারণার জন্যেও খাটে না?
সমতা মানুষের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির উপায়ঃ আঠেরশ শতকে মেরি উলস্টোনক্র্যাফট দেখিয়েছিলেন
আয় অর্জনে সমতা, শিক্ষা ও ভোটাধিকারের সমতা কীভাবে মানুষে মানুষে সম্পর্ক পালটে দেয় । বিশেষ করে মেয়েদের ভোটাধিকার পরিবারে ও সমাজে তাদের অবস্থান বদলে দেয়। ওঁর মতে অসাম্যের ফলে সবাই ভোগে। গরীবেরা বেশি, মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত হওয়ার চিন্তায়, ধনীরা ধনরক্ষার চিন্তায়।
“যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে ফেলিছে যে নীচে,
পশ্চাতে ফেলিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।“
তাই সমতা ‘উপায়’ হিসেবে আরেকটা কাজ করে—রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারের পায়ে বেড়ি পরায়। যেমন হেবিয়াস কর্পাস রিট পিটিশনের অধিকার। কাউকে রাষ্ট্র ঘর থেকে জিগ্যেস করার নাম করে তুলে নিয়ে ২৪ ঘন্টার বেশি আটকে রাখতে পারে না। এমন হলে তার বাড়ির লোকজন হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাসের রিট লাগিয়ে দাবি করতে পারে যে বন্দীকে আদালতে সশরীরে হাজির করা হোক । মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে নাগরিক হাইকোর্ট বা সুপ্রীম কোর্টে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে। এই পদ্ধতিগত সমতার প্রশ্নেই আজকাল এলজিবিটি এবং শারীরিক রূপে বিশেষ সক্ষমরা নিজেদের সম্মানের প্রশ্নে আইনি স্বীকৃতি পেয়েছেন। ‘সমান কাজের জন্যে সমান বেতন’ –নারীপুরুষ সবার জন্যে একটি স্বীকৃত নীতি এবং সুপ্রীম কোর্টের অনেক রায়ের ভিত্তি।
কিন্তু সমতাকে যদি শুধুমাত্র উপায় না ভেবে লক্ষ্যও ভাবি?
ইগালিটেরিয়ান দর্শনঃ মানুষ যেন ভাগ্যের কারণে অন্যদের তুলনায় সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, এবং যার জন্যে সে নিজে দায়ি নয় (জন্ম, সামাজিক অবস্থান) তার জন্যে সমাজের সম্পদের বন্টনে বাদ না পড়ে যায়। রাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে মানুষকে দুর্ভাগ্যের স্বীকার হতে না দেওয়া।
রাষ্ট্র মাঝখানে আম্প্যায়ার না হলে মানুষ খোলাখুলি ভাগ্যতাড়িত বৈষম্যের স্বীকার হয়ে দুর্ভোগ ।
প্রশ্ন ওঠেঃ আমাদের স্বেচ্ছায় বেছে নেয়া কাজের ফল আর ভাগ্যতাড়িত কাজের ফলের মধ্যে তফাৎ করা সবসময় সম্ভব কি? আমাদের সব নির্ণয় কি স্বতন্ত্র? কিছু নির্বাচন কি পরিস্থিতি বা ভাগ্যের চাপে বাধ্য হয়ে করা নয়? স্বাতন্ত্র্য এবং ভাগ্যের সীমারেখা কি মাঝেমাঝে মুছে যায় না? সমতাবাদী দর্শন বলবে মানুষের নির্ণয়ের ভুলের জন্যে রাষ্ট্র যেন তার সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ না করে। জেল খেটে আসা মানুষ যেন আগের মতই অন্যদের সমান সুবিধা ও সুযোগ পায়।
বর্তমান শতাব্দীর একজন মহত্বপূর্ণ সমতার পক্ষধর দার্শনিক, জন রলসের প্রাক্তন ছাত্রী এলিজাবেথ অ্যান্ডারসন, বলেন সমতার লক্ষ্য শুধু ‘দুর্ভাগ্যের’ বলি মানুষের (গরীবঘরে জন্ম, বাপ-মার উদাসীনতা, দুর্ঘটনা) পাশে দাঁড়ানোয় সীমিত নয় , রাষ্ট্রের কাজ হল সামাজিক দমনপীড়নকে আটকানো যাতে সমাজে সবাই নৈতিক ভাবে তার যা প্রাপ্য তা পেতে পারে। এমন সমাজের নির্মাণ যার ভিত্তি হল সবাইকে সমানভাবে স্বীকার করা। তার বৈচিত্র্যময় জীবনকে স্বীকৃতি দেওয়া। [9]
আইনের চোখে সব সমান? বাস্তবে তাই কখনও হয়?
বিগত আগস্ট ২০১৯ সালে কাশ্মীরে বাড়ি থেকে তুলে বিনাবিচারে আটকে রাখা বেশকিছু মানুষের(যাদের মধ্যে নাবালিকও রয়েছে) হেবিয়াস কর্পাস আবেদন হাইকোর্ট শোনে ধীরে সুস্থে। অথচ সরকারের পছন্দের একটি ইংরেজি চ্যানেলের মালিক তথা অ্যাঙ্করের ‘আর্জেন্ট’ হিয়ারিং এর আবেদন সুপ্রীম কোর্ট শোনে ২৩ এপ্রিল রাত্রি ৮টায় যা নিয়ে আইনজ্ঞ মহলে অনেকের ভুরূ উঁচু হয় ।[10]
আইন প্রণয়নের জন্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ার অধিকার কাগজে রাম শ্যাম যদু মধু সবার আছে। কিন্তু আমাদের জনপ্রতিনিধিদের স্বরূপ দেখুন। গত ২০০৫ সালে সংসদে প্রশ্ন করার জন্যে টাকা বা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ১১ জন তৎকালীন এমপি’র বিরুদ্ধে একটি স্পেশাল কোর্টে বিচার শুরু হয়।[11] তারপর কি হইল জানে শ্যামলাল! বর্তমান সংসদে ৪৩% এমপি’র বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস চলছে। এদের মধ্যে শাসক দল বিজেপির ১১৬ জন (৩৯%) এবং প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের ২৯ জন(৫৭%) রয়েছেন।[12]
অর্থাৎ বাহুবল ধনবল জনবল একজন মানুষকে অন্যদের থেকে বেশি যোগ্য করে দেয় ,
যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ? তাহলে আমরা কী করব? লটারি করে ক্যান্ডিডেট ঠিক করব? প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কাকে দাঁড় করাব-- বাইডেন না বার্ণি?
অথবা বাংলাদেশের সেলফ হেল্প গ্রুপ আন্দোলন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুস যেমন কয়েক দশক আগে বলেছিলেন—ডাকাইতটারে ঠেকাইতে চোরটারে ভোট দ্যান!
সিলেক্ট দ্য লেসার ইভিল?
সামাজিক আর্থিক বৈষম্যভিত্তিক সমাজে আইনের চোখে সাম্য, রাজনৈতিক অধিকারের সাম্য , সুযোগের সাম্য বাস্তবে বড় কঠিন। সমাধান ?
নৈতিক কাঠামোঃ স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্যের মহত্ত্ব এবং সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভুমিকার তত্ত্ব
স্বাধীনতা ও মুক্তির আদর্শ নিয়ে ঘোষণা প্রায় সব ধরণের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে করা হয়। আমরা যাচাই করে দেখতে চাই বাস্তবে এঁরা স্বাধীনতার কী মানে করেছেন বা স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখতে কী কী চাই এবং তার জন্যে রাষ্ট্র কী করতে পারে।
আমেরিকার সংবিধানে ‘লিবার্টি’ কথাটি আছে, ‘ফ্রীডম’ শব্দটি উচ্চারিত হয়নি। তবে রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রতক্ষ কর থেকে আয় ভাগাভাগির প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে ভিত্তি হবে তাতে যত মুক্ত বা ফ্রি মানুষ আছে (১০০%) এবং অন্যধরণের [13]( দাস ) মানুষদের জনসংখ্যার ৩/৫ ভাগ ধরে।[14] ওই সংবিধানের প্রথম স্বীকৃতির সময় (১৭৯০ সালে) আমেরিকার জনসংখ্যার ২০% দাস ছিল । বিল অফ রাইটস এ দাস প্রথা উচ্ছেদ বা তাদের অধিকার নিয়ে কিচ্ছু বলা নেই।
আমেরিকার ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স মন দিয়ে পড়লে দেখা যাবে তাতে আইনের চোখে সব নাগরিক সমান বলা হলেও সেই ‘নাগরিক’এর ধারণায় নারী ও কালো মানুষেরা নেই। নারীদের ভোটাধিকার এল অনেক পরে, ১৯২০ সালে। ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্রেও তাই; ফ্রান্সে ১৯৪৪ সালে , সুইজারল্যান্ডে ১৯৭১। আইন ও সংবিধান চুপ করে থেকেও অনেক কথা বলে।
কিউবার সংবিধান প্রথম অনুচ্ছেদেই রাষ্ট্রকে শ্রমজীবি মানুষের এক সার্বভৌম, স্বতন্ত্র সমাজবাদী রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এটি ব্যষ্টি ও সমষ্টির সার্বিক কল্যাণের জন্য সবার সহযোগে তৈরি একটি সংযুক্ত গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে সবার রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায় এবং সার্বিক ঐক্যবোধ সুরক্ষিত।[15] কিন্তু যেহেতু রাষ্ট্রের চরিত্র সমাজবাদী বলে ঘোষিত, তাই রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলে তা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবেনা।
আর্টিকল ৯ বলছে মানুষের পূর্ণ মর্য্যাদা এবং স্বাধীনতার গ্যারান্টি[16] এবং আর্টিকল ৫৩ গ্যারান্টি দিচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার, কিন্তু বলছে রাষ্ট্র সমাজতন্ত্রের আদর্শে দেশ গড়ছে তাই খবরের কাগজ, টিভি, মুভি সবই রাষ্ট্রের বা সমাজের সম্পত্তি হবে, কোন ব্যক্তি মালিকানা মানা হবে না,[17] এই বৈপরীত্য ।
২০০৬ সালে আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস একটা রিপোর্ট বের করে। অন্ততঃ ৭.২ মিলিয়ন মানুষ তখন কোন না কোন ভাবে বিচার ব্যবস্থার খপ্পরে, হয় বিচারাধীন বন্দী, নয় শাস্তিপ্রাপ্ত, নয় প্যারোলে ছাড়া, নয় শর্তাধীন মুক্তি। মানে প্রায় প্রতি ৩২ জন আমেরিকানের একজন বিচারব্যবস্থার লেন্সে। অনুপাতটি এখনও তাই। বিশ্বের সমস্ত বন্দীদের ২৫% আমেরিকায়, অথচ আমেরিকার জনসংখ্যা গোটা বিশ্বের ৫%।[18]
এবং আফ্রিকান-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর প্রতি ব্যবস্থার প্রেজুডিস জনসংখ্যার বিষমানুপাতিক সাজা থেকে স্পষ্ট।
দেখা যাচ্ছে দুটো দুই মেরুর রাষ্ট্রেও ফ্রীডম বা স্বাধীনতা নিয়ে স্পষ্ট করে কথা বলতে বেশ সমস্যা। তাহলে বাস্তবিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই সমস্যা তো আরও প্রকট হবে। আর যাদের সংবিধানে ফ্রীডম বা লিবার্টি নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই তাদের কথা বলাইবাহুল্য।
যাই হোক , রাষ্ট্রের অবধারণার মধ্যেই কোথাও এ দুটো শব্দ নিয়ে কেমন একটা অসহজ ভাব, একটা সমস্যা রয়েই যাচ্ছে।
ফ্রীডম অর্থাৎ মুক্তি বা স্বাতন্ত্র্য
পজিটিভ এবং নেগেটিভ ফ্রীডম,
অমর্ত্য সেন ও মার্থা নুসবাউম সমতা ও ন্যায়ের প্রশ্নে আলো ফেলেছেন ফ্রীডম বা স্বাতন্ত্র্যের উপর। রাষ্ট্রের পিতৃসত্তাত্মক রূপ বা সংযুক্ত পরিবারের জ্যেঠুর মত ব্যবহার অমর্ত্য সেনের বিলকুল না-পসন্দ। হিতসাধনের অনেকগুলো বিকল্প বা ক্যাপাবিলিটির (সক্ষমতা) ঝুলির মধ্যে কোন কোন গুলো আমার পছন্দ এবং তার ব্যবহার কীভাবে করব তা তো আমি ঠিক করব। নইলে আমি সমান হয়েও স্বাধীন বা স্বতন্ত্র নেই। রাষ্ট্র আমাকে রোটি -কাপড়া- মকান , চাকরি, পড়াশুনো বা রাজকাজে অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ এবং পারদর্শিতা (রলস কথিত ফেয়ারনেস) দেখালেও যদি আমার নিজের জীবন নিজের মত করে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা না থাকে তাহলে আমি পূর্ণ হব কি করে?
রাষ্ট্রের আছে তার নীতির পক্ষে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা। তাহলে রাষ্ট্র নাগরিকের ফ্রীডম বাড়াতে এবং কমাতেও পারে। কিন্তু সেটা হবে নেগেটিভ ফ্রীডম বা বাইরের শেকল থেকে মুক্তি। যেমন নির্ভয়ে চলাফেরা করার স্বাধীনতা, নিজের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ইত্যদি।
কিন্তু অমর্ত্য জোর দিচ্ছেন ‘পজিটিভ ফ্রীডম” বা অন্তরের স্বাধীনতার উপর। ইসাইয়া বার্লিন (১৯০৯—১৯৯৭) এই দুই ধরণের ফ্রীডমের ধারণাকে স্পষ্ট[19] করেছেন এভাবেঃ নেগেটিভ ফ্রীডম হল বাইরের শেকল থেকে মুক্তি। আর পজিটিভ ফ্রীডম হল নিজের অন্তরের শেকল থেকে মুক্তি। যখন আমি নিজের পছন্দের ব্যাপারে সচেতন, যখন আমি নিজের নির্ণয়ের যুক্তি বা ঔচিত্য অন্যদের বলতে পারি বা আমার কাছে স্পষ্ট এবং আমি তার দায়িত্ব নিতে সক্ষম। রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য’, বা নির্মাণ করেন ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে নিখিলেশের মত চরিত্র , তখন বোধহয় আমরা ওই ‘পজিটিভ ফ্রীডম” এর খানিকটা আভাস পাই।
মনে হয় রাষ্ট্রের সাহায্যে ‘নেগেটিভ ফ্রীডম’ অর্জন আমাদের পূর্ণতার নেসাসারি কন্ডিশন, আর ‘পজিটিভ ফ্রীডম’ হল সাফিশিয়েন্ট কন্ডিশন।
সামুদায়িক স্বাতন্ত্র্য বা কম্যুনিটি ফ্রীডম এবং রাষ্ট্রঃ
এহ বাহ্য। ফ্রাঞ্জ ফ্যানন(১৯২৫- ১৯৬১) বলেন-- ঔপনিবেশিক সমাজে রাষ্ট্র কলোনিয়াল প্রভুর ক্রীড়নক। প্রশ্ন তোলেন-- যেখানে গোটা কমিউনিটি বা সমুদায়ের স্বাধীনতা নেই সেখানে একজন ব্যক্তির পক্ষে একটি ফ্রীডম বিহীন সমুদায়ের সদস্য হলে কতখানি ব্যক্তিগত ফ্রীডম ( পজিটিভ বা নেগেটিভ) ভোগ করা সম্ভব?[20]
রাষ্ট্রের চোখ বুঁজে থাকায় বা প্রত্যক্ষ মদতে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোব বহু বছর ধরে কথিত অনুন্নত দেশের সম্পদ লুঠ করেছে।
অনিয়ন্ত্রিত বাজার ইকনমি এমনভাবে আয়বৈষম্যকে বাড়িয়েছে যে ইউনিসেফের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আজ বিশ্বে ২২০০০ শিশু প্রতিদিন দারিদ্র্যের কারণে মারা যাচ্ছে। গোটা বিশ্বের ২.২ বিলিয়ন শিশুর মধ্যে অন্ততঃ ১ বিলিয়ন দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৭২ মিলিয়ন শিশু কোন পাঠশালায় যায় না। শিক্ষার সুযোগের ব্যাপারে মেয়েরা বিশেষ করে বঞ্চিত। এই পৃথিবী যখন ২১ শতকের দোরগোড়ায় পা রাখল তখন অন্ততঃ ১ বিলিয়ন লোক বইপড়া তো দূর, নাম লিখতেও শেখেনি।[21]
বর্তমান বিশ্বে মাত্র ৮৫ জন ধনী মানুষের সম্পদ গোটা বিশ্বের ৩.৫ বিলিয়ন লোকের আয়ের ও সম্পদের যোগফলের সমান। খেলাটা আগে থেকেই ফাউল গেম। কেউ চাইলেই ঐ ৮৫জনের দলে ঢূকতে পারবে না। এই বিশাল আর্থিক সামাজিক বৈষম্যে ভরা দুনিয়ায় রাষ্ট্র বা তার রাজনৈতিক এবং আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো বৈষম্য দূর করতে কতটুকু চেষ্টা করেছে?
কম্যুনিটি ফ্রীডমছাড়া একজন ব্যক্তির পক্ষে একা রাষ্ট্রের থেকে নেগেটিভ ফ্রীডম ভোগ করা সম্ভব নয়। আর পজিটিভ ফ্রীডম তো অনেক পরের কথা।
কিন্তু যে লোকটি এর মধ্যেই ভয় এবং সার্বিক ঘৃণাকে ছাড়িয়ে কাউকে আশ্রয় দিচ্ছে সে নিশ্চয়ই পজিটিভ ফ্রীডম লাভ করেছে, অন্ততঃ তুলনামূলক ভাবে।
আজ গোটা দুনিয়ার অধিকাংশ দেশেই ফ্যাননের বর্ণিত কলোনিয়ালিজম নেই। কিন্তু কিছু কমিউনিটি বা সাব-গ্রুপ অনেক দেশেই আছে যাদের কন্ঠস্বর দেশের রাজনৈতিক এবং আইনি ব্যবস্থায় দমিত। আমেরিকার আফ্রিকান আমেরিকান, ভারতে মুসলিম ও দলিত। এইভাবে ফ্যাননের দুই বিশ্ব আজ একই দেশে বিদ্যমান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ২.৩ মিলিয়ন মানুষ জেলের ভেতরে, মানে প্রতি ১ লক্ষ নাগরিকের মধ্যে ৬৯৮ জন। আর ২০০৮ সালের ডেটা অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বের ৯.৮ মিলিয়ন বন্দীর ২৪.৭% রয়েছে আমেরিকার জেলে।[22] আজকে এই সংখ্যাটি সামান্য কমেছে—২.১ মিলিয়ন।এদের মধ্যে কালো মানুষেরা জনসংখ্যার ১২% হয়েও জেলে ৩৩%, এবং ইস্পাহানীরা জনসংখ্যার ১৬% কিন্তু জেলে আছেন ২৩%।
ভারতে ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর প্রকাশিত ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী জেল রয়েছে ১৪০১টি, যাতে ৩,৯৬,২২৩ জন বন্দীকে রাখা যেতে পারে। তবে ওখানে রয়েছে ৪,৬৬,০৮৪ জন।[23] আর ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার প্রতিশত হিসেবে মুসলিম হল ১৪.২%, দলিত ১৬.৬% এবং আদিবাসী ৮.৬%। কিন্তু বন্দীদের মধ্যে হিসেবটা হল মুসলিম ১৯.৭%, দলিত ২১.৬% এবং আদিবাসী ১১.৮%।[24]
এখন আয়না নিজেদের দিকে ঘোরানো যাক । বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রের চিন্তাভাবনা আইন ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনৈতিক সমুদায়—বলা ভাল মেজরিটি সমুদায়। উদাহরণ, মুম্বাইয়ের হাজি আলি দরগায় আদালতের রায়ে মুসলিম মেয়েরা ঢুকতে পারবে।[25] কেরালার মন্দিরে মেয়েদের মন্দিরমসজিদ তিনতালাক, গুরবায়ুর। হায়দ্রাবাদের ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটির (নালসার) ভাইস চ্যান্সেলর ফরজান মুস্তাফা সম্প্রতি একটি প্রবন্ধে বলেছেন সুপ্রীম কোর্ট মুসলিম মহিলাদের দুর্দশার প্রতি যতটা সহানুভূতিশীল ততটা হিন্দু মহিলাদের জন্যে নয়।[26]
রাষ্ট্র আজ লেভিয়াথান। কিন্তু করোনার পর রাষ্ট্রের ক্ষমতা সর্বব্যাপী। রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে তার নিজস্ব রূপকথা, চমস্কি কথিত ‘ম্যানুফ্যাকচারড কন্সেন্ট’। ‘প্রলয়পয়োধিজলে’ সব ভেসে গিয়েছে –রুশোর সামাজিক চুক্তি, বেন্থামের হিতবাদ, রলসের ফেয়ারনেস বা ন্যায়ের ধারণা – সবকিছু।
এখন কথা বোল না, কোন শব্দ কোর না ।
উপসংহার
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল বিজ্ঞানের দার্শনিক টমাস কুনের (Thomas Kuhn) আলোড়ন ফেলে দেওয়া গ্রন্থ The Structure of Scientific revolutions। এ গ্রন্থে কুন দেখিয়েছিলেন যে আমরা একটা প্যারাডাইমের মধ্যে “normal science” বা স্বাভাবিক বিজ্ঞানের চর্চা করি। এরপরে ক্রমাগত বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতি জমা হতে থাকে সে প্যারাডাইমের মধ্যে। একটা সময়ের পরে আর পুরনো প্যারাডাইমের মধ্যে থাকা যায়না, এটা ভেঙ্গে যায়। একটি নতুন প্যারাডাইম তৈরি হয়। একে কুন বলেছেন “প্যারাডাইম শিফট”। এবং বিশ্বের সারস্বত ও বৈজ্ঞানিক সমাজের প্রধান অংশ একে গ্রহণ করেছেন, মান্যতা দিয়েছেন।[27]
রাষ্ট্রের ধারণাতেও প্যারাডাইম শিফট হয়েছে। আদিম বর্বর সমাজ থেকে মুক্তি, সামাজিক চুক্তি, হিতবাদ; তারপর শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র। আজ যে ইনফরমেশন টেকনোলজি ও ‘কৃত্রিম মেধা’র ক্ষমতা বেড়ে চলেছে তার ভিত্তিতে কি রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে বিতর্কে --- সাম্য, ন্যায় ও রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি—আর একবার প্যারাডাইম শিফট দরকার?
===============================================================
[1] জন রলস, “থিওরি অফ জাস্টিস অ্যাজ ফেয়ারনেস”,
[2] বিজনেস টুডে, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯; ইকনমিক টাইমস, ২০ জানুয়ারি , ২০২০ এবং পিটি আই।
[3] অমর্ত্য সেন, “ দি আইডিয়া অফ জাস্টিস” (২০০৯) এবং “ইনইকুয়ালিটি রিএগজামিন্ড” (১৯৯৫)
[4] মার্থা নুসবাউম ; ‘ক্রিয়েটিং ক্যাপাবিলিটিজ” (২০১১), “পলিটিক্যাল ইমোশন্স” (২০১৩)।
[5] স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলজফি। (২০১৬)।
[6] অমর্ত্য সেন, “ইনইকুয়ালিটি রিএগজামিন্ড”, পৃঃ ৪১, ফুটনোট ৮।
[7] ব্ল্যাকলাইভস ম্যাটার ডট কম, ‘হোয়াট উই বিলিভ’।
[8] দ্য প্রিন্ট, ৯ জুলাই, ২০২০।
[9] এলিজাবেথ অ্যান্ডারসন, “ল এন্ড ফিলজফি”।
[10] আউটলুক, ১ মে, ২০২০।
[11] টাইমস অফ ইন্ডিয়া এবং ইকনমিক টাইমস, ১০ আগস্ট, ২০১৭।
[12] দি হিন্দু, ২৬ মে, ২০১৯।
[13] উইকিপিডিয়া।
[14] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান, আর্টিকল ১।
[15] কিউবার সংবিধান, আর্টিকল ১।
[16] ঐ, আর্টিকল ৯।
[17] ঐ, আর্টিকল ৫৩ ।
[18] অ্যানুয়াল রিপোর্ট অফ ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস, ইউ এস এ। (২০০৬)।
[19] ইসায়া বার্লিন , “ টু কন্সেপ্টস অফ লিবার্টি” এবং “ফোর এসেস অন লিবার্টি”।
[20] ফ্রাঞ্জ ফ্যানন, ‘ ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস’।
[21] ইউনিসেফ রিপোর্টঃ “ দ্য স্টেট অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস চিল্ড্রেন” ( ২০১৯)।
[22] উইকিপিডিয়া।
[23] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৩ জানুয়ারি, ২০২০।
[24] টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০।
[25] দি হিন্দু, ২৪ অক্টোবর, ২০১৬।
[26] ফরজান মুস্তফা , ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৩ জুলাই, ২০২০।
[27] টমাস কুন, “দ্য স্ট্রাকচার অফ সায়েন্টিফিক রেভলুশন” (১৯৬২)।>
<৩
রাষ্ট্র এবং ন্যায় ও সমতা
জন রলস (১৯২১ –২০০২)[1] বললেন যে এই হিতবাদ বা ইউটেলিটারিয়ান তত্ত্ব ধরে নিয়েছে যে রাষ্ট্রের সংস্থাগুলো সব ঠিকঠাক এবং সুব্যবস্থিত। ফলে গড়পড়তা সুখ বা কল্যাণসাধন সহজেই সম্ভব। কিন্তু ওই আনন্দ ও কষ্টের ধারণা খুব সীমিত। এতে বাদ পড়ে যায় মানবজীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা ও অনুভূতি যা আমাদের সন্তোষ বাড়াতে পারে—যেমন, জ্ঞানের পিপাসা, স্বাধীন চিন্তা, ব্যক্তিগত উন্নতি এবং শিল্পের আনন্দ ।
আবার নৈতিক প্রশ্নে শুধু ফলাফল নিয়ে মাপতে গেলে মুশকিল আছে। ‘এন্ড জাস্টিফায়েজ মীন্স’ বা উদ্দেশ্য মহৎ হলে যেকোন পন্থা মেনে নেয়া যায় – সবসময় ঠিক নয়।
ধরুন, উন্মত্ত জনতা অন্য সম্প্রদায়ের কাউকে চুরি, গোহত্যা বা ছেলেধরার বা খুনের অভিযোগে ধরে এনেছে। এখানে ব্যক্তিটির দোষ সন্দেহাতীত নয় । কিন্তু জনতা চাইছে হাতে গরম ন্যায়। থানায় রয়েছে অল্প পুলিশ, তারা কি করবে? না বাঁচালে মবলিঞ্চিংর চোটে লোকটি মারা যাবে । কিন্তু একজনকে বাঁচাতে গিয়ে গুলি চালালে একাধিক লোক মরবে। তারপর দাঙ্গায় দুই সম্প্রদায়ের আরও লোকজন মারা যাবে। এখানে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি পুলিশ প্রশাসন কী করবে?
এখানে ইউটিলিটিয়ান থিওরি মানলে যা কম -সে- কম দুঃখ দেবে তাই করা উচিত, অর্থাৎ লোকটিকে উন্মত্ত জনতার থেকে ছিনিয়ে আনা উচিৎ নয় । একেবারে ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় মৈত্র মহাশয়ের অ্যাকশন!
কিন্তু ব্যাপারটা এত সরল নয়। পালটা উদাহরণ দেখুন।
যদি কাল জানাজানি হয়ে যায় যে অপদার্থতা ঢাকতে রাষ্ট্র একজন নিরপরাধের বলি চড়িয়েছে? তার প্রতিক্রিয়া?
রলস আরও বলেন যে রাষ্ট্র যদি পক্ষপাতহীন না হয় তাহলে নাগরিক কী করে তার থেকে ন্যায়পূর্ণ ব্যবহার আশা করতে পারে? ফলে রাষ্ট্রের সম্পদ বিতরণে মোট প্রান্তিক সন্তোষ বেড়ে গেলেও বেশির ভাগ লোকের হিত কমে যেতে পারে।
এটা যেন রলস আজকের ভারতের কথা বলছেন। আমাদের জিডিপি বাড়ছে, আমরা বড় মুখ করে বলছি। কিন্তু জিনি সূচক বাড়ছে—মানে অসাম্য বাড়ছে। ভারতের শীর্ষ ১% ধনীর হাতে গোটা দেশের সম্পত্তির ৭৩% বা নীচের দিকের ৭০% জনসংখ্যার সম্পত্তির চারগুণ। এটা অক্সফ্যামের অধ্যয়ন যা ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের সামনে ২০১৮তে পেশ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে ভারতের বিলিওনারদের সম্পত্তির পরিমাণ সরকারের একবছরের বাজেটের চেয়ে বেশি।[2]
রলস জোর দিলেন দুটো বিষয়ে।
এক, রাষ্ট্রকে পক্ষপাতহীন হতে হবে। তার জন্যে আগে রাজনৈতিক সংস্থাগুলোকে ঠিক করতে হবে। এক বিশেষ অর্থে আমরা সবাই সমান। আইনের চোখে সব নাগরিক সমান বললেই হবে না। দেখতে হবে কেউ যেন জন্মসূত্রে বা অন্য কোন ভাবে প্রাপ্ত ধনবল অথবা সামাজিক মর্যাদার জোরে রাষ্ট্রের কাছে বেশি সুযোগ না পায় । অথবা তার জন্যে সে যেন তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। ধরা হোক আমি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে চাই বা আমি কোন ধর্মে দীক্ষিত হতে চাইনা। তাতে যেন রাষ্ট্রের থেকে আগে যেসব অধিকার ও মর্য্যাদা পাচ্ছিলাম তা যেন অটুট থাকে।
হবস, লক , রুশো এবং কান্ট মনে করতেন --সমান এবং মুক্তমনা নাগরিকদের নিয়ে শিক্ষিত উদার এবং পারস্পরিক সহযোগিতামূলক আধুনিক সমাজ গড়ে তোলা রাষ্ট্রের লক্ষ্য; এর সঙ্গে রলস জুড়ে দিলেন—ন্যায়পরায়ণ রাজনৈতিক কাঠামোর শর্ত।
উনি আরও বলেন যে এর জন্যে দরকার মোট আয় বা জিডিপি বা গড়পড়তা সন্তোষ বৃদ্ধির হিসেব কষা ছেড়ে সবচেয়ে বঞ্চিত বা পিছিয়ে পড়া মানুষটির দিকে নজর দেওয়া।
দুই, রলস চিহ্নিত করেছেন খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, সমান সুযোগ, জাত-ধর্ম-ধনবল নির্বিশেষে সমান সম্মান ইত্যাদি পনেরটি জিনিসের একটি ঝুলি যাকে উনি বলছেন প্রাইমারি গুডস। যদি রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককে অন্ততঃ ওই প্রাইমারি গুডসের প্রাপ্তিটুকু সুনিশ্চিত না করতে পারে তাহলে সেটা ‘ন্যায়পরায়ণ’ (ফেয়ার) নয়।
রাষ্ট্র এবং সাম্যঃ ক্যাপাবিলিটি বা সক্ষমতার তত্ত্বঃ
চিন্তা এখানেই থেমে যায়নি। অমর্ত্য সেন (১৯৩৩)[3] এবং মার্থা নুসবাম (১৯৪৭)[4] রলসের ন্যায়ের এবং রাষ্ট্রের বিমূর্ত ধারণার পরিবর্তে আনলেন বাস্তব দুনিয়ায় ‘ক্যাপাবিলিটি’ বা সক্ষমতার ধারণা। এঁরা বলছেন শুধু আজকে কোন ব্যক্তি সমাজের বা জীবনযাপনের কোন স্তরে আছে ( অমর্ত্য সেনের ‘বিইং) দেখলে চলবে না দেখতে হবে মানুষটির কী কী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল এবং তার জন্যে রাষ্ট্র কী ভূমিকা পালন করছে। যেমন যে পরিযায়ী শ্রমিকটি কাজ ও বাসস্থান হারিয়ে দিশেহারা সে সামান্য খিচুড়ি ও ঘরে ফেরার ট্রেনভাড়া পেলেই রাষ্ট্রের কল্যাণকারী ভুমিকায় পঞ্চমুখ হবে; অন্য কোন বিকল্প সম্ভাবনার কথা ভাববে না।
মার্থা তুলে ধরেছেন দশটি মাপকাঠি ( যার মধ্যে যে কোন রাজনৈতিক সংস্থায় পদের জন্যে প্রার্থী হওয়ার, নিজের পছন্দ মত ভালবাসার, বা খেলতে পারার অধিকার সামিল) যা ওঁর মতে মানুষের পূর্ণতার ন্যুনতম শর্ত (থ্রেশহোল্ড লিমিট)। মার্থা এই সূচীকে অন্তিম মনে করেন না । বরং দেশকালের বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে বিস্তৃত করতে চান।
এঁদের এই সক্ষমতার তত্ত্বের মূলে ওতপ্রোত রয়েছে দুটো ধারণা।
এক, আমার ভালো থাকার বা হিতসাধনের অধিকার একটি প্রাথমিক এবং নৈতিক ব্যাপার।
দুই, এই নিজস্ব হিতসাধনের স্বাধীনতাকে বুঝতে হবে ব্যক্তির মধ্যে নিহিত সম্ভাবনা এবং সেটা নিয়ে সে কী করতে চায় এবং তার জন্যেও রাষ্ট্র তাকে কতটুকু সুযোগ দিচ্ছে তার ভিত্তিতে।
এইভাবে অমর্ত্যরা গড়ে তোলেন ইউটেলেটিরিয়ান ধারণার পালটা একটি তত্ত্ব যা মানুষের হিতসাধনে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে আরও বিস্তৃত করবে। [5]
সমতা ও স্বাধীনতাঃ
অমর্ত্য প্রশ্ন তোলেন ‘সমতা’ বা ইকুয়ালিটির প্রচলিত ধারণা নিয়ে । বলেন কোন একটি মাপকাঠিতে সাম্য অন্যদিকে অসাম্যের সৃষ্টি করে।
যদি সবার আয় সমান করে দেওয়া হয় তাহলে তাদের জীবনযাত্রার মান অ-সম হবে। যেমন দিল্লি, মুম্বাই ও কোলকাতায় একই মানের বাড়ির ভাড়া বা দামে আকাশ পাতাল তফাৎ। আবার যদি সবার আবাসন সমান করে দেওয়া হয় তাহলে তাদের আয় সমান হবে না । কাজেই ব্যক্তিকে পছন্দ করার স্বাধীনতা দিতে হবে। কেউ হয়ত শহরে নয় গ্রামে থাকতে চায়; কেউ সারাজীবন ছবি আঁকতে চায়।
অমর্ত্যের মতে রলসের সমান সুযোগের ধারণাটিতে সক্ষমতার প্রশ্নটিকে বাদ দিয়ে কেবল সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্থার ‘ন্যায়পরায়ণতা’র দিকে বেশি জোর দেওয়ায় সমাজ ও রাজনীতিতে ব্যাপ্ত অসাম্য চাপা পড়ে যায়। যেমন ভারতে ‘আরক্ষণ’ প্রশ্নে কেবল ‘মেধা’র পক্ষে যাঁরা ওকালতি করেন তাঁরা সমান খেলার জমির প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। অসাম্যভিত্তিক সমাজে জন্ম নেওয়ার ‘দোষে’ কেউ কেন শাস্তি পাবে?
অমর্ত্যের চোখে সাম্যের ধারণায় ব্যক্তিমানুষের ফ্রীডম (স্বাধীনতা) এবং অটোনমির ( স্বাতন্ত্র্য) ধারণা নিহিত। তাই সাম্যভিত্তিক সমাজে ফ্রীডমের ছবি তুলে ধরতে উনি মার্ক্সের ‘জার্মান ইডিওলজি’ থেকে উদ্ধৃত করেন মাছ ধরা, শিকার করা, সমালোচনায় মেতে ওঠা নিয়ে সুপরিচিত প্যারাগ্রাফটিঃ
“ (যেখানে সমাজ সুনিশ্চিত করবে এমন পরিস্থিতি) যাতে আমি সকালে একরকম ও বিকেলে আরেকরকম কাজ আমার ইচ্ছে মত করতে পারি”[6]।
স্পষ্টতঃ লেনিনের “রাষ্ট্র ও বিপ্লব” লেখাটিতে “শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বে” পরিচালিত এক পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে ছবি ফুটে ওঠে তার থেকে এঁদের কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা একেবারে ১৮০ ডিগ্রিতে দাঁড়িয়ে।
ন্যায় ও সমতা নিয়ে আরও কিছু কথা
মানুষ কীসে সমান? সমতার ধারণা কি ন্যায়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ? নাকি এক স্বয়ংসম্পূর্ণ নৈতিক আদর্শ ?
এর উত্তর বোধহয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের বর্বর অসংবেদনশীল ব্যবহারের ফলে জনৈক কালো মানুষের মৃত্যুতে যে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বলে জন-আন্দোলনের জোয়ার, তাদের বক্তব্যে রয়েছে।
‘গায়ের রঙ্গে পোষাকে আসাকে বা ধর্ম ভাষার ভিত্তিতে এক নই , কিন্তু আদমের পুত্র হিসেবে কিছু অধিকার আছে। আমাদের গুণতির মধ্যে ধরতে হবে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’।‘ উই অ্যাকনলেজ , রেসপেক্ট অ্যান্ড সেলিব্রেট ডিফারেন্সেস অ্যান্ড কমনালিটিজ’।[7]
তাই করোনার সময় দর্শকশূন্য মাঠে টেস্ট ম্যাচ খেলতে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ডের প্লেয়াররা এক হাঁটু গেড়ে বসে মুঠো করা হাত তুলে ধরে । একসময়ের প্রবাদপ্রতিম বোলার মাইকেল হোল্ডিং বলেন–রাজনীতিকে বাদ দিয়ে শুদ্ধ নিরপেক্ষ ক্রিকেট অলীক কল্পনা। [8] এটা কি ‘শুদ্ধ নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে’র ধারণার জন্যেও খাটে না?
সমতা মানুষের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির উপায়ঃ আঠেরশ শতকে মেরি উলস্টোনক্র্যাফট দেখিয়েছিলেন--
আয় অর্জনে সমতা, শিক্ষা ও ভোটাধিকারের সমতা কীভাবে মানুষে মানুষে সম্পর্ক পালটে দেয় । বিশেষ করে মেয়েদের ভোটাধিকার পরিবারে ও সমাজে তাদের অবস্থান বদলে দেয়। ওঁর মতে অসাম্যের ফলে সবাই ভোগে। গরীবেরা বেশি, মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত হওয়ার চিন্তায়, ধনীরা ধনরক্ষার চিন্তায়।
“যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে ফেলিছে যে নীচে,
পশ্চাতে ফেলিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।“
তাই সমতা ‘উপায়’ হিসেবে আরেকটা কাজ করে—রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারের পায়ে বেড়ি পরায়। যেমন হেবিয়াস কর্পাস রিট পিটিশনের অধিকার। কাউকে রাষ্ট্র ঘর থেকে জিগ্যেস করার নাম করে তুলে নিয়ে ২৪ ঘন্টার বেশি আটকে রাখতে পারে না। এমন হলে তার বাড়ির লোকজন হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাসের রিট লাগিয়ে দাবি করতে পারে যে বন্দীকে আদালতে সশরীরে হাজির করা হোক । মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে নাগরিক হাইকোর্ট বা সুপ্রীম কোর্টে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে। এই পদ্ধতিগত সমতার প্রশ্নেই আজকাল এলজিবিটি এবং শারীরিক রূপে বিশেষ সক্ষমরা নিজেদের সম্মানের প্রশ্নে আইনি স্বীকৃতি পেয়েছেন। ‘সমান কাজের জন্যে সমান বেতন’ –নারীপুরুষ সবার জন্যে একটি স্বীকৃত নীতি এবং সুপ্রীম কোর্টের অনেক রায়ের ভিত্তি।
কিন্তু সমতাকে যদি শুধুমাত্র উপায় না ভেবে লক্ষ্যও ভাবি?
ইগালিটেরিয়ান দর্শনঃ মানুষ যেন ভাগ্যের কারণে অন্যদের তুলনায় সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, এবং যার জন্যে সে নিজে দায়ি নয় (জন্ম, সামাজিক অবস্থান) তার জন্যে সমাজের সম্পদের বন্টনে বাদ না পড়ে যায়। রাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে মানুষকে দুর্ভাগ্যের স্বীকার হতে না দেওয়া।
রাষ্ট্র মাঝখানে আম্প্যায়ার না হলে মানুষ খোলাখুলি ভাগ্যতাড়িত বৈষম্যের স্বীকার হয়ে দুর্ভোগ ।
প্রশ্ন ওঠেঃ আমাদের স্বেচ্ছায় বেছে নেয়া কাজের ফল আর ভাগ্যতাড়িত কাজের ফলের মধ্যে তফাৎ করা সবসময় সম্ভব কি? আমাদের সব নির্ণয় কি স্বতন্ত্র? কিছু নির্বাচন কি পরিস্থিতি বা ভাগ্যের চাপে বাধ্য হয়ে করা নয়? স্বাতন্ত্র্য এবং ভাগ্যের সীমারেখা কি মাঝেমাঝে মুছে যায় না? সমতাবাদী দর্শন বলবে মানুষের নির্ণয়ের ভুলের জন্যে রাষ্ট্র যেন তার সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ না করে। জেল খেটে আসা মানুষ যেন আগের মতই অন্যদের সমান সুবিধা ও সুযোগ পায়।
বর্তমান শতাব্দীর একজন মহত্বপূর্ণ সমতার পক্ষধর দার্শনিক, জন রলসের প্রাক্তন ছাত্রী এলিজাবেথ অ্যান্ডারসন, বলেন সমতার লক্ষ্য শুধু ‘দুর্ভাগ্যের’ বলি মানুষের (গরীবঘরে জন্ম, বাপ-মার উদাসীনতা, দুর্ঘটনা) পাশে দাঁড়ানোয় সীমিত নয় , রাষ্ট্রের কাজ হল সামাজিক দমনপীড়নকে আটকানো যাতে সমাজে সবাই নৈতিক ভাবে তার যা প্রাপ্য তা পেতে পারে। এমন সমাজের নির্মাণ যার ভিত্তি হল সবাইকে সমানভাবে স্বীকার করা। তার বৈচিত্র্যময় জীবনকে স্বীকৃতি দেওয়া। [9]
আইনের চোখে সব সমান? বাস্তবে তাই কখনও হয়?
বিগত আগস্ট ২০১৯ সালে কাশ্মীরে বাড়ি থেকে তুলে বিনাবিচারে আটকে রাখা বেশকিছু মানুষের(যাদের মধ্যে নাবালিকও রয়েছে) হেবিয়াস কর্পাস আবেদন হাইকোর্ট শোনে ধীরে সুস্থে। অথচ সরকারের পছন্দের একটি ইংরেজি চ্যানেলের মালিক তথা অ্যাঙ্করের ‘আর্জেন্ট’ হিয়ারিং এর আবেদন সুপ্রীম কোর্ট শোনে ২৩ এপ্রিল রাত্রি ৮টায় যা নিয়ে আইনজ্ঞ মহলে অনেকের ভুরূ উঁচু হয় ।[10]
আইন প্রণয়নের জন্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ার অধিকার কাগজে রাম শ্যাম যদু মধু সবার আছে। কিন্তু আমাদের জনপ্রতিনিধিদের স্বরূপ দেখুন। গত ২০০৫ সালে সংসদে প্রশ্ন করার জন্যে টাকা বা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ১১ জন তৎকালীন এমপি’র বিরুদ্ধে একটি স্পেশাল কোর্টে বিচার শুরু হয়।[11] তারপর কি হইল জানে শ্যামলাল! বর্তমান সংসদে ৪৩% এমপি’র বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস চলছে। এদের মধ্যে শাসক দল বিজেপির ১১৬ জন (৩৯%) এবং প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের ২৯ জন(৫৭%) রয়েছেন।[12]
অর্থাৎ বাহুবল ধনবল জনবল একজন মানুষকে অন্যদের থেকে বেশি যোগ্য করে দেয় ,
যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ? তাহলে আমরা কী করব? লটারি করে ক্যান্ডিডেট ঠিক করব? প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কাকে দাঁড় করাব-- বাইডেন না বার্ণি?
অথবা বাংলাদেশের সেলফ হেল্প গ্রুপ আন্দোলন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুস যেমন কয়েক দশক আগে বলেছিলেন—ডাকাইতটারে ঠেকাইতে চোরটারে ভোট দ্যান!
সিলেক্ট দ্য লেসার ইভিল?
সামাজিক আর্থিক বৈষম্যভিত্তিক সমাজে আইনের চোখে সাম্য, রাজনৈতিক অধিকারের সাম্য , সুযোগের সাম্য বাস্তবে বড় কঠিন। সমাধান ?
নৈতিক কাঠামোঃ স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্যের মহত্ত্ব এবং সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভুমিকার তত্ত্ব
স্বাধীনতা ও মুক্তির আদর্শ নিয়ে ঘোষণা প্রায় সব ধরণের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে করা হয়। আমরা যাচাই করে দেখতে চাই বাস্তবে এঁরা স্বাধীনতার কী মানে করেছেন বা স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখতে কী কী চাই এবং তার জন্যে রাষ্ট্র কী করতে পারে।
আমেরিকার সংবিধানে ‘লিবার্টি’ কথাটি আছে, ‘ফ্রীডম’ শব্দটি উচ্চারিত হয়নি। তবে রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রতক্ষ কর থেকে আয় ভাগাভাগির প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে ভিত্তি হবে তাতে যত মুক্ত বা ফ্রি মানুষ আছে (১০০%) এবং অন্যধরণের [13]( দাস ) মানুষদের জনসংখ্যার ৩/৫ ভাগ ধরে।[14] ওই সংবিধানের প্রথম স্বীকৃতির সময় (১৭৯০ সালে) আমেরিকার জনসংখ্যার ২০% দাস ছিল । বিল অফ রাইটস এ দাস প্রথা উচ্ছেদ বা তাদের অধিকার নিয়ে কিচ্ছু বলা নেই।
আমেরিকার ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স মন দিয়ে পড়লে দেখা যাবে তাতে আইনের চোখে সব নাগরিক সমান বলা হলেও সেই ‘নাগরিক’এর ধারণায় নারী ও কালো মানুষেরা নেই। নারীদের ভোটাধিকার এল অনেক পরে, ১৯২০ সালে। ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্রেও তাই; ফ্রান্সে ১৯৪৪ সালে , সুইজারল্যান্ডে ১৯৭১। আইন ও সংবিধান চুপ করে থেকেও অনেক কথা বলে।
কিউবার সংবিধান প্রথম অনুচ্ছেদেই রাষ্ট্রকে শ্রমজীবি মানুষের এক সার্বভৌম, স্বতন্ত্র সমাজবাদী রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এটি ব্যষ্টি ও সমষ্টির সার্বিক কল্যাণের জন্য সবার সহযোগে তৈরি একটি সংযুক্ত গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে সবার রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায় এবং সার্বিক ঐক্যবোধ সুরক্ষিত।[15] কিন্তু যেহেতু রাষ্ট্রের চরিত্র সমাজবাদী বলে ঘোষিত, তাই রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলে তা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবেনা।
আর্টিকল ৯ বলছে মানুষের পূর্ণ মর্য্যাদা এবং স্বাধীনতার গ্যারান্টি[16] এবং আর্টিকল ৫৩ গ্যারান্টি দিচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার, কিন্তু বলছে রাষ্ট্র সমাজতন্ত্রের আদর্শে দেশ গড়ছে তাই খবরের কাগজ, টিভি, মুভি সবই রাষ্ট্রের বা সমাজের সম্পত্তি হবে, কোন ব্যক্তি মালিকানা মানা হবে না,[17] এই বৈপরীত্য ।
২০০৬ সালে আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস একটা রিপোর্ট বের করে। অন্ততঃ ৭.২ মিলিয়ন মানুষ তখন কোন না কোন ভাবে বিচার ব্যবস্থার খপ্পরে, হয় বিচারাধীন বন্দী, নয় শাস্তিপ্রাপ্ত, নয় প্যারোলে ছাড়া, নয় শর্তাধীন মুক্তি। মানে প্রায় প্রতি ৩২ জন আমেরিকানের একজন বিচারব্যবস্থার লেন্সে। অনুপাতটি এখনও তাই। বিশ্বের সমস্ত বন্দীদের ২৫% আমেরিকায়, অথচ আমেরিকার জনসংখ্যা গোটা বিশ্বের ৫%।[18]
এবং আফ্রিকান-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর প্রতি ব্যবস্থার প্রেজুডিস জনসংখ্যার বিষমানুপাতিক সাজা থেকে স্পষ্ট।
দেখা যাচ্ছে দুটো দুই মেরুর রাষ্ট্রেও ফ্রীডম বা স্বাধীনতা নিয়ে স্পষ্ট করে কথা বলতে বেশ সমস্যা। তাহলে বাস্তবিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই সমস্যা তো আরও প্রকট হবে। আর যাদের সংবিধানে ফ্রীডম বা লিবার্টি নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই তাদের কথা বলাইবাহুল্য।
যাই হোক , রাষ্ট্রের অবধারণার মধ্যেই কোথাও এ দুটো শব্দ নিয়ে কেমন একটা অসহজ ভাব, একটা সমস্যা রয়েই যাচ্ছে।
ফ্রীডম অর্থাৎ মুক্তি বা স্বাতন্ত্র্য
পজিটিভ এবং নেগেটিভ ফ্রীডম,
অমর্ত্য সেন ও মার্থা নুসবাউম সমতা ও ন্যায়ের প্রশ্নে আলো ফেলেছেন ফ্রীডম বা স্বাতন্ত্র্যের উপর। রাষ্ট্রের পিতৃসত্তাত্মক রূপ বা সংযুক্ত পরিবারের জ্যেঠুর মত ব্যবহার অমর্ত্য সেনের বিলকুল না-পসন্দ। হিতসাধনের অনেকগুলো বিকল্প বা ক্যাপাবিলিটির (সক্ষমতা) ঝুলির মধ্যে কোন কোন গুলো আমার পছন্দ এবং তার ব্যবহার কীভাবে করব তা তো আমি ঠিক করব। নইলে আমি সমান হয়েও স্বাধীন বা স্বতন্ত্র নেই। রাষ্ট্র আমাকে রোটি -কাপড়া- মকান , চাকরি, পড়াশুনো বা রাজকাজে অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ এবং পারদর্শিতা (রলস কথিত ফেয়ারনেস) দেখালেও যদি আমার নিজের জীবন নিজের মত করে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা না থাকে তাহলে আমি পূর্ণ হব কি করে?
রাষ্ট্রের আছে তার নীতির পক্ষে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা। তাহলে রাষ্ট্র নাগরিকের ফ্রীডম বাড়াতে এবং কমাতেও পারে। কিন্তু সেটা হবে নেগেটিভ ফ্রীডম বা বাইরের শেকল থেকে মুক্তি। যেমন নির্ভয়ে চলাফেরা করার স্বাধীনতা, নিজের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ইত্যদি।
কিন্তু অমর্ত্য জোর দিচ্ছেন ‘পজিটিভ ফ্রীডম” বা অন্তরের স্বাধীনতার উপর। ইসাইয়া বার্লিন (১৯০৯—১৯৯৭) এই দুই ধরণের ফ্রীডমের ধারণাকে স্পষ্ট[19] করেছেন এভাবেঃ নেগেটিভ ফ্রীডম হল বাইরের শেকল থেকে মুক্তি। আর পজিটিভ ফ্রীডম হল নিজের অন্তরের শেকল থেকে মুক্তি। যখন আমি নিজের পছন্দের ব্যাপারে সচেতন, যখন আমি নিজের নির্ণয়ের যুক্তি বা ঔচিত্য অন্যদের বলতে পারি বা আমার কাছে স্পষ্ট এবং আমি তার দায়িত্ব নিতে সক্ষম। রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য’, বা নির্মাণ করেন ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে নিখিলেশের মত চরিত্র , তখন বোধহয় আমরা ওই ‘পজিটিভ ফ্রীডম” এর খানিকটা আভাস পাই।
মনে হয় রাষ্ট্রের সাহায্যে ‘নেগেটিভ ফ্রীডম’ অর্জন আমাদের পূর্ণতার নেসাসারি কন্ডিশন, আর ‘পজিটিভ ফ্রীডম’ হল সাফিশিয়েন্ট কন্ডিশন।
সামুদায়িক স্বাতন্ত্র্য বা কম্যুনিটি ফ্রীডম এবং রাষ্ট্রঃ
এহ বাহ্য। ফ্রাঞ্জ ফ্যানন(১৯২৫- ১৯৬১) বলেন-- ঔপনিবেশিক সমাজে রাষ্ট্র কলোনিয়াল প্রভুর ক্রীড়নক। প্রশ্ন তোলেন-- যেখানে গোটা কমিউনিটি বা সমুদায়ের স্বাধীনতা নেই সেখানে একজন ব্যক্তির পক্ষে একটি ফ্রীডম বিহীন সমুদায়ের সদস্য হলে কতখানি ব্যক্তিগত ফ্রীডম ( পজিটিভ বা নেগেটিভ) ভোগ করা সম্ভব?[20]
রাষ্ট্রের চোখ বুঁজে থাকায় বা প্রত্যক্ষ মদতে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোব বহু বছর ধরে কথিত অনুন্নত দেশের সম্পদ লুঠ করেছে।
অনিয়ন্ত্রিত বাজার ইকনমি এমনভাবে আয়বৈষম্যকে বাড়িয়েছে যে ইউনিসেফের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আজ বিশ্বে ২২০০০ শিশু প্রতিদিন দারিদ্র্যের কারণে মারা যাচ্ছে। গোটা বিশ্বের ২.২ বিলিয়ন শিশুর মধ্যে অন্ততঃ ১ বিলিয়ন দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৭২ মিলিয়ন শিশু কোন পাঠশালায় যায় না। শিক্ষার সুযোগের ব্যাপারে মেয়েরা বিশেষ করে বঞ্চিত। এই পৃথিবী যখন ২১ শতকের দোরগোড়ায় পা রাখল তখন অন্ততঃ ১ বিলিয়ন লোক বইপড়া তো দূর, নাম লিখতেও শেখেনি।[21]
বর্তমান বিশ্বে মাত্র ৮৫ জন ধনী মানুষের সম্পদ গোটা বিশ্বের ৩.৫ বিলিয়ন লোকের আয়ের ও সম্পদের যোগফলের সমান। খেলাটা আগে থেকেই ফাউল গেম। কেউ চাইলেই ঐ ৮৫জনের দলে ঢূকতে পারবে না। এই বিশাল আর্থিক সামাজিক বৈষম্যে ভরা দুনিয়ায় রাষ্ট্র বা তার রাজনৈতিক এবং আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো বৈষম্য দূর করতে কতটুকু চেষ্টা করেছে?
কম্যুনিটি ফ্রীডমছাড়া একজন ব্যক্তির পক্ষে একা রাষ্ট্রের থেকে নেগেটিভ ফ্রীডম ভোগ করা সম্ভব নয়। আর পজিটিভ ফ্রীডম তো অনেক পরের কথা।
কিন্তু যে লোকটি এর মধ্যেই ভয় এবং সার্বিক ঘৃণাকে ছাড়িয়ে কাউকে আশ্রয় দিচ্ছে সে নিশ্চয়ই পজিটিভ ফ্রীডম লাভ করেছে, অন্ততঃ তুলনামূলক ভাবে।
আজ গোটা দুনিয়ার অধিকাংশ দেশেই ফ্যাননের বর্ণিত কলোনিয়ালিজম নেই। কিন্তু কিছু কমিউনিটি বা সাব-গ্রুপ অনেক দেশেই আছে যাদের কন্ঠস্বর দেশের রাজনৈতিক এবং আইনি ব্যবস্থায় দমিত। আমেরিকার আফ্রিকান আমেরিকান, ভারতে মুসলিম ও দলিত। এইভাবে ফ্যাননের দুই বিশ্ব আজ একই দেশে বিদ্যমান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ২.৩ মিলিয়ন মানুষ জেলের ভেতরে, মানে প্রতি ১ লক্ষ নাগরিকের মধ্যে ৬৯৮ জন। আর ২০০৮ সালের ডেটা অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বের ৯.৮ মিলিয়ন বন্দীর ২৪.৭% রয়েছে আমেরিকার জেলে।[22] আজকে এই সংখ্যাটি সামান্য কমেছে—২.১ মিলিয়ন।এদের মধ্যে কালো মানুষেরা জনসংখ্যার ১২% হয়েও জেলে ৩৩%, এবং ইস্পাহানীরা জনসংখ্যার ১৬% কিন্তু জেলে আছেন ২৩%।
ভারতে ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর প্রকাশিত ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী জেল রয়েছে ১৪০১টি, যাতে ৩,৯৬,২২৩ জন বন্দীকে রাখা যেতে পারে। তবে ওখানে রয়েছে ৪,৬৬,০৮৪ জন।[23] আর ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার প্রতিশত হিসেবে মুসলিম হল ১৪.২%, দলিত ১৬.৬% এবং আদিবাসী ৮.৬%। কিন্তু বন্দীদের মধ্যে হিসেবটা হল মুসলিম ১৯.৭%, দলিত ২১.৬% এবং আদিবাসী ১১.৮%।[24]
এখন আয়না নিজেদের দিকে ঘোরানো যাক । বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রের চিন্তাভাবনা আইন ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনৈতিক সমুদায়—বলা ভাল মেজরিটি সমুদায়। উদাহরণ, মুম্বাইয়ের হাজি আলি দরগায় আদালতের রায়ে মুসলিম মেয়েরা ঢুকতে পারবে।[25] কেরালার মন্দিরে মেয়েদের মন্দিরমসজিদ তিনতালাক, গুরবায়ুর। হায়দ্রাবাদের ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটির (নালসার) ভাইস চ্যান্সেলর ফরজান মুস্তাফা সম্প্রতি একটি প্রবন্ধে বলেছেন সুপ্রীম কোর্ট মুসলিম মহিলাদের দুর্দশার প্রতি যতটা সহানুভূতিশীল ততটা হিন্দু মহিলাদের জন্যে নয়।[26]
রাষ্ট্র আজ লেভিয়াথান। কিন্তু করোনার পর রাষ্ট্রের ক্ষমতা সর্বব্যাপী। রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে তার নিজস্ব রূপকথা, চমস্কি কথিত ‘ম্যানুফ্যাকচারড কন্সেন্ট’। ‘প্রলয়পয়োধিজলে’ সব ভেসে গিয়েছে –রুশোর সামাজিক চুক্তি, বেন্থামের হিতবাদ, রলসের ফেয়ারনেস বা ন্যায়ের ধারণা – সবকিছু।
এখন কথা বোল না, কোন শব্দ কোর না ।
উপসংহার
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল বিজ্ঞানের দার্শনিক টমাস কুনের (Thomas Kuhn) আলোড়ন ফেলে দেওয়া গ্রন্থ The Structure of Scientific revolutions। এ গ্রন্থে কুন দেখিয়েছিলেন যে আমরা একটা প্যারাডাইমের মধ্যে “normal science” বা স্বাভাবিক বিজ্ঞানের চর্চা করি। এরপরে ক্রমাগত বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতি জমা হতে থাকে সে প্যারাডাইমের মধ্যে। একটা সময়ের পরে আর পুরনো প্যারাডাইমের মধ্যে থাকা যায়না, এটা ভেঙ্গে যায়। একটি নতুন প্যারাডাইম তৈরি হয়। একে কুন বলেছেন “প্যারাডাইম শিফট”। এবং বিশ্বের সারস্বত ও বৈজ্ঞানিক সমাজের প্রধান অংশ একে গ্রহণ করেছেন, মান্যতা দিয়েছেন।[27]
রাষ্ট্রের ধারণাতেও প্যারাডাইম শিফট হয়েছে। আদিম বর্বর সমাজ থেকে মুক্তি, সামাজিক চুক্তি, হিতবাদ; তারপর শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র। আজ যে ইনফরমেশন টেকনোলজি ও ‘কৃত্রিম মেধা’র ক্ষমতা বেড়ে চলেছে তার ভিত্তিতে কি রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে বিতর্কে --- সাম্য, ন্যায় ও রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি—আর একবার প্যারাডাইম শিফট দরকার?
===============================================================
[1] জন রলস, “থিওরি অফ জাস্টিস অ্যাজ ফেয়ারনেস”,
[2] বিজনেস টুডে, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯; ইকনমিক টাইমস, ২০ জানুয়ারি , ২০২০ এবং পিটি আই।
[3] অমর্ত্য সেন, “ দি আইডিয়া অফ জাস্টিস” (২০০৯) এবং “ইনইকুয়ালিটি রিএগজামিন্ড” (১৯৯৫)
[4] মার্থা নুসবাউম ; ‘ক্রিয়েটিং ক্যাপাবিলিটিজ” (২০১১), “পলিটিক্যাল ইমোশন্স” (২০১৩)।
[5] স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলজফি। (২০১৬)।
[6] অমর্ত্য সেন, “ইনইকুয়ালিটি রিএগজামিন্ড”, পৃঃ ৪১, ফুটনোট ৮।
[7] ব্ল্যাকলাইভস ম্যাটার ডট কম, ‘হোয়াট উই বিলিভ’।
[8] দ্য প্রিন্ট, ৯ জুলাই, ২০২০।
[9] এলিজাবেথ অ্যান্ডারসন, “ল এন্ড ফিলজফি”।
[10] আউটলুক, ১ মে, ২০২০।
[11] টাইমস অফ ইন্ডিয়া এবং ইকনমিক টাইমস, ১০ আগস্ট, ২০১৭।
[12] দি হিন্দু, ২৬ মে, ২০১৯।
[13] উইকিপিডিয়া।
[14] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান, আর্টিকল ১।
[15] কিউবার সংবিধান, আর্টিকল ১।
[16] ঐ, আর্টিকল ৯।
[17] ঐ, আর্টিকল ৫৩ ।
[18] অ্যানুয়াল রিপোর্ট অফ ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস, ইউ এস এ। (২০০৬)।
[19] ইসায়া বার্লিন , “ টু কন্সেপ্টস অফ লিবার্টি” এবং “ফোর এসেস অন লিবার্টি”।
[20] ফ্রাঞ্জ ফ্যানন, ‘ ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস’।
[21] ইউনিসেফ রিপোর্টঃ “ দ্য স্টেট অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস চিল্ড্রেন” ( ২০১৯)।
[22] উইকিপিডিয়া।
[23] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৩ জানুয়ারি, ২০২০।
[24] টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০।
[25] দি হিন্দু, ২৪ অক্টোবর, ২০১৬।
[26] ফরজান মুস্তফা , ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৩ জুলাই, ২০২০।
[27] টমাস কুন, “দ্য স্ট্রাকচার অফ সায়েন্টিফিক রেভলুশন” (১৯৬২)।
এলসিএম,
শুধরে দিয়েছেন, অনেক ধন্যবাদ। তবে ১ ও ৩ নম্বরের হেডিঙয়ে কি ওই -১ এবং -৩ জোড়া যেতে পারে? তাহলে ভালো হয় ।