গ্র্যান্ডভিউ হোটেল
শাশ্বতী বসু
- স্লো করো, স্লো করো ----
হঠাৎ বলে ওঠে নীলা। সুনন্দ তাড়াতাড়ি করে গাড়ির গতি কমায়।রাস্তার পাশেই একটু নিচু জমিতে পাইনের জঙ্গল সেইজঙ্গলের বাইরে খোলা জমিতে দিনের আলোয় ঝাড়বাতি সদৃশ্য বিশালাকায় শিং নিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সেই চির পরিচিত সান্তার শ্লেজগাড়ীর সারথী সারথি --- রেইন্ডিআর । হরিণ। নীলা ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঝটিতি গাড়ি থেকে নামতে যায়।
- নেমো না। ওরা চলে যেতে পারে। আর গেলে, তাকিয়ে দেখো আমাদের গাড়ি পেছনে অন্য গাড়িগুলোরদিকে । ওরা তোমায় আস্ত রাখবে ভেবেছো? সুনন্দ বলে।
নীলা থামে। খুব ধীরে গাড়ির কাচ নামায়। তারপর ক্যামেরা ফোকাস করে ক্লিক্ করতেই তিনি মুখ ঘুরিয়ে পেছন ফিরে চলতে শুরু করলেন। ক্যামেরার পর্দায় ততক্ষনে তার পেছনের অংশটি বিদ্যমান।
- যাঃ ধরতে পারলাম না। হতাশ হয়ে বলে নীলা।
আবার কোনো সময়ে পেয়ে যাবে। এখন চলো । সানসেটের আর মাত্র আধঘন্টা বাকি আছে। সুনন্দ গাড়ি স্টার্ট করতে যায়।
- না দাঁড়াও না আর একটু। নীলা অধীর ব্যাগ্রতায় বলে।
- তবে দাঁড়াই। সানসেট দেখতে না পেলে আমায় যেন বোলো না কিছু ।
ওরা দাঁড়িয়ে থাকে। আরিযোনা স্টেটের ইউএস হাইওয়ে 64 এর ওপর। ঝক্ ঝকে কালো পীচের রাস্তাসোজা চলে গিয়েছে সেই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সামনে। যেন কেউ একটা কুচকুচে কালো চাদর টানটান করে পেতে রেখেছে -- এমন পরিস্কার সে রাস্তা। দু পাশে পাইনের ঘন জমাট জঙ্গল। কোনোটা বয়স্ক , কোনোটা তরুন , কোনোটা আবার লাল রঙে রঙ্গীন। পাইনের তলায় বুনো ঘাস। ঘাসে হলুদ ফুল ফুটে আছে। সেইফুল আর সজীব ঘাস খেতে হরিণেরা জঙ্গল ছেড়ে চলে আসে হাইওয়ের ধারে। আবার তাদের লোভে আসে তাদের প্রেডেটর – নেকড়ে রা I
গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে বেড়াতে আসা ভ্রমনার্থীরা ভাগ্যবান হোলে তাদের দেখা পেয়েও যেতে পারে। নীলারা সেই ভাগ্যবানদের দলে বোধহয় নয়। তাই খানিকক্ষন অপেক্ষা করেও রেইন্ডিআর বা বা তাদের প্রেডেটর, কারোর দেখাই মিললো না। সূর্য ততক্ষে যাই যাই করছে। তরুন পাইনদের ছায়া একদিক থেকে আর এক দিকে দীর্ঘতর হোচ্ছে। নীলা মন্ত্রমুগ্ধ।
অনেক হোয়েছে। এবার চলো। ঘড়িতে তখন কয়েক মিনিট বাকি সূর্য ডোবার। সুনন্দ গাড়ির স্পীড তোলে গাড়িতে স্টার্ট দিয়েই। লক্ষ্য ইভাপাই ভিউপয়েন্ট । গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন । সাউথ রিম।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে এসেছে ওরা সেই কলকাতা থেকে। তারপরে লস্ এন্জেলেস্ থেকেই ওরা গাড়ী ভাড়া করেছে। সান ডিয়েগো , টুস্কান, ফিনিক্স আর ফ্ল্যাগস্টাফ হয়ে তারপরে এখানে । ক্যালেন্ডারের ছবি দেখে আর বন্ধুদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার রোমহষর্ক বিবরন শুনে শুনে ওদের মনে অনেক দিন ধরেই এখানে আসার ইচ্ছেটা দানা বাঁধছিল। এবার কিছুদিনের ছুটি পেয়েই ওরা সটান বেড়িয়ে পরেছে। টিকিট বুক করেই সুনন্দ নীলা কে ফোনে বলেছিল -- মেনি, ডান-- গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন । নো জোক্। হাতে কড়কড়ে ই-টিকিট। বলেই প্রান খুলে হেসেছিল সুনন্দ।
হেসেছিল নীলাও। তবে অন্য আর একটা কারণেও। মন খুব ভালো থাকলে সুনন্দ নীলাকে ঐনামে ডাকে। নামটা কিছু বেমানান নয় অবশ্য। মেনি বা মেনি বেড়াল। সত্যি নীলার চোখ দুটো বেড়ালের মত। বা বলা যায় দামী cat's eye বা বৈদুর্য মণির সঙ্গে তুলনীয় নীলার চোখ। শুধু চোখই নয় -- নীলার চুলও তাম্রাভ। মজার ব্যাপার হোল ঐ কটা চোখ আর কটা চুলের জন্য নীলার এ্যাডমায়ারার বেশী না শত্রু বেশী-- সেটা হিসেব করে বলা মুসকিল। gorgeous, splendid, বেড়াল চোখো, ধলা বিলাই ---সবই সে শুনতে অভ্যস্ত।
হালকা চেহারা, তামাটে ত্বক আর চুল ,কটা চোখ নিয়ে ওযে কোন্ দেশের লোক সেটাই অনেকের মাথা ব্যথার কারণ হোয়ে যেত। ঠাকুমাই প্রথম থেকে ‘মেনি’ বলতো নীলা কে। আর বলত – মেনি আমার পাহাড় দেশ থেকে এসেছে। ঐখান থেকে , যেখানে সব্বার চুল কটা আর চোখ কটা। কথাটা হয়তো নীলার ও মনে গেঁথে গেছে । নীলা বেড়াতে ভালবাসে। ঝোঁক তার সমুদ্র আর পাহাড় দু এরই উপর। কিন্তু নীলা জানে পাহাড়ের ওপর তার এক অজানা আকর্ষন। দুর্দমনীয় টান। শিরায় শিরায় এই টান সে পাহাড় দেখলেই অনুভব করে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নেরর ছবি দেখেই সেই দুর্দমনীয় টান সে আবার অনুভব করেছে। কিন্তু সে টান যেন অন্য সাধারন একটা পাহাড় দেখেই যেমন হয় তেমন নয়। তার চেয়েও বেশী , তার চেয়ে আরও তীব্র। কেন ? কে জানে। নীলার আশা কবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে দুচোখ মেলে কাছ থেকে মন ভরে দেখবে ।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে দুচোখ ভরে দেখার জন্য কতগুলি নির্দিষ্ট জায়গা বা ভিউয়িং এরিয়া সুন্দর করেঘিরে দেওয়া আছে ভ্ৰমণার্থীদের জন্য। এদের বলা হয় ভিউয়িং পয়েন্ট। এরকম একটি পয়েন্ট -- "ইভাপাই" পয়েন্টে ওরা যখন পৌঁছলো তখন সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু শুধু ক্যানিয়নের দেওয়ালের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় মৃদু আলো ছড়িয়ে আটকে আছে।
- তুমি নেমে পড় ক্যামেরা নিয়ে। আমি গাড়িটা পার্ক করেই আসছি। সুনন্দর বলার অপেক্ষায় নেই নীলা। সে ততক্ষনে ক্যামেরা নিয়ে ছুট্টে একদম ভিউয়িং এরিয়ার রেলিং এর সামনে
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। সামনেই গ্র্যন্ড ক্যানিয়ন। নীলার যেন বিশ্বাসই হোচ্ছিল না-- এত বিশাল-- এত দিগন্ত বিস্তৃত -- এত গম্ভীর – এত নিরব একটি জিনিষের অস্তিত্ব ওর চোখের সামনে --- একদম কাছে, যেন ছোঁয়া যাবে এক্ষুনি ...নীলার নিঃশ্বাস বন্ধ হোয়ে আসছিল।
- দেখছ? কখন সুনন্দ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। এটা একটা প্লেটো। এটা সি লেভেল থেকে প্রায় সাত হাযার ফুট উঁচু। সামনেই কিছুটা দূরেই যে ফাটলটা দেখছো সেটা আসলে একটা নদীখাত। কলোরাডো নদীর। এই নদীটিই মিলিয়ন বছর ধরে এই প্লেটোর পাথুরে বুকের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে খইয়ে খইয়ে তৈরী করেছে এই ফাটলটি বা ক্যানিয়নটি। এই ফাটলের একদম তলায় কলোরাডো --- দেখা যাচ্ছে না। অথচ একদিন--- আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার সামনে দিয়েই বয়ে যেত খরস্রোতা কলোরাডো। নীলা শোনে আর দেখে……..
ক্যানিয়নের ছোট খাটো টিলাগুলি বাতাসের বেগে ক্ষয়ে ক্ষয়ে আকার নিয়েছে এক প্রাসাদ নগরীর। সে প্রাসাদের গড়ন কোনটা ঠিক বুদ্ধ মন্দির, কোনটা ঠিক যেন পিরামিডের হুবহু প্রতিচ্ছবি, শীর্ষবিন্দু অবিকল। সূর্যের শেষবেলার রাঙ্গা আলো তার শরীরে। নীলা ভুলে যায় ক্যামেরা তাক করতে। ত্রিকোনাকৃতি বুদ্ধমন্দিরের গায়ের টকটকে গোলাপী রং ধীরে ধীরে ততক্ষনে ম্লান হোয়ে আসছে। সূর্য্য ডুবে গেছে ওরা আসার আগেই। নীলার কিছু তাতে খেদ নেই। যে চলে গেছে সে তার সব টুকু সুষমা আর লাবণ্য নিয়ে যায় নি। যেটুকু রেখে গেছে তাতেই নীলা আকন্ঠ নিমজ্জিত।
নীলা ভিউয়িং পয়েন্টের রেলিং ধরে অনেকটা ঝোঁকে সামনের দিকে। নিচ অনেক অনেক নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কলোরাডো। দেখা যায় না এখান থেকে। অন্য ভিউ পয়েন্ট থেকে আবার তিনি দৃশ্যমান। তবে তার ফাটলটি এখান থেকে দেখা যায় কিছুদূর পর্যন্ত । তারপরে ফাটলটিও অদৃশ্য উচু নীচু পাথুরে টিলার ভিড়ে।
নীচে বহু নীচে যেখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কলোরাডো তার আশেপাশেই আছে একটা এবং নীচের একমাত্র হোটেল। ওপর থেকে যেসব যাত্রীরা বিভিন্ন পাকদন্ডী বা ট্রেইল দিয়ে ক্যানিয়নের তলদেশে যায় ওই কলোরাডোর পাড়ে, সেখানেই তারা রাতে বিশ্রাম নেয় । আবার ফেরে পরদিন ।
ইস্ যদি যেতে পারতাম ওখানে, ওইরকম পাকদন্ডী ধরে ধরে - কিম্বা ঘোড়ায় চড়ে আরব বেদুইনদের মতো-----
- কি এত ভাবছো? সুনন্দ ওর কাঁধ ছোঁয় আলতো করে। সুনন্দ জানে নীলার কল্পনা প্রবণ মন হয়তো এতক্ষনে কলোরাডোর স্রোতের উজান ঠেলে কয়েক মিলিয়ন বছর পেছিয়ে গেছে।
- তুমি একটু থাকো এখানে। আমি চট্ করে গাড়ীটাকে কাছেই কোথাও পার্ক করে আসছি। আজ থাকবো এখানে মাঝরাত অবধি। হেসে সুনন্দ পেছন ফেরে।
ভিউয়ার পয়েন্টে সবার চোখের সামনে ধীরে ধীরে সূর্য্য ডুবে যায় পশ্চিমে। দর্শকেরা ফিরে যায় প্রায় সবাই। কেউ বসে থাকে কাঠের বেন্চের ওপর।
ভিউয়িং এরিয়া আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে যায়। নীলাও বসে থাকে একা -- অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে। কিসের এ অনুভূতি নীলা বোঝে না। হয়তো বিরাটের সম্নুখে ক্ষুদ্রতার, তুচ্ছতার যে অনুভব -- সেই অনুভব ধীরে ধীরে গ্রাস করে নীলাকে
চারদিকে আশ্চর্য নীরবতা। শুধু সোঁ সোঁ একটানা আওয়াজ পাইনবনের ভেতর দিয়ে হাওয়া বয়ে যাবার । কিছু দশর্ক যারা এখনও বসে আছে নীলার মত তারাও চুপচাপ । নীলা লক্ষ করেছে এ পর্যন্ত কেউ এখানে কথা বলেনি জোরে । প্রকৃতির নীরব উপস্থিতি, , বিশেষ করে ক্যানিয়নের এই বিশালত্বের , এই ব্যাপ্তির এত প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব যে সেই নীরবতা ভেঙ্গে কথা বলতে দর্শক মাত্রেরই সন্কোচ হয়। নীরবতাই এখানকার একচ্ছত্র অধিপতি। সঙ্গিনী তার এই আদিগন্ত বিস্তৃতি।
হঠাৎ নীলা দেখতে পায় যেন সমুখের অন্ধকার সমুদ্রের অতল তলে এক টুকরো আলো চমকে উঠেই নিভে গেল। হয়তো ওটা সেই কলোরাডোর ধারের একমাত্র হোটেলটির আলো। হয়ত এখন সারাদিনের পথশ্রমে ক্লান্ত হাইকাররা হোটেলের ভেতরে আগুনের সামনে বসে হাত পা সেঁকে নিচ্ছে। গার্ডেনের কিচেনে ঝলসানো হচ্ছে মাংসের টুকরো। হাইকাররা চুমুক দিচ্ছে রঙ্গীন পানীয় তে।
নীলা শুনেছে হোটেলটির নাম নাকি "ইন্ডিয়ান গার্ডেন"। এই ইন্ডিয়ান কারা ? আমেরিকান ইন্ডিয়ান বা মেক্সিকান নিশ্চয়ই। মেক্সিকানরা তো অনেকটাই ভারতীয়দের মত দেখতে। এরিকা টেরেস এর কথা মনে হোল নীলার ---ইস্তাম্বুলের এক কনফারেন্সে আলাপ হওয়া মেক্সিকান মেয়ে। কিন্ত দেখতে যে কোনো একটি বাঙ্গালী মেয়ে। হয়তো এরিকার মত কোন সুন্দরী সেখানে এখন গান গাইছে। হাতে তারও রঙ্গীন পানীয়।
পানীয়র কথা মনে হোতেই নীলার যেন তেষ্টা পায় সহসা। একটু জল পেলে ভালো হোতো। কিন্তু কোথায় জল? আকাশে পঞ্চমীর চাঁদ। অন্ধকার খানিকটা যেন তরল হোয়েছে মনে হোচ্ছে। চারদিকে জমাট পাইন আর জুনিপারের জঙ্গল। জঙ্গলের তলায় হাঁটু সমান বুনো ঘাস। অদ্ভুত একটা মিষ্টি অথচ বুনো গন্ধ আসছে কোথা থেকে যেন। মিষ্টি গন্ধটা কিসের ? ল্যাভেন্ডারের না পাইনের? শোনা যায় এখানকার এক ধরনের পাইনের ছাল থেকে হালকা একটা মিষ্টি গন্ধ বেরোয়। গন্ধটা বেশ অবশ করা। চারদিকে কেউ নেই। নীলা একা। শুধু পাইনের পাতার ঝুলে থাকা ঝালর গুলি বাতাসে ধীরে ধীরে দুলছে। যেন কোন কিশোরীর ঝাপানো চুল। ভয়ের একটা শিরশিরে অনুভূতি নীলার শিরদাঁড়া বেয়ে উঠতে থাকে হতাৎ ।
নীলা উঠে দাঁড়ায়। একটা আওয়াজ আসছে কোথা থেকে যেন .... কল্ কল্ কল্ কল্ করে.... যেন জল পড়ছে দুরে কোথাও.... যেন বয়ে যাচ্ছে জল জোরে জোরে । তবে কি কলোরাডোর বয়ে যাবার শব্দ এত ওপর থেকেও শোনা যায়? তবে কি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সেই কুখ্যাত খরস্রোতা অংশটি যার নাম "Hance Rapid" সেটি আশে পাশে কোথাও? নীলা ভূতগ্রস্তের মতো চলতে শুরু করে। সরু পাথুরে নুড়ি ভরা রাস্তা....কখনো চড়াই , কখনো উৎরাই ধরে নীলা চলে। ছোট ছোট ঝাঁকরা জুনিপারের অন্ধকার ছায়া। সেই ছায়ার তলায় আচমকা কেউ নীলার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে যায়.... নীলা ভয়ে চমকে ওঠে। অনুভব করে তৃষ্ণায় ওর সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে।
- জল খাবে? জল কিন্তু আমাদের "কিভা" তে আছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে মিস্টি গলায় কেউ বলে ওঠে। নীলা চমকে পেছন ফেরে। দেখে একটি কিশোরী দাঁড়িয়ে। আমেরিকান ইন্ডিয়ান বা স্প্যানিশ গোছের, চেহারা। পরনে একটি বাদামী লোমের টিউনিক কপালে একটি সাদা রিবন ঘুরিয়ে পেছন দিকে বাঁধা
- হুই ওইদিকে...... মেয়েটি নীলার পেছন দিকে একটা ঝোঁপের দিকে অঙ্গুলি নিদের্শ করে। ওখানে চলো মা তোমাকে জল দেবে। মিসেস বেরীও তোমাকে বসতে দেবে আগুনের সামনে
- ওখানে কি আছে? নীলা কোন রকমে জিজ্ঞেস করে।
- ওখানে আমাদের বাড়ী মানে মিঃ বেরীর বাড়ি আছে।
-চলো যাই। নীলা এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে। তেষ্টায় ততক্ষনে তার সব অনুভূতি অবশ হোয়ে আসছে। নীলার আগে আগে মেয়েটি হাঁটে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওরা একটি বড় ঢিবির আড়ালে চলে যায়। আড়ালটি শেষ হোতেই চোখে পড়ে একটি বড় অদ্ভূৎ গোল ধরনের বাড়ি। সম্পূর্ণ গোল, কাঠের। জানলা দরজা নেই... ছাদে একটি মইয়ের একটা দিক দেখা যাচ্ছে.... মনে হোচ্ছে বাকিটা ছাদ দিয়ে ঘরের ভেতর নামানো। ওটাই ঘরে ঢোকার দরজা মনে হোচ্ছে। ঘরের সামনে প্রশস্ত উঠোন... তার মাঝখানে আগুন জ্বলছে। একটি মধ্যবয়স্কা নারী পাথরের একটি পাত্রে আর একটি পাথর দিয়ে, যেন হামান দিস্তা, কিসব গুঁড়ো করছে। তার সামনে বড় বড় নানা আকারের গামলা জাতীয় কাঠের পাত্র। তার মধ্যে বিভিন্ন রংয়ের বিভিন্ন আকারের শস্য জাতীয় জিনিষ। আগুনের মাঝখানে ঝলসানো হোচ্ছে আস্ত বুনো কাঠবেড়ালী ---- শিকে গাঁথা। পর পর অনেকগুলো ... রাতের খাবারের আয়োজন।
নীলা গিয়ে দাঁড়াতেই কিশোরীটি উঠোনের এককোণে রাখা চামড়ার থলে থেকে জল ঢালে একটি কাঠের বাটিতে। তারপর নীলার দিকে এগিয়ে দেয়।
মধ্যবয়স্কা নারীটি ততক্ষনে নীলার দিকে ফিরেছে। ফিরেই কিরকম উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে ছুটে আসে নীলার কাছে।
- তু-ই-ই-!!! তু-ই-ই- কোথায় ছিলি .... ওরে কোথায় ছিলি এতদিন... বলতে বলতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নীলাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। মুখ ঘসতে থাকে পাগলের মত নীলার গালে, কাঁধে , গলায়... সঙ্গে সঙ্গে চলে আতর্স্বরে বিলাপ। তোকে আমি কত খুঁজেছি , কত খুঁজেছি পাহাড়ে নদীতে ঝোঁপে ... তুই সেই যে নদীতে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে গেলি , তারপর , তারপর তো আর ফিরে এলি না ... কোথায় গেছিলি তুই ? কোথায় গেছিলি আমার সব খালি করে...
পরিস্থিতির আকস্মিকতায় নীলা হতভম্ব। কি করবে ভেবে পায় না। এদিকে দম বন্ধ হোয়ে আসছে এই বুকভাঙ্গা স্নেহের অসহ্য পীড়নে। বুঝতে পারছে এক মা তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে ... অদম্য বাঁধভাঙ্গা তার উচ্ছ্বাস... সে উচ্ছ্বাসের আলিঙ্গন যেন ফাঁসের মতো নীলার গলায় এঁটে বসে যাচ্ছে...
- ছাড়ো , ছাড়ো আমায় । আমি তোমায় চিনি না। আমি তোমার কেউ নই। প্লীজ্ আমার হাজব্যান্ড আমাকে খুঁজবে... আমি এখনি চলে যাবো।.ছাড়ো .... নীলা কোন রকমে বলতে পারে।
- এক্ষুনি আমি খুঁজে আনছি তোমার হাজব্যান্ডকে। বলে কিশোরীটি দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
- কি বললি? কি বললি তুই . আমি তোর কেউ নই? ওরে তোকে না পেয়ে আমি যে পাহাড় থেকে নীচে ঝাঁপিয়েছিলাম ...
সন্তানহারা মায়ের আতর্বিলাপে বাতাস ভারী হয়ে যায়। কত যত্ন করে আমি তোকে বড়টি করেছিলাম .....
- এই তো মাদাম এখানে জল খেতে এসেছিল...নীলা চমকে ওঠে তাকায় কিশোরীর গলার আওয়াজ শুনে। ততক্ষনে সে লতাপাতার কঠিন ফাঁস থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে। পা পিছলে পড়ে পুরো একটা বুনো গাছের মধ্যে আটকে গেছিল সে। সুনন্দর টর্চের আলো ততক্ষনে নীলার মুখের ওপর।
- তুমি!!! তুমি এখানে ? সুনন্দ বিষ্ময়ের শেষ সীমায়। আমি এতক্ষন ধরে খুঁজছি তোমায়...
- হ্যাঁ জল খেতে এসেছিলাম। নীলা অস্ফুটে বলতে যায়....
- এখানে জল? কোথায়? কে বললো এখানে জল আছে?
- চারদিকে তাকায়। কোথায় কিশোরীটি আর তার মা ... ঝলসানো কাঠবেড়ালী আর আগুন.... কি সব দেখছিল ও? একটা বিস্ময় আর আতন্কের অনুভব এতক্ষন পরে নীলাকে গ্রাস করতে থাকে।
- তোমায় খুঁজতে গিয়ে একটা সাপের ওপর প্রায় পড়েছিলাম আরকি । একটা মেয়ে ..আমেরিক্যান.. ইন্ডিয়ান মনে হোল .... ছোট .. পেছন থেকে চিৎকার করে আমায় থামায়। নাহলে কি যে হোত আজ কে জানে। ওইতো আমায় এখানে নিয়ে এল...বলেছিলাম না বসে থাকো কিছুক্ষন...
- ওঃ তুমিও দেখেছো? সবিস্ময়ে নীলা প্রায় চিৎকার করে ওঠে সুনন্দর কথা শেষ হবার আগেই।
- কি দেখেছি?
- ওই ছোট মেয়েটাকে? ওই ইন্ডিয়ান ছোট মেয়েটিকে? ওই তো আমায় বলেছিল যে তোমাকে সে খুঁজে আনতে যাচ্ছে...একটু আগে ওর মাও ছিল ... মেয়েটি আমাকে জল দিল... খেলাম…. নীলা ঝড়ের গতিতে বলতে চায় সব একসঙ্গে। ওযে সত্যি নিজের চোখেই সব দেখেছে……….. ।
কিন্তু হঠাৎ নীলা থেমে যায়। ওর জিবটাতো এখনও শুকনো । তেষ্টা তো কই একটুও মেটেনি নীলার কিন্তু ওতো জল খেল , তবে কি ও সত্যি সত্যি জল খেয়েছিল?
সুনন্দ আর নীলা স্তব্ধ হোয়ে দাঁড়িয়ে। হাইওয়ে দিয়ে তীব্র গতিতে একটা গাড়ী চলে যায়। স্তব্ধতা ভেঙ্গে সুনন্দ বলে , চলো যাই। গাড়ীটা সামনেই পার্ক করেছি।
হঠাৎ শোনা যায় -
- হু ইজ দেয়ার? ……. একটা টর্চের আলো এসে পড়ে ওদের মুখে।
- আপনারা কে? এতরাতে? কোনো টুরিস্ট তো এখানে থাকে না এতরাতে?? আপনারা ঠিক আছেন তো ? সিকিউরিটির ভদ্রলোকটি খুব অবাক হোয়ে জিজ্ঞেস করে।
- কেন কি হোয়েছে এখানে? কোন প্রবলেম? সুনন্দ জিজ্ঞাসা করে।
- হ্যাঁ, না, মানে নানা রকম গুজব আছে তো এই জায়গাটা নিয়ে …..মানে ঠিক যে জায়গাটায় আমরা এখন রয়েছি এই জায়গাটা নিয়ে আর কি। তাই জিজ্ঞেস করছি ।
- কি গুজব? কি রকম ? এই জায়গাটা ? এই জায়গাটায় কি হয়েছে?
নীলার এতগুলো ব্যাগ্র ব্যাকুল প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক চোখ নামায় মাটিতে। একটু ইতস্তত করে। যেন বলবে কি বলবে না এ ব্যাপারে ঠিক মনস্থির করতে পারছে না। মুহূর্ত মাত্র। তারপরেই ভদ্রলোক গলা পরিস্কার করেন। মাথা তুলে শান্ত ভাবে বলেন,
- লোকে এখানে একটি মহিলাকে দেখতে পায় মাঝে মাঝে। মধ্যবয়সী এবং একটি ছোট মেয়েকেও মাঝেমাঝে....
- কে সে ? কারা তারা? এবার সুনন্দ সজাগ।
-প্রায় দেড়শো বছর আগে এখানে একটা হোটেল ছিল। মিঃ বেরীর। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সবর্প্রথম হোটেল।গ্র্যান্ডভিউ হোটেল। সেই হোটেলটা এই ভিউ পয়েন্টেরই, মানে এই আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে তার আসে পাশে কোথাও ছিল। সে হোটেলে একটি মেয়ে নাচতো। মেয়েটি পোবলান উপজাতীয়। খুব সুন্দরী ......সবুজ চোখ, চুল আর গায়ের রং তামাটে। তাকেই নাকি লোকে দেখতে পায় এখানে।
- কেন আসে এখানটায়? কি চায়? নীলা অস্ফুটে জানতে চায়।
- সে নাকি তার মেয়েকে খুঁজে বেড়ায়। তার ১৫ বছরের মেয়েটিকে । সে হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যায়। ছিল খুব সুন্দরী, মায়ের মতই। তাকে খুঁজতে গিয়েই পাহাড় থেকে পড়ে মায়ের মৃত্যু হয়। কিন্তু গভীর রাতে তাকে নাকি দেখা যায় মাঝে মাঝে। মহিলার ছোট মেয়েটিকে ও মাঝে মাঝে এখানে ওখানে লোকে দেখেছে অনেক রাতে।
- তাই বলছিলাম আপনারা এখানে কি কছেন। আশা করি আপনারা কিছু দেখেন নি। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকান। সুনন্দ নীলার মুহূর্তে একবার চোখাচোখি হয়ে যায়।
- না না আমাদের কিছু চোখে পড়েনি,কিচ্ছু না। চলো সুনন্দ। হ্যাঁ আমরা এখন ফিরি। অনেক রাত হোল। বাই। সিকিউরিটির দিকে তাকিয়ে নীলা হাত নেড়ে চলতে শুরু করে হঠাৎ।
*পূর্ব প্রকাশিত: বাতায়ন জুলাই সঙ্কলন, ২০১৭
ভালো লেগেছে।
সানসেট পয়েন্ট এর কথা মনে পড়ে গা টা একটু শিরশির করল। ভাল লাগল, বিশেষত প্রথম দিকটা তো বেশ ভালো।
রঞ্জন, স্বাতি রায় আপনাদের গল্পটি ভাল লেগেছে - খুব ভাল লাগলো শুনে । অনেক ধন্যবাদ ।